“শাহজাহানের রাজত্বকাল মুঘল ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ছিল।”- ব্যাখ্যা কর ।

ভূমিকা : মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল একটি বিশেষ যুগান্তকারী অধ্যায়। সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, শিল্পকলার উন্নতি, উন্নত শাসনব্যবস্থা প্রভৃতি সকল দিক দিয়ে শাহজাহানের রাজত্বকাল গৌরবোজ্জ্বল ছিল। তাঁর আমলে সাহিত্য, স্থাপত্য ও শিল্পকলার চরম উন্নতি সাধিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ও গ্যারেট শাহজাহানের রাজত্বকালকে মুঘল ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। স্মিথ বলেন, " Shah Jahan's reign marks the climax of the mughal dynesty and empire." স্বর্ণযুগ : যে সমস্ত কারণের পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল স্বর্ণযুগ হিসেবে খ্যাত নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. বিদ্রোহ দমন : সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি নানা বিপদের সম্মুখীন হলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী শাহরিয়ারকে তিনি বন্দী ও অন্ধ করে ফেলেন। বুন্দেলখণ্ডের রাজা ঝুঝর সিংহ এবং দাক্ষিণাত্যের ভূতপূর্ব শাসনকর্তা খাঁন জাহান লোদী বিদ্রোহী হন। কিন্তু সম্রাট সহজেই সকল বিদ্রোহ দমন করেন।
২. পর্তুগীজ দমন : পর্তুগীজরা ১৫৭৯ খ্রিঃ হতে হুগলীতে কুঠি নির্মাণ করে বাণিজ্য করেছিল। তারা অনাথ হিন্দু ও মুসলমান শিশুদেরকে অপহরণ করে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করতো এবং ব্যবসার নামে এ দেশের লোকের উপর নানারূপ অত্যাচার করতো। শাহজাহানের আদেশে বাংলার সুবাদার কাসিম খান হুগলী দখল করেন এবং চার হাজার পর্তুগীজকে বন্দী করে আগ্রায় প্রেরণ করেন ৷
৩. রাজ্য বিস্তার : বাল্যকাল হতেই শাহজাহান দক্ষ সেনানীরূপে গড়ে উঠেন। সেনাবাহিনী পরিচালনা ও যুদ্ধবিগ্রহে তাঁর প্রভূত দক্ষতা ছিল। সিংহাসনে আরোহণ করে অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমন করে হৃত রাজ্য উদ্ধার ও সাম্রাজ্যের পরিসর বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দেন । যেমন-
কান্দাহার পুনরুদ্ধার : জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ ভাগে কান্দাহার মুঘলদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। কান্দাহারের শাসনকর্তা আলী মর্দান খাঁনের সঙ্গে শাহজাহান এক লক্ষ টাকা পুরস্কারের বিনিময়ে কৌশলে তা পুনরুদ্ধার করেন ।
মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার : মধ্য এশিয়ায় পিতৃপুরুষের আবাসভূমি সমরখন্দের উপর শাহজাহানের লোভ ছিল। রাজপুত্র মুরাদ ১৬৪৭ খ্রিঃ বল্খ ও বাদাখশান দখল করেন। কিন্তু শীঘ্রই এ স্থানগুলো হস্তচ্যুত হয়ে যায়। মধ্য এশিয়ায় মুঘলদের অসাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পারস্য রাজ্য কান্দাহারও কেড়ে নিলেন। পর পর তিনটি অভিযানে ব্যর্থ হয়ে শাহজাহান কান্দাহার জয়ের আশা পরিত্যাগ করেন।
