স্বদেশী আন্দোলন কি? স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।

ভূমিকা : ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে দেখা যায় যে, ভারতীয় জনসাধারণ আন্তরিকভাবে কোন দিনই ব্রিটিশ শাসনকে গ্রহণ করেন নি। তাই যখন ভারতীয়দের স্বার্থে সামান্যতম আঘাত লাগে তখনই তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এমনি ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, লর্ড কার্জনের সময় ব্রিটিশ সরকার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে একাংশের (মুসলমানদের) প্রাণের দাবি, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের (হিন্দু) কাছে ছিল বিরাট আঘাত। এ বঙ্গভঙ্গকে তারা জাতীয়তাবাদে আঘাত বলে প্রচার চালান। যার জন্য সংঘটিত হয় স্বদেশী আন্দোলন।
স্বদেশী আন্দোলন : ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাত দেখিয়ে বঙ্গভঙ্গ করার স্বপক্ষে যুক্তি দাড় করান। সরকারের যুক্তিকে নস্যাৎ করে বাঙালি যে বক্তব্য তুলে ধরে এর সারমর্ম হল বাংলার লোকসংখ্যার বৃদ্ধি যদি প্রশাসনিক অসুবিধার কারণ হয় তাহলে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত না করে হিন্দি ও ওড়িয়াভাষী অঞ্চলকে বাদ দিলেই সমস্যার সমাধান হয়। আসলে বাংলা ব্যবচ্ছেদের মধ্যে কার্জনের সরকার যে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় তা দেশবাসীর কাছে
স্পষ্ট হয়ে উঠে। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অসংখ্য প্রতিবাদ সভা, মিটিং বা মিছিলের আয়োজন করা হলে সরকারের জিদ আরো বেড়ে যায়। তার প্রমাণ ১৯০৩ সালের পর ১৯০৫ সালে যে নতুন প্রস্তাব পেশ করা হয় তা পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষতিকারক ছিল। এমতাবস্থায় সকলের কাছে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সরকারের কাছে আবেদন, নিবেদন, প্রস্তাব গ্রহণ, প্রতিবাদ জ্ঞাপন কোন কিছুরই মূল্য নেই। তাই চরমপন্থিদের তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের যে ঔদ্ধত্য এবং বাঙালিদের দুর্বল করার যে হীন ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেয়েছিল তাতে একথা বাঙালি মাত্রই উপলব্ধি করে যে, নিছক প্রতিবাদের দ্বারা সরকারের মনকে টলানো যাবে না। এর জন্য যে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের প্রয়োজন সে কথা সকলে উপলব্ধি করতে থাকে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ শাসনের অর্থনৈতিক আওতায় দেশবাসীর যে সর্বনাশ সাধিত হয়েছিল তাতে দেশ জুড়ে অসন্তোষ ক্রমশ যে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পথ সুগম করেছিল এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। উপরন্তু বঙ্গভঙ্গ ঐক্যবদ্ধ বাংলার মানুষের মধ্যে বিভেদের যে বীজ রোপণ করেছিল তাতে আন্দোলন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন। বয়কট ছিল নেতিবাচক এবং স্বদেশী ছিল ইতিবাচক আন্দোলন। বয়কট ও স্বদেশী এ দুই কর্মপন্থা অবলম্বন করে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তাই সামগ্রিকভাবে 'স্বদেশী আন্দোলন' নামে অভিহিত
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আছে ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন নিবেদনের অসারতা: বিদেশী শাসকদের কাছে আর অশ্রুসিক্ত নয়নে আবেদন নয়। নবজাগ্রত এ দেশাত্মবোধ ও দেশ ভক্তি মানুষের মনে এক নতুন চেতনার সঞ্চার করেছিল। বিপিনচন্দ্র এ নতুন চেতনাকে এ ভাষায় ব্যক্ত করেন (১ অক্টোবর ১৯০৫ ) যে, ইংরেজদের উপর নির্ভরশীলতার পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গির এখন পরিবর্তন ঘটেছে। পুরাতন ধারণায় সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা আদায় করাই ছিল রীতি। আর এখনকার নতুন পদ্ধতি হল আত্মশক্তির অনুশীলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা। নিম্নে স্বদেশী আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হল : ১. স্বদেশীর ঘোষণা : আনুষ্ঠানিকভাবে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের দিন ধার্য করেন ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর সে বছরের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলের এক সভায় বাংলার তদানীন্তন নেতৃবর্গ স্বদেশী আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেন। ঐ একই সভায় বয়কট বা বর্জন নীতিও ঘোষণা করা হয়। যদিও এ ব্যাপারে কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঞ্জীবনী পত্রিকা ছিল অগ্রণী। জুলাই মাসে ঐ পত্রিকা বর্জনের ডাক দিয়েছিল। ড. সুমিত সরকার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, স্বদেশী আন্দোলন পরে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়।
