আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি আলোচনা কর ৷ সমালোচনাসহ আওরঙ্গজেবের হিন্দুনীতি বিবৃত কর ।

উত্তর ভূমিকা : আওরঙ্গজেব ছিলেন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান। সুন্নী মুসলমানরা তাকে 'living saint (জিন্দাপীর) বলে মনে করতো। ভারতকে long of Islam' এ পরিণত করাই তার ধর্মনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আব্দুল করিম এর মতে, “সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী চলতেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও তিনি যথাসম্ভব শরীয়তের বিধানসমূহ কার্যকারী করার চেষ্টা করেন।” আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল রাষ্ট্র অনেকটা ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তিনি কোন বৈষয়িক উন্নতির আশায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রবর্তন করেন নি। তার এ ধর্মনীতিকে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখেছেন। তাঁর এ ধর্মনীতি ইসলামী উলামাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও অমুসলিম তথা হিন্দুদের কাছে ছিল হিন্দু বিরোধী অর্থাৎ বৈষম্যমূলক। ফলে আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি একটি বিতর্কমূলক বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যা অনেক ঐতিহাসিকের মতে, একাধিক গণঅভ্যুত্থাণের ঘোষণা সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ দুর্বল করে দেয় ৷
আওরঙ্গজেবের ধর্মীয়নীতি প্রবর্তনের কারণ : আওরঙ্গজেবের ধর্মীয়নীতি প্রবর্তনের কারণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল ঃ
সম্রাট আকবরের সময় থেকে ইসলামের পবিত্রতা বিবিধ ধর্মের সংস্পর্শে বিকৃত হয়ে পড়েছে বলে যে সন্দেহ গোড়া মুসলমানদের মনে ছিল সেটা আওরঙ্গজেব অনুধাবন করেন এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় অনুশাসন চালু করেন। ড. সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে, রাজনৈতিক কারণে মৌলবাদী শক্তির সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই তিনি ধর্মনীতি অনুসরণ করেন। তিনি নিজেকে গাজী, ইসলামের সেবক ও প্রচারক এবং ইমাম আবু হানিফার মতানুসারী মনে করতেন। তাই মুঘল সম্রাজ্যে মুহাম্মদ (সঃ) ও কোরআনের প্রভুত্ব স্থাপন করাই ছিল তার ধর্মনীতির চরম লক্ষ্য।
আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিসমূহ : নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন : অতুল চন্দ্র রায়ের মতে, “গোড়া সুন্নী মুসলমান হবার কারণে প্রথমেই আওরঙ্গজেব মুসলিম নীতি বিরোধী আচার-আচরণ নিষিদ্ধ করেন।” যেমন-
১. দরবারের প্রচলিত বহু অনুষ্ঠান ও রীতি নীতির পরিবর্তন সাধন করতে গিয়ে স্বর্ণ ও মনিমুক্তা দিয়ে সম্রাটের দেহ ওজনের প্রথা রদ করেন।
২. হিন্দুদের ‘দশহারা' অনুষ্ঠানে সম্রাটের যোগদানের পূর্বতন প্রথা বন্ধ করেন । দিল্লী ও আগ্রার সংলগ্ন অঞ্চলে এবং দক্ষিণ ভারতে হিন্দুদের একাধিক বিদ্রোহ আওরঙ্গজেবের মনে স্বভাবতই এক দারুণ আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয় এবং এ কারণে হিন্দুদের প্রতি এ যাবৎ অনুসৃত নীতি পরিবর্তন করে হিন্দু বিরোধী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হন ।
হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর ধার্য : ১৫৭৯ খ্রিঃ আকবর হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব এ কর পুনরায় ধার্য্য করেন। কারণ, ঈশ্বর দাসের (ফতুহাত-ই-আলমগীরি) মতে, "মুসলিম বিশেষজ্ঞরা হিন্দুদের প্রতি সম্রাটের উদার মনোভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে ইসলামী আইন অনুসারে জিজিয়া কর ধার্য করার জন্য তাকে প্ররোচিত করেন।" অতুল চন্দ্র রায়ের মতে, “সিংহাসনে আরোহণ করার পর আওরঙ্গজেব ৮০ প্রকারের বিভিন্ন কর বাতিল করায় রাষ্ট্রের আয় হ্রাস পায় এবং অপর দিকে বিদ্রোহ দমন ও বহু যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে রাষ্ট্রের ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের নিমিত্তে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের উপর পুনরায় জিজিয়া কর ধার্য করেন।”
রাজকার্য হতে হিন্দুদের বহিষ্কার : আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে প্রথম কুড়ি বছরে মোট ৪৮৬ জন অভিজাতের মধ্যে ১০০জন ছিল হিন্দু। অন্যদিকে পরের কুড়ি বছরে (১৬৭৮-১৭০৭ খ্রিঃ) ৫৭৫ জন অভিজাতের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১৮৪ জন কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারণে দূর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য হিন্দু কেরানী দেওয়ান ও রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বরখাস্ত করেন এবং তাদের পরিবর্তে মুসলমান কর্মচারী নিয়োগ করেন।
১. 'নওরজ' নামক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেন।
2. রাজদরবারে নৃত্যগীত নিষিদ্ধ করা হয়। গনিকাদের বিবাহ করার আদেশ দেওয়া হয় এবং তার এ আদেশ "ঠিকমত পালন হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য মুহতাসিব নামে কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়।
৪. মুসলমান পীর বা সন্ন্যাসীদের সমাধিস্থলে বাতি দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।
5. ১৬৬৯ খ্রিঃ মহরম অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়।
৬. এছাড়া শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমানদের প্রতিও তিনি জেহাদ ঘোষণা করেন।
9. . প্রশাসন থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার দূরীকরণার্থে দরবার হতে জ্যোতিষিদের বিতাড়িত করেন। ভাঙ্গের চাষ ও তার ব্যবসা এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পয়গম্বর (সঃ) এর জন্মদিনে ধর্মীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেন।
১০. স্বর্ণখচিত পোষাকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন।
১১. মানুচির মতে, নির্দিষ্ট মাপের অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের দাড়ি কেটে ফেলার জন্য একদল লোক নিযুক্ত করেন।
১২. হিন্দু ও মুসলিম অনষ্ঠানে জীব-জন্তু, পুরুষ ও নারীর কোনরূপ প্রতিমূর্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন।
হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের নীতি : আওরঙ্গজেব তার রাজত্বের প্রথম দিকে হিন্দুদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন। দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের অভ্যূত্থান ঘটলে হিন্দুদের মধ্যে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠ। শিবাজীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও স্পৃহা হিন্দুদের মুঘল সাম্রাজ্য বিরোধী কার্যকলাপে প্রবৃত্ত করে।
হিন্দু ব্যবসায়ীদের উপর বিধিনিষেধ আরোপ
: অথবা হিন্দুদের প্রতি অনুদার নীতি ঃ ১৬৬৫ খ্রিঃ এক আদেশ জারি করে আওরঙ্গজেব হিন্দু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৫% হারে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়ে দুই শুল্ক ধার্য্য করেন। দুই বৎসর পর্যন্ত হিন্দু ব্যবসায়ীদের উপর শুল্ক কর ধার্য থাকলেও মুসলমান ব্যবসায়ীদের উপর থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৬৬৯ খ্রিঃ হিন্দুদের বিদ্যালয় ও মন্দির ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের আদেশ দেন। হিন্দুদের হলি ও দেওয়ানী প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো একমাত্র গ্রামাঞ্চলে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনেই উদযাপন করার আদেশ দেন। অতুল চন্দ্র রায়ের মতে, এক বছরে ২৪০টি মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির ফলাফল : আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতি তার ধর্মানুরাগের পরিচয় হতে পারে কিন্তু এতে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম অধ্যুষিত হিন্দু সন্তানের সম্রাট পদের দায়িত্বের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আওরাঙ্গজেবের ধর্মান্ধ নীতির বিরুদ্ধে সম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে এক দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৬৬৯ খ্রিঃ তিলপতের জাঠ জমিদার গোকলার নেতৃত্বে জাঠগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বুন্দেল খণ্ডের বুন্দেলা রাজপুতগণ তাদের নেতা ছত্রশালের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পাতিয়ালা ও আলোয়ার অঞ্চলে সং নামী নামে এক হিন্দু ভক্ত সম্প্রদায় বসবাস করতো। এক মুঘল সেনা কর্তৃক এক সত্ত্বামী নিহত হলে তারা ১৬৭২ খ্রিঃ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আওরঙ্গজেবের অদূরদর্শি ধর্মনীতি শিখ জাতির মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালায় ।
ধর্মনীতির সমালোচনা : আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির ব্যাপারে কঠোর সমলোচনা করে থাকেন। তাদের মতে,
3. আওরঙ্গজেব ধর্মান্ধ ছিলেন এবং ধর্মান্ধতার দরুন তিনি অমুসলিমদের এবং শিয়াদের প্রতি অত্যাচার করেছেন। ২. ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে হিন্দুদের উপর পুনরায় জিজিয়া কর ধার্য করেন।
৩. তিনি ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক সকল পদ হতে হিন্দুদের বহিষ্কার করেন। ৪. হিন্দুদের মন্দিরগুলোর ধ্বংস করেন।
সতীশ চন্দ্র, ইরফান, হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে, অযথা আওরঙ্গজেবকে নিন্দা করা হয়েছে। তারা মনে করেন যে, হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের পূর্বসূরীদের অসাবধানতার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার মোকাবিলা করার জন্য আওরঙ্গজেবকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কঠোরতা গ্রহণে এবং মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করতে বাধ্য করে। সতীশ চন্দ্র এর মতে, “আওরঙ্গজেব ইসলামী শরীয়া আইন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও কেন তার প্রথম বাইশ বছর হিন্দুদের জিজিয়া কর আরোপ করেন নি?" আসলে দাক্ষিণাত্যে এ সময় রাজনৈতিক সংকট ঘণিভূত হওয়ায় সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায় তাই জিজিয়া কর আরোপ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া শুধুমাত্র হিন্দুদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে চাপানো হয় নি। মুসলমানদের উপরও যাকাতের কর ধার্য করা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]