অহোমদের বিরুদ্ধে অভিযান : শাহজাহানের রাজত্বকালে আসামের অহোমগণ কামরূপ আক্রমণ করে। শাহজাহানের আদেশে বাংলার সুবাদার দ্বিতীয় ইসলাম খান অহোমোদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে পুনরায় কামরূপ দখল করেন । দাক্ষিণাত্যে রাজ্য বিস্তার : ১৬৩৩ খ্রিঃ শাহজাহান আহম্মদনগর জয় করেন। অতঃপর তিনি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয় করবার জন্য স্বয়ং দাক্ষিণাত্যে গমন করেন। গোলকুণ্ডার সুলতান ভীত হয়ে বাৎসরিক কর দিতে বাধ্য হলেন। বিজাপুরের সুলতান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন। শাহজাহান তার তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করেও পাঠান। আওরঙ্গজেব প্রথমবারে আট বছর দাক্ষিণাত্যের সুবাদার রূপে বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দেন। আওরঙ্গজেরকে দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করা হয়। এর আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন এবং গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর রাজ্য আক্রমণ করেন। কিন্তু দারার পরামর্শে শাহজাহানের বিরোধিতায় তিনি রাজ্য দুটি জয় করতে ব্যর্থ হন। তথাপি তিনি উভয় রাজ্যের কিয়দংশ অধিকার করেন।
৪. সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থাপক : শাহজাহান শুধু সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সাধন করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য সুশাসনের ব্যবস্থা করে প্রজার অশেষ মঙ্গল সাধন করেছেন। ন্যায়বিচার ও বদান্যতার জন্য তিনি প্রশংসা অর্জন করেছেন । তারই আদেশে দেওয়ান মুর্শিদকুলী খান রাজা টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করে সাম্রাজ্যের ধনসম্পদ বহুগুণে বর্ধিত করেন। ফরাসি পরিব্রাজক টেভারনিয়ার বলেন, “শাহজাহান তাঁর প্রজাদেরকে সুলতান হিসেবে শাসন না করে পিতার ন্যায় প্রতিপালন করেছেন।”
৫. কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতি সাধনকারী : সম্রাট জাতির মেরুদণ্ড কৃষককূলকে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা দান করেন। ব্যবসায়ীদের প্রতিও সম্রাট অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। বি. পি. সাকসেনা বলেন, “শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির এবং প্রাচুর্যের উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল।”
৬. শিল্প ও স্থাপত্যের উৎকর্ষ সাধনকারী : শাহজাহান এর ন্যায় সৌন্দর্য ও জাকজমকপূর্ণ নরপতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। স্থাপত্য শিল্পের দিক দিয়ে পৃথিবীর অপর কোন সম্রাটই এত গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হননি। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল :
ক. তাজমহল : আগ্রার যুমনা নদীর তীরে পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার উদ্দেশ্যে ‘তাজমহল' নির্মাণ করেন। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে শাহজাহান ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে হীরা, মতি, জহরত, পান্না, ফিরোজা, ইয়াকুত, আকিক প্রভৃতি মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল এ মহলে। এর সৌন্দর্য সম্পর্কে রবীঠাকুর বলেন-
এক বিন্দু চোখের জলে
কালের কোপলতলে শুভ্র সমুজ্জল
এ তাজমহল।
খ. মতি মসজিদ : শাহজাহান আগ্রা দুর্গের শ্বেত পাথরে নির্মিত মতি মসজিদটি নির্মাণ করে স্থাপত্য শিল্পে আরও একটি বিস্ময়কর অবদান সৃষ্টি করে গেছেন। সাদুল্লাহ খানের তত্ত্বাবধানে দশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এ মসজিদটির নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা হয়।
