মুঘল আমলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিবরণ দাও । উত্তর

ভূমিকা : সম্রাট আকবরের আমলে বাংলাদেশে মুঘলের সামরিক বিজয় হলেও স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সামন্ত শক্তিগুলোকে দমন করা যায় নি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলেই বাংলায় প্রকৃত মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। মুঘল শাসনামলের পূর্বে বাংলার শাসনব্যবস্থায় কোন স্থিতিশীলতা ছিল না। মুঘল শাসনামল ছিল শান্তি স্থাপনের এবং উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের এক গৌরবময় যুগ। এ যুগে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। এ সময়ে বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ঘটে এবং বাংলার সামুদ্রিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হয়। স্যার জে. এন. সরকার 'History of Bengal' গ্রন্থে বাংলায় মুঘল শাসনের হিতকর প্রভাব উল্লেখ করে বলেছেন যে, "During the first century of Mughal rule the outer world came to Bengal and Bengal went out herself to outer world and the economic, social and cultural changes that grew out of the mangling of peoples mark a most important and distinct stage in the evolution of modern Bengal."
মুঘল আমলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিবরণ : মুঘল আমলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মূলত বাংলার অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য এ তিনটি থামের উপর দাঁড়িয়েছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল :
ক. কৃষি : বাংলায় যে কৃষিপণ্যগুলো বিশেষভাবে উৎপন্ন হতো তা ছিল ধান বা চাল। 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থ অনুসারে, বাংলায় এত বেশি চাল উৎপন্ন হতো যে ভারতের ঘাটতি অঞ্চল বিশেষত কোচিন প্রভৃতি অঞ্চলে চাল বাংলা থেকে রপ্তানি হতো। বাংলার কোন কোন জেলার জমি ছিল তিন ফসলি। এছাড়া আখ, নারিকেল, আম ও অন্যান্য ফল বাংলায় প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হতো। পাট, তামাক, সরিষা, নীল ও সুপারি উৎপন্ন হতো। কৃষি ছিল বাংলার প্রধান জীবিকা। এমনকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও লোকজন দ্বারা জমি আবাদ করে তার দ্বারা নিজেদের ভরণপোষণ করত। কবি কঙ্কনের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে তা জানা যায়।
খ. শিল্প : মুঘল যুগে বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শিল্পোৎপন্ন দ্রব্যাদির প্রাচুর্য। এ যুগে বাংলায় বিভিন্ন প্রকার শিল্প দ্রব্য উৎপাদিত হতো। নিম্নে মুঘল আমলে বাংলায় উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. রেশম শিল্প। মুঘল যুগে বাংলার রেশম শিল্প ছিল বিখ্যাত। বাংলায় এত প্রচুর পরিমাণে রেশন উৎপাদিত যে, তা চীনের উৎপাদিত রেশম অপেক্ষা পরিমাণে অনেক বেশি ছিল। বাংলায় রেশমের গুটি পোকার মধ্যে খুঁত পাে ব্যাপক আবাদ হতো। মোটা রেশম থেকে মটকা এবং মিহি রেশম থেকে কাপড় তৈরি হতো। বাংলার রেশম ডিপ পারি ও সিসিলির রেশমের মত সোনালি। খোলশ শতকে বাংলা থেকে ২২ হাজার পাঁচ অর্থাৎ, ২১ লক্ষ পাউন্ড ওজনের বেশ বিদেশে রপ্তানি হতো। এছাড়া তার ও বনজ রেশমত উৎপাদিত হে
২. বস্ত্র শিল্প। বাংলার অপর প্রধান শিল্প ছিল বক্সের উৎপাদন। সুখ মসলিন বরের জন্যে অত্যন্ত সুক্ষ্ম সুতা উৎপাদন দরকার হতো। এজন্য ১৮-৩০ বছর বয়স্ক রমণী যার চোখের জ্যোতি ছিল তীক্ষ্ণ এবং হাতের আঙ্গুল ছিল নরন, গৃহকাজে আঙ্গুল শক্ত হয় নি তারাই তকলি দ্বারা এ সুতা তৈরি করতেন। মসলিন বস্ত্রের দাম খুব কড়া ছিল। মির্জা না
৪ হাজার টাকায় খরিদ করেন। বাংলার গ্রামগুলোতে প্রচুর পত্ন তৈরি হতো। ইংরেজ বণিক রবার্ট জাতীয় শিল্প বলেছেন। বড় বড় শহর ও রাস্তার ধারে এমন একটিও গ্রাম ছিল না যেখানে সকল লোক তাঁতে কাপড় বুনত না। সরবর্তী, মকমল, নয়নসুখ, তত্ত্বীব প্রভৃতি শ্রেণির সৌখিন কাপড় এবং সাধারণ লোকের ব্যবহারের জন্যে মাঝারি ও মোটা কাপড় তৈরি হতো। তাণ্ডা, মালদহ, সাতগী ও সোনারগায় মসলিন উৎপাদন হতো। বাংলার এ কাপড় শুধু ভারতের বিভিন্ন অ বিক্রি হতো না, বাংলা থেকে খোরাসান, পারস্য, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশে এ কাপড় রপ্তানি হতো বলে ইউরোপীয় পর্যটক মানবিধ বলেছেন। বাংলার এ বস্ত্রের রপ্তানি ইউরোপীয় বণিকরা বিশেষভাবে করত। মানুচ্চি বলেছেন যে, ডাচ, ইংরেজ বণিকরা ঢাকাই মকমল, লং রুথ ও খাকি কাপড় এড রুথ বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করত। গবেষক Moreland বলেছেন, যে, "Cotton weaving was by far the most extensive industry of India."
