শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের বিবরণ দাও। আওরঙ্গজেবের সফলতার কারণ নির্ণয় কর।

ভূমিকা : সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বের শেষভাগে তাঁর চার পুত্রের মধ্যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষ সংঘটিত হয়, তা মুঘল শাসনের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুর দারাশিকো পাঞ্জাবের শাসনভার পেয়েছিলেন। ১৬৫৭ সালে অসুস্থতার সময় তিনি রাজধানীতে পিতার শয্যাপার্শ্বে দিলেন এবং কার্যত তিনিই সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু শাহজাহান ধীরে ধীরে সুস্থ তিনি দারার নিকট হতে শাসন ক্ষমতা ফিরিয়ে না নেওয়ায় তাঁর ক্ষমতা পিলু পুত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ দ্বন্দ্ব সেই স ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে রূপান্তরিত হয়।
সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব : শাহজাহানের রাজত্বকাল মুঘল যুগের স্বর্ণযুগ ব অভিহিত হলেও তাঁরই রাজত্বকালের শেষের দিকে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে মুঘল তথা সমগ্র মুসলিম ভারতের ইতিহাসে এর কলঙ্কময় ইতিহাস সংযোজন করেছে। নিম্নে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের কারণগুলো বর্ণনা করা হল ঃ
১. সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব : শাহজাহানের জীবদ্দশায় তাঁর পুত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের অন্যতম কারণ ছিল মুঘল সিংহাসনের জন্য সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতির অভাব। যার ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব অথবা বিদ্রোহ একটি মুঘল ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
২. পুত্রদের চারিত্রিক বৈপরীত্য : শাহজাহানের চার পুত্রের চারিত্রিক পার্থক্যই ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। আওরঙ্গজের ছাড়া অন্যান্য সবাই ছিলেন আয়েশী, ভোগবিলাসী, মদ্যপায়ী। প্রতিদ্বন্দ্বী যুবরাজদের এ চারিত্রিতে বৈশিষ্ট্যের বৈপরীত্যও সংঘর্ষকে ত্বরান্বিত করে ।
৩. দারার প্রতি শাহজাহানের দুর্বলতা : পুত্রদের মধ্যে আওরঙ্গজেব সর্বদিকে যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও জ্যৈষ্ঠ পুর দারার প্রতি তিনি দুর্বল ছিলেন। যা কিছুটা হলেও এ বিরোধের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল।
৪. দারাশিকোর দুরভিসন্ধি : ঐতিহাসিক হান্টার, লেনপুল প্রমুখের মতে, শাহজাহানের অসুস্থতার সুযোগে দারা সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। দারা শাহজাহানের নামে আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ সকল সুযোগ্য সেনাপতিকে রাজধানীতে ডেকে পাঠান। তিনি ভ্রাতাদের রাজধানীতে অবস্থানরত দূতগণকে রাজদরবার তথা সম্রাট সম্পর্কে স্ব-স্ব প্রভুগণের নিকট তথ্য প্রেরণ না করার নির্দেশ দেন এবং তদানুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
৫. সন্দেহ ও অবিশ্বাস : রাজধানী হতে দূরবর্তী প্রদেশে অবস্থানকারী সুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ পিতার অসুস্থতার কোন সংবাদ না পেয়ে মনে করেন যে দারা পিতার মৃত্যুর সংবাদ গোপন করে বলপূর্বক সিংহাসন দখল করেছেন। এ সময় রাজধানী দিল্লীর সাথে বাংলার গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রূপ নেয় ।
৬. দারাশিকোর স্বৈরাচারীনীতি : দারা রাজধানীর সাথে বাইরের সমস্ত সংযোগ বন্ধ করে দেন। রাজধানীতে আওরঙ্গজেবের দূত ছিলেন ঈসা বেগ। দারা তাকেও বন্দী করে তার গৃহ বাজেয়াপ্ত করেন। এভাবে স্বীয় কর্মচারী ও সমর্থকদের প্রতি দুর্ব্যবহারের সংবাদ আওরঙ্গজেবের কানে পৌঁছলে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্থির সংকল্প গ্রহণ করেন।
উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব : উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলো নিম্নরূপ :
১. বাহাদুর গড়ের যুদ্ধ : সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর বাংলার শাসনকর্তা শাহ সুজাই সর্বপ্রথম ১৬৫৭ সালে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে স্বনামে মুদ্রা প্রচলন করেন। অতঃপর তিনি দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন, কিন্তু ১৬৫৭ সালে দারার পুত্র সোলায়মান শিকোর নিকট বাহাদুর গড়ের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন।
২. দারার ভাগ্য বিপর্যয় : পরবর্তীতে ১৬৫৯ সালের এপ্রিল মাসে আজমীরের নিকট দেওয়াইর যুদ্ধে আওরঙ্গজেব দারাকে শেষবারের মত পরাজিত করেন এবং বন্দী অবস্থায় দারাকে দিল্লী আনা হয়। দিল্লীতে এক বিচারে ইসলাম ত্যাগসহ তিনি বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং ১৬৫৯ সালের আগস্ট মাসে মৃতুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এভাবে আওরঙ্গজেব সকল ভাইদেরকে পরাজিত করে দিল্লীর শাসন ক্ষমতা লাভ করেন।
৩. মুরাদের সুরটি বন্দর দখল । অন্যদিকে গুজরাটের শাসনকর্তা মুরাদও নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে স্বীয় ভগ্নি জাহানারা বেগমকে প্রদত্ত সুরাট বন্দর বিধ্বস্ত করেন এবং তার দেওয়ান মীর আলী নকীকে নিজ হস্তে হত্যা করেন।