গ. লালকিল্লা : ১৬৩৯ খ্রিঃ সম্রাট শাহজাহান তাঁর রাজধানী আগ্রা হতে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করে ১৬৪৮ খ্রিঃ - এর উদ্বোধন উৎসব উদযাপন করেন। এ নতুন রাজধানীতে নির্মিত লালকিল্লার অভ্যন্তরে 'সম্রাট মহল', 'দেওয়ান-ই- আম', 'দেওয়ান-ই-খাস' প্রভৃতি আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর হর্ম্যরাজি নির্মাণ করে সুশোভিত করেন। দেওয়ান-ই- খাসের প্রবেশ দ্বারে ফারসি ভাষায় যে মূল্যবান শ্লোকটি লিপিবদ্ধ রয়েছে 'তাঁর বঙ্গানুবাদ উপস্থাপিত হল : স্বর্গ যদি ধরা মাঝে থাকে কোন খানে
এই খানে, তাহা এইখানে, এইখানে ।
ঘ. দিল্লীর জামে মসজিদ : ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দিল্লীর জুমা মসজিদ লাল পাথরে নির্মিত হয়েছিল। এতদ্ব্যতীত নিযাম উদ্দিন আওলিয়ার সমাধি সৌধ, শিশমহল, রঙমহল ইত্যাদি নির্মাণ করা ছাড়াও লাহোরের শালিমার বাগ শিল্পরুচির পরিচয় ঘটে।
ঙ. ময়ূর সিংহাসন : শিল্পাধ্যক্ষ বেবাদিল খাঁ তত্ত্বাবধানে প্রায় আট বছরে আট কোটি টাকা ব্যয়ে ইহার নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়। ময়ূর সিংহাসনের চারটি পায়া স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত। ১২টি মরকত মণির স্তম্ভের উপর নির্মিত। এর ভেতরের দিক চুন্নী-পান্নার দ্বারা একেবারে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথায় মণি-মাণিক্য খচিত এক জোড়া ময়ূর মুখোমুখি বসানো হয়েছিল। প্রতি জোড়া ময়ূরের মধ্যস্থলে এক একটি মণি মাণিক্য নির্মিত গাছ এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যেন ময়ূর ঠুকরে গাছের ফল খাচ্ছে।
৭. শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন : সম্রাট শাহজাহান ছিলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তাঁর আমলে সাহিত্যের প্রভূত চর্চার সাধন হয়। 'বাদশাহ নামার' রচয়িতা আব্দুল হামিদ লাহোরী, 'শাহজাহান নামার' লেখক ইনায়েত খাঁন, 'আমলে সালিহ' গ্রন্থের রচয়িতা মুহাম্মদ সালেহ, আব্দুল কাসিম ইরানী ও মীর্জা গিয়াস উদ্দিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শাহজাদারাও ঐ সময়ে 'সাবিনাতুল আউলিয়া', 'হাসনাতুল আরেফিন' ও 'রিসালাহ-ই-হকনামা' প্রভৃতি বিখ্যাত এবং আরও অনেকগুলো গ্রন্থ সংস্কৃত হতে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এককথায় তাঁর রাজসভা ছিল কবি সাহিত্যিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের কেন্দ্রস্থল। ৮. শাহজাহানের রাজত্বকালের গুরুত্ব : শাহজাহানের রাজত্বকাল বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মুঘল সাম্রাজ্য সর্বক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়। দেশের ব্যবসা, বাণিজ্য, কৃষি, রাজস্ব সকল ক্ষেত্রে অপরিসীম উন্নতি ঘটে। তাঁর আমলে কাব্য-সাহিত্য ও শিল্পেরও অসাধারণ প্রগতি সাধিত হয়। দেশে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। সর্বক্ষেত্রে এ অসাধারণ উন্নতির জন্য শাহজাহানের রাজত্বকালকে মুঘল ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে। উপসংহার : অতএব বুঝা যায় যে, শাহজাহানের আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের ঐশ্বর্য সম্ভার বহু বিদেশীর মন আকর্ষণ করেছিল। তাঁর স্থাপত্য কীর্তিগুলো তাঁর আমলের আর্থিক প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর আমলেই মুঘল স্থাপত্য শিল্পের চরম উন্নতি সাধিত হয়। ঐতিহাসিক হান্টার বলেন, "The Mughal empire attained its highest union of strength and magnificence under Shahjahan. (শাহজাহানের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য শক্তি ও জাকজমকের চরম শিখরে আরোহণ করেছিল।) বস্তুত গৌরবময় বিজয়, সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা, স্থাপত্যশিল্প ও সাহিত্যের চরম বিকাশ প্রভৃতির দিক দিয়ে শাহজাহানের রাজত্বকাল মুঘল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। প্রশ্ন ২৭৷ শিল্প স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে শাহজাহানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর। অথবা, মুঘল স্থাপত্য বিকাশে সম্রাট শাহাজাহানের অবদান মূল্যায়ন কর । উত্তর ভূমিকা : মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল ভারতের স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়। শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছেন। তার রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য শিল্প, সাহিত্যে ও স্থাপত্যে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিল। বহু বিদেশী পর্যটক শাহজাহানের স্থাপত্য শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে 'স্থাপত্য শিল্পের রাণী' বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঐতিহাসিক বি.পি.সাকসেনা বলেন, “সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য শাস্তি, সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল।" শাহজাহানের আমলে নির্মিত সৌধরাজির অনবদ্য রূপশ্রীকে ঐতিহাসিক ফার্গুসন 'Jwewl caskets mangnified into architecture, বলে বর্ণনা করেছেন। তার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপত্য ও শিল্পকলা চর উৎকর্ষতা লাভ করে। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ : শাহজাহান ছিলেন শিল্পরসিক সম্রাট। শিল্প সৃষ্টিই ছিল তার জীবনের সাধনা। তিনি বিভিন্ন ধরনের সৌধরাজীর দ্বারা দিল্লীকে সুশোভিত করে উহার নাম রাখেন শাহজাহানাবাদ। সম্রাটের বত্রিশ বছর রাজত্বকালের প্রধান প্রধান ইমারতগুলো হচ্ছে তাজমহল, মতি মসজিদ, দিওয়ান-ই-খাস, দিওয়ান-ই-আম, দিল্লীর জামে মসজিদ ইত্যাদি। এসব ইমারতগুলো মুঘল ঐশ্বর্য ও স্থাপত্যকলার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। পারসিক ও ভারতীয় শিল্প কৌশলের সংমিশ্রণে মুঘল স্থাপত্যকলার বিকাশ ঘটেছে। নিম্নে শাহজাহানের স্থাপত্য শিল্পগুলো আলোচনা করা হল : ১. শাহজাহানাবাদ : সম্রাট শাহজাহান তার রাজত্বকালে রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করেন। পরে স্বীয় নামানুসারে এর নামকরণ করেন 'শাহজাহানবাদ'। এরপর এ দিল্লীকে সুমজ্জিত করার জন্য তিনি দেশী-বিদেশী শিল্পী ও স্থপতিদের আমন্ত্রণ করেন এবং বিভিন্ন প্রকার সুরোম্য অট্টালিকা গড়ে তোলেন । ২. তাজমহল : সম্রাটের সর্বোত্তম কীর্তি হল 'স্থাপত্য শিল্পরাণী' বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল। প্রিয়তমা মহিষী মমতাজের স্মৃতিকে চির স্মরণীয়, চির অম্লান করে রাখার জন্য শাহজাহান যমুনা নদীর তীরে আগ্রায় তাজমহল নির্মাণ করেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, "No woman of high rank has acquired such celebrity in history as Shahajahans dearly loved queen Arjumand Banu Begam, Familiarly know a mumtaj mahal or the lady of the Taj." তাজমহল নির্মাণের প্রধান স্থপতি ছিলেন উস্তাদ ঈশা। ১৬৩২ খ্রিঃ তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় বিশ হাজার শ্রমিকের বাইশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে তাজমহলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। তাজমহলের স্থাপত্যিক