২. স্বদেশীর তিনটি ধারা : স্বদেশী আন্দোলনের তিনটি ধারা ছিল। যথা : গঠনমূলক স্বদেশী, বয়কট বা বর্জন এবং জাতীয় শিক্ষা। গঠনমূলক স্বদেশী বলতে বুঝায় আবেদন নিবেদনের ভিক্ষুক নীতির পরিবর্তে আত্মশক্তির জাগরণ এবং আত্মনির্ভরশীলতার অনুশীলন। বয়কট বা বর্জন নীতি হল এমন একটি অস্ত্র যা ইংল্যান্ডের শিল্পপতিদের আঘাত করবে। ভারতে বিলাতি দ্রব্যের বর্জনকে নীতি হিসেবে গ্রহণ এবং তাকে কার্যকর করলে অর্থনৈতিক চাপ বিলাতের ব্যবসায়ীরা বিশেষত ম্যানচেস্টারের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ইংল্যান্ডের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে উদ্যোগী হবে। আর জাতীয় বলতে বুঝায় শিক্ষাদীক্ষাকে স্বদেশীয় আওতায় আনয়ন করা তথা বিদেশী শিক্ষাকে বর্জন করে দেশীয় পদ্ধতিতে আধুনিক বিদ্যার অনুশীলন ।
৩. শিল্পের পুনরু ীবন : স্বদেশীর ধারণা হতে শুরু হয় কুটির বা মাঝারি শিল্পের বিকাশ। বাংলার তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, বর্ধমান ও বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাটের তাঁতিরা স্বদেশী আমলে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সমর্থ হয়। তবে সাধারণভাবে সস্তা দামের বিলাতি মিলের কাপড় সহজলভ্য থাকায় এ শিল্পের জোয়ার প্লাবন সৃষ্টি করে নি। তাঁতশিল্প ছাড়া হোসিয়ারি, চীনামাটি, সাবান, দিয়াশলাই প্রভৃতি শিল্পের সূচনা হয়। ড. সুমিত সরকারের মতে, স্বদেশী শিল্প আসলে ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার মাত্র। এসব শিল্পোদ্যোগ মূলধনের অভাব এবং অভিজ্ঞতার অভাবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে নি। এদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভবপরও ছিল না। তবে অমিত ভট্টাচার্য তাঁর গবেষণা গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, স্বদেশী শিল্প আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক নতুন সামাজিক শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করেছিল, যাদের তিনি স্বদেশী বুর্জোয়া বলে অভিহিত করেছেন।
৪. বর্জন নীতি : বয়কট বা বর্জন নীতি বলতে বুঝায় মূলত বিদেশী দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। এছাড়া বর্জনের দ্বারা বিলাতি ব্যবসায়ীরা যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে তাতে তারা ইংরেজ সরকারের উপর চাপ দেবে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য। বর্জন নীতি বিলাতি কাপড়ের বৃহৎ উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছিল। দোকানে দোকানে পিকেটিং করে বিলাতি কাপড় ক্রয়ের বিরুদ্ধে জনমত জাগ্রত করার চেষ্টা চলছিল। তবে বয়কট নিয়ে চরমপন্থি ও নরমপন্থিদের মধ্যে
পৃথক পৃথক ধারণা ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বা গোখলের মত নরমপন্থিরা একে ব্যবহার করতে চান ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু চরমপন্থি তিলক বা অরবিন্দ বয়কট বলতে বুঝাতেন, ইংরেজ শাসনের সবদিক, সবকিছুকে বর্জন করা বিলাতি বস্ত্রই হোক, আর ইংরেজি শিক্ষা। ইংরেজ শাসনের সাথে কোন সমঝোতা নয়। বিচারব্যবস্থা, আইন সবকিছু বর্জন করার কথা অরবিন্দও বলেছিলেন বয়কট প্রসঙ্গে।
৫. জাতীয় শিক্ষা : স্বদেশী আন্দোলনের তৃতীয় অঙ্গ ছিল জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন। ইংরেজি স্কুল কলেজের পরিবর্তে জাতীয় প্রতিষ্ঠানে নতুন পাঠ্যসূচি অনুসারে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ইতোমধ্যে আবার স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের উপর সরকারের কুনজর পড়েছিল। স্বদেশী আন্দোলন করার অপরাধে তাদের স্কুল কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হতে থাকে। কালাইল সার্কুলার জারি করে সরকার ছাত্রদের সভাসমিতিতে যোগদান নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করলে শচীন্দ্রনাথ বসু মহাশয় 'অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি' অর্থাৎ, কালাইল সার্কুলার বিরোধী সমিতি গঠন করে সরকারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের উৎসাহিত করতে থাকেন। এছাড়া সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অক্রান্ত প্রচেষ্টায় ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। স্থাপিত হয় বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এবং বোলে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। বাংলার উদ্যোগে যে জাতীয় শিক্ষার প্রবর্তন করা হয় তা ক্রমে ভারতের অপরাপর স্থানেও বিস্তার লাভ করেছিল।
