লর্ড রিপনের সংস্কারসমূহ আলোচনা কর ।

ভূমিকা : ব্রিটিশ যুগের ইতিহাসে লর্ড রিপন একটি গৌরবোজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছেন। লর্ড রিপন একজন উদারপন্থি লোক ছিলেন। শান্তি, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাতয়্যবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি যখন গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় নিযুক্ত হয়ে আসেন তখন ভারতের শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের কোন স্থান ছিল না বললেই চলে। গণতান্ত্রি নীতি অনুযায়ী জনমতের ইঙ্গিত অনুসারে শাসন পরিচালনার প্রশ্নই তখন ছিল না। ইংরেজ রাজকর্মচারীগণের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর শাসনকার্যাদি নির্ভর করত। তারা যা ভালো মনে করত তাই করত। জনসাধারণের তাতে মঙ্গল হয় সে বিষয়ে ভাবার বা জনমতের ধার ধারার কোন প্রয়োজন কেউ বোধ করত না। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পাশ্চাত্য দেশসমূহের শাসনব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে শাসনকার্যে পি অংশগ্রহণের দাবিও ভারতবাসীরা করতে আরম্ভ করল। শিক্ষিত সমাজ প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক শাসন এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক সংস্কার দাবি উত্থাপন করলেন। লর্ড রিপন ভারতবাসীর এ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশ ছিলেন। তিনি স্বভাবতই ভারতীয় শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্রমূলক করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তার উদারপন্থি জন সংস্কারের জন্য ভারতবাসীর কাছে স্থায়ী আসন লাভ করে আছেন।
লর্ড রিপনের সংস্কারসমূহ : লর্ড রিপন নানাবিধ সংস্কার সাধন করেন। নিম্নে সেগুলোর বিবরণ দেওয়া হল ঃ
১. শুষ্ক ও রাজস্ব সংক্রান্ত সংস্কার : লর্ড রিপন যখন ভারতের গভর্নর জেনারেল বা ভাইসরয় হয়ে আসেন তখন ভারত সরকারের আর্থিক অবস্থা খুবই সচ্ছল ছিল। এ আর্থিক সচ্ছলতার ফলেই সংস্কার সম্পাদনের উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে রিপন নর্থব্রুক প্রবর্তিত এবং লিটন কর্তৃক অনুসৃত অবাধ বাণিজ্য নীতির 'সম্পূর্ণতা সাধন করলেন। লবণ, মদ, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃ সামান্য কয়েকটি দ্রব্যের উপর শুল্ক বাতিল করেন। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কর্তৃক পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভারত সচিব এ প্রস্তাব অনুমোদন করেন নি। লর্ড রিপনের প্রস্তাব গৃহীত হলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি প্রধান ত্রুটি দূর হতো।
২. শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক ব্যবস্থা : লর্ড রিপনের সংস্কার কার্যাদির মধ্যে স্বায়ত্তশাসনমূলক আইন প্রবর্তন ভারতের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। লর্ড রিপন ভারতের রাজনৈতিক চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ১৮৮১ সালে বঙ্গীয় মিউনিসিপ্যাল আইন লিপিবদ্ধ করেন। তিনি স্থানীয় লোকের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে জেলা বোর্ড ও লোকাল বোর্ড গঠন করেন এবং এদের হাতে স্থানীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্ত াঘাট নির্মাণ, মহামারি ও সংক্রামক ব্যাধি নিরোধ প্রভৃতি নানাবিধ কার্যের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা অবশ্য লর্ড রিপনের পূর্ব থেকে ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বড় বড় শহরে ইতঃপূর্বে পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এ সকল পৌরসভার সদস্য, মেয়র, চেয়ারম্যান প্রভৃতির উপর অর্পণ করে একে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে গড়ে তোলেন। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন সরকারি মনোনীত সদস্য রাখার এবং এগুলোর উপর সরকারি পরিদর্শনের ব্যবস্থাও তিনি করেন।
৩. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা : লর্ড লিটন সরকারের কার্যাদির সমালোচনা রুদ্ধ করার জন্য দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সমালোচনার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু লর্ড রিপন Vernacular press Act বাতিল করে দিয়ে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সমালোচনার ক্ষমতা কেড়ে নেন ।
৪. শিক্ষা সংস্কার : লর্ড রিপন ভারতীয় জনসাধারণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে হান্টার কমিশন নিয়োগ করেন। এ মিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হান্টার কমিশন সরকারকে ক্রমশ অধিক পরিমাণে অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ বৃদ্ধির উপদেশ দেন। হান্টার কমিশনের রিপোর্টের ফল হিসেবে স্কুল-কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।
৫. সামাজিক সংস্কার : লর্ড রিপন ভারতীয় জনসমাজের প্রতি প্রকৃত সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং জনসাধারণের উন্নতির জন্য নানাবিধ সংস্কার কার্যকরী করেছিলেন। জমিদার কর্তৃক রায়তদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ রোধ করার উদ্দেশ্যে রিপন একটি প্রজাস্বত্ব আইনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। এ বিলটি অবশ্য তার পরবর্তীকালে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক আইনে পরিণত হয়েছিল। তিনি সর্বপ্রথম ১৮৮১ সালে লোক গণনার ব্যবস্থা করেন ।
৬. বিচার ব্যবস্থার বৈষম্য দূর : ১৮৮৩ সালের ফৌজদারি আইন অনুসারে ভারতীয় কোন বিচারক ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারতেন না। জাতিগত বৈষম্যের জন্য ভারতীয় বিচারক ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারতেন না। লর্ড রিপন জাতিগত বৈষম্য দূর করে এবং ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের সমান ক্ষমতা দেওয়ার জন্য 'ইলবার্ট বিল' নামে একটি আইনের খসড়া করেন। এ বিলে ভারতীয় বিচারক ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমমর্যাদা ও সমক্ষমতা দানের নীতি গৃহীত হয়। কিন্তু এ বিলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় সমাজ বিরাট আন্দোলন আরম্ভ করলেন এবং লর্ড রিপন শেষ পর্যন্ত ইলবার্ট বিলের সংশোধন করতে বাধ্য হন। এ সংশোধনের ফলে স্থির হল যে, ভারতীয় বিচারক ইউরোপীয়দের বিচার করবেন কিন্তু বিচারকালে ইউরোপীয় জুড়ির সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
৭. আশ্রিত রাজ্যের প্রতি আচরণ । দর্ড বেন্টিংকের আমলে শাসনকার্যে অব্যবস্থার অজুহাতে মহীশুর রাজ্যের শাসনভার কোম্পানির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। লর্ড রিপন মহীশুর রাজ্যের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে রাজবংশের উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেন।
৮. কারখানা আইন: লর্ড রিপন ১৮৮১ খ্রিঃ শ্রমজীবিদের সুবিধার্থে ফ্যাক্টরি আইন পাস করেন। এর দ্বারা তিনি শিশু শ্রমিকদের দিনে মোট নয় ঘণ্টা কাজ করার নিয়ম প্রবর্তন করেন। এছাড়া বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি উপযুক্তভাবে ঢেকে রাখার নিয়ম এ আইন দ্বারা বাধ্যতামূলক করা হয়। কারখানা আইন প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য ফ্যাক্টরি পরিদর্শক নামে এক শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা করেন।
মূল্যায়ন : লর্ড রিপনের শাসনকাল গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাস সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতবাসীদের শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লর্ড রিপন লর্ড লিটন প্রবর্তিত Vernacular press Act নাকচ করে এবং ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে বৈধ সমালোচনার অধিকার দান করে ভারতবাসীর রাজনৈতিক শিক্ষা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধির পথ প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে চেয়ারম্যান, মেয়র প্রভৃতি নির্বাচনের দ্বারা নিযুক্ত করে ভারতবাসীকে অধিকতর দায়িত্বশীল করে তোলেন। শিক্ষার ব্যাপারে লর্ড রিপন আমূল পরিবর্তন করেন। তার প্রচেষ্টায় ভারতে অনেক সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এবং ভারতবাসী পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে পরিচিতি লাভ করেন। এভাবে লর্ড রিপন নানা প্রকার জনহিতকর কাজ এবং ভারতবর্ষের স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক শিক্ষা ও দায়িত্ববোধ ভারতবাসীর মধ্যে বিস্তার লাভ করে ভারতবাসীর আস্থা অর্জন করেন।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড রিপন একজন সংস্কার মনোভাবাপন্ন মহান ব্যক্তি। তিনি প্রথম ভারতবাসীর নৈতিক উন্নয়নের জন্য সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে তার শাসনামল প্রশংসিত হয়। এছাড়া তিনি আইন ক্ষেত্রে যে সংস্কার সাধন করেন তা বেশি প্রশংসনীয়। তার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার প্রবর্তন যুগান্তকারী পদক্ষেপ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]