. বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশন সম্পর্কে আলোচনা কর। (Discuss About the Boundary Commission of Bengal.)

সীমানা কমিশন গঠন Formation of Border Commission
সীমানা চিহ্নিতকরণ কার্যক্রমকে সামনে রেখে তখন শুরু হয় আরেক নাটকের। যুগে যুগে সরল-নিরীহ জনগণ কখনো প্রত্যাশার কিছু পায় নি, এখানেও তাই হয়।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা বিভক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যকার সঠিক সীমানা নির্ধারণ করার জন্য একটি সীমানা কমিশন গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর এ কমিশন কথাটি বলার সাথে সাথেই সর্বজন গ্রহণযোগ্যতার একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে চিন্তার অন্তরালে। বাস্তবে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে আজ অবদি সেই সর্বজন গ্রহণযোগ্যতার স্বপ্নটি কখনো বাস্তবায়িত হয় নি । প্রায় প্রতিবারই শাসককুলের অনুকূলে গঠিত হয় সেই কমিশন, জনগণের ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা পূরণে নয়। আর এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রাথমিক চিন্তায় বাংলা ও পাঞ্জাবের জন্য দুটি ভিন্ন কমিশন গঠনের এবং প্রতি কমিশনে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় বিবেচিত হয়। সীমানা চিহ্নিতকরণ বিষয়টি ছিল অত্যন্ত জটিল। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিবর্গ সীমানা নির্ধারণে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দিবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। এমতাবস্থায় লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয় দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ৮ জুন ১৯৪৭ তারিখে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের সীমানা কমিশনের প্রতিটিতে প্রিভি কাউন্সিলের বিচার বিভাগীয় কমিটির ৩ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। তাঁরা বৃদ্ধ বয়সে ভারতবর্ষের গরম সহ্য করতে পারবেন না- এ অজুহাতে মাউন্টব্যাটেন উক্ত প্রস্তাব নাকচ করলে জিন্নাহ বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রতি কমিশনে ৩ জন করে অভারতীয় বিশেষজ্ঞকে নিয়োগের সুপারিশ করেন, যা আরেক জটিলতার সৃষ্টি করে।
এ পদ্ধতিতে কমিশন গঠন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার এবং যেহেতু ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর পূর্বেই সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ সমাপ্ত করতে হবে। তাই জিন্নাহর দ্বিতীয় প্রস্তাবও নাকচ করা হয়। ১০ জুন ১৯৪৭ তারিখে লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জিন্নাহর দ্বিতীয় প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন এবং সময়ের স্বল্পতার কথা বিবেচনা করে তা নাকচ করা হয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ প্রস্তাব করেন যে, প্রতি কমিশনে ২ জন মুসলিম লীগ ও ২ জন কংগ্রেসের প্রতিনিধি এবং উভয় কমিশনের জন্য একজন নিরপেক্ষ চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হোক। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিরপেক্ষ চেয়ারম্যানের নাম প্রস্তাব করবে। কমিশনের সদস্যবৃন্দ হবেন বিচার বিভাগীয়। এবার প্রশ্ন থেকে যায় কাকে নিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে মাপা যেতে পারে।
ক. জওহরলাল নেহেরুর প্রস্তাব (Proposal of Zowhorlal Neheru) এরূপ জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই শেষ অবদি গঠন করা হয় নেহেরু কমিশন নামে একটি সীমানা কমিশন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুন নেহেরু কমিশনের 'প্রাইম অব রেফারেন্স' কি হওয়া উচিত তার খসড়া গভর্নর জেনারেলকে প্রদান করা হয় । অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত উক্ত খসড়ায় নেহেরুর প্রস্তাব ছিল যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. বাংলার দুই অংশের সীমানা মুসলমান ও অমুসলমানগণ যেসব সংলগ্ন এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ তা নির্ণয়ের ভিত্তিতে নির্ধারণ
করতে হবে । এভাবে সীমানা নির্ধারণ করার সময় অন্যান্য বিষয়ও (Other factors) বিবেচনায় রাখতে হবে।
2
