আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তিনি কতখানি দায়ী? আলোচনা কর ।

ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আওরঙ্গজেবের বহুমুখী কার্যাবলি একটি বিতর্কিত বিষয়। ইউরোপের ঐতিহাসিক ও বিদেশী পর্যটকদের মতামতের উপর ভিত্তি করে ভারতের ঐতিহাসিকগণ সম্রাটের কার্যাবলির বিরূপ সমালোচনা করেছেন। সমসাময়িক ফারসি গ্রন্থের উপর গবেষণা করে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ অভিমত প্রকাশ করেন যে, আওরঙ্গজেব আদর্শ সম্রাট ছিলেন। ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান মুসলমানগণ তাকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম নরপতি হিসেবে সম্মান দান করেন। ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরী প্রাসাদ বলেন, "Aurangzeb is one the greatest ruler of the Mughal dynesty." তিনি অর্ধশতাব্দীর অধিককাল পর্যন্ত অসামান্য বীরত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে ভারতবর্ষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও কৃতিত্ব ঃ নিম্নে আওরঙ্গজেবের কৃতিত্বগুলো আলোচনা করা হল :
১. আওরঙ্গজেবের চরিত্রে বহুমুখী গুণের সমাবেশ : আওরঙ্গজেবের চরিত্রে বহুমুখী গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি একজন সুদক্ষ সেনাপতি, আদর্শ শাসক, নিরপেক্ষ বিচারক, সরল এবং ধার্মিক লোক ছিলেন। ইউরোপীয় পর্যটক ও ঐতিহাসিকগণ অনেকেই আওরঙ্গজেবের চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বার্নিয়ার তাকে প্রতিভাবান, সুচতুর ও শ্রেষ্ঠ নরপতি বলে বর্ণনা করেছেন। হ্যামিলটন তাকে নিরপেক্ষ বিচারক ও রাজোচিত গুণাবলির অধিকারী ও ধর্মভীরু নরপতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ঐতিহাসিক কিনিও তাকে শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন।
২. মানুষ হিসেবে আওরঙ্গজেব : আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান। তিনি নিষ্ঠার সাথে ইসলামের বিধিনিষেধ পালন করতেন। "Judged by the purety of character can claim comparison with Aurangzeb." আদর্শবাদী ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আওরঙ্গজেবকে সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ রাজার পোশাকে দরবেশ নামে আখ্যায়িত করেছেন। কাফী খানের মতে, “তৈমুরী বংশের নয় বরং দিল্লীর সমস্ত সম্রাটের মধ্যে সিকান্দার লোদীর পর ধর্মানুরাগ কৃচ্ছ্রসাধন এবং ন্যায়পরায়ণতার জন্য অপর কেউ যদি কৃতিত্ব অর্জন করেন তবে তিনিই। নির্ভিকতা, কষ্ট, সহিষ্ণুতা এবং সুবিচারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”
৩. নিরপেক্ষ বিচারক : আওরঙ্গজেব একজন নিরপেক্ষ বিচারক ছিলেন। তার নিকট দরিদ্র এবং ধনী, অভিজাত এবং সাধারণ মানুষ সমান বিচার পেত। তিনি ছিলেন বিচার বিভাগের সর্বময়কর্তা। তিনি বলতেন, “আমি আইন অমান্য করলে প্রজাবর্গ আইন অমান্য করবে।” তিনি নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা কোমল স্বভাবের অধিকারী ছিলেন।
৪. সরল ও পবিত্র জীবন : আওরঙ্গজেবের ব্যক্তি জীবন ছিল সহজ, সরল, কঠোর ও কলুষমুক্ত। তিনি কখনও প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়েন নি এবং নিষিদ্ধ খাদ্য, পানীয় এবং পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণ করতেন না। তিনি কঠোর সংযমের অধিকারী ছিলেন। রাজভাণ্ডারকে তিনি পবিত্র আমানত মনে করতেন এবং নিজের ব্যয়ের জন্য রাজকোষ হতে এক কপর্দকও গ্রহণ করতেন না। পবিত্র কুরআন শরীফ নকল করে এবং নিজের হাতে টুপি সেলাই করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
