কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাঠামো
Central and Provincial Structure
ভূমিকা
Introduction
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয় এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ শাসনতন্ত্র বহাল থাকে, যা 'পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র' নামে অভিহিত। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবর জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খান পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের পাশাপাশি নিজ হাতে দেশের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র বা সংবিধান ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে কিছু সংশোধনীসহ এ শাসনতন্ত্রই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের বিভক্তি পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এ শাসনতন্ত্র অনুসারে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার কাঠামো নির্ধারিত হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
Features of Pakistan State
ব্রিটিশদের তাড়িয়ে নবগঠিত পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের শতকরা ৮৪.৩ ভাগ আয়তন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের এবং মাত্র ১৫.৭ ভাগ আয়তন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অথচ মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৩.৭ ভাগ লোকের বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ৫৬.৩ ভাগ লোক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলার উচ্চবিত্তরা ছিলেন জমিদারগোষ্ঠী, তাদের বাস ছিল কলকাতায়। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর তারা ভারতে চলে যান এবং তাদের সম্পত্তি ভারতে স্থানান্তর করেন। তাছাড়া ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববাংলায় জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হলে এখানকার মুসলমান জমিদারদের পতন ঘটে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারত বিভক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ছিল একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র। হাজার মাইলের অধিক দূরত্বের মধ্যখানে ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অংশ নিয়ে গঠিত ছিল এ রাষ্ট্র । পাখির বিস্তৃত ডানা সদৃশ্য এমন একটি রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দু'অংশের মধ্যে জলবায়ু, সমাজ কাঠামো, উৎপাদন ব্যবস্থা, জনগণের ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কোনো কিছুতেই মিল ছিল না। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। একমাত্র ধর্ম ও বিদেশি ভাষা ইংরেজি ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তাদের কোনো মৌলিক ঐক্যবন্ধন ছিল না। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলা ও প্রবঞ্চনা শুরু হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি সুস্পষ্ট হবে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল ঔপনিবেশিক, যা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনা ও নির্যাতনের এক করুণ ইতিহাস ।
পাকিস্তানি শাসক চক্র এদেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের মাধ্যমে নিজেদের শোষণ ও শাসন শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। ফলে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদে একই রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে উঠে একটি প্রভুত্বকারী ও শোষক গোষ্ঠী। মূলত উপনিবেশিক শক্তি দেশিয় মূল্যবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসহ স্বকীয়তা ধ্বংস করে নিজেদের শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয় । সর্বোপরি নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক শোষণ অব্যাহত রাখতে গড়ে তোলে জনবিচ্ছিন্ন ক্ষমতাভোগকারী সম্প্রদায় (ভূস্বামী, আমলা ও সামরিক গোষ্ঠী)। পাকিস্তানি শাসনামল তাই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের নেতিবাচক দৃষ্টান্ত ছিল।
যে বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উসকে দিয়েছিল তা হলো একধরনের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, ভাষাভিত্তিক ভিন্নতা নয়। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সমন্বয়হীনতার প্রধান কারণ ছিল দ্বিজাতিতাত্ত্বিক
বিষাক্ত পরিবেশ।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৭২ লক্ষ শরণার্থী ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয় যার মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে আসে ৬৫ লক্ষ। পাকিস্তানের আগত লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাসস্থান ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করা নতুন সরকারের জন্য কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পাশাপাশি যে প্রায় ৩৫ লক্ষ হিন্দু ও শিখ পাকিস্তান ছেড়ে ভারত গমন করেছিল তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার এক কঠিন দায়িত্বও সরকারকে পালন করতে হয়। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির মৌলিক উপাদানে ছিল দুর্বলতা।
আমাদের চলতি পর্যালোচনায় এটা প্রায় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর এর রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে মৌলিক বৈষম্যটা ধর্মীয় ছিল না, ছিল উৎপাদন-অর্থনৈতিক, ভাষা-সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক-সামরিক। তাই এ বিদ্যমান বৈষম্যকে কেন্দ্র করেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের দানা বাঁধে। সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোগত বৈষম্য থেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তথা বাঙালি সমাজ ।