সিলেটে গণভোটের ফলাফল যদি উক্ত জেলার পূর্ববাংলার সংযুক্তির পক্ষে হয় তাহলে বাংলার সীমানা কমিশনই সিলেটে ও সিলেট সংলগ্ন জেলাসমূহের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নির্ধারণের মাধ্যমে সীমানা চিহ্নিত করবেন।
২৩ জুন মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে আলোচনার সময় জিন্নাহ এ টার্মস অব রেফারেন্সে সম্মতি দেন। বাংলার সীমানা কমিশন এই টার্মস অব রেফারেন্সের ভিত্তিতেই কাজ করে।
খ. গৃহীত সিদ্ধান্ত (Taken Decision)
১৩ জুন ১৯৪৭ মাউন্টব্যাটেন লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের যৌথ সভা আহ্বান করেন। নেহেরু, প্যাটেল, কৃপালিনী, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, সরদার আবদুর রব নিশতার ও বলদেরব সিং উক্ত বৈঠকে যোগদান করেন। বৈঠকে উভয় দল একটি সমঝোতায় উপনীত হন এবং নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
১. প্ৰতি সীমানা কমিশন একজন নিরপেক্ষ সভাপতি এবং মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের ২ জন করে মোট ৪ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে ।
২. সদস্যবৃন্দ বিচার বিভাগীয় হবেন। পাঞ্জাব কমিশনে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের একজন শিখ প্রতিনিধি থাকবেন ।
৪ জিন্নাহ ও নেহেরু স্ব-স্ব দলের প্রতিনিধিদের নাম গভর্নর জেনারেলের নিকট জমা দিবেন ।
৫ প্রতি সীমানা কমিশনের সদস্যবৃন্দ বৈঠকে বসে একজন নিরপেক্ষ সভাপতির নাম সুপারিশ করবেন। তারা এ কাজে ব্যর্থ হলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যৌথ বৈঠকে তা ঠিক করবেন।
৬. টার্মস অব রেফারেন্স সংক্রান্ত ইতোপূর্বে পেশকৃত নেহেরুর খসড়া রিপোর্টটি ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বিবেচনা করে তাদের
মতামত গভর্নর জেনারেলকে অবহিত করবেন।
সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ প্রসঙ্গে জিন্নাহসহ ২৩ জন গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিমত ব্যক্ত করেন যে একজন ব্রিটিশ বিচারক বাংলা ও পাঞ্জাব এ উভয় কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হতে পারেন। তিনি Arbitration Tribunal-এরও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেতে পারেন। র‍্যাডক্লিফের নাম ভারতসচিব কর্তৃক প্রস্তাবিত হয়েছে। জিন্নাহ এর পরদিন র‍্যাডক্লিফকেই বাংলা ও পাঞ্জাব কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে গ্রহণের জন্য মুসলিম লীগের সম্মতির কথা গভর্নর জেনারেলকে জানিয়ে দেন।
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ২৬ ও ২৭ জুন অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকলীন কেবিনেট সভার বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে জিন্নাহর সুপারিশ অবহিত করেন। উভয় দলের নেতৃবৃন্দ র‍্যাডক্লিফকে বাংলা ও পাঞ্জাব কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে জিন্নাহ এবং নেহেরু কমিশনের স্বীয় দলের সদস্য-প্রতিনিধির নাম ভাইসরয়ের নিকট জমা দেন ।
গ. সীমানা কমিশনে মুসলিম লীগের সদস্য (Muslim League's Members in Border Commission) বাংলার সীমানা কমিশনে মুসলিম লীগের মনোনীত সদস্যরা ছিলেন:
১ কলকাতা হাইকোর্টের জাস্টিস আবু খ্রিষ্টাব্দেহ মোহাম্মদ আকরম এবং পাঞ্জাব হাইকোর্টের জাস্টিস এস. এ. রহমান ।
. সীমানা কমিশনে কংগ্রেসের সদস্য (Congress' Members in Border Commission) অন্যদিকে সীমানা কমিশনে কারোসের सी < আসি. সি. বিশ্বাস
জাস্টিস বিজন কুমার মুখার্জি। তাই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন।
অন্তর্ভূকির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আসাম সীমানা কমিশ
এই সময় আসামের গঠনের প্রস্তাব পেশ করে। ान गाনা কমিশন আসাম-সিলেট অপরাপর সীমানা চিহ্নিত করবেন, তাতো
লীগের এ সিয়াস্তের আলোকে আসাম গভর্নরের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়।
সীমানা কমিশনের কার্যক্রম
Activities of Border Commission
