মুঘল আমলে ভারতে ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের উপর একটি প্ৰেবন্ধ লিখ।

ভূমিকা : বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি এ ভারতবর্গ। ভারতের অফুরন্ত ধন সম্পদ এবং ঐশ্বর্য যুগে যুগে বিদেশীদের আকর্ষণ করেছে। তাই বान উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতির আগমন হাটছে সম্পদ আহরণের নেশায়। ভারতের অতুল ঐশ্বর্য এবং ধনসম্পদের খবর পেয়ে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে অন্যান্য জাতীয় মায়ে ইউরোপীয়গণও এদেশে আগমন করেন।
ইউরোপীয়দের ভারত আগমনের কারণ : নিম্নে ইউরোপীয়দের ভারত আগমনের কারণসমূহ ধরা হল ১. ক. অজানাকে জানার ইচ্ছা ১৪৫৩ খ্রিঃ তরঙ্গ কনস্টান্টিনোপল অধিকার করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করলে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা ইউরোপীয়গণ নতুন পথ আবিষ্কার করার জন্য উদগ্রীব হরেনেসার ফলে অজানাকে জানবার ইচ্ছা নতুন পথ আবিষ্কার করতে ইউরোপীয়দেরকে উদ্বুদ্ধ করে। স্পেনের রাণী ইসাবেলার নির্দেশে ভারতের সাথে ব্যবসায়ের জন্য বাণিজ্যিক পথ আবিষ্কার করতে গিয়ে কলম্বাস ১৪৯২ গিঃ আমেরিকা আবিষ্কার করেন।
২. নতুন জলপথ আবিষ্কার : অতি প্রাচীন কাল হতেই ভারতের সাথে পাশ্চাত্য দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সপ্তম শতাব্দী হতে ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরের উপর আরবগণ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে এবং ভারতীয় বাণিজ্য তাদের একচেটিয়া হয়ে পড়ে। তাদের নিকট থেকে জেনোয়া, ভেনিস এবং ইতালির ব্যবসারীগণ পণ্যদ্রব্য জয় করে ইউরোপের সর্বত্র রপ্তানি করত। ভারতীয় পণ্যের উপর আরব বণিকদের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকায় ইউরোপের অন্যান্য বণিকগণ চর্যান্বিত হয়ে ওঠেন এবং নতুন সমুদ্র পথ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হন।
৩. ভাস্কো-দা-গামা কর্তৃক নতুন পথের সন্ধান ১৪৮৭ খ্রিঃ প্রখ্যাত পর্তুগীজ নাবিক বার্থালোমিও দিয়াজ দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করেন। তারই প্রদর্শিত পথে আরবীয় নাবিকদের সাহায্যে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কোদা খামা ১৪৯৮ খ্রিঃ উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূল কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। এভাবে নতুন পথ আবিষ্কারের দ্বারা ভারতের সাথে ইউরোপের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সূচিত হয়।
পর্তুগীজদের আগমন : ভাস্কো-দা-গামার পর পদ্রো আলভারেজ কাবরাল আরব বণিকদেরকে পরাজিত করে এ দেশের সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর ১৫০২ সালে ভাস্কো-দা-গামা দ্বিতীয়বারের মত ভারতে আগমন করে কোচিল ও কানালের বাণিজ্য কুঠির স্থাপন করেন।
১. ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : ফ্রান্সিসকো ডি আলমিডা ছিলেন ভারতে নিযুক্ত প্রথম পর্তুগীজ প্রতিনিধি। অতঃপর আলফানসো আল বুকার্ন ১৫০১ সালে ভারতে গভর্নর হয়ে আসেন। তিনিই ছিলেন ভারতে পর্তুগীজ শক্তির প্রতিষ্ঠাতা কোচিন কানানোর ছাড়াও তিনি বিজাপুর সুলতানের নিকট হতে গোয়া দমন করে বাঁচো সেটাকে পর্তুগীজদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি ১৫০৯ সালে পুনরার গভর্ণর নিযুক্ত হয়ে ভারতে আসেন।
২. অত্যাচারমূলক আচরণ : আল বুকার্ক ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি ভারতবর্ষে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অনুচরদেরকে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে ভুল করেন।
৩. পরবর্তী অবস্থা। ১৫১৫ সালে তার মৃত্যুর পর পর্তুগীজরা দিউ, দমন, সলসেট, বেসিন, চৌল, বোম্বাই, সিংহল ও বাংলার হুগলী প্রভৃতি স্থানে তাদের কুঠি স্থাপন করেন। এভাবে পর্তুগীজগণ এক শতাব্দীকাল ধরে এখানে বাণিজ্য করে। ৪. পর্তুগীজদের পতনের কারণ ঘোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজগণ প্রাচ্যের সমুদ্রের সর্বময় কর্তা ছিল। কিন্তু ভারতবাসীদের প্রতি দুর্ব্যবহার সত্ত্বর পর্তুগীজ শক্তির পতন ডেকে আনল।
অত্যাচার ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা : অসহিঞ্চুতা ও নিপীড়ন নীতি পর্তুগীজ শক্তির পতনের জন্য দায়ী ছিলো। পর্তুগীজরা ভারতের ব্যবসায়ীদের উপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে হয়রানি করত। তারা হিন্দু ও মুসলমান বালক-বালিকাদেরকে ধরে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত। তাদের এ নীতির ফলে দেশে বিরাট অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। সম্রাট শাহজাহান তাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে হুগলি হতে বিতাড়িত করেন।
১. কর্মচারীদের দুর্নীতি : পর্তুগীজ কর্মচারীরা উদ্ধত ও দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন। বিজিত অঞ্চলের লোকদের সাথে বিশেষ করে মুসলমানদের সাথে তাদের নিষ্ঠুর ব্যবহার এ দেশে পর্তুগীজ স্বার্থের পরিপন্থি ছিলো।
২. পর্তুগীজ ও স্পেন রাজ্যের মিলনের কুফল দ্বিতীয় ফিলিপের অধীনে পর্তুগালের সাথে স্পেন রাজ্য এক হওয়ায় এ উপমহাদেশে পর্তুগীজ শক্তির পতনের পথ প্রশস্ত হয়।
৩. লন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজদের উত্থান : পর্তুগীজদের অনুকরণে ওলন্দাজ ফরাসি ইংরেজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকরা দলে দলে প্রাচ্যে ব্যবসা করার জন্য আসতে থাকে এবং তাদের সাথে পর্তুগীজদের প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির সাথে প্রতিযোগিতার আটি উঠতে না পারায় কালক্রমে গোয়া দমন ও দিউ ব্যতীত সমস্ত বন্দরই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তারা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
৪. ওলন্দাজদের ভারত আগমন : ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগীজদের পরেই হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজগ ভারতে আসেন। ১৬০২ সালে "United East India company" গঠন করে ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য উপলক্ষে আগমন করেন। ১৬০৫ সালে তারা পর্তুগীজ অধিকৃত এঘোয়ালা দখল করেন। তারা নাগাপট্রাম, বাংলার চূড়ায় বাণিত কুঠি স্থাপন করেন। করমণ্ডল, গুজরাট, বিহার, উড়িষ্যা, কাশিমবাজার। সুরাট পুলিকট, প্রভৃতি স্থানে ওলন্দাজগণ বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন।
স্পেনীয়দের সাথে তাদের বাণিজ্য দ্বন্দ্ব শুরু হলে তাদের পতন ঘটে। ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে ভারতে আগমন করে। ১৬২০ খ্রিঃ তারা দক্ষিণ ভারতের তাওর জেলার ট্রাঙ্কভার এবং ১৬৭০ ৫. দিলেমারগণের আগমন : ওলন্দাজদের পরে দিলেমারগণ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ১৬১৬ খ্রিঃ ইস খ্রিঃ শ্রীরামপুরে তাদের কুঠি স্থাপিত হয়। কিন্তু ব্যবসায়ে সুবিধা করতে না পারায় ইংরেজদের নিকট বাণিজ্য কুঠি করে তারা এ দেশ হতে চলে যায় ।
৬. ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্তিমিত প্রায় মুঘল সাম্রাজ্য যেদিন শ্মশান শয্যা রচনা করে যবনিকার অন্তরালে আত্ম-অপসারণে উদ্যত, স্পর্ধিত মুঘল সাম্রাজ্যের রাজদও যেদিন ধূলায় লুণ্ঠিত সেদিন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনাচে ইংরেজ বণিক সম্প্রদায় এ রাজদণ্ড শিথিল মুঘল মুষ্টি হতে হস্তগত করে বিশাল ভারতের কোটি কোটি নরনারীকে এর 'নতুন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার সুযোগ লাভ করেছিল।
ক. আগমনের কারণ : ইংরেজরা জানতে পারে যে, পর্তুগীজ এবং ওলন্দাজরা এদেশীয় ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হয়। ১৫৯১ সালে ও ১৫৯৯ ভারতে ভ্রমণকারী পর্যটকদের বর্ণনা হতে ইংরেজ ভারতের বিপুল ঐশ্বর্য সম্পর্কে অবগত হয়। খ. এলিজাবেথের অনুমতি নিয়ে ভারতে আগমন : উক্ত কারণে তারা রাণী এলিজাবেথের নিকট হতে বাণিজ্য সুবিধা লাভের অনুমতি পত্র নিয়ে সম্রাট আকবরের দরবারে এসে হাজির হয়। ১৬০০ সালে রাণী The Governor and company of merch ants of London Trading in to the cast Indies নামক কোম্পানিকে প্রাচ্যের সকল দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি ও অধিকার প্রদান করেন। এ কোম্পানি East India company নামে পরিচিত। ১২৫ জন শেয়ার হোল্ডার এবং ৭০,০০০ পাউন্ড মূলধন নিয়ে ১৫ বছরের জন্য এ কোম্পানি এখানে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়।
গ. কলকাতা প্রতিষ্ঠা : ১৬৯০ সালে বোম্বাই এর ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সাথে সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ইংরেজরা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্রাপ্ত হন। ঐ বছরেই হকিন্স ভাগিরথী নদীর তীরে সুতানটি, কালিকট এবং গোবিন্দপুর এ তিনটি গ্রাম খরিদ করে কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তন করেন। এখানে প্রতিষ্ঠিত দুর্গ ইংল্যান্ড রাজ তৃতীয় উইলিয়ামের নামানুসারে ফোর্ট উইলিয়াম রাখা হয় ।
ঘ. কয়েকটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন : ১৬০৮ সালে তারা সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পেলেও পর্তুগীজদের বিরোধিতায় তা ব্যর্থ হয় । ১৬১২ সালে অবশ্য সফল হয়। ১৬৩৯ সালে করমণ্ডলে, অতঃপর মাদ্রাজ, বোম্বাই প্রভৃতি স্থানে কুঠি স্থাপন করে ।
ঙ. নতুন কোম্পানি : ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ প্রতিষ্ঠার পর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের মন্ত্রীসভার প্রভাব ও পরামর্শে নতুন ও পুরাতন কোম্পানি দুটিকে সংযুক্ত করে The united company of merchants of England trading to the East Indias নামে আখ্যায়িত করে।
৭. ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি : ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে ভারতবর্ষে সর্বশেষে আগমন করে ফরাসিগণ। ১৬৬৪ সালে সম্রাট চতুর্দশ লুই French East India company গঠন করে ভারতে পাঠান। তারা ১৬৬৮ সালে প্রথমে সুরাট বন্দরে, পরের বছর মুসলিম পটমে বাণিজ্য কুঠি প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে তারা পণ্ডিচেরী, চন্দননগর প্রভৃতি স্থানে কুঠি স্থাপন করে। তবে ইংরেজদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে না পেরে ভারত ছেড়ে চলে যায়। ইতঃপূর্বে তারা এখানে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন,
After 1742 political motives began to overshadow the desire for commercial gain and daipbeix began to charish the ambition of a French empire in Indo pak. ৮. অন্যান্য বণিক সম্প্রদায় : পর্তুগীজ বণিকদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ১৭২২ খ্রিঃ ফরাসি বণিকগণ ওস্টেড কোম্পানি, সুইডেনের বণিকগণ সুইডিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, অস্ট্রিয়ার বণিক অস্ট্রিয়ান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রভৃতি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে আসে। কিন্তু বাণিজ্য ক্ষেত্রে তারা কেউ আধিপত্য বিস্তার করতে পারে নি ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতের অতুল ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে এবং এদেশে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় জাতিগুলো পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, দিনেমার ইংরেজ, ফরাসি ও অপরাপর বণিক সম্প্রদায় ভারতবর্ষে আগমন করে। আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রামে ইংরেজ বণিকদের নিকট অপরাপর সম্প্রদায়গুলো পরাজিত হয়ে এদেশ হতে বিতাড়িত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজ বণিকদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ভারতের কাল হয় এবং মুসলিম স্বাধীন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]