১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মধ্যে কোনটি উন্নততর? আলোচনা কর ।

ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দলিল এবং পূর্ববর্তী সবগুলো ভারতীয় কাউন্সিল ও সংস্কারমূলক আইন অপেক্ষা উন্নততর। ১৯৬১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত যে কয়টি আইন পাস করা হয়েছে তন্মধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, এ আইন ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাদি সমাধানের ক্ষেত্রে এক দিকনির্দেশনাস্বরূপ। এ আইন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা বহুগুণ উন্নত ছিল। নিম্নের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে।
১. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ঃ ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ব্রিটিশ ভারতে এককেন্দ্রিক সরকার প্রবর্তন করে। ফলে সরকারের সমুদয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। পক্ষান্তরে, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এ আইন ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশসমূহ এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে একটা সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করে। ফলে আইন প্রণয়ন ও শাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। এতে করে একক ও কেন্দ্রীভূত শাসনের অবসান ঘটে। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার কিছুটা আভাস দেওয়া হয়েছিল মাত্র; কিন্তু তা কোন রকম বাস্তব রূপ লাভ করে নি। ১৯৩৫ সালের আইনে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
২. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন কোন প্রকার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে নি। প্রাদেশিক গভর্নরগণ শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরূপে কাজ করতেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ফলে প্রদেশগুলো সুনির্ধারিত ক্ষমতা লাভ করে এবং প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তিত হয়। প্রাদেশিক সরকার ও আইন পরিষদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ সীমিত করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নর ও মন্ত্রিপরিষদকে প্রাদেশিক আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়। ১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে প্রাদেশিক গভর্নরগণ ব্রিটিশ রাজ্যের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি লাভ করে ।
৩. কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন প্রদেশে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল কিন্তু তা সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সক্ষম হয় নি। বরং বলা চলে যে, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এ অবস্থা অবলোকন করে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে প্রদেশে দ্বৈতশাসন রহিত করে কেন্দ্রে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। প্রশাসন ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনয়ন করাই ছিল এর লক্ষ্য। ৪. দায়িত্বশীল সরকা ব্যবস্থা : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তন করা হয়। দায়িত্বশীল শাসনের ক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। কিন্তু এ আইন কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। কিন্তু ১৯৩৫ সালের আইন দ্বারা কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকারের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিগণ আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন। আইসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিগণ পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকতেন। ১৯১৯ সালের আইনের অধীনে এরূপ দায়িত্বশীলতার কোন ব্যবস্থা ছিল না। পক্ষান্তরে, ১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে শুধু কেন্দ্রেই নয় প্রদেশগুলোতেও দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তনের ব্যবস্থা গৃহীত হয় যদিও তা যথাযথভাবে কার্যকর করা হয় নি।
৫. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনপরিষদ : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে প্রাদেশিক আইনসভা এক কক্ষের স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। এ স্বেচ্ছাচারিতা রোধকল্পে ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে অধিকাংশ প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা হয়। এতে প্রাদেশিক আইনপরিষদগুলো এক কক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত হয়।
৬. শাসন বিষয়সমূহের বণ্টন নীতি : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সরকারি বিষয়গুলোকে দু'ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। যথা : কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়সমূহ এবং প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত বিষয়সমূহ। সরকারের কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আংশিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পক্ষান্তরে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সরকারি বিষয়গুলোকে তিনটি বিভিন্ন তালিকায় বিভক্ত করা হয়; যেমন- কেন্দ্রীয় তালিকা, প্রাদেশিক তালিকা ও যুগ্ম তালিকা। কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক, প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক এবং যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক সম্মিলিতভাবে শাসিত হবে বলে নির্ধারণ করা হয়। এভাবে সরকারের বিষয়গুলোকে তিনটি তালিকায় বিভক্ত করে তিনটি ভিন্ন উপায়ে তাদের শাসন করার ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে ১৯১৯ সালের আইন অপেক্ষা উন্নততর ছিল । ৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত প্রতিষ্ঠার কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৫ সালের আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করাই ছিল এ আদালতের প্রধান কাজ। কিন্তু ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলের বিচার কমিটিই ছিল আপিলের চূড়ান্ত আদালত ৷
৮. ভোটাধিকার বৃদ্ধি ঃ ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে জনগণের ভোটাধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু ১৯৩৫ সালের আইন দ্বারা ভোটাধিকার আরও প্রশস্ত ও বিস্তৃত করা হয়। ফলে ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। প্রশাসনব্যবস্থায় জনগণ পূর্বের চেয়ে অধিক পরিমাণে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।
৯. উপদেষ্টা সংস্থা ঃ ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতেন। প্রয়োজনবোধে তিনি প্রাদেশিক শাসনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটের ঐতিহাসিক কাউন্সিলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে। এর স্থলে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন একটা উপদেষ্টা সংস্থা গঠন করে।
তুলনামূলক আলোচনার মূল্যায়ন : ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের তুলনামূলক আলোচনা হতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯১৯ সালের আইন ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে এদেশবাসীকে জাতীয় প্রশাসন পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়ার যে ব্যবস্থা করে তাই ১৯৩৫ সালের আইন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা যথেষ্ট উন্নত ছিল। যদিও এ আইন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এ আইনের ফেডারেল অংশটুকু ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দ কর্তৃক যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে ভারতে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা কোনদিনই কার্যকর হয় নি। বিশেষ করে গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরের হাতে বিশেষ ক্ষমতা প্রদানের ফলে কেন্দ্র বা প্রদেশ কোন ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় নি।
উপসংহার : এত সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতি ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে ১৯৩৫ সালের আইনের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না। এ আইন ১৯৩৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্থাৎ, পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতে প্রবর্তিত ছিল। বস্তুত, এ আইনের বহু ধারা পরবর্তীকালে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে গৃহীত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]