৬. স্বদেশী আন্দোলনের বিস্তার : স্বদেশী আন্দোলনের উৎস বঙ্গভঙ্গ হলেও এটা কেবল বাঙালির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। এ আন্দোলন কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। স্বদেশী আন্দোলন বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে এক সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের মানুষের মধ্যে এ আন্দোলন বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে পুনাতে স্বদেশী আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া স্বদেশী আন্দোলন কোন বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে যে সীমিত ছিল না তার প্রমাণ হল এ যে, স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্ররা যেমন অংশগ্রহণ করেছিল, তেমনিভাবে নারীসমাজ, শ্রমিক সকলে কোন না কোনভাবে এতে অংশগ্রহণ করেছিল। এছাড়া গোখলের ভাষণ থেকে বুঝা যায় যে, এ আন্দোলন কতটা ব্যাপকতা লাভ করেছিল। তিনি বলেন যে, সকল শ্রেণীর মানুষ হিন্দু-মুসলিম, উঁচুনিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। স্কুল কলেজের ছাত্ররা যেমন বিলাতি পণ্যের দোকানে পিকেটিং করেছিল, তেমনি নারীরা আবার পুরুষদের সাথে সমানতালে স্বদেশী ব্রত পালন করেছিল। ইংরেজ সরকার মুসলিমদের উস্কানি দেওয়া সত্ত্বেও বহু মুসলিম, হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। স্বদেশী আন্দোলন জনমত গঠন করার জন্য জেলায় জেলায় সমিতি স্থাপন করা হয়েছিল। এভাবে স্বদেশী আন্দোলন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এক ব্যাপকতর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল।
স্বদেশী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণসমূহ : স্বদেশী আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে ব্যাপক আকার ধারণ করলেও সফল হতে পারে নি। নিম্নে স্বদেশী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা করা হল : ১. সরকারের দমন নীতি : এ আন্দোলন ব্যর্থতার অন্যতম কারণ সরকারের দমন নীতি। সরকার এ আন্দোলনের বৈপ্লবিক সম্ভাবনা বুঝতে পেরে প্রচণ্ড দমন নীতির আশ্রয় নেয়। জনসভা, শোভাযাত্রা ও সংবাদপত্রের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যেসব ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয় তাদেরকে স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কা করা হয়। এভাবে সরকারি দমন নীতির ফলে আন্দোলন ক্রমেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
২. কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ভাঙন এ আন্দোলনকে বিশেষভাবে দুর্বল করেছিল। ১৯০৭ সালে কংগ্রেসের ভাঙনের পর অসংখ্য নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাকে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। বালগঙ্গাধর তিলককে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অজিত সিং ও লাজপত রায়কে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। সরকারি দমন নীতির কারণেই বাংলার বিপীনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। প্রায় এক আঘাতেই সমগ্র আন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করে দেওয়া হয়।
৩. হিন্দু ও মুসলিম দ্বন্দ্ব : এ আন্দোলন ব্যর্থতার অপর কারণ হল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবগতি। আন্দোলনের প্রথমদিকে কিছু মুসলমান সামিল হলেও অধিকাংশ মুসলমান স্বদেশী আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে বাংলার মুসলমানরা স্বাগত জানায়। কারণ, বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানরা তাদের সার্বিক উন্নতি ও ঢাকার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পায়। এছাড়া মুসলমানদের সমর্থন না থাকায় গণভিত্তিক আন্দোলনের পরিধি সীমিত হয়ে যায়। স্বদেশী আন্দোলন উচ্চবিত্ত হিন্দু আন্দোলনের চরিত্র গ্রহণ করে।
৪. সংগঠনের অভাব : স্বদেশী আন্দোলন পরিচালনার জন্য কোন কার্যকর সংগঠন ছিল না। এ আন্দোলন কর্মসূচির দিক থেকে পরোক্ষ প্রতিরোধ, অহিংসা, অসহযোগিতা, সামাজিক সংস্কার, গঠনমূলক কাজ প্রভৃতি গান্ধীবাদী কৌশলের প্রায় সবটাই কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু এ আন্দোলন এসব কৌশলকে একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত সুশৃঙ্খল রূপ দিতে ব্যর্থ হয়। বাংলার বাইরে মহারাষ্ট্র ছাড়া বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নি।