৪. মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের চুক্তি : এদিকে আওরঙ্গজেবও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি সুজা ও মুরাদের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে কৌশলে মুরাদকে নিজ পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হন এবং মালবে তাঁর সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। শর্ত ঠিক হয় যে, যুদ্ধ জয়ের পর সাম্রাজ্য দু'ভাগে ভাগ করা হবে এবং মুরাদ উত্তরাঞ্চলের পাঞ্জাব, আফগানিস্ত নি. কাশ্মীর ও সিন্ধু লাভ করবেন। যুদ্ধলব্ধ সামগ্রীর এক তৃতীয়াংশ পাবেন মুরাদ। চুক্তিবদ্ধ হয়ে উভয়ে রাজধানীর দিকে সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হন।
৫. ধর্মাটের যুদ্ধ : সম্মিলিত বাহিনী উজ্জয়িনীর নিকট ধর্মাটে তাবু ফেলেন। ফলে ১৬৫৮ সালে দারার নির্দেশে সেনাপতি রাজা যশোবন্ত সিং তাদের গতিরোধ করতে অগ্রসর হলে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু আওরঙ্গজেবের উন্নত যুদ্ধ কৌশল ও বীরের নিকট দারা বাহিনী পর্যুদস্ত হয়।
৬. সামুগঢ়ের যুদ্ধ ধর্মাটের যুদ্ধে জয়লাভের পর সম্মিলিত বাহিনী চঞ্চল নদী অতিক্রম করে আমার অনতিদূরে গামুগড় প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেণ। ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত দারাও ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শোচনীয়ভাবে তিনি সামুগড়ের যুদ্ধে পরাজিত হন।
৭. খাজওয়ার যুদ্ধ ও সুজার পরাজয় : অপরদিকে আওরঙ্গজেব শাহ সুজার সাথেও সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করেন। কিন্তু সুজা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। ফলে ১৬৫৯ সালে খাজাওয়ার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর নিকট সুজা পরাজিত হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। জে.এন. সরকারের মতে, সুজা সপরিবারে মগ দস্যুদের হাতে নিহত হন। আওরঙ্গজেবের সাফল্যের কারণ : উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের সাফল্যের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে,
. ১. আওরঙ্গজেবের যোগ্যতা ও দক্ষতা : শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন সৎ ও যোগ্য। তাঁর ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অসাধারণ কূটনৈতিক কৌশল, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, যা তাঁর সাফল্যকে নিশ্চিত করে।
২. শাহজাহানের দুর্বলতা ও নির্বুদ্ধিতা : উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় শাহজাহানের কতিপয় ত্বরিত সিদ্ধান্তহীনতা ও দুর্বলতা আওরঙ্গজেবের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল। তাঁর মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচার বন্ধ না করা, মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের যুদ্ধযাত্রা প্রতিহত করতে না পারা এবং দারার ভুল পরামর্শ এক্ষেত্রে আওরঙ্গজেবের সাফল্যের অন্যতম কারণ বলা যায়। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তিনি পুত্রদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব ও দ্বন্দ্ব উপশমের চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়েছেন ।
৩. আওরঙ্গজেবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা : আওরঙ্গজেব ছিলেন অসীম সাহসী ও উচ্চাভিলাষী। পক্ষান্তরে দারার প্রতিভা, কূটনীতিজ্ঞান প্রভৃতি মোটেই তাঁর সমকক্ষ ছিল না। বিশেষত বিবাদের সময় যেরূপ সাহসীকতা ও ত্বরিত কৌশলের প্রয়োজন হয়, দারার মধ্যে তা ছিল না। ফলে খুব শীঘ্রই তিনি পরাজয়বরণ করে নিতে বাধ্য হন ।
৪. সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব : আওরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী ছিল সুশৃঙ্খল ও যুদ্ধ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। সে সাথে উন্নত যুদ্ধ কৌশলের প্রয়োগ ও তাঁর নিজস্ব যুদ্ধ পরিচালনা এক্ষেত্রে আরো জ্বরিত প্রভাব ফেলে। তাছাড়া দারার গোলন্দাজ বাহিনী অপেক্ষা আওরঙ্গজেবের গোলন্দাজ বাহিনী অধিকতর সুদক্ষ ও শক্তিশালী ছিল। ফলে সহজেই তিনি দারা ও সুজার বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
৫. ইসলামের প্রতি নিষ্ঠা : ব্যক্তিগতভাবে আওরঙ্গজেব ছিলেন ন্যায়নিষ্ঠ, ধর্মপ্রাণ ও ইসলামের প্রতি একনিষ্ঠ । ফলে রাজ্যের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন এবং তাঁর বিজয়কে ত্বরান্বিত করেন ।
৬. দারার বিরুদ্ধে সাফল্য : সর্বোপরি দারার অধীনে মুঘল বাহিনী ও রাজপুত বাহিনীর মধ্যে সংহতি ও ঐক্যের সম্পূর্ণ অভাব ছিল। ফলে যুগ্ম নেতৃত্ব নিয়ে মুঘল শিবিরে বারবার বিপর্যয় দেখা দেয়। অপরদিকে আওরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী ছিল সংযত, সুসংবদ্ধ ও একক নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত। ফলে দারার বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য লাভ সহজতর ও সুনিশ্চিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বীয় যোগ্যতা, মেধা, প্রতিভা ও উন্নত কৌশলের বলেই আওরঙ্গজেব ভ্রাতাদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। চারিত্রিক দৃঢ়তা, ইসলামের প্রতি অবিচল আস্থা এবং আপন শ্রেষ্ঠত্বই ছিল তাঁর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। ঈশ্বরী প্রসাদ তাই বলেন, "The victory Aurangazeb was the victory of action over soupiness, of intrepidity over inertia and of organization and discipline over confusion and incoherence."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]