চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিবরণ দাও। বাংলার রায়ত/প্রজাদের উপর এর প্রভাব আলোচনা কর।

ভূমিকা : ১৭৬৫ সালে বেনিয়া শ্রেণী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেন। কিন্তু কোম্পানির দেওয়ানি লাভ করার পর থেকে বাংলার জনসাধারণের ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়। এক পর্যায়ে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস এটা অবগত হলে ১৭৭৩ সালে কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রেগুলেটিং এ্যাক্ট প্রণয়ন করেন। কিন্তু এতে কিছুটা সমস্যা দূরীভূত হলেও রাজস্ব সমস্যার সমাধান হয় নি। তাই রাজস্ব সমস্যার সমাধানের জন্য ১৭৭৬ সালে কর্নওয়ালিসের আবির্ভাব হয়। কর্নওয়ালিসের শাসনামলে ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষিত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট / পটভূমি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য জমিদারদের সাথে সম্পাদিত একটি চুক্তি সমতুল্য ব্যবস্থা। ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক এটা ঘোষিত হয়। কিন্তু আইডিয়া হিসেবে এ বন্দোবস্ত কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচিত হতে থাকে প্রায় দুদশক আগে থেকেই। বিমূর্তভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া প্রথম দেন সমকালীন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ/অর্থনীতিবিদ আলেকজান্ডার দাও ও হেনরি পেটুপ্পো। দাও-পেটুপ্পো প্রদত্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া থেকে প্রথম বিমূর্ত রূপ দেন কাউন্সিলর ফিলিপ ফ্রান্সিস। কিন্তু ফিলিপ ফ্রান্সিসের বন্দোবস্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি। তবে অনেকটা ব্রিটিশ সরকারকে ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ফিলিপ ফ্রান্সিসের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে পরে ব্রিটিশ সরকার ১৭৮৪ সালে 'Pitt India Acts' পাস করেন। এ 'Pitt India Acts'-এর ৩৯নং ধারায় রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছিল। 'Pitt India Acts' পাস হওয়ার পর কাউন্সিলর চার্লস স্টুয়ার্ট প্রথম দিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন এবং 'Pitt India Acts'-এর ৩৯নং ধারা মোতাবেক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই দেখা যায়, চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনা প্রশংসিত হলেও তা কার্যকরী করা সম্ভব ছিল না। কারণ, গভর্নর জেনারেলের পরিকল্পনা কার্যকরী না করে কাউন্সিলের পরিকল্পনা কার্যকরী করার কোন পরিবেশ ছিল না। তাই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার মধ্যে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের আভাস পান ।
চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার কিছুদিন পরে কোম্পানি দেখলেন যে, ভারতে কোম্পানির রাজস্ব নিয়ে যে সমস্যা তা সমাধান করার একমাত্র উপায় হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে রাজস্ব সমস্যা সমাধান করা । তাই ১৭৮৬ সালে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠান। কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসেই রাজস্ব সমস্যা সমাধানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু এ কার্যে তাঁর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা ও বোর্ড অব রেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর। জন শোর মতামত ব্যক্ত করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পূর্বে জানা দরকার :
১. জমিদার, তালুকদার ও রায়তের বর্তমান আর্থিক অবস্থা।
2. মুঘল শক্তির অবক্ষয়ের আগে জমিদার ও রায়তের অধিকার।
0. মুঘল শক্তির পতন পর্বে রায়তের খাজনা সংক্রান্ত আইন।
न স 8. দেওয়ানি লাভের পর জমিদার কর্তৃক আরোপিত নতুন আবওয়াব, মামথ ইত্যাদি ।
&. সাধারণ রায়তের স্বার্থরক্ষার উপায়।
৬. বর্তমান রাজস্ব ধার্য ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ দূর করার উপায়।
9. ১৭৭২ সাল থেকে প্রত্যেক জমিদারির বিস্তারিত জমা, উত্তল ও বাকি হিসাব সংগ্রহ। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর দেখা গেল লর্ড কর্নওয়ালিসের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল ।
| এ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকরী করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়াল তা হল- ১. নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব ও ২, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সরকারি বিশেষজ্ঞ মহলে ঘোরতর মতানৈক্য।