৫. সমাজের সকল শ্রেণীর সমর্থনের অভাব : ড. সুমিত সরকারের মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলন দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়কে আন্দোলনে সামিল করতে পারে নি। কারণ, এ আন্দোলনে 'সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি' ছিল না। ফলে কৃষকরা এ আন্দোলনের সাথে আত্মিক যোগ খুঁজে পায় নি। কৃষিভিত্তিক কর্মসুচির অভাবের ফলেই স্বদেশী আন্দোলন প্রকৃত গণআন্দোলনের চরিত্র গ্রহণ করে নি। মার্কসবাদীদের মতে, আন্দোলনটি ছিল এলিটিস্ট।
স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য ঃ স্বদেশী আন্দোলন ব্যর্থ না হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যথা : ১. রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি : ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে এ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ আন্দোলনের ফলে ভারতীয় জনগণের কাছে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ইংরেজ ও ভারতবাসীর স্বার্থ কখনই এক নয়। ইংরেজ সরকার দ্বারা ভারতবাসীর মঙ্গল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং ভারতবাসীর নিজের উন্নতি নিজেই। করতে হবে।
২. সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি : সরকারি দমননীতির কারণে স্বদেশী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দেয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে যায়। বাংলায় বহু গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে। এ সমিতিগুলোর মধ্যে অনুশীলন ও যুগান্তর গোষ্ঠীর নাম উল্লেখযোগ্য।
৩. ভারতীয় শিল্পের উন্নতি : এ আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ ব্যবসায় বাণিজ্যের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ভারতে ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বিশেষ করে কার্পাস ও রেশমজাত সামগ্রীর আমদানি ক্ষুণ্ণ হয়। তবে এ আন্দোলনের ফলে ভারতীয় শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। ভারতীয় সুতি বস্ত্রের চাহিদা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তাঁত শিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। বিদেশী পণ্যের উপর নির্ভরতা ক্রমশ কমতে থাকে এবং ভারতীয় অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটে।
৪. বঙ্গভঙ্গ রদ : স্বদেশী আন্দোলনের ফলে একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে। কারণ, বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের জন্য বিরাট অপমানস্বরূপ। তাই ১৯১১ সালে বঙ্গবঙ্গ রদ হয় এবং দুই বাংলা আবার একত্রিত হয়।
৫. সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নতি : স্বদেশী আন্দোলন কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নয়, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক নতুন উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ১৯০৫ সালকে বাংলার সুবর্ণ যুগের প্রভাত বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য স্বদেশী গানগুলো এ যুগেই রচিত হয়। বর্তমানে যা আমাদের জাতীয় সংগীত তা এ সময়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। রজনীকান্ত সেন, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আবু মুহাম্মদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রভৃতি কবি ও সাহিত্যিকরা সৃষ্টিশীল কাব্য ও সাহিত্য রচনা করে দেশপ্রেমের অমর কীর্তি রেখে গেছেন। এছাড়া এ সময় অসংখ্য কবি জেলায় জেলায় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে এবং গান লিখে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেরণা যুগিয়েছিল।
৬. শিল্পের বিকাশ : সাহিত্য, কাব্য ও সঙ্গীতের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে স্বদেশী যুগ শিল্পের ক্ষেত্রেও স্থায়ী কীর্তি রেখে গেছেন। এ যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রাচ্যাভিমানী ও কাকুরা, নিবেদিতা ও হ্যাডেলের প্রভাবে ভারতের শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেন। অবনীন্দ্রনাথ এদের প্রভাবে ইউরোপীয় শৈলী বর্জন করে ভারতীয় শৈলীর সাহায্যে চিত্র আঁকেন। এছাড়া অন্যান্য শিল্পেরও বিকাশ ঘটেছিল।
উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, স্বদেশী আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। এ সংগ্রামে ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের নৈতিক সমর্থন ছিল। এছাড়া এ আন্দোলনে সমাজের সকল স্তরের মানুষসহ ছাত্র-শিক্ষক-নারী সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে এ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার মত যে কৌশলের দরকার ছিল তা ছিল না বিধায় এটা ব্যর্থ হয়। তবে ব্যর্থ হলেও জাতীয় চেতনাবোধ জাগাতে অনেকটা প্রয়োজনীয় ছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]