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩০ জুন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও পাঞ্জান কমিশনের সদস্যদের নাম সরকারিভাবে ঘোষণা করেন। ঘোষণায় উল্লেখ করা হয় যে, বাংলা কমিশন পূর্ববাংলা ও আসামের সীমানা চিহ্নিত করবেন। ৪ জুলাই ভাইসরয় বাংলা এ পাঞ্জাব কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নাম ঘোষণা করেন। স্যার রাডক্লিফ ৮ জুলাই ি পৌঁছেন এবং অনতিবিলম্বে ভাইসরয়, কমান্ডার ইন চিফ এবং মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন এবং তা ধারণা পান যে ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-এর মধ্যেই সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ করতে হবে। ১০ জুলাই অনুষ্ঠিত পার্টিশন কাউন্সিলের সভায় র্যাডক্লিফ এ মর্মে এক সিদান্ত পাস করিয়ে নেন যে, সীমানা চিহ্নিতকরণের ব্যাপারে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত পার্টিশন কাউন্সিলের সভায় দীপ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে র্যাডক্লিফ আরও পাস করিয়ে নেন যে তার কোনো সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না এবং কমিশন যেরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তা চুবহু মেনে নেবে। তাই কমিশনের চেয়ারম্যান হন সর্বেসর্বা। বাস্তবে সদস্যদের কোনো ক্ষমতাই ছিল না।
সাধারণত কোনো কমিশন যখন কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার কাছে দায়বদ্ধ থাকে তখন সেই কমিশন জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ করতে পারেনা। অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ যা বলতে বলে তাই বলে থাকেন অনেকাংশে কৌশলগত দক্ষতায়। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ দিল্লিতে বসেই সীমানা চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শুধু একবার কলকাতা ঘুরে নিয়ম করেন যে, কমিশনের সদস্যগণ কলকাতা ও লাহোর থেকে প্রত্যহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁর নিকট দিল্লিতে প্রেরণ করবেন এবং তিনি সেখানে সেগুলো পর্যালোচনা করবেন।
আসলে কমিশন যে নামেই করা হোক না কেন সেই কমিশনকে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব না দেওয়া হলে তা কার্যকর হতে পারে না। কলকাতায় বাংলা কমিশনের পক্ষ থেকে আগ্রহী বিভিন্ন দলকে সীমানা সংক্রান্ত দাবিনামা পেশ করার আহ্বান জানান। জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বাংলা কমিশন ১৬ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই আগ্রহীদের সাক্ষাৎকার নেন। কংগ্রেস, বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবিনামা পেশ করা হয়।
আধিপত্যবাদী ব্রিটিশ শাসককুল নিজস্ব কৌশলগতভাবেই সামনে এগুতে থাকেন। আর ফন্দি আটতে থাকেন কীভাবে ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘাতের বীজ বপন করে যেতে পারে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ থেকে ৭ জুলাই সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোট অনুযায়ী সিলেট জেলা পূর্ববাংলার সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার সীমানা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে কমিশন ৪ থেকে ৬ আগস্ট কলকাতায় এক বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে আসাম সরকার ও পূর্ববাংলা সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ, আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ও আসাম প্রদেশিক হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিবর্গ এবং পূর্ববাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ও সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিনিধিগণ যোগদান করেন। হিন্দু নেতৃত্বের কংগ্রেস আর মুসলিম নেতৃত্বের মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ অকার্যকর ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের বিশ্বাসে একে অন্যকে অবিশ্বাস করবে তেমনি একটা ধারণা ব্রিটিশ শাসককুলের ছিল এবং বাস্তবে তাই দেখা গেছে পরবর্তীতে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে
যে দাবিনামা পেশ করা হয় তাতে বাংলার মোট ৭৭,৪৪২ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ৪০,১৩৭ বর্গমাইল দাবি করা হয়। দাবিকৃত এলাকার জনসংখ্যা ছিল অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার ৪৫%, তন্মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ৩২% এবং বাকিরা অমুসলমান। কংগ্রেস যেসব এলাকার দাবি করে সেগুলো হচ্ছে গোটা বর্ধমান বিভাগ, নদীয়া, যশোর ও খুলনা জেলাসমূহের সামান্য অংশ বাদে গোটা প্রেসিডেন্সি বিভাগ, রাজশাহী বিভাগের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, রংপুর জেলা থেকে ডিমলা ও হাতিবান্ধা থানা, দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশ এবং নবাবগঞ্জ মহকুমা বাদে মালদাহ জেলা, ঢাকা বিভাগের বরিশাল জেলা থেকে গৌরনদী, নজিরপুর, স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠি থানাসমূহ, ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমা ও রাজৈর থানা। এসব দাবির যৌক্তিকতা উত্থাপন করা হয়েছিল কিনা তার প্রমাণিত তথ্যাদি আপাত আমাদের হাতে পর্যাপ্ত নয় ।
ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে আসামের রেল-যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস রংপুর জেলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা ভুরুঙ্গামারিও দাবি করে বসে। কংগ্রেস কলকাতা শহর পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি পেশ করে। তাদের দাবির সপক্ষে তারা যুক্তি দেখায় যে-
১৯৪১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী কলকাতা শহরে মুসলমান জনসংখ্যা মাত্র ২৩.৫৯% (মোট ২,১০৮,৮৯১-এর মধ্যে ৪,৯৭,৫৩৫)। কর প্রদানকারী মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১৪.৮% (৬৮,৫৬৭-এর মধ্যে ১০,১৪৯)। কলকাতা শহরের ৮১,১৫৯ টি বাড়ির মধ্যে মুসলমান বাড়ির সংখ্যা মাত্র ৬,৮৬৩ (৮. ৪৫%)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত বেসরকারি সাহায্যের মধ্যে মুসলমানদের দান মাত্র ১% (প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মধ্যে মাত্র ১ লাখ)।
৫. কলকাতার আশপাশে যে ১১৪টি পাটকল আছে সেগুলোর মালিক অমুসলমান ব্যক্তিবর্গ । সুতরাং, সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা বিভক্ত করলে কলকাতা পশ্চিম বাংলারই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর কলকাতা শহরও-এর অধিবাসীদের প্রয়োজনে (রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে, সড়ক ও রেল যোগাযোগ নির্বিঘ্নে রাখতে, প্রভৃতি) মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়া, যশোর জেলাসমূহ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জেলাগুলোকে পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ।
অপরপক্ষে, মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিভাগের বেশিরভাগ অংশ এবং বর্ধমান জেলাভুক্ত হুগলি ও ভাগীরথীর পূর্বাংশ পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করা হয়। মুসলিম লীগের দাবিতে ধরা হয় দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা হওয়া সত্ত্বেও ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে এবং পূর্ববাংলার অর্থনীতির প্রয়োজনে এ জেলাগুলো পূর্ববাংলাভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় ।
১. উত্তর বাংলার অর্থনীতিতে তিস্তা নদী ও-এর শাখানদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলে এ নদীগুলো জলপাইগুড়ি জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত।
২. পূর্ববাংলার রেলপথ সংরক্ষণের একমাত্র উৎস হচ্ছে জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং-এ অবস্থিত পাহাড়ের পাথর ।
৩. পূর্ববাংলার কাঠের চাহিদা মেটানো হতো জলপাইগুড়ি জেলার বনজঙ্গল থেকে সংগৃহীত কাঠ থেকে ।
৪. পূর্ববাংলায় ভবিষ্যতে হাইড্রো-ইলেকট্রিক শক্তি উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলী নদীর অধিকার আবশ্যক। এজন্য পার্বত্য
চট্টগ্রামকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্তির দাবি করা হয়।
মুসলিম লীগ কলকাতা শহর পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর দাবি পেশ করে। মুসলিম লীগ যুক্তি পেশ করে যে- কলকাতা শহরটি গড়ে উঠেছে মূলত পূর্ববাংলার সম্পদ দিয়ে। পৃথিবীর ৮০% পাট পূর্ববাংলায় উৎপাদিত হয় এবং ঐ পাট দিয়েই কলকাতার আশপাশের পাটকল চলে ।
কলকাতা ছিল বাংলার একমাত্র সমুদ্র বন্দর। উক্ত বন্দরে কর্মরত শ্রমিক, কর্মচারী নাবিকরা মূলত পূর্ববাংলার লোক। অতএব, কলকাতা পূর্ব বাংলারই প্রাপ্য।
ক. কমিশনের মৌলিক প্রশ্নাবলি (Basic Questions of the Commission)
তিনি
বুঝতে
এভাবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দাবি দাওয়ার মীমাংসা করা সীমানা কমিশনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পারেন যে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সীমানা চিহ্নিত করা অসম্ভব। তাই তিনি কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নের উদ্ভাবন
করেন; যেমন :
১. বাংলার কোন অংশকে কলকাতা শহর প্রদান করা উচিত? এ শহরকে দ্বিখণ্ডিত করে উভয় অংশকে খুশি করা কি সম্ভব?