৫. ধার প্রতি অনুরাগ সে আওরঙ্গজেবের গভীর জ্ঞান ছিল। পবিত্র ধর্মমত কুরআন তার কন্ঠস্থ ছিল। পারসিক, হিন্দি, আরবি ও তুর্কি ভাষায় তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। প্রখর ধীশক্তির অধিকারী আত -ই-কুরান ছিলেন এবং হাদিস শাস্ত্রেও তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় ফতোয়া-ই-আলমগীর নামক মুসলিম আইন সম্বন্ধীয় হয়। নাথ সরকার বলেন, “স্বীয় ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের বিধানসমূহ পুজানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ এবং তা প্রত্যেককে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন, "পদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এমন একজন অনমনীয় মুসলিম সম্রাট পরিলক্ষিত হয় যিনি কেবল কাঠিন্যই অবলম্বন করতেন রাজত্বের আগে স্থান দিতেন।"
৬. মহান শাসক সুদক্ষ শাসক হিসেবে আওরঙ্গজের অশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি শাসন বিভাগের প্রতিটি দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি অন্যায় কর, দুর্নীতি ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করেন। ন্যূনতম পক্ষে ৮০ প্রকারের কর উঠিয়ে দেন। তিনি কৃষি ও বাণিজ্যে বিশেষ উৎসাহ প্রদান করেন। তার সময়ে অসংখ্য রাস্তা ও সেতু নির্মিত হয়। আওরঙ্গজেব ছিলেন অসাধারণ ও বিরল প্রতিভাশালী বাকি। অদ্বিতীয় রাজনীতিবিদ ও মহান শাসক। প্রখ্যাত ইতালীয় চিকিৎসক ক্যাবেরী সম্রাটের কর্তব্য নিষ্ঠা ও দায়িত্বজ্ঞানের ছয়নী প্রশংসা করে গেছেন।
৭. সেনাপতি হিসেবে দক্ষতা : আওরঙ্গজের বাল্যকাল হতেই অত্যন্ত সাহনী ও তেজস্বী ছিলেন। তিনি ছিলেন দক্ষ সেনাপতি। তার যেমন ছিল দৈহিক শক্তি, তেমনি ছিল মনোবল। সম্রাট খুব কম যুদ্ধেই পরাজয়বরণ করেন। অর্ধ শতাব্দীব্যাপী তিনি অবিরাম যুদ্ধ করে রাজপুত, মারাঠা ও দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের পর্যদুস্ত করেন। তার রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য উত্তরে কাশ্মির হতে দক্ষিণে তাজেত্তার পূর্বে বাংলা ও আসাম হতে পশ্চিমে কান্দাহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার যুদ্ধ পরিচালনার প্রশংসা করে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, He was as much a master of the pen as master of the sword.
৮. শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক : আওরঙ্গজেব শিক্ষা ও সংস্কৃতির একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঈশ্বরী প্রসাদের ভাষায়, “কৃতি সেনাধ্যক্ষ এবং শাসক ছাড়াও তিনি একজন প্রকৃত অর্থে বিদ্বান ছিলেন। তিনি ধর্মতত্ত্বে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তার রাজদরবার ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জ্ঞানী ও গুণীর সমাগম স্থান শিক্ষার প্রসারকল্পে তিনি তার বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেন। কুরআন ও হাদীসসহ ধর্মশাস্ত্রে তার অগাধ বুৎপত্তি ছিল। আরবী ও ফারসি সাহিত্যেও তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। দিওয়ান-ই-হাফিজ নামক অমূল্য ফারসি সাহিত্যেও তাঁর প্রগাঢ় অনুরক্তি ছিল। তাঁর রাজত্বকালে কাফী খান, 'মুনতাখাব-আল-জেবুর', আলমগীর নামা, गा আমীর-ই-আলমগীরি, খুলাসাত আত-তাওয়ারিখী প্রভৃতি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। যদুনাথ সরকার বলেন, “লেখনী ও তরবারী তার হয়ে দক্ষতার শোভা পেত। "
৯, স্থাপত্য, চিত্রকলা ও সঙ্গীত: আওরঙ্গজেব কর্তৃক দিল্লীতে নির্মিত অপূর্ব সুন্দর মতি মসজিদ এবং লাহোর নির্মিত বাদশাহী মসজিদ স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তার অনুরক্তির কথাই প্রমাণ করে। তাজমহলের অনুকরণে আওরঙ্গজেব ১৬৭৮ খ্রিঃ আওরঙ্গজেবের পত্নী 'বারী আপ-দৌরানীর' সমাধি নির্মিত হয়। তার রাজত্বকালে মুঘল চিত্রকলারও উৎকর্য সাধিত হয়। বিজাপুর অবরোধের দৃশ্য অতি চাতুর্যের সাথে চিত্রকর ফুটিয়ে তোলেন। সাকী মুস্তাদ খানের মতে, "আওরঙ্গজেবের রাজত্বের প্রথমদিকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত গায়কগণ দরবারে সঙ্গিত পরিবেশন করতেন এবং আওরঙ্গজেব তা এবণ করতেন।”