অলঙ্করণ ও নৈপুণ্য দর্শকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। এটা বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। একে 'একবিন্দু এটা অশ্রু' ও 'মার্বেলের স্বপ্ন' বলে অভিহিত করা হয়। তাজমহলের অনুপম সৌন্দর্য যুগ যুগ ধরে কবি সাহিত্যিকদের রচনার বিষয়বস্তু হিসেবে সমাদৃত। তাজমহল শুধুমাত্র মুঘল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করে নি বরং উহা পত্নী প্রেমের অমর নিদর্শন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এ স্মৃতিসৌধটি সম্পর্কে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন- এক বিন্দু নয়নের জল কালের কোপলতলে শুভ্র সমুজ্জল এ তাজমহল । ৩. মতি মসজিদ : মতি মসজিদ শাহজাহানের নির্মিত অপর এক কীর্তিমান স্থাপত্যশিল্পের উদাহরণ। ১৬৪৫ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৬৫৩ সালে শেষ হয়। সাদুল্লা খানের তত্ত্বাবধানে ৩০ লক্ষ মুদ্রা ব্যয়ে এ মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এ মসজিদের আয়তন দৈর্ঘ্যে ২৩৪ ফুট এবং প্রস্থে ১৮৭ ফুট। শাহজাহানের নির্মিত এরূপ অপরূপ মসজিদের মত এত সুন্দর মসজিদ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এর স্থাপত্যিক সৌন্দর্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাই পর্যটকগণ এর সৌন্দর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ৪. দিল্লীর জামে মসজিদ : শাহজাহানের স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শন হল দিল্লীর জামে মসজিদ। এটি ভারতের বৃহত্তম মসজিদগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৬৫৬ খ্রিঃ সম্রাট শাহজাহান এ ভুবন বিখ্যাত মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এ মসজিদ নির্মাণে প্রায় দশ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় হয়েছিল । ১৫৯ ৫. দিওয়ান-ই-খাস : লাল কিন্নার অভ্যন্তরে দিওয়ান-ই-খাস নির্মাণ করা হয়। শাহজাহানের আমলের যে কোন ইমারত অপেক্ষা উহা অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত। দিওয়ান-ই-খাসে ছিল মূল্যবান রৌপ্যছাদ, বিমিশ্র মর্মর হর্স রাজা, সুবর্ণ ও সুন্দর পাথরের অলংকরণ। সম্রাট উহাকে ভূস্বর্গ বলে মনে করতেন। শাহজাহান অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে দেওয়ানী খাসের প্রবেশ দ্বারে ফারসি ভাষায় লিখে রেখে ছিলেন যার বাংলা অর্থ হল : স্বর্গ যদি ধরা মাঝে থাকে কোন্খানে এইখানে তা এইখানে, এইখানে। ৬. ময়ূর সিংহাসন : সম্রাট শাহজাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন। এটি তার শিল্পানুরাগের এক অক্ষয় কীর্তি। শিল্পাধ্যক্ষ বেবাদল খানের তত্ত্বাবধানে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সাত বছরের পরিশ্রমে ৮ কোটি টাকা د ব্যয়ে এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। সিংহাসনটি লম্বায় 8 গজ, প্রস্থে ২ গজ এবং উচ্চতায় ৫ গজ ছিল। সিংহাসনের চার পায়া স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত। বারটি মরকত মনির স্তম্বের উপর এটার চন্দ্রাতাপ ছাদ বসানো ছিল। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথায় মনিমাণিক্য খচিত একজোড়া ময়ূর এমনভাবে বসানো হয়েছিল যেন দেখলে মনে হয় ময়ূর দুটি ঠোকরিয়ে ঠোকরিয়ে গাছের ফল খাইতেছে। ১৭৩৯ খ্রিঃ পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ভারত অভিযানকালে উহা পারস্যে নিয়ে যান। বর্তমানে উহা ইংল্যান্ডের জাদুঘরে রক্ষিত আছে। ৭. দিওয়ান-ই-আম : দিল্লীর প্রাসাদ দুর্গে দেওয়ান-ই-আম নির্মাণ করা হয়। এর নির্মাণকার্যে ও অলঙ্করণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। সৌন্দর্য ও স্থাপত্যিক অলঙ্করণের দিক থেকে দিওয়ান-ই-খাসের পরই উহার স্থান। উহা মুঘল স্থাপত্যকীর্তির একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। ৮. শিশমহল ও যুই মহল : ১৬৩১ খ্রিঃ সম্রাট শিশমহল ও যুই মহল নির্মাণ করেন। লাহোর অবস্থানকালে সম্রাজ্ঞী উহাতে বসাবস করতেন। এটা ছিল বিশ্বের সুশোভিত রাজকীয় আবাসগৃহ । • ৯. শালিমার উদ্যান : ১৬৩৭ খ্রিঃ শাহজাহান রাজপ্রাসাদের কেন্দ্ররূপে লাহোরে শালিমার উদ্যান নির্মাণ করেন । লাহোরে নির্মিত শালিমার উদ্যান আজও দর্শকদের পূলকিত করে। এ উদ্যান রাজকীয় প্রমোদ কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। শালিমার উদ্যানের মনোরম দৃশ্য কবি ও পর্যটকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। এ উদ্যানটি শাহজাহানের স্থাপত্যরুচির অনুপম নিদর্শন। এছাড়াও সম্রাট কাশ্মির, দিল্লী ও বিভিন্ন স্থানে সুন্দর সুন্দর উদ্যান নির্মাণ করেন । ১০. অন্যান্য ইমারত : শাহজাহানের আমলে অসংখ্য সুরম্য ইমারত নির্মিত হয়। এগুলোর মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার স্মৃতিসৌধ, কাবুল, কাশ্মির, আজমীর ও আহমেদাবাদের প্রাসাদ, দুর্গ, মসজিদ ও অট্টালিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ১১. চিত্রকলা ও হস্তলিপিবিদ্যা : শাহজাহানের আমলে চিত্রকলা ও হস্তলিপি বিদ্যা যথেষ্ট উৎকর্ষতা লাভ করে । এ সময়ে চিত্রশিল্প নতুন রূপ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বিকশিত হয়। মীর হাশিম, ফকির উল্লাহ খান প্রমূখ চিত্রশিল্পীদের বিশেষ প্রচেষ্টায় মুঘল চিত্রকলার চরম উন্নতি ঘটে। প্রত্যেক মুঘল বাদশাহ চিত্রশিল্পের প্রতি অনুরক্ত ছিল। মুঘল চিত্রশিল্পে পারস্য প্রভাব বিদ্যমান । শাহজাহানের আদেশে চেঙ্গিসনামা, জহুর নামা, পদ্মনামা, কালিলা ওয়া দিমনা, রামায়ন প্রভৃতি গ্রন্থে অভিজ্ঞ শিল্পীদের দ্বারা চিত্রায়িত করা হয়। মুঘল চিত্রে বিশেষ করে গাছপালা পশুপাখির প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিদ্যমান খ্যাতনামা চিত্রশিল্পীদের মধ্যে ফারুক বেগ, মুহাম্মদ নাদির, ওস্তাদ মনসুর ও বিজন দাস উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি সাহিত্য ও সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। স্থাপত্যকলা, চিত্রকলা, হস্তলিপি বিদ্যা এবং অন্যান্য কার্যাবলি বিচারে শাহজাহানের রাজত্বকালকে মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয় ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, মুঘল সম্রাটদের মধ্যে একমাত্র শাহজাহানের আমলেই শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্প উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে। ঐশ্বর্যশালী ও মহিমামণ্ডিত শাহজাহানের কীর্তিগুলো তার আমলে আর্থিক প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করে। প্রকৃতির করালগ্রাসে মুঘল সাম্রাজ্য বিলীন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছেন কীর্তিমান পুরুষ সম্রাট শাহজাহান কিন্তু তাঁর স্মৃতি আজও অতীতের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রকাশ করছে তাদের মর্মকথা। এজন্য সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালকে মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]