আন্তর্জাতিক উৎপাদন-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক কাঠামোই হচ্ছে অর্থনৈতিক উৎপাদন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আর পেশাগত সুযোগ-সুবিধার যৌক্তিক বিভাজন বা যৌক্তিক বণ্টন ব্যবস্থা। তাই পাকিস্তানের দুই পৃথক অংশের অর্থনৈতিক উৎপাদন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক-সামরিক সুযোগ-সুবিধার বৈষম্যই একদিন ভাষাভিত্তিক পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম দেয় ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমস্যাবলি
Problems of Pakistan State
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাষ্ট্রে ইসলামের ভূমিকা। পাকিস্তান হবে উপমহাদেশের মুসলমানদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ আবাসভূমি, নাকি শরিয়া নিয়ন্ত্রিত একটি ইসলামি রাষ্ট্র, যেখানে অমুসলমানরা থাকবে সংখ্যালঘু নাগরিক হয়ে ? সুতরাং রাষ্ট্রের আদর্শ নির্ধারণে তথা ইসলাম রাষ্ট্র শাসনের ভিত্তি হবে কিনা এ ব্যাপারে স্পষ্ট মতভেদ ছিল। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের সমস্যা। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় (অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন) নাকি এককেন্দ্রিক (ক্ষমতা ভাগাভাগি না করে কেন্দ্রের হাতে ন্যাস্ত), তা স্থির করা। পাকিস্তানের জন্য একটি যুগোপযোগী সংবিধান রচনা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে কারণে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে দীর্ঘ ৯ বছর সময় লেগে যায়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? উর্দু না বাংলা? এ প্রশ্নের সমাধানে পাকিস্তানি উদ্যোগ, রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে। তাছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকে বাঙালি বনাম অবাঙালি বা পশ্চিম পাকিস্তানি বনাম পূর্ব পাকিস্তানি দ্বন্দ্ব প্রধান হয়ে দেখা দেয়। আর একে কেন্দ্র করেই পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছিল ।
প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দুটি অংশের হাজার মাইলের ব্যবধান ছাড়াও যে নৃতাত্ত্বিক, ভূ-রাজনৈতিক, ভাষা ও সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্যের কারণে পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে বাঙালির ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মোহভঙ্গ ঘটতে থাকে এবং বাঙালি নতুন জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। পাকিস্তানের দুই অংশের সম্পর্ককে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন,-এর বিরুদ্ধে বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদমুখর হয়েছে। যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান যথার্থই বলেছেন যে, “পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি জাতিই প্রথম সাফল্যজনক মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয়।” তাছাড়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র পায়। কিন্তু রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এ অবস্থা পাকিস্তানের গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাঙালিদের বিপুল ভোটদান ও সর্বাত্মক সমর্থন ব্যতীত পাকিস্তান আদৌ প্রতিষ্ঠিত হতো কিনা সন্দেহ। অথচ সে রাষ্ট্রে সর্বক্ষেত্রে বাঙালিরা ছিল অধস্তন। তাদের দৃষ্টিতে, বাঙালি মুসলমানরা ছিল নীচু জাতের।
অপরাপর পাকিস্তান থেকে পালাচ্ছিল। প্রায় ১০ লক্ষ মুসলমান ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে পর্ববাংলায় প্রবেশ করে। পাঞ্জাব ও পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ লেগেই ছিল। এতে অন্যূন ২ লক্ষ ৫০ হাজার নিহত এবং ১ কোটি ২০ লক্ষ থেকে ২ কোটি ৪০ লক্ষ লোক উদ্বাস্ত হয়েছিল।
পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর এবং উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল না। কলকাতা কিংবা দিল্লির মতো কোনো ব্যবসাকেন্দ্র কিংবা শিল্পকারখানাও পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত কাশ্মীর সংঘর্ষের সূত্র ধরে ভারত তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১০০০ কোটি টাকার সম্পদ পাকিস্তানকে দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। পাকিস্তানের প্রাপ্য সামরিক ও বেসামরিক সরঞ্জামাদির অংশ দিতেও সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে ।
এমনি পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মধ্যে সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রয়োজনীয়তা ছিল। পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায় দুই অংশের জনগণের সমানুপাতিক অংশগ্রহণ। উভয় অংশের সমস্যার সমাধান সমান দৃষ্টিতে করা এবং উভয় অংশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা হওয়া উচিত ছিল বৈষম্যহীনভাবে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দুই অংশের জনগণের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার আবশ্যকতা ছিল ।
ড. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর তাঁর 'বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-৫৮' শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, 'একমাত্র ধর্মীয় ঐক্য ছাড়া পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে কোনো ক্ষেত্রেই মিল ছিল না।'
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাঠামো
Central and Provincial Structure