১০. দূরদর্শী কূটনীতিবিদ ঃ আওরঙ্গজেব তীক্ষ্ণ কূটনীতিজ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি রাজপুত শক্তিকে দুর্বল করার জন্য মারওয়ার এবং মেবার দখল করেন। মারাঠাদের চরম শত্রু জেনেও আওরঙ্গজেব বিশ্বাসঘাতক শিবাজীর প্রতি উদারতা প্রদর্শন করেন এবং চরপতীকে দিল্লীতে সম্বর্ধনা ও রাজা খেতাব প্রদান করেন। যদুনাথ সরকার বলেন, "কুটনীতির দিক হতে আওরঙ্গজেব অপ্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন এবং কোন প্রকার কুটচক্র এবং গুপ্তকার্য তাকে বিচলিত করতে পারে নি। তিনি কুটকৌশলে সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছেন।”
১১. পরদর্শে সহিষ্ণুতা একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হলেও আওরঙ্গজেব অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন। কাফি খান বালেন, "কেবল তৈমুরের বংশের সুলতান নয়, ধর্মানুরক্তি, কঠোর পবিত্র জীবনযাপন এবং ন্যায়পরায়ণতা তার মত কারও ছিল না। সাহস, কষ্ট সহিষ্ণুতা এবং সুবিচারের ক্ষেত্রে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।" তার মত ধার্মিক ও ধর্মবেত্তা সম্রাটকে জিন্দাপীর বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মুঘল বংশের পতনের জন্য আওরঙ্গজেব দায়ী ছিলেন কি কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে, "আওরঙ্গজেবের নীতি বিশেষ করে ধর্মীয় নীতি ও দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী ছিল। ঐতিহাসিকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস পাব ঃ
১. ধর্মীয় নীতি বংশের পতনের জন্য দায়ী ছিল না : 'আওরঙ্গজেব তার ধর্মীয় নীতি দ্বারা রাজপুত, শিখ ও হিন্দুদের সহানুভূতি হারিয়েছিলেন' এমত গ্রহণযোগ্য নহে। রাজপুত এবং হিন্দুদের বিদ্রোহ ও চক্রান্ত শুধু আওরঙ্গজেবের সময়ই নি। আকবর, জাহাঙ্গির এবং শাহজাহানের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিলেন। সুতরাং আওরঙ্গজেবকে উপরিউক্ত দোয় দোষী করা সমীচিন হবে না।
২. দাক্ষিণাত্য নীতিও বংশের পতনের জন্য দায়ী ছিল না : আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী ছিল এ মতও অসমর্থিত ও ভিত্তিহীন। দাক্ষিণাত্যের ব্যাপারে আওরঙ্গজেব পূর্ব পুরুষদের নীতি অনুসরণ করেছিলেন মাত্র। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তাকে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়।
৩. আওরঙ্গজেবের দুর্বল উত্তরাধিকারীগণ বংশের পতনের জন্য দায়ী ছিলেনঃ পরবর্তী মুঘলদের অযোগ্যতা এক চরিত্রের অবনতি মুঘল বংশের পতনের জন্য দায়ী ছিলেন। একমাত্র বাহাদুর শাহ ব্যতিত আওরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটগণ দুর্বল ও অযোগ্য হওয়ায় মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের গতিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় নি। এককভাবে আওরঙ্গজেবকে মুঘল বংশের পতনের জন্য দায়ী করা যায় না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আওরঙ্গজের ক্ষমতাবান শাসক, সুদক্ষ সেনা নায়ক এবং সুক্ষ্ণ কুটবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। লেনপুল বলেন, আওরঙ্গজেব মুঘল বংশের মধ্যে শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনি আকবর অপেক্ষা বৃহত্তর সাম্রাজ্য ও বিশালতর সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব করে গিয়েছেন। ফরাসি পরিব্রাজক বারনিয়ার বলেন, “আওরঙ্গজেব ছিলেন অসাধারণ ও বিল প্রতিভাশালী ব্যক্তি, অদ্বিতীয় রাজনীতিবিদ ও মহান শাসক।”

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]