১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার কোন উদ্দেশ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিল? এর ফলাফল কি হয়েছিল?

ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতে কোম্পানির শাসনের ইতিহাসে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে ব্যস্তবায়িত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে এ ব্যবস্থা ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত হলেও অনেক আগ থেকে তা গবেষণার ফসল ছিল। দীর্ঘ দুই যুগের বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা, আলোচনা, তর্কবিতর্কের শেষ ফল ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এছাড়া উপনিবেশিক সরকারের উদ্দেশ্য বিবেচনা করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সব ঔপনিবেশিক সরকারেরই উদ্দেশ্য থাকে প্রশাসনকে যথাসম্ভব সরল ও নির্ঝঞ্চাট রাখা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার রাজস্ব সমস্যার সমাধানের জন্য বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্নওয়ালিসের সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য জমিদারদের সাথে ১. পাদিত একটি চুক্তি সমতুল্য ব্যবস্থা। ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক এটা ঘোষিত হয়। কিন্তু আইডিয়া হিসেবে এ বন্দোবস্ত কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচিত হতে থাকে প্রায় দুদশক আগে থেকেই। বিমূর্তভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া প্রথম দেন সমকালীন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ/অর্থনীতিবিদ আলেকজান্ডার দাও ও হেনরি পেটুপ্পো। দাও-পেটুরো প্রদত্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া থেকে প্রথম বিমূর্ত রূপ দেন
কাউন্সিলর ফিলিপ ফ্রান্সিস। কিন্তু ফিলিপ ফ্রান্সিসের বন্দোবস্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি। তবে অনেকটা ব্রিটিশ সরকারকে ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ফিলিপ ফ্রান্সিসের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে পরে ব্রিটিশ সরকার ১৭৮৪ সালে 'Pitt India Acts' পাস করেন। এ 'Pitt India Acts'-এর ৩৯ নং ধারায় রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পরে বলা হয়েছিল। 'Piu India Acts' পাস হওয়ার পর কাউন্সিলর চার্লস স্টুয়ার্ট প্রথম দিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন এবং 'Pitt India Acts' এর ৩৯নং ধারা মোতাবেক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই দেখা যায়, চার্লস স্টুয়ার্টে পরিকল্পনা প্রশংসিত হলেও তা কার্যকরী করা সম্ভব ছিল না। কারণ, গভর্নর জেনারেলের পরিকল্পনা কার্যকর কাউন্সিলের পরিকল্পনা কার্যকরী করার কোন পরিবেশ ছিল না। তাই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার মধ্যে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের আভাস পান ।
চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার কিছুদিন পরে কোম্পানি দেখলেন যে, ভারতে কোম্পানির রাজস্ব নিয়ে যে সমস্যা তা সমাধান করার একমাত্র উপায় হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে রাজস্ব সমস্যা সমাধান করা। তার ১৭৮৬ সালে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠান। কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসেই রাজস্ব, সমস্যা সমাধানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যক করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর এ কার্যে বাধা হয়ে দাঁড়ান তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা ও বোর্ড অব রেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর। জন শোর মতামত ব্যক্ত করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পূর্বে জানা দরকার :
১. জমিদার, তালুকদার ও রায়তের বর্তমান আর্থিক অবস্থা। মুঘল শক্তির অবক্ষয়ের আগে জমিদার ও রায়তের অধিকার। মুঘল শক্তির পতন পর্বে রায়তের খাজনা সংক্রান্ত আইন। দেওয়ানি লাভের পর জমিদার কর্তৃক আরোপিত নতুন আবওয়াব, মামথ ইত্যাদি । সাধারণ রায়তের স্বার্থরক্ষার উপায়।
৬. বর্তমান রাজস্ব ধার্য ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ দূর করার উপায়।
9. ১৭৭২ সাল থেকে প্রত্যেক জমিদারির বিস্তারিত জমা, উত্তল ও বাকি হিসাব সংগ্রহ। জন শোরের মতানৈক্যের জন্য কর্নওয়ালিসের পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভব হল না। এছাড়া ঐ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে দুটো সমস্যাও ছিল। যথা : (১) নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব,
(২) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সরকারি বিশেষজ্ঞ মহলে ঘোরতর মতানৈক্য। এ ধরনের পারিপার্শিক অবস্থায় বোর্ড অব রেভিনিউ এর প্রেসিডেন্ট জন শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে আপাতত এক বা দুদশকের জন্য একটি পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত করার পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাই ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত করা হয়। এ শর্তে বলা হয় যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তৎক্ষণাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করলে দশসালা বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করা হবে। তাই ১৯৯২ সালের শেষের দিকে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত দিলে কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করেন। ফলে রাজস্ব সমস্যা নিয়ে যে দুদশকের আলোচনা পর্যালোচনা তার অবসান হয়। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কর্নওয়ালিসের শাসনামলে প্রবর্তিত হলেও এককভাবে তাঁর কৃতিত্ব ছিল বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে দুদশক ধরে সাধারণ জেলা প্রশাসক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক, পার্লামেন্ট ও কোর্ট অব ডাইরেক্টরস সভার অবদান ছিল। কর্নওয়ালিস এসবের মধ্যে সমন্বয় করেন মাত্র।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য : ১৭৭২ সাল থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত প্রস্তাবিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে যে তর্ক-বিতর্ক চলে এবং যে যুক্তির উপর অবশেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হয় তা বিশ্লেষণ করলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্যসমূহ পাওয়া যায় :
১, বৃহৎ জমিদারিগুলো খণ্ডিতকরণ, সরকারি রাজস্ব নিশ্চিতকরণ, প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জন, কৃষি বিপ্লব, নিম্নে উদ্দেশ্যগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল : ১. বৃহৎ জমিদারিগুলো খণ্ডিতকরণ : ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্তের সময় বাংলায় সরকার রাজ পরিমাণ ছিল, ১,৯০,৪০,০০০ সিক্কা টাকা। বাংলার অনেক জমিদার থাকলেও বড় বড় আটটি জমিদার পরিবার মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক টাকা দিত। নিম্নে বড় আটটি জমিদারের জমার পরিমাণ দেখানো হল ঃ জমিদার রাজস্বের পরিমাণ (১৭৯০) ৩২,৬৬,০০০ (সিকা টাকা) ১. বর্ধমান রাজ শতকরা হার ২. রাজশাহী রাজ " ৩. দিনাজপুর রাজ ১১.৮১ ৪. নদীয়া রাজ ৫. বীরভূম রাজ ১৪,৮৪,০০০ v,28,000 " 99.98 " 08.81 4,00,000 ৬. বিষ্ণুপুর রাজ 99,00 8,00,000 ৭. ইউসুফপুর জমিদারি ०. ৮. রাজনগর জমিদারি ৩,০৩,০০০ " মোট ৮জন জমিদার 85,00 ,00,000 ৯৪,৮৭,০০০ (সিকা টাকা) এতে দেখা যায়, সরকার নির্ভরশীল ছিল রাজস্বের উপর। আর এ রাজস্বের বেশিরভাগ আসে এই আটটি জমিদারদের কাছ থেকে । এ আট জমিদারের আনুগত্য ও যোগ্যতার উপর নির্ভর করত কোম্পানির শাসন এর সফলতা বা ব্যর্থতা। এটা রাজনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এছাড়া ঐসময় অনেক ঐতিহাসিক বড় বড় জমিদারি প্রথম করে ছোট জমিদার সৃষ্টি করার জন্য মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। অনেকে এমন মত পোষণ করেন যে, বড় বড় জমিদারগুলো একজোট বাধলে তারা কোম্পানির শাসনকে উৎখাত করতে পারবে। তাই কোর্ট অব ডাইরেক্টরস বড় জমিদারি গ্রহন করার পক্ষে অবস্থান নেয়। এ ধরনের অবস্থায় কর্নওয়ালিস ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে আসেন। তনি বড় বড় জমিদারগুলোর পতনের পক্ষে রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও অর্থনৈতিক কারণ তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন যে, বাংলায় কৃষি বিপ্লবের জন্য বেশি উপযোগী ছোট জমিদার, বড় জমিদার নয়। তাই কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবরের মাধ্যমে এ জমিদারগুলোর জন্য কঠিন শর্ত বেঁধে দেন। যারা রাজস্ব নিয়মিত শোধ করতে না পারবে তাদের জমিদারি নিলামে দিয়ে অর্থ আদায় করা হবে। ঐ সময় বড় বড় জমিদারগুলোর মধ্যে আবার অসংখ্য তালুকদার ছিল যারা রাজস্ব দিত তাদের উপরস্থ জমিদারদের মাধ্যমে। এছাড়া উত্তরাধিকার আইনও সংশোধন করেন। ফলে বৃহৎ জমিদার পরিবারগুলো আইনের কঠোরতার জন্য জমিদারি হারায়। তাই দেখা যায়, দশ বছরের মধ্যে বর্ধমান ছাড়া প্রায় সব জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে বড় বড় জমিদারদের ধ্বংস স্তূপের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য ছোট ছোট জমিদারের। এ ছোট ছোট জমিদাররাই ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল।
২. সরকারি রাজস্ব নিশ্চিতকরণ : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। তাই কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যায়। পূর্বে বিভিন্ন সময় অনেক জমিদার বিভিন্ন অজুহাতে রাজস্ব নির্দিষ্ট সময়ে দিতে ব্যর্থ হন। ফলে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি হয়। তাই ১৭৯৩ সালে দশসালা বন্দোবস্তের আলোকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয়। এতে বলা হয় যে, ভবিষ্যতে কখনও রাজস্ব বৃদ্ধি করা হবে না। কিন্তু চিরস্থায়ীকৃত রাজস্ব সংগ্রহ যেন পূর্বের মত অনিশ্চিত হয়ে না পরে সেজন্য আইন করা হয়। আইনে বলা হয় যে, ভবিষ্যতে খরা, বৃষ্টি, মহামারী বা অন্যকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ফসলহানির নামে জমিদার তালুকদারগণ রাজস্ব বাকি রাখতে পারবে না। এখন থেকে রাজস্ব বাকি পড়ার সাথে সাথে জমিদারি নিলামে বিক্রি করে বকেয়া রাজস্ব আদায় করা হবে। কোম্পানির সরকার অবগত ছিল যে, ভবিষ্যতে জনসংখ্যা ও মূল্য বৃদ্ধির ফলে জমিদারদের আয় বাড়বে এবং এর সাথে বাড়বে সরকারি খরচ। কিন্তু ভূমি রাজস্ব খাত থাকবে অপরিবর্তনীয়। কিন্তু সরকার যে চিন্তাভাবনা করেন ফলাফল দেখা দেয় তার উল্টো। তাই দেখা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম আট বছরে অনেক জমিদার রাজস্ব বাঁচানোর অজুহাতে খাজনা বাকি রাখেন, ফলে জমি নিলামে দেন সরকার । এভাবে এক পর্যায়ে জমি নিলামে দেওয়ার ফলে সরকারের ভূমির পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে র প্রবক্তাগণ ভেবেছিলেন যে, জমিদারগণের জমিদারি নির্দিষ্ট হলে তারা ভূমির উন্নয়নে মনোযোগী হবেন। কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়। শেষে দেখা যায়, কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের কৌশল ব্যর্থ হয়। তাদের রাজস্বের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই তারা পরে, ঘাটতি বাজেট পূরণ করার জন্য বাড়তি কর আরোপ করেন।
৩. প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জন : প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য দূর করে ব্রিটিশ সভ্যতা সুলভ একটি শান্তি ও সুশৃঙ্খল শাসন প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ ছিল কর্নওয়ালিসের উপর। অল্পসংখ্যক ইউরোপীয় অফিসার নিয়ে অল্প খরচে একটি দক্ষ প্রশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এক বিশেষ উদ্দেশ্য। কর্নওয়ালিস ও তাঁর তাত্ত্বিকগণ ভেবেছিলেন যে, সমাজের প্রাকৃতিক শাসক হিসেবে জমিদারগণ সহজেই রায়তের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে এবং আরও আনায়াসে জেলা কালেক্টর সক্ষম হবে জমিদার থেকে সরকারি রাজস্ব সংগ্রহ করতে। তারা মনে করে যে, কালেক্টর তার |
সঞ্চিত শক্তি ও প্রশাসনিক দক্ষতা বিধান ও জনসাধারণের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত থাকবে। জমিদারদের উপর আইন জাি করা হয় তারা যেন প্রজাদের পাট্টা দান করে এবং পাট্টায় উল্লেখিত খাজনার উর্ধ্বে যেন কোন আবওয়াব অর্থাৎ, নানাবিদ অন্যায়কর ও চাদা দাবি না করে। জমিদাররা যেন প্রজাদের অধিকার, ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত করে আইন প্রণীত হয়। কালেক্টরগণকে ক্ষমতা দেওয়া হয় জমিদার কার্য পর্যবেক্ষণের। কিন্তু দেখা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারদের সম্পর্কে কর্নওয়ালিস যা ভাবেন তার উল্টো ফল দেখা দেয়। তাত্ত্বিকগণ ভেবেছিলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জেলা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত সময় পাবে কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে দেখা যায়, সরকার যা আশা করেন তার বিপরীত ফলাফল দেখা দেয়।
৪. কৃষি বিপ্লব : সমকালীন ব্রিটেনে যেমন ভূস্বামী শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষি বিপ্লব সম্ভব হয়। তেমনি জমিদারদের নেতৃত্বে বাংলাদেশেও অনুরূপ কৃষি বিপ্লব আনয়ন করা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণেতাদের উদ্দেশ্য। তারা তাত্ত্বিক যুক্তি দেন যে, ব্রিটেনে কৃষি বিপ্লব হয়েছে Land lord কর্তৃক ভূমিতে পুঁজি বিনিয়োগের ফলে। Land lord কর্তৃক ভূমিতে পুঁজি বিনিয়োগের কারণ ভূমিতে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবক্তাগণও বাংলাদেশে জমিদারগণকে আনতে চান। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকরী করতে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, লর্ড কর্নওয়ালিসের বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর এ ব্যবস্থা কার্যকরী করার মত আদৌ পরিবেশ ছিল না। তাই কোম্পানির যে উদ্দেশ্য ছিল তা প্রশংসনীয় হলেও বাস্ত বায়িত হয় নি।
. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটি ব্যাপক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শাসনতন্ত্র। কর্নওয়ালিসের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, পুলিশ, আইন-আদালত সর্বত্রই ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব প্রতিষ্ঠানের ফলে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজকাঠামো ও বিন্যাসে যে পরিবর্তন আসে, অর্থনৈতিক জীবনে যে মনোভঙ্গি বিকাশ লাভ করে তা সবই বলা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রত্যক্ষ ফল। শাসনব্যবস্থার দিক থেকে এ ব্যবস্থা ফলদায়ক ছিল। এ ব্যবস্থার ফলে প্রত্যেক জেলায় একজন জজ ও একজন কালেক্টর নিযুক্ত হয়। জজ, কালেক্টর, আমলা, উকিল, মোক্তার, অগণিত বিচার প্রার্থী, দর্শনার্থী প্রভৃতির প্রয়োজন মেটানোর জন্য নির্মিত হয় বাসা-বাড়ি, দোকান-পাট, হোটেল রেস্তোরাঁ, জেলায় কোর্ট কাচারিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে মফস্বল শহর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে শহর গড়ে উঠে সে শহরকে কেন্দ্র করে উদ্ভব হয় একশ্রেণীর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণী ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হল ?
১. প্রশাসনিক ফলাফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে প্রশাসনিক ক্ষেতে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এক শ্রেণীর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশাসনিক যন্ত্র থেকে। উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্য বলতে ছিল মূলত উকিল, মোক্তার, মুনসেফ, কোর্ট কাছারির আমলা, জমিদারি আমলা, মধ্যস্বত্বভোগী, মহাজন ইত্যাদি। এককথায়, এর নাম দেওয়া যায় প্রশাসনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তবে ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য ছিল। ফলে অসুবিধা হয়।
২. সামাজিক ফলাফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ সমাজ বিন্যাসেও পরিবর্তন হয়। এ বন্দোবস্তের ফলে দুধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়- শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সমাজে দেখা যায়, উপরে জমিদার ও নিচে সাধারণ রায়তের মধ্যবর্তী এ শ্রেণীর সদস্য ছিল ধনী কৃষক, জোতদার, ক্ষুদ্র জমিদার-তালুকদার, মধ্যস্বত্ব উপস্বত্ত্বাধিকারী ভূস্বার্থসমূহ, গ্রামীণ মহাজন, শস্য ব্যবসায়ী ইত্যাদি। এরাই একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে গ্রামীণ অর্থনীতি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সামাজিক স্তরবিন্যাসেও বিরাট পরিবর্তন হয়।
৩. অর্থনৈতিক ফলাফল : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। কৃষিতে পুঁজিবাদ সৃষ্টি ছিল এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তাত্ত্বিকদের ধারণা ছিল যে, যে জমিদার শ্রেণী উদ্ভব করা হবে তাঁরা মালিকানার নিশ্চয়তার জন্য ভূমিতে বিনিয়োগ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করবে। ফলে কৃষির উন্নতি হবে। তাতে কোম্পানিও লাভবান হবে। অতি বিলম্বে হলেও এ ব্যবস্থা কার্যকরী হয়। ফলে বাংলার অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি হয়।
৪. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে অনেক পুরাতন জমিদার শ্রেণী ধ্বংস হয়। ফলে পুরাতন জমিদার শ্রেণীর ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এ নতুন জমিদাররা জমিদারি সম্পর্কে ছিলেন একেবারে অজ্ঞ। তারা জমিদারির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব নির্দিষ্ট দিনে পরিশোধ করার জন্য নির্দিষ্ট জমিদারির একাংশ নির্দিষ্ট শর্তে বিক্রি করে দেন এক শ্রেণীর হাতে। এই শ্রেণী হল মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছিল।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পশ্চাতে কোম্পানির স্বার্থ ছিল কিভাবে রাজস্ব বন্দোবস্তের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মজবুত করে ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা। তাই তারা সকল দিক ঠিক রেখে রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। কারণ, অর্থই হল সকল বিষয়ের চাবিকাঠি। তবে উপরিউক্ত আলোচনায়ু দেখা যায়, ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় নি। কারণ, অন্যায়ভাবে আরোপিত ব্যবস্থা দ্বারা বাঙালির উন্নতি হতে পারে না।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]