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পর সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটি-এর পূর্ব ও পশ্চিম অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মোট আয়তনের শতকরা ৮৪.৩ ভাগ ভূখণ্ড ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের এবং ১৫.৭ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। এবং সমগ্র পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৩.৭ ভাগ বাস করত পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ৫৬.৩ ভাগ লোক বাস করত পূর্ব পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ছিল বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ছিল মূলত উর্দু। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ৫টি প্রদেশ, ৫টি দেশীয় রাজ্য এবং কিছু উপজাতি এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল।
পর্ব পাকিস্তান
পশ্চিম পাকিস্তান
[৪টি প্রদেশ : পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্থান প্রদেশ।
৫টি দেশীয় রাজ্য : (উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রাজ্য, খয়েরপুর রাজ্য, ভাওয়ালপুর রাজ্য, বেলুচিস্থান রাজ্য ও জুনাগড় রাজ্য) এবং কিছু উপজাতি এলাকা]
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ৭ জুলাই মারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে সকল প্রদেশের নেতাগণ সংবিধান সম্পর্কে একটি চুক্তি সম্পাদন করে যা মারি চুক্তি নামে পরিচিত।
উক্ত চুক্তির বিধান ছিল নিম্নরূপ :
১. পাকিস্তানের দুটি প্রদেশ থাকবে, যথা : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান ।
পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করে একটি প্রদেশ গঠন করা হবে।
৩. উভয় প্রদেশকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে।
৪. উভয় প্রদেশের সকল বিষয়ে সাম্যনীতি (Principle of parity) কার্যকরী করা হবে ।
৫. যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হবে।
৬. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।
উল্লিখিত মারি চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করে পশ্চিম পাকিস্তান নামকরণ করা হয়। এবং পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর করাচি শহরকে রাজধানী করা হয়। পরে ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়।
হাজার মাইলের ব্যবধানে পাকিস্তানের দুই অংশের আর্থ-সামাজিক আর উৎপাদন-অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই বিবেচনায় আসে পাকিস্তানের পূর্বাংশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের সমৃদ্ধির বিষয়টি। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক ও কৃষিজাত সম্পদই ছিল পাকিস্তানের উৎপাদন-অর্থনৈতিক উন্নয়ন- সমৃদ্ধির মূলভিত্তি । পূর্ব পাকিস্তানের কৃষিজ কাঁচামালে পরিচালিত হতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প-কারখানা যেভাবে ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতার শিল্প-কারখানা পরিচালিত হতো পূর্ববঙ্গের কৃষিজ কাঁচামালে। তাই একথা বলতেই হবে যে, ব্রিটিশ ও ব্রিটিশপূর্ব কিংবা পাকিস্তানি শাসনামল তথা সব শাসনামলেই পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে অন্য অংশের জনগণের কল্যাণে। একইভাবে চাকরি-ব্যবসায় সর্বদিকের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এখানকার জনগণ বঞ্চিত হয়েছে নিজেদের প্রাপ্য ন্যায়সংগত অধিকার থেকে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে পাকিস্তান ছিল এক অস্বাভাবিক রাষ্ট্র।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের দুই অংশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো (Socio-Economic Structure of Two Parts of Pakistan in 1947) : ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। জন্মক্ষণে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ ‘পূর্ববাংলা' নামে অভিহিত হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর মারি চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করা হয় এবং একে ‘পশ্চিম পাকিস্তান' নামকরণ করে গণপরিষদে একটি বিল পাস হয়। মারি চুক্তির সময় উভয় অংশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ মর্মে সমঝোতা হয় যে, এরপর থেকে 'পূর্ববাংলার' নাম পরিবর্তন করে 'পূর্ব পাকিস্তান' হবে। জন্মক্ষণে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে ৪টি প্রদেশ (পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান প্রদেশ) এবং কয়েকটি দেশীয় রাজ্য; যেমন-খয়েরপুর রাজ্য, ভাওয়ালপুর রাজ্য, বেলুচিস্তান রাজ্য, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রাজ্য, জনাগড় রাজ্য এবং কিছু উপজাতি এলাকা ছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের সবগুলো প্রদেশ, দেশিয় রাজ্য এবং উপজাতীয় এলাকাসমূহ এক ইউনিটে এনে একটি প্রদেশ করে তার নামকরণ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান ।
আয়তন (Area) : সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের শতকরা ৮৪.৩ ভাগ আয়তন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের এবং মাত্র শতকরা ১৫.৭ ভাগ আয়তন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। জম্মু ও কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ যে আজাদ কাশ্মীর নামে পাকিস্তানের সাথে আছে, তা পশ্চিম পাকিস্তানের আয়তনের মধ্যে ধরা হয়নি।
জনসংখ্যা (Population) : পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬.৩ ভাগ ছিল পূর্ববাংলার বা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী আর শতকরা ৪৩.৭ নাগরিকের বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ।
