মুঘল যুগে বাংলার প্রধান প্রধান শিল্পের বিবরণ দাও ।

ভূমিকা : মুঘল শাসনামলে ছিল শান্তি স্থাপনের এবং উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের এক গৌরবময় যুগ। স্যার জে. এন. সরকার 'History of Bengal' গ্রন্থে বলেছেন, "During the first century of mughal rule, the outer world came to bengal and bengal went herself to outer world and the economic, social and cultural changes that grew out of the mengling of peoples mark a mast important and distinct stage in the evolution of modern Bengal." এ যুগে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। মুঘল আমলে বাংলার অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য এ তিনটি থামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যার মধ্যে শিল্প ছিল অন্যতম ।
মুঘল যুগে বাংলার প্রধান শিল্প : মুঘল যুগে বাংলার অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শিল্পোৎপন্ন দ্রব্যাদির প্রাচুর্য। এ যুগে বাংলায় বিভিন্ন প্রকার শিল্পদ্রব্য উৎপাদিত হতো। নিম্নে মুঘল আমলে বাংলায় উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হল : ১. রেশম শিল্প : মুঘল যুগে বাংলার রেশম শিল্প ছিল বিখ্যাত। বাংলায় এত প্রচুর পরিমাণে রেশম উৎপাদিত হতো যে, তা চীনের রেশম অপেক্ষা পরিমাণে অনেক বেশি ছিল। বাংলায় রেশমের গুটি পোকার জন্যে তুঁত গাছের ব্যাপক আবাদ হতো। মোটা রেশম থেকে মটকা এবং মিহি রেশম থেকে কাপড় তৈরি হতো। বাংলার রেশম ছিল পারসিক ও সিসিলির রেশমের মত সোনালি। ১৬ শতকে বাংলা থেকে ২২ হাজার গাঁইট অর্থাৎ, ২২ লক্ষ পাউন্ড ওজনের রেশম বিদেশে রপ্তানি হতো। ভার্নিয়ার বলেছেন, বছরে কাশিমবাজার থেকে কয়েক গাঁইট রেশম রপ্তানি হতো। এছাড়া তসর ও বনজ রেশমও বাংলায় উৎপাদিত হতো।
২. নম্র শিল্প। বাংলার অপর প্রধান শিল্প ছিল বস্ত্র উৎপাদন। ময়মনসিংহ জেলার কালেক্টর রাওটন সাহেব বলেছেন যে, বঙ্গদেশে সূক্ষ্ম সূতা প্রস্তুত হতো। এখানকার কারিগরেরা 'মসলিন' নামক এক প্রকার নয়নাভিরাম সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করত। বিশ্বের সর্বত্র কারিগরি নৈপুণ্যের জন্যে তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। ১৮-৩০ বছর বয়স্ক রমণী যার চোখের জ্যোতি ছিল তীক্ষ্ণ এবং হাতের আঙ্গুল ছিল নরম, গৃহকাজে যার আঙ্গুল শক্ত হয় নি তারাই তকলি দ্বারা মসলিন কাপড়ের জন্য প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম সুতা তৈরি করতেন। মসলিন বস্ত্রের দামও ছিল চড়া। মীর্জা মাথান একটি মসলিন ৪ হাজার টাকায় খরিদ করেন। মসলিন বস্ত্রের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা। এ বস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে বঙ্গদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। ঢাকা ছাড়াও তাণ্ডা, মালদহ, সাতগা, সোনারগাঁয় মসলিন উৎপাদিত হতো। বাংলার এ কাপড় শুধু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হতো না। বাংলা থেকে খোরাসান, পারস্য, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশে এ কাপড় রপ্তানি হতো বলে ইউরোপীয় পর্যটক মানরিখ বলেছেন। বাংলার এ বস্ত্রের রপ্তানি ইউরোপীয় বণিকরা বিশেষভাবে করত।
মসলিন ছাড়া অন্যবিধ বস্ত্রও এখানে তৈরি হতো যেমন : মকমল, সরবর্তী, নয়নসুখ, তঞ্জীব, জামদানি প্রভৃতি শ্রেণির সৌখিন কাপড় এবং সাধারণ লোকের ব্যবহারের জন্যে মাঝারি ও মোটা কাপড় তৈরি হতো। সাধারণ কাপড়ের সুতা কৃষক রমণীরা, অসহায় ব্রাহ্মণীরা তৈরি করতেন। বাংলার গ্রামগুলোতে প্রচুর বস্ত্র তৈরি হতো। ইংরেজ বণিক রবার্ট অর্থ বস্তু শিল্পকে বাংলার জাতীয় শিল্প বলেছেন। মানুচ্চি বলেছেন যে, ডাচ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা ঢাকাই মকমল, লংক্লথ ও থাকি কাপড় বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করত। গবেষক Moneland বলেছেন যে, "Cotton weaving was by far the most extensive industry of India."
৩. চিনি শিল্প : বঙ্গদেশে প্রচুর ইক্ষু উৎপন্ন হতো বলে এখানে চিনিশিল্প একটি লাভজনক ব্যবসায়ে উন্নীত হয়েছিল। বার্নিয়ারের বর্ণনানুযায়ী এখান হতে অসংখ্য জাহাজ চিনি বোঝাই করে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। বার্নিয়ার বলেন, গোলকুন্ডা, কর্ণাট, আরব, মেসোপটেমিয়া এমনকি বঙ্গদেশ হতে চিনি রপ্তানি করা হতো। ওলন্দাজদের বর্ণনানুযায়ী, বাৎসরিক প্রায় ৮০,০০০ মণ চিনি রপ্তানি করা হতো। জাভার চিনি বাজারে চালু হওয়ার পর বঙ্গদেশের চিনি রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। ৪. কুটিরশিল্প : কুটিরশিল্প হিসেবে তাঁতের খুব খ্যাতি ছিল। তাঁত বোনা তখন একটি সম্মানজনক পেশা ছিল। মহিলারাও বাড়িতে বসে এ কাজ করত। তাঁতিরা কাপড় উৎপাদন ও বিক্রয়ের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করত।
৫. লবণ শিল্প : মুঘল আমলে দক্ষিণ বাংলায় ও পূর্ব বাংলার সমুদ্র উপকূলে সমুদ্রের লোনা জল মাঠে ধরে রোদে শুকিয়ে করকচ লবণ ও এ জল আগুনে ফুটিয়ে সাধারণ লবণ তৈরি করা হতো। যেসব দক্ষ শ্রমিক লবণ তৈরির কাজ করত তাদের নাম ছিল মলঙ্গী ।
৬. লৌহ শিল্প ! বিদেশী লেখকদের বর্ণনায় লৌহ শিল্পের কথা জানা যায়। মল্লারপুর, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের সিউড়ির লোহার খনি থেকে লোহা তুলে লোহার জিনিস তৈরি করা হতো। মুঘল আমলে বাংলায় নির্মিত বন্দুক ইউরোপীয়দের প্রশংসা অর্জন করেছিল। কলিকাতা ও কাসিমবাজারে বাঙালিরা কামান তৈরি করত। কামানের বারুদও এখানে তৈরি হতো। লোহার কারখানাগুলোতে কৃষি উপকরণ ও নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র নির্মিত হতো।
৭. নৌ নির্মাণ শিল্প : বাংলায় নৌ নির্মাণ শিল্প বিখ্যাত ছিল। বাংলায় প্রচুর অরণ্য সম্পদ থাকায় নৌকা ও জাহাজ তৈরির কার্যের অভাব ছিল না। গাম্ভারি কাযের তৈরি জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যেত। ভানিয়ারের 'Travels in India' গ্রন্থে ঢাকা নগরীর এক বিস্তৃত অংশে নৌবহর নির্মাণকারী সূত্রধরদের বসবাসের কথা উল্লেখ আছে। বর্তমান সূত্রাপুর এলাকা মনে হয় সে স্মৃতি রক্ষা করছে।
৮. শাখা শিল্প : ঢাকার একটি বিখ্যাত শিল্প ছিল শঙ্খ। তখন শাঁখা শিল্পের খুব চাহিদা ছিল। বাংলার প্রতি সধবা হিন্দু রমণী শাঁখা পরতেন। ঢাকাই শাঁখার বেশ নাম ডাক ছিল। ঢাকার শাঁখারিপট্টি এলাকা এর প্রমাণ বহন করছে।
৯. অন্যান্য শিল্প : বাংলার অন্যান্য শিল্পের মধ্যে পাটের তৈরি চট, সোনা ও রূপার তৈরি অলঙ্কার শিল্প, কাঁসার বাসন ছিল উল্লেখযোগ্য। বাঙালি স্বর্ণকারেরা ব্রোঞ্জ, কার্যেও পাথরের উপর সূক্ষ্ম কারুকাজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সোনা রূপার অলংকার নির্মাণে তাদের পারদর্শিতা ছিল বিস্ময়কর।
উপসংহার : মুঘল আমলে বাংলার উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্যাদির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। কাঁচামালের অপ্রতুলতা এ উৎকর্যের অন্যতম কারণ ছিল। শিল্পজাত পণ্যের প্রাচুর্যের ফলে মুঘল শাসনামলে বঙ্গদেশ ব্যবসায় বাণিজ্যে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল এবং অর্থনীতি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]