সমগ্র কলকাতা কোনো একটি অংশকে প্রদান করার পেছনে নদীয়া কিংবা কুলাট নদী ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত কি-না।
টার্মস অব রেফারেন্সে উল্লিখিত 'সম্প্রদায়গত সংলগ্ন এলাকার' নীতিকে উপেক্ষা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা যশোর ও নদীয়া পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা যথার্থ হবে কি-না।
মালদহ ও দিনাজপুর জেলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কিছু অংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা কি পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে?
দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। তবে জেলাদ্বয়ের মুসলমান জনসংখ্যা অত্যন্ত কম (১৯৪১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী দার্জিলিং-এ মাত্র ২.৪২% ও জলপাইগুড়িতে ২৩.০৮%।) সুতরাং, এ জেলাদ্বয় কোন অংশে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত?
পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলমান জনসংখ্যা মাত্র ৩% হলেও জেলাটি চট্টগ্রাম জেলার অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং, এ জেলাটি কোন ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে?
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসককুল নানাবিধ ফন্দিফিকির করে প্রায় ২০০ বছর টিকিয়ে রেখেছে তাদের শাসন ক্ষমতাকে। আর সবশেষে যখন তাদের বিদায়ের ঘণ্টাই বেজে ওঠে তখন কি এত সহজেই আমাদের ছেড়ে দেবে?
মাউন্টব্যাটেনের ৩ জুন পরিকল্পনায় যদিও ‘সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং এলাকার সংলগ্নতা' (Majority and Contiguity Principles)-এর ভিত্তিতে সীমান চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছিল র‍্যাডক্লিফ উক্ত নীতি এবং মুসলিম লীগ- কংগ্রেস-এর সমঝোতা নীতিকে উপেক্ষা করে নিজের বিচারবুদ্ধিমতো সীমানা চিহ্নিত করেন। জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সীমানা নির্ধারণ করলে অন্তত কয়েক মাস সময়ের প্রয়োজন ছিল। র‍্যাডক্লিফ তার দিল্লির অফিসে বসে টেবিলের ওপর ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মাইলের সীমানা চূড়ান্ত করেন। এ কাজ করতে তিনি মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায় । সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৫ জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার এক জনসভায় উল্লেখ করেন যে, “আমরা ভারত বিভাগে রাজি হওয়ার পূর্বশর্তস্বরূপ কলকাতা শহর যেন ভারতভুক্ত থাকে তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম। আমাদেরকে সে নিশ্চয়তা দেয়া হলে আমরা ভারত বিভক্তিতে সম্মত হই। মাউন্টব্যাটেন যেভাবেই হোক কলকাতা ভারতকে দেবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন । সম্ভবত সেজন্যই তিনি সীমানা কমিশনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য কিংবা জাতিসংঘের মনোনীত প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা সমর্থন করেননি।
যাহোক, র‍্যাডক্লিফের ঘোষণায় কলকাতা পশ্চিম বাংলাভুক্ত করা হয়। তিনি নদীয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬১% মুসলমান) জেলা হওয়া সত্ত্বেও-এর ২/৩ অংশ এলাকা পশ্চিম বাংলাকে দেন। সম্পূর্ণ মুর্শিদাবাদ (৫৬.৬% মুসলমান) পশ্চিম বাংলাভুক্ত করা হয়। মালদহ (৫৭% মুসলমান) থেকে কেবল নবাবগঞ্জ মহকুমা পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়, বাকি অংশ (মালদহের প্রায় ২/৩ অংশ) পশ্চিম বাংলাভুক্ত করা হয়। দিনাজপুরকে দুই অংশে বিভক্ত করে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সৃষ্টি করে তা পশ্চিম বাংলাভুক্ত হয়। আর খুলনা (৪৯.৩৬% মুসলমান) পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। জলপাইগুড়ি জেলার ৩টি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা ও দুটি অমুসলমান গরিষ্ঠ থানা পূর্ববাংলাভুক্ত করা হয়। মুসলমান অধ্যুষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকা ভারতকে প্রদানের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম গ্রহণের ব্যাপারে কংগ্রেসের ততটা আগ্রহ ছিল না।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]