৩. চিনি শিল্প : বঙ্গদেশে প্রচুর ইক্ষু উৎপন্ন হতো। ফলে এখানে চিনি শিল্প একটি লাভজনক ব্যবসায়ে উন্নতি হয়েছিল। বার্নিয়ারের বর্ণনানুযায়ী, এখান হতে অসংখ্য জাহাজে চিনি বোঝাই করে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। বার্ণিয়া বলেছেন, গোলকুণ্ডা, কর্ণাট, আরব, মেসোপটেমিয়া এমনকি বঙ্গদেশ হতে চিনি রপ্তানি করা হতো। ওলন্দাজদের বর্ণনানুযায়ী, বাৎসরিক প্রায় ৮০,০০০ মণ চিনি রপ্তানি করা হতো। জাভার চিনি বাজারে চালু হওয়ার পর বঙ্গদেশের চিনি রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল।
৪. অন্যান্য শিল্প : বাংলার অন্যান্য শিল্পের মধ্যে পাটের তৈরি চট, সোনা ও রুপার তৈরি অলংকার শিল্প, কাঁসার বাসন ও লবণ শিল্পের নাম উল্লেখ করা যায়। দক্ষিণ বাংলায় ও পূর্ব বাংলার সমুদ্র উপকূপে সমুদ্রের লোনা জল মাঠে ধরে রোদে শুকিয়ে করকচ লবণ ও এ জল আগুনে ফুটিয়ে সাধারণ লবণ তৈরি করা হতো। যেসব দক্ষ শ্রমিক লবণ তৈরির কাজ করত তাদের নাম ছিল মলঙ্গী ।
এছাড়া শাঁখা শিল্পেরও বেশ চাহিদা ছিল। বাংলার প্রতি সধবা হিন্দু রমণী শাঁখা পরতেন। ঢাকাই শাঁখার বেশ নাম ডাক ছিল। মল্লারপুর, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের সিউড়ির লোহার খনি থেকে লোহা তুলে লোহার জিনিস তৈরি হতো।
এছাড়া বাংলায় নৌ নির্মাণ শিল্প বিখ্যাত ছিল। বাংলায় প্রচুর অরণ্য সম্পদ থাকায় নৌকা ও জাহাজ তৈরির কাঠের অভাব ছিল না। এখানে বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য জাহাজে বোঝাই করে নিজ নিজ দেশে রপ্তানি করত। বাংলার বাণিজ্যের সিংহভাগ সমুদ্রপথে পরিচালিত হলেও স্থলপথের ভূমিকাও কম ছিল না। জল ও স্থলপথে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বণিকগণ প্রবেশ করত। সমসাময়িক বৈদেশিক বিবরণ হতে জানা যায় যে, কাশ্মীরি, মুলতানি, পাঠান, শেখ, ভুটিয়া ও সন্ন্যাসীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ হতে ব্যবসায় বাণিজ্যের উপলক্ষে বঙ্গে আগমন করত। সন্ন্যাসীরা সম্ভবত হিমালয় অঞ্চল হতে চন্দন কাঠ, ভূর্জপত্র, রুদ্রাক্ষ, লতাগুল্ম ইত্যাদি ভেষজ দ্রব্য আনত। কাশ্মীরি বণিকেরা আগাম টাকা দিয়ে সুন্দরবনে লবণ তৈরি করত। কাশ্মীরি ও আর্মেনীয় বণিকেরা বাংলা হতে নেপাল ও তিব্বতে ফর্ম, নীল, মণিমুক্তা, তামাক, চিনি, মালদহের সার্টিনও নানারকমের বস্ত্র বিক্রি করত। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বাঙালি বণিকেরা বাণিজ্য করত। সপ্তদশ শতকে বাংলায় ইউরোপীয় বণিকগণ ব্যবসায় বাণিজ্যে বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছিল না। গান্তারি কাঠের তৈরি জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যেত। তাভারনিয়ারের "Travelsin India' গ্রন্থে ঢাকা নগরীর এক বিস্তৃত অংশে নৌবহর নির্মাণকারী সূত্রধরদের বসবাসের কথা উল্লেখ আছে। বর্তমান সূত্রাপুর এলাকা মনে হয় সে স্মৃতি রক্ষা করছে। অষ্টাদশ শতকের শেষাংশেও চট্টগ্রামে সমুদ্রগামী নৌবহর নির্মাণের কথা জানা যায় ।
