ভারতীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বিকাশে লর্ড রিপনের অবদান মূল্যায়ন কর।

ভূমিকা ঃ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপনের শাসনকাল (১৮৮০-৮৪) হল একটি ব্যক্তিক্রম অধ্যায় । ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের তিক্ততা স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে এক বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের দুর্নীতির জন্য কয়েকবার দুর্ভিক্ষও দেখা দিয়েছিল। ভারতবর্ষের এমন দুর্দিনে লর্ড রিপন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝতে পারেন যে, ভারতবর্ষের প্রকৃত উন্নয়নসাধন করতে হলে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার প্রদান করতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ভারতবর্ষের শাসনকার্যে বেশ কিছু সংস্কার আনয়ন করেন। এ সংস্কারের মধ্যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও এর ক্রমবিকাশ : ১৮৮৫ সালের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আলোচনার আগে জানা দরকার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কি? স্বায়ত্তশাসন অর্থ হল স্বশাসন বা নিজের শাসন। কারণ দেখা যায়, প্রতিটি মানুষই কোন না কোন দেশ, প্রদেশের বাসিন্দা। তাই যে যেখানে বসবাস করে সেখানে যদি 'কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে স্বশাসন কায়েম করতে পারে তাই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। অন্যদিকে স্বায়ত্তশাসন অর্থ হল, যখন স্থানীয় সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকার এর নিযুক্ত কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ধারণা নতুন নয়। বহু প্রাচীনকাল থেকে এ ধারণা প্রচলিত ছিল। এ স্বায়ত্তশাসন বৈদিকযুগে জনসাধারণ দ্বারা নির্বাচিত সভা ও সমিতির হাতে গ্রাম ও শহরের, বিচার, পুলিশ ও শান্তিরক্ষা, শিক্ষা ও যাতায়াত ব্যবস্থার ভার ন্যস্ত থাকতো। মৌর্য ও গুপ্ত শাসনামলেও শহর ও গ্রাম এলাকার জন্য স্বায়ত্তশাসিত সরকার ছিল। বাংলার ইতিহাসে পাল ও সেন আমলে সুগঠিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল। ভারতে একমাত্র মুসলিম শাসনামলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা বিকাশ লাভ করেনি।
ভারতে মুসলিম শাসনের অবসানের পর ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণ করলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। যেসকল স্থানে স্থানীয় সভা বা সমিতিগুলো টিকে ছিল ইংরেজ সরকার তার সংস্কার সাধন করে পুনরুজ্জীবিত করতে সচেষ্ট হন। ১৬৮৭ সালের ইংল্যান্ডের ডাইরেক্টর সভার নিদের্শক্রমে সর্বপ্রথম মাদ্রাজে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের নিয়ে পৌর কর্পোরেশন গঠিত হয়। পৌরসভার কাজ ছিল রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণ, কর ধার্য এবং তা আদায় ইত্যাদি। কিন্তু এ কর্পোরেশন স্থায়ী হয় নি। ১৯৯৩ সালের সনদ আইনে গভর্নর জেনারেলের হাতে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১৮৫৬ সালে আরো দু'টি আইন পাস হয় ।
১৮৫৮ সালে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ সরকার সরাসরি গ্রহণ করেন। তখন থেকে সরকার স্থানীয় এলাকার উন্নয়নের জন্য যত্নবান হন। ১৮৭০ সালে এ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে লর্ড মেয়ো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থাকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এর ফলে এ ব্যবস্থার আরো উন্নতি সাধিত হয়। লর্ড মেয়োর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে ১৮৭০ সালে বাংলার আইনসভায় 'চৌকিদারি আইন' প্রণীত হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থার বেশ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির পরিপ্রেক্ষিতে তা দূরীকরণের এবং ইংল্যান্ডের প্রচলিত বিধি অনুকরণে প্রকৃত স্থানীয়
স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে লর্ড রিপন ১৮৮২ সালে স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব পাস করেন। লর্ড রিপন বলেছেন, “আমি ভারতবর্ষে ইংল্যান্ডের ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু এদেশেই যে ব্যবস্থা ছিল তা পুনরুজ্জীবিত ও প্রসারের চেষ্টা করছি।" ১৮৮২ সালের সংস্কার প্রস্তাব পাস : লর্ড রিপন ছিলেন এদেশে স্বায়ত্তশাসনের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সর্বপ্রথম এদেশে সত্যিকার অর্থে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণকে অধিকতর রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বলেছিলেন, অধ্যবস্যায় সবচেয়ে বড় শিক্ষক। তাই জনগণকে ক্ষমতা ও সুযোগ প্রদান করতে তারা নিশ্চয়ই ভালোভাবে তাদের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত করতে পারবে। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর হাতে অধিকতর ক্ষমতা দান করে এ সংস্থাগুলোর কাজকর্মে আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ রদ করা দরকার। এটি গম্ভব না হলে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনে ভারতবাসী শিক্ষা লাভ করতে পারবে না। এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনি ১৮৮২ সালে স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব পাস করেন।
১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের আইনে প্রস্তাবসমূহ ঃ লর্ড রিপনের প্রস্তাবে বলা হয় ঃ
১. প্রতিটি জেলায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।
8. জেলা সংস্থাগুলোর নাম হবে লোকাল বোর্ড। লোকাল বোর্ডগুলোর সীমানা যত ছোট হয় ততই ভালো। এতে প্রতিনিধিদের সাথে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। লোকাল বোর্ডগুলোতে সরকারি কর্মচারীদের আসন সংখ্যা - অংশের 'বেশি হবে না। বোর্ডগুলোর সভাপতি হবেন বেসরকারি ব্যক্তি
৫. বেসরকারি সদস্যগণ জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
৫. বোর্ডগুলোকে সরকার পরামর্শ বা পথ নিদের্শ করতে পারবেন।
৭. বোর্ডগুলোর কাজকর্মে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তবে জনগণের উপর কর আরোপ ও আদায়ের ক্ষেত্রে বোর্ডগুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
৮. যদি কোন লোকাল বোর্ড তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকার বোর্ডের বেআইনি কাজকর্ম রদ করতে পারবেন। তবে বোর্ড বাতিল করতে হলে ভারত সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে লর্ড রিপনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, "If should be the general function of the executive officers of government to watch, aspecially at the outset. The proceeding of the local boards to point out to them matters calling for their consideration to draw their attention to any neglect of duty on their part and to cheek by offecial remonstrance any attempt to exceed their proper functions or to any illegally or in any arbitrary or unreasonable manner."
৯. বোর্ডগুলোকে তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
১০. বোর্ডগুলোর উপর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, আলো প্রভৃতি জনহিতকর কার্যাদির দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে। তাছাড়া কর আরোপ ও কর আদায়ের দায়িত্ব বোর্ডগুলোর উপর ন্যস্ত থাকবে । পৌর শাসনব্যবস্থার বিকাশ : ১৮৮২ সালের লর্ড রিপনের আমলে পৌরসভার সংগঠনের ক্ষেত্রেও বিরাট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় । তার উদ্যোগে ১৮৮৪ সালে 'বঙ্গীয় পৌরসভা আইন' প্রণীত হয়। এ আইনে তিনি পৌর শাসনব্যবস্থার তত্ত্বাবধান ও কর্তৃত্ব শহরগুলো হতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ করার প্রস্তাব করেন। এ আইনে পৌরসভার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের পদও নির্বাচন ভিত্তিক করা হয়। মূলত এ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পৌরসভার ভিত্তি সুদৃঢ় হয় । মূল্যায়ন : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় লর্ড রিপনের প্রস্তাবের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ, এটা ছিল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মূল ভিত্তি। তবে তার প্রস্তাবের গুরুত্ব যাই হোক না কেন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ ও প্রাদেশিক সরকার কেউই তার প্রস্তাবিত নীতিকে কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি। তাই ১৯১৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের কোন উন্নতি হয় নি। এক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল লর্ড কার্জনের মত প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া ব্রিটিশ আমলারাও স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। ফলে লর্ড রিপনের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তেমন কোন অগ্রগতি হয় নি। তবে তার উদ্যোগ যে ভালো ছিল এতে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই।
উপসংহার ঃ ভারতীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বিকাশে লর্ড রিপনের অবদান ভারতীয়রা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে অনন্তকাল ধরে। গণতন্ত্রকে সার্থকভাবে রূপায়িত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার আবশ্যকতা রয়েছে। এ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনার নিমিত্ত যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে পরবর্তীতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। এ ব্যবস্থার ফলে স্থানীয় সমাজজীবনে একটি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং, এ আইনের বিভিন্ন ত্রুটি থাকলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]