আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি পর্যালোচনা কর। এটা কি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী ছিল?

ভূমিকা : ঘটনা। মূলত আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমল হতেই দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চলতে থাকে এবং আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ছিল পূর্ববর্তী সম্রাটদের দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতিরই অনুসরণ। are Edward set, "He was following the policy of aggrassive inprealism, in itiated by Abu in the loth century." (১৬৮২-১৭০৭ পর্যন্ত সম্রাটের দাক্ষিণাত্যে অবস্থান, মারাঠাদের সাথে সং, ছিল দক্ষিণ নীতির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।)
অভিযান সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের (১৬৫৮-১৭০৭) একটি উদ্দেশ্য : আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ধর্মীয় গোড়ামীর দ্বারা পরিচালিত হয় নি, সমাজের বিস্তৃতিই ছিল তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতির মূল উদ্দেশ্য। পিতার জীবদ্দশায় দাক্ষিণাত্যের সুবাদার অবস্থা বিজাপুর ও গোলকুত্তাকে সাম্রাজ্যভুক্ত করার চেষ্টা করেন। কাজেই অনেক আগে থেকে সম্রাটের দাতার উপর
দাক্ষিণাত্য নীতির কারণ : আওরঙ্গজেবের অনুসৃত দাক্ষিণাত্য নীতির মূলে বিবিধ কারণ ছিল। কারণগুলো নিম্নরূপ ঃ 2.
অনুসরণ। আকবরের রাজত্বকাল হতেই দাক্ষিণাত্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন মুসলিম রাজ্য বিষয়, বেরার, বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, আহমেদ নগর বিজয়ের প্রচেষ্টা শুরু হয়। আওরঙ্গজেবও পূর্ববর্তী সম্রাটদের এ নীতি অনুসরণ করেন।
২. কর প্রদান না করা : বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য দুটি নিয়মিত করদানে বিরত থাকায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে আওরঙ্গজের অভিযান প্রেরণ করেন।
৩. শাহাজাদা আকবরের বিদ্রোহ : শাহজাদা আকবরের সাথে মারাঠা বীর শম্ভুজীর সন্ধিতে আওরঙ্গজেব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং পুত্রকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তাকে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ যাত্রা করতে হয়।
৪. মারাঠাদের দমন : আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থানে মুঘল ইতিহাসের ধারা কিঞ্চিৎ ব্যাহত হয় এবং মারাঠা বীর শিবাজীর সঙ্গে তাকে দীর্ঘদিন যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। ফলে মারাঠা শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য তিনি গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর স্বীয় রাজ্যভুক্ত করার প্রয়াস পান। দাক্ষিণাত্য নীতি : আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। নিচে এর বিভিন্ন পর্যায় উল্লেখ করা হল ।
প্রথম পর্যায় । এ পর্যায় ছিল শিবাজীর সাথে আওরঙ্গজেবের সংঘর্ষের যুগ। শিবাজী ছিলেন দুর্ধর্ষ মারাঠা নেতা। উচ্চাগতিতে মারাঠাদের উত্থান দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনার অবতারণা হয়। ফলে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের প্রতিনিধি থাকাকালেই শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। কিন্তু উত্তরাধিকার সংগ্রামের চাপে পড়ে তিনি উত্তর ভারতে চলে গেলে শিবাজী কাঙ্কন প্রদেশের উত্তরাংশ দখল করে নেন। পরবর্তীতে আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণ করে শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার করে পাঠান। কিন্তু মারাঠাদের বিরুদ্ধে কতিপয় সাফল্য লাভের পর শায়েস্তা খান শিরাজীর হাতে নাজেহাল হলে সম্রাট তাঁর স্থানে দিলির খান ও জয়সিংহকে শিবাজীর বিরুদ্ধে পাঠান। সেনাপতিদ্বয় ১৬৬৫ খ্রিঃ শিবাজীকে পুরন্দরের সন্ধি করতে বাধ্য করেন। সম্রাটও তাকে বন্দী করে রাখেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে পালিয়ে এসে পুনরায় মুঘলদের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন এবং সুরাট ও বেরার লুণ্ঠন করেন। ১৬৭৪ খ্রিঃ শিবাজী রামগড়ে নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করেন। এরপর শিবাজী হিজঞ্জি, ভেলোর, বেলারী প্রভৃতি প্রদেশ জয় করেন। কিন্তু ১৬৮০ খ্রিঃ শিবাজীর মৃত্যু হলে প্রথম পর্যায়ের অবসান ঘটে।
দ্বিতীয় পর্যায় : শিবাজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শম্ভুজী মুঘলদের বিরোধিতা করতে থাকেন। ফলে আওরঙ্গজেব তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযান প্রেরণ করেন। ১৬৮৯ সালে শম্ভুজী মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলে তাঁর রাজধানী রামগড় মুঘল বাহিনীর করতোলগত হয় এবং ১৬৯০ খ্রিঃ মুঘল সাম্রাজ্য তালোর ও ত্রিচোনা পল্লী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অতঃপর আওরঙ্গজের বিজাপুর অবরোধ করেন এবং আদিল শাহী বংশের সিকান্দার শাহকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। ১৬৮৭ সালে তিনি গোলকুণ্ডা অবরোধ ও দখল করে কুতুবশাহী বংশের অবসান ঘটান। এভাবে দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, মারাঠা রাজ্য, তাজোর প্রভৃতি রাজ্য জয়ের ফলে আওরঙ্গজেব কাবুল হতে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর হতে কাবেরী পর্যন্ত বিস্তৃত গাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট হলেন। Lanepoole বলেন, "With the conquest of Golkunda & Bijapur Aurangazebs censidered himself master of the decean."
তৃতীয় পর্যায় : শম্ভুজীর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রাজারাম ও অন্যান্য মারাঠা সর্দারগণ মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তাদেরকে প্রতিহত করে সম্রাট কোন্দলা, পানহালা, তোরনা, পালি প্রভৃতি দুর্গ জয় করে স্বীয় কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করেন। দাক্ষিণাত্যে এসব ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাকে ১৬৮২-১৭০৭ পর্যন্ত এখানে অবস্থান করতে হয়। অতঃপর ১৭০৭ খ্রিঃ এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এভাবে তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতির পরিসমাপ্তি ঘটে । দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল : দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন রাজ্য জয়ের ফলে আওরঙ্গজেব ভারতীয় উমহাদেশের সর্বাধিক অঞ্চলের একমাত্র সম্রাট রূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। মুঘল সাম্রাজ্য এ সময়ই সর্বাপেক্ষা বিস্তার লাভ করে এবং আওরঙ্গজেব অপ্রতিদ্বন্দ্বী নৃপতির মর্যাদা লাভ করেন। এতদ্বসত্ত্বেও এ সময়েই মুঘল সাম্রাজ্যের নানা বিপর্যয় দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে পতনের দিকে ধাবিত হয়। এর ফলাফল ছিল নিম্নরূপ :
১. রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা : দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে সাম্রাজ্যসীমা এতদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয় যে, একই লোকের পক্ষে তা শাসন করা সম্ভবপর ছিল না। ফলে উত্তর ও মধ্য ভারতে চরম অরাজকতা দেখা দেয় ।
২. অর্থনৈতিক সংকট : দীর্ঘ ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তি ও বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যের বিরুদ্দে সংগ্রাম পরিচালনা করার ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ৩. সৈন্যদের বিদ্রোহ : অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সম্রাটের পক্ষে বিশাল মুঘল সেনাবাহিনীকে নিয়মিত বেতন প্রদান করা সম্ভব হয় নি। তাই তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে মারাঠা শিবিরে যোগ দিতেও দ্বিধাবোধ করে নি। যার ফলে স্বভাবতই মুঘল সাম্রাজ্যের ভীত কেপে উঠে ।
৪. কূটনৈতিক বিপর্যয় : কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও এটা বিরাট প্রভাব ফেলে। কেননা, মারাঠাদের সমূলে ধ্বংস করা সম্ভব না হওয়ায় পরবর্তীতে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তারা বিজয় অর্জন করে বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে উঠে ।
৫. কেন্দ্রীয় শাসনে শৈথিল্য : সম্রাটের অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় শাসনে শৈথিল্য দেখা দেয়। ফলে উচ্চাভিলাষী জমিদার ও ভূ-স্বামীগণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে থাকে। ভারতের শাসনযন্ত্র বিকল ও রাজকর্মচারীগণ দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ফলে রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসে।
৬. কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশ ব্যহত : দাক্ষিণাত্য নীতির পরোক্ষ ফলাফল ছিল কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশ ব্যহত হওয়া। যুদ্ধ বিগ্রহে অজস্র অর্থ ব্যয়ের ফলে কলা ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন স্থায়ী নিদর্শন রাখা সম্ভব হয় নি।
দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য যতটুকু দায়ী : আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অনেকখানী দায়ী করা যায়। কারণ, তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযানের ফলে দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেন। যার ফলে তিনি সাম্রাজ্যের অন্য দিকে কোন খেয়াল রাখতে পারেন নি। তাছাড়া একাধারে দীর্ঘ সময় দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। যা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এদিকে দাক্ষিণাত্যেও তিনি বিশেষ কোন সফলতা অর্জন করতে পারেন নি। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে আলোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়। তাই আওরঙ্গজেবকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা যায় না।
সমালোচনা : দাক্ষিণাত্য নীতির ব্যর্থতার মূলে আওরঙ্গজেব কতটুকু দায়ী তা ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়। একে সম্রাটের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এ কথা সত্য যে, মুঘল সাম্রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থেই দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালানো হয় এবং এটা পূর্ববর্তী মুঘল সম্রাটদের অনুসৃত নীতির ফলশ্রুতি। এতদসত্ত্বেও এক্ষেত্রে আওরঙ্গজেবের ব্যর্থতার কারণে অযোগ্য প্রাদেশিক শাসক, মারাঠাদের অদ্ভূত রণকৌশল, শিবাজীর সুদক্ষ নেতৃত্ব প্রভৃতিকে দায়ী করা চলে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘকালব্যাপী আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যে অভিযান তাঁর অদূরদর্শিতারই পরিচায়ক। যে কারণেই হোক দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের ব্যর্থতা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। স্পেনিয় ক্ষত যেমন নেপোলিয়নের ধ্বংস সাধন করেছিল তেমনি দাক্ষিণাত্য ক্ষত আওরঙ্গজেবের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। v. Smith, "The Decean, form which he never returned, was the grave of his reputation as well as at his body." (দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের খ্যাতি ও দেহ উভয়েরই সমাধিস্থল।)

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]