. পাকিস্তান আমলে কিভাবে বাঙালিদেরকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষণ করা হতো তা আলোচনা কর। (How was the Bangalees Exploited in the Economic Sector in Pakistan Regime.)

অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য Economic, Social and Cultural Disparity
ঐতিহাসিকভাবে এটা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তান আন্দোলন ও বাস্তবায়নে পূর্ববাংলার মানুষের অবদান অপরিসীম। মুসলিম লীগের সৃষ্ট ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার মারাত্মক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে বাঙালি মুসলমান সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র। একমাত্র ধর্মীয় ঐক্য ছাড়া পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে কোনো ক্ষেত্রেই মিল ছিল না। পাকিস্তানের উভয় অংশের ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া, খাদ্যাভাস, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সমগ্র দেশের মানুষের জন্য সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা, একটি কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন প্রভৃতির কোনোটিই করা সম্ভব হয় নি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশনা প্রদানের ব্যর্থতার জন্য ধর্মীয় নেতারা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, যেহেতু মুসলমানদের আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলাই হবে যুক্তিসংগত। উপরন্তু ভারত থেকে আগত মুহাজির শরণার্থীরা পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ একচেটিয়াভাবে দখল করে নেয়। এভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই ভূস্বামী, সামন্ত জমিদার, ধর্মান্ধ ওলামা, পীর, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটা লুটের শাসক ও শোষকশ্রেণি। আর এ শাসকশ্রেণির কাছে (১৯৪৭-৭১) দীর্ঘ ২৪ বছর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, সামরিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের এক পাহাড় সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের স্বাধিকার- স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল অপেক্ষাকৃত উন্নত শিল্পকাঠামো, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অবস্থান, বৃহৎ বন্দর এবং সমৃদ্ধ কয়েকটি শহর। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পকারখানা পায় নি। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলা পাটচাষের জন্য বিখ্যাত থাকলেও সকল পাটকল গড়ে ওঠে কলকাতার আশপাশে ।
তৎকালীন ভারত থেকে পূর্ববাংলায় বিভিন্ন পর্যায়ের চাকরিজীবী এলেও কোনো শিল্পপতি কিংবা ধনী ব্যবসায়ীশ্রেণি এখানে আসেন নি। যে সকল মুসলমান শরণার্থী ভারত থেকে মূলধন সঙ্গে এনেছিল তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানে আগমন করে। নিজেদের নিরাপদ ব্যবসায়িক বিনিয়োগের চিন্তা করেই মূলধন সম্পন্ন শরণার্থীরা পশ্চিম পাকিস্তানে আসেন এবং যারা পূর্ব পাকিস্তানে আসেন তারা প্রায় সবাই শরীর সর্বস্ব। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে পশ্চিম পাকিস্তান এক শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণি সমৃদ্ধ মহাজির, আমলাবর্গ এবং সেনাবাহিনী পায়। এ সুবিধাবাদী গোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনকাঠামো গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। তাই কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতাবণ্টনে তাদের অনীহা শুরু থেকেই ছিল। পূর্ববাংলাকে তাদের কাঁচামালের যোগানদার ও তৈরি পণ্য সামগ্রীর বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে । ব্রিটিশের শাসনামলের মতো আবারও বাঙালি হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শিল্পকারখানার কাঁচামালের যোগানদার। এ উদ্দেশ্যেই প্রণীত হয় দেশের সকল প্রকার অর্থনৈতিক নীতি। তাছাড়া বাজেট বরাদ্দের বাইরেও ঢালাওভাবে অর্থ ব্যয় করে পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহদায়তন বাঁধ ও পানি প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হতে থাকে। বৃহৎ সব শিল্পকারখানা পশ্চিম পাকিস্তানে নির্মিত হওয়ায় উক্ত অঞ্চলের লোকেরাই সেখানে মজুর-শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি লাভ করে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েই শুধু নয়, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টার মাধ্যমেও পূর্ববাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। ভারত থেকে আগত মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করেন। বাঙালির ভাগ্য তাই এক শোষকের হাত থেকে আরেক শোষকের হাতে পতিত হয়।
ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশের কাছ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের পর বিত্তশালী শরণার্থীরা পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করেন। ভাষা ও সাংস্কৃতিক নৈকট্যের কারণে এবং ফেডারেল রাজধানী অবস্থিত হওয়ায় বোম্বে ও উত্তর প্রদেশের মুসলমান ব্যবসায়ী-শিল্পপতিবৃন্দ করাচি ও লাহোর গমন করেন এবং সেখানে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। অন্যদিকে, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজিপতি হিন্দুদের ভারত গমনে বাধা দেননি, আবার ভারত থেকে আগত মুসলমান পুঁজিপতিদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে গমন করতেও উদ্বুদ্ধ করেন-নি। পাট এবং তুলা রফতানির একচেটিয়া অধিকারও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায় ।
এভাবে অর্জিত বিপুল মুনাফা তারা ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ টেক্সটাইল শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পের প্রসার ঘটানোর জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎ এবং সেচ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ।
প্রাদেশিক উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৈষম্য (Expenditure Disparity in Provincial Development Sector) : পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ২/৩ বছরের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ১৯৪৭- '৫৫ সময়কালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্থব্যয় করেন তার প্রায় ৯০% ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে (সারণি-৬)। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় হয় ১,৬৮১ মিলিয়ন টাকা এবং সেখানে ব্যয় করা হয় মাত্র ৪২৭ মিলিয়ন টাকা ।
সারণি-৬ : ১৯৪৭-৫৫ সময়কালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদেশভিত্তিক ব্যয়ের পরিমাণ disparaty between east west pakistan
উৎস : Safar A. Akanda, op.cit, p. 176 Table XXIII.
১৯৪৭-'৫