বিত্তবানদের অবস্থান (Situation of Wealthy / Richmen) : ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববাংলার উচ্চবিত্তরা ছিলেন প্রধানত কলকাতায় বসবাসকারী হিন্দু জমিদারগোষ্ঠী। তবে তাদের জমিদারি ছিল পূর্ববাংলায়। এ অঞ্চলেও তাদের ঘরবাড়ি ও বিনিয়োগ ছিল। পূর্ববাংলায় কার্যত উচ্চবিত্তের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এছাড়া ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববাংলায় জমিদারির প্রথা উচ্ছেদের ফলে এখানকার ছোট ছোট মুসলমান জমিদারদের পতন ঘটে। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় সেখানকার বিত্তবান গোষ্ঠী সামন্তবাদী বড় জমিদার শ্রেণি দ্বারা গঠিত ছিল। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল প্রায় অনুপস্থিত।
রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি (Basement of Political Support) : জন্মলগ্নে পূর্ববাংলার রাজনীতি ছিল মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নিয়ন্ত্রণে এবং গ্রামীণ শ্রমজীবী, কৃষক, মেহনতী মানুষ ছিল তাদের সমর্থন ও সাফল্যের মূলভিত্তি। পূর্ববাংলায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কোনো দিনই তেমন প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়নি। কেননা, এ অঞ্চলের কলকাতামুখী হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের কারণে কোনো দিনই তেমন জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হননি এবং কার্যত তারাই ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিস্বরূপ।
অর্থনৈতিক কাঠামো (Economic Structure) : জন্মলগ্নে পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পকারখানা পায়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে পূর্ববাংলা পাটচাষের জন্য বিখ্যাত থাকলেও সকল পাটকল গড়ে ওঠে কলকাতার আশপাশে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের লগ্নে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধানের মাত্রা ছিল খুবই কম। চা উৎপাদন এবং বস্ত্র উৎপাদনে পূর্ব পাকিস্তান সামান্য এগিয়ে ছিল, যদিও চিনি এবং ধাতব দ্রব্যের উৎপাদন ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বেশি সুবিধা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সেচ পরিকল্পনা ছিল উন্নততর, তবে ব্যাংক ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের সুযোগ ছিল সামান্য বেশি। মোটের উপর, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের উভয় অংশ অর্থনৈতিক দিক থেকে মোটামুটিভাবে এক পর্যায়ে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের অবশ্য মাথাপিছু আয় ছিল সামান্য বেশি। যেসব তথ্য প্রমাণ রয়েছে তাতে দেখা যায়, ভারত বিভাগের সময় পাকিস্তানের দুই অংশ যে অর্থনীতির উত্তরাধিকারী হয় তাতে তাদের বিকাশের স্তরে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বৈষম্য ছিল না। উভয় অঞ্চলের শিল্প ভিত্তিই ছিল উপেক্ষণীয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থার সুবিধা ও বিদ্যুৎ ইত্যাদি থেকে একটা উন্নততর অবকাঠামো লাভ করে। উভয় অংশের জিডিপি প্রায় সমানই ছিল।
জন প্রশাসন (Public Administration) : পূর্ববাংলার প্রশাসনে হিন্দুদের আধিক্য ছিল। দেশ বিভাগের সময়ে এবং পরে পূর্ববাংলা থেকে বেশিরভাগ হিন্দু ডাক্তার, উকিল-মোক্তার, সরকারি কলেজ ও স্কুলের শিক্ষক, বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ভারতে গমন করলে পূর্ববাংলায় দক্ষ প্রশাসন ও পেশাজীবী শ্রেণির শূন্যতা দেখা যায়। ভারত থেকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের চাকরিজীবী শরণার্থীরা এসে এ শূন্যস্থান পূরণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের চিত্র ছিল ভিন্ন। তারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এক সুশৃঙ্খল আমলা ব্যবস্থা লাভ করে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে বাঙালি মুসলমান ছিল না বিধায় জন্মলগ্নে পাক সিভিল সার্ভিসেও বাঙালি অফিসার ছিল না বললেই চলে ।
বিশাল ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম দুই প্রান্তে ১,২০০ মাইলের ব্যবধানে দুই ভিন্ন ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। জন্মলগ্নে-এর পূর্ব অংশ ‘পূর্ববাংলা' নামে অভিহিত হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে-এর নাম পরিবর্তিত হয়ে নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান ।
কেন্দ্রীয় সরকার
Central Government
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান সংসদ বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংসদীয় সরকারের রীতি অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল (রাষ্ট্রপ্রধান) নামমাত্র প্রতীকী প্রধানের ভূমিকায় থাকেন। বাস্তবে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল।
পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভা
ক্র. নং | নাম | পদবী |
---|---|---|
1 | মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ | গভর্নর জেনারেল |
২ | লিয়াকত আলী খান | প্রধানমন্ত্রী |
3 | আই আই চুন্দ্রিগড় | বাণিজ্য ও শিল্প |
4 | গোলাম মুহাম্মদ | অর্থ |
5 | সর্দার আবদুর রব নিশতার | যোগাযোগ |
6 | রাজা আলী খান | খাদ্য ও কৃষি |
7 | যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল | আইন, শ্রম ও পূর্ত |
8 | ফজলুর রহমান | স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা |
9 | স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ | পররাষ্ট্র |
10 | মৌলভী তমিজউদ্দিন খান | স্পিকার |
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত