লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সামাজিক সংস্কার পর্যালোচনা কর।

ভূমিকা ঃ ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেন এবং তা প্রায় বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে দুইশত বছর টিকিয়ে রাখেন। তাদের সুদীর্ঘ শাসনামলে অনেক গভর্নর জেনারেল ইংল্যান্ডের ডাইরেক্টর সভা কর্তৃক মনোনীত হয়ে ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য এসেছিলেন। এদেরই একজন ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক । তিনি ১৮২৮ সালে লর্ড আমহাস্টের পর গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতবর্ষে আসেন। কিন্তু গতানুগতিক অন্যান্য গভর্নর জেনারেলের তুলনায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে যুদ্ধবিগ্রহ ত্যাগ করে সংস্কার কার্য দ্বারা ভারতবাসীর নৈতিক মঙ্গল সাধন করে শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চান ।
লর্ড বেন্টিংকের গভর্নর জেনারেল নিয়োগের পটভূমি : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক প্রথম জীবনে (দঃ উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিশ বেন্টিংক) প্রথম জীবনে মাদ্রাজের গভর্নর হয়ে ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু তার শাসনামলে (১৮০০- ০৭) তোলারে বিদ্রোহ দেখা দিলে তাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়া হয়। অনেকের মতে, তাকে স্বদেশে ডেকে নিয়ে কর্তৃপক্ষ অনেকটা ভুল করেছিলেন। নেপোলিয়ন পূর্বে নেপোলিয়ন বিজেতা ডিউক অব ওয়েলিংটনের অধীনে সৈনিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কোন সামরিক কূটচাল বা সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেন নি। তবে তাঁর ভারত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল প্রচুর। তাই দ্বিতীয়বার ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসলে এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। এছাড়া পূর্বে মাদ্রাজের গভর্নর থাকাকালীন তাঁর শাসনব্যবস্থার যে কোন ত্রুটি ঘটে নি একথা তিনি স্বদেশী কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে তারপর ১৮২৮ সালে লর্ড আমহাস্টের পর ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝতে পারেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে মজবুত করতে হলে এদেশীয় জনসাধারণের সমর্থনের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। তাই তিনি কৌশল হিসেবে সংস্কারকার্যকে বেছে নেন। তাই অনেকে তাঁর প্রশংসা সম্পর্কে মুক্ত মনের অধিকারী, ভিক্টোরিয়ার যুগের মূর্ত প্রতীক, উদার শাসক ও সংস্কারক আখ্যা দেন । লর্ড বেন্টিংকের সংস্কার : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক-এর সংস্কার ভারত ইতিহাসে বিখ্যাত। তাঁর সংস্কার কার্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামাজিক ক্ষেত্রে সমকালে যে অন্যায় অবিচার বিরাজিত ছিল তা দূর করা। তবে তিনি শাসন, বিচার, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও উদার মনোভাবের প্রমাণ দেন। নিম্নে তাঁর শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকার্য-সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হল ঃ ১. সামাজিক সংস্কার : বেন্টিংকের সামাজিক সংস্কার ছিল ভারত ইতিহাসে প্রশংসনীয়। তাঁর সামাজিক সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা নিচে দেওয়া হল ঃ
ক. সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন : ভারতবর্ষে পূর্ব থেকে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। সতীদাহ প্রথার মূল বিষয় হল যে, স্বামী মারা গেলে একই চিতায় স্ত্রীকেও ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারা। এ সতীদাহ প্রথা আবার দু ধরনের ছিল যথা : হমরণ প্রথা : যদি স্বামী-স্ত্রী বসবাস করাকালীন কোন সময় স্বামী আগে মারা যায় তাহলে ঐ একই চিতায় স্ত্রীকেও সামাজিক বিধান অনুসারে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারা হতো। এ প্রথা ছিল একেবারে অমানবিক ।
i. ii. অনুসরণ প্রথা : এ প্রথার মূল বিষয় ছিল যে, স্বামী দূর দেশে বা অন্য কোন অজ্ঞাত স্থানে মারা গেলে এবং সে সংবাদ প্রচারিত হলে বিধবা স্ত্রীকে একাকী ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারা হতো। এ প্রথা ছিল ন্যক্কারজনক। তাই বেন্টিংকের শাসনামলে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয় । ভারতের প্রগতিশীল ব্যক্তি মাত্রই এ বীভৎস ও অমানুষিক প্রথা অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতে লাগলেন। লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনকাল থেকে কোম্পানি সতীদাহ প্রথা উঠে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য ইংরেজ কর্মচারীগণকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে বলা হয়েছিল। লর্ড ওয়েলেসলি সতীদাহ প্রথা নিবারণার্থে সদর নিয়ামত আদালতের জজদের অভিমত এ ব্যাপারে জানতে চান। তারা এ প্রথা একেবারে উঠিয়ে না দিয়ে কতকগুলো কঠোর নিয়মকানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেন। লর্ড মিন্টোর শাসনকালে এ সুপারিশ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কর্মচারীর বিনা অনুমতিতে সতীদাহ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। লর্ড হেস্টিংসের শাসনামলে ডাইরেক্টর সভা এ অমানুষিক প্ৰথা
বিলোপের নির্দেশ প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয়দের ধর্মে আঘাত দেওয়া সমীচীন হবে না মনে করে লর্ড আমহার্স্ট সতীদাহ নিবারণের চেষ্টা করতে সাহসী হন নি। লর্ড বেন্টিংক ক্ষমতা গ্রহণ করে এ প্রথা বিলোপের জন্য কৃৎসংকল্প হন। তিনি এ কার্যে ভারতীয় শিক্ষিত উদারপন্থি হিন্দু নেতৃবর্গ ও সদর নিয়ামত আদালতের জজদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিলেন। তাই তিনি ১৯২৯ সালে আইন পাস করেন (সতীদাহ নিষিদ্ধ আইন)। তবে তিনি কেবল আইন পাস করে ক্ষান্ত হন নি, তা অমান্যকারীদের শাস্তির বিধানও রাখেন।
খ. ঠগি দমন : লর্ড বেন্টিংকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান হল ঠগি দমন। ঠগিদের অত্যাচার বহু পূর্ব হতেই নিরাপদে চলার পথে অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে এটোয়া জেলার পাঁচশত ঠগিকে হত্যা করেছিলেন। ফরাসি পর্যটক খেতেনা-এর বর্ণনা থেকে আওরঙ্গজেবের আমলে ঠগিদের অত্যাচারের কথা পাওয়া যায়। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকেও ঠগিদের অত্যাচারে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। অতর্কিত আক্রমণ করে তারা পথিককে ফাঁস ( গলায়) লাগিয়ে হত্যা করে সমস্ত কিছু লুটে নিত। বেন্টিংক এ ঠগি দস্যুদের দমন করার দায়িত্ব কর্নেল শ্রীম্যানের উপর অর্পণ করেন। কর্নেল শ্রীম্যান ফেরিহিয়া নামে জনৈক ঠগির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের গোপন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। এতে কারো কারো মতে প্রায় ১৫০০ (পনের শত) জন ঠগি মারা যায় । এভাবে তিনি ভারতীয় জনসাধারণকে ঠগিদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন।
:: গ. বিবিধ ঃ উপরিউক্ত সংস্কার ছাড়াও বেন্টিংক সামাজিক ক্ষেত্রে আরো অন্যান্য যে কুসংস্কার ছিল তা দূর করেনা। পূর্বে ভারতীয়রা প্রথম সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন দিত, বিবাহ দিতে অসুবিধা বিধায় কন্যা সন্তানকে হত্যা করত এবং কোন কোন অঞ্চলে নরবলি প্রচলিত ছিল। বেন্টিংক এ নরবলি-এর উচ্ছেদসহ এসব প্রথা বাতিল করেন। তবে এ ক্ষেত্রে কেবল আইন পাস করে তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না, আইন অমান্যকারীকে শাস্তি দিয়েও এগুলো কার্যকরী করেন।
মূল্যায়ন : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ভারতবাসীর জন্য তথা ভারতীয় জনসাধারণের নৈতিক কল্যাণের জন্য আজীবন/গভর্নর জেনারেল থাকাকালীন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেও তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তাঁর সমালোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ঘনটন বলেন, বেন্টিংক নিজের যশ ও খ্যাতির প্রতি অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। তিনি তাঁর শাসনামলের বিবরণে ফলাফল শূন্য বলেছেন। তিনি বলেন, উনিশ শতকের গোড়ায় যেসব গভর্নর জেনারেল ভারতে আসেন তাদের কেউ বেন্টিংকের মত নিজের খ্যাতি লাভের জন্য ভারতবাসীর স্বার্থকে গৌণ স্থান দেন নি। তিনি আরো যুক্তি দেখান যে,
১. তিনি শাসনব্যবস্থায় ভারতবাসীর অংশীদারিত্বের কথা বললেও হাতে কলমে তার কিছুই ছিল না ।
২. ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের তিনি নিয়ম করলেও তা পুরোপুরি কার্যকরী হয় নি। ভারতবাসীর মঙ্গল সাধনের জন্য যদিও বেন্টিংক অনেক হিতবাদী মতামত দেন তবুও একমাত্র সতীদাহ প্রথা বন্ধ ও ঠগি দমন ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেন নি
৪. বেন্টিংক রাজা রামমোহন রায়ের পথিকৃত হিসেবে এ হাওয়ায় পাল খাটিয়ে দু একটি সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্কার সাবধানতার সাথে সম্পাদন করেন মাত্র। কোন আমূল পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা তিনি করেন নি।
রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, বেন্টিংকের তথাকথিত সংস্কারবাদের আড়ালে ইংল্যান্ডের শিল্পপতি, বণিক ও ধনতন্ত্রীদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করা উচিত। তবে এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর সংস্কার কার্য প্রশংসনীয় ছিল বলা যায়। ভারতীয় সমাজে কুসংস্কার দূরীকরণ, ভারতীয় ও ইংরেজ কর্মচারীর মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, ভারতীয়দের শিক্ষাদীক্ষার উন্নতি সাধন প্রভৃতির জন্য লর্ড মেকলে উইলিয়াম বেন্টিংকের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম প্রাচ্য দেশীয় অত্যাচারী শাসনের * স্থলে ব্রিটিশ স্বাধীনতার আস্বাদ ভারতবাসীকে দেন। তাই নিরপেক্ষ বিচারে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, তিনি কোম্পানির আর্থিক অনটন দূর করে কোম্পানির বাৎসরিক আয় ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করে প্রতি বছর যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব উদ্বৃত্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্কার সাধনের পশ্চাতে জনকল্যাণের ইচ্ছাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য । এসকল কারণে বেন্টিংক ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের কোম্পানি শাসনের ইতিহাসে বেন্টিংক যোদ্ধা হিসেবে নয় সংস্কারক হিসেবে সবিশেষ পরিচিত। তাঁর সমাজ ও শিক্ষা সংক্রান্ত সংস্কারগুলো ভারত ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তাই উদারকামী, শান্তিপ্রিয়, নির্ভেজাল সংস্কারক, মুক্ত প্রতিযোগিতার অধিকারী হিসেবে বেন্টিংক ছিলেন ভিক্টোরিয়া যুগের মূর্ত প্রতীক। এছাড়া তুলনামূলক বিচারে তিনি অন্যান্য গভর্নর জেনারেলদের চেয়ে প্রশংসনীয় ছিলেন বলা যায়। কিন্তু বেন্টিংকের ভারতবাসীর প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব থাকলেও ঐ মনোভাবের মধ্যে ব্রিটিশ সংস্কারের স্বার্থ লুকায়িত ছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]