গ. ব্যবসায় বাণিজ্য : মুঘল শাসনামলে বঙ্গদেশ ব্যবসায় বাণিজ্যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এর প্রধান কারণ ছিল কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের প্রাচুর্য এবং সমুদ্র ও নদীপথে পণ্য পরিবহণের সুবিধা। অসংখ্য নদীনালা ও খালবিল পরিবেষ্টিত হওয়ায় এখানে সহজে ও স্বল্পমূল্যে পণ্য পরিবহণের এবং বিদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের বিশেষ সুবিধা ছিল। পারসিক, আবিসিনীয়, চীনা, তুর্কি, মুর, ইহুদি, আর্মেনীয় প্রভৃতি ব্যবসায়ীরা বঙ্গে আসত। বাংলার সুবাদার এবং নবাবগণ ইউরোপীয় বিশেষত ইংরেজ বণিকদেরকে বাণিজ্যের জন্য নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলে বাংলার অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভূত হতে থাকে। এক সময় বাংলার ব্যবসায়ে মুসলিম বণিকদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় বণিকদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ধনীদের ঐশ্বর্য ও খাদ্যের সস্তা দাম : বাংলা শস্যের প্রাচুর্য এবং বাণিজ্যের প্রসার এদেশবানীর অর্থনৈতিক জীবনকে সমৃদ্ধশালী করেছিল। এদেশের খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য এত কম ছিল যে তা বিদেশীদেরকে বিস্মিত করেছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনানুযায়ী এ দেশের মত জিনিসপত্রের এত সস্তা দাম বিশ্বের কোথাও ছিল না। সপ্তদশ শতকের পর্যটক বার্নিয়ারও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। বার্নিয়ারের মতে, “নামমাত্র মূল্যে এখানে চাল, ঘি ও কয়েক প্রকার শাকশবজি পাওয়া যায়।” হাঁস মুরগিও সস্তা ছিল এবং নানা রকম মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী মুর্শিদাবাদে এক টাকায় উন্নতমানের চাল (বাঁশফুল) ১ মণ ১০ সের, এক টাকায় প্রথম শ্রেণির গম ৩ মণ ও প্রথম শ্রেণির ঘি টাকায় সাড়ে দশ সের পাওয়া যেত। মুঘল যুগে বাংলাদেশকে বলা হতো 'ভারতের স্বর্গ"।
২. সাধারণ মানুষের দুঃখদুর্দশা : মুঘল যুগে বাংলাদেশকে ভারতের স্বর্গ বলা হলেও এ 'স্বর্গ' ছিল ধনবানদের জন্য। সাধারণ লোকে দারিদ্র্যে দিন কাটাত। কৃষকদের উপর সরকারি কর্মচারীরা শোষণ ও অত্যাচার করত। কবি কখন মুকুন্দরাম বর্ধমানের দামুন্যা গ্রামের ডিহিদার মামুদের অত্যাচারে ভিটা ছাড়েন। দেবী চণ্ডীর কাছে ফুরলার নিবেদন ও
“হের দুঃখ
কর অবধান আমানি খাওয়ার
গর্ত দেখ বিদ্যমান।"
দ্বিজ হরিরাম চণ্ডীকাব্যে শাসনকর্তার অত্যাচারের কথা বলেছেন : '
“লাঙ্গল বেচায় জোয়াল বেচায়
আরো বেচায় ফাল । খাজনার তাপেতে বেচায়
দুধের ছাওয়াল।"
মানরিখ বলেছেন যে, খাজনা দিতে না পারলে প্রজাদের স্ত্রী, কন্যা নিলাম করা হতো। মানরিখ আরও বলেছেন, কৃষক কর দিতে না পারায় তাকে বেঁধে বাজারে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং পিছনে চলছে সেই কৃষকের ক্রন্দনরত স্ত্রী ও শিশুরা। এরকম দৃশ্য গ্রামে প্রায়শই দেখা যেত। মুঘল সেনারা যুদ্ধের সময় চলাফেরা করলে সে অঞ্চলে খাদ্যশস্য সব শেষ হতো, লুটপাটও হতো ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা দুঃখদুর্দশা বহাল থাকলেও সার্বিকভাবে মুঘল যুগে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। মুঘল শাসন সাধারণভাবে বাংলার উন্নতির কারণ ছিল । মুঘল সম্রাটরা সর্বদাই প্রজাদের মঙ্গল চাইতেন এবং প্রজাদের উপর অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরোধী ছিলেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]