এ ধরনের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বোর্ড অব রেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে আপাতত এক বা দুদশকের জন্য একটি পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত করার পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাই ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত করা হয়। এতে বলা হয় যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তৎক্ষণাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করলে দশসালা বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করা হবে। তাই ১৭৯২ সালের শেষের নিতে মতামত দিলে কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করেন। ফলে রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে দুদর্শকের যে আলোচনা পর্যালোচনা তার অবসান হয়। বাংলার রায়ত/কৃষকদের উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব ঃ বাংলার রায়ত/কৃষকদের উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. রায়তদের অধিকার অরক্ষিতঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকার জমিদার, জমিদার-সরকার সম্পর্কের কথা বল থাকলেও রায়ত ও জমিদার বা রায়তের সাথে বিরূপ সম্পর্ক হবে তার বিবরণ ছিল না। অর্থাৎ, এ ব্যবস্থায় রায়তের অধিকার সুরক্ষিত হয় নি। জমিদাররা শুধু এ-ব্যবস্থার স্থায়ী মালিকানা লাভ করেছিল। তারা রায়তকে ইচ্ছা করলে জমি থেকে উৎখাত করতে পারেন, যদি রায়ত তার পাওনা জমিদারকে সময়মত না দেয়। অবশ্য এ বন্দোবস্তে দশ বছরের জন্য পাঠায় লিপিবদ্ধ করে রায়তের অধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয় নি।
২. রায়তের উপর অত্যাচার : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বলা হয়েছিল যে, জমিদার খাজনা অনাদায়ের জন্য রায়তকে দৈহিক নির্যাতন করতে পারবে না। অথবা রায়তের সম্পত্তি, লাঙল, গরু প্রভৃতি দখল বা ক্রোক করতে পারবেন না। তবে জমিদার দেওয়ানি মামলায় রায়তকে অভিযুক্ত করতে পারবেন। এভাবে জমিদার ও রায়তের পূর্বের সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাছাড়া খাজনা বকেয়া পড়লে নতুন জমিদার কর্তৃক রায়তের উপর দৈহিক নির্যাতন ও রায়তের সম্পত্তি ক্রোক করা কোন কিছুই তারা বাদ দেন নি।
৩. অতিরিক্ত অর্থের দাবি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারকে জমির মালিকানা দিলেও এতে বলেন যে, জমিদাররা খাজনার অতিরিক্ত কোন অর্থ রায়তের কাজ থেকে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু দেখা যায় কার্যকরী হয় এর উল্টোটা। রায়তকে প্রায়ই নানা কারণে অর্থ দিতে হতো, যে অর্থ রায়তের রাজস্ব হিসাবের বাইরের। তাই একদিকে উচ্চহার, উপরন্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার ফলে রায়তের আর্থিক কষ্টের সীমা ছিল না।
৪. রায়তের হস্তে সম্পদের মাত্র ৪০ ভাগ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে বলা যায় যে, যদিও সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয় যে এটা সুদীর্ঘ দুদশকের পর্যালোচনার ফসল কিন্তু তারা কোন নথিপত্র বা পরিসংখ্যানের ধার ধারেন নি। যে কারণে দেখা যায় রাজস্ব নির্ধারিত হয় অতি উচ্চহারে সরকারের খেয়াল খুশিমত। এ ব্যাপারে জমিদারদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন সরকার মনে করতেন না। বলাবাহুল্য সরকার খুবই উচ্চহারে খাজনা ধার্য করেছিল এবং আদায় করেছিল। এ ধরনের অবস্থায় দেখা যায় বাংলার মোট উৎপাদনের শতকরা মাত্র ৪০ ভাগ ছিল রায়তের এবং বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে সরকারের ৪৫ ভাগ এবং জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর ১৫ ভাগ।
উপসংহার ঃ অতএব বলা যায়, ১৯৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন তা ছিল কোম্পানির একটি রাজস্ব আদায়ের কৌশল মাত্র। এ কৌশল প্রয়োগ করে কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা পান। কিন্তু অন্যদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে এ ব্যবস্থায় আদৌ তেমন সুফল বয়ে আনে নি। এ ব্যবস্থার ফলে সুদীর্ঘকাল থেকে জমিদার ও রায়তের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা বিনষ্ট হয়। জমিদার শুধু খাজনা আদায় করবেন এটাই ছিল তাদের নীতি। তাই বলা যায়, কোম্পানির স্বার্থগত দিক থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভালো হলেও বাংলার মানুষের কাছে এটা ছিল শোষণের হাতিয়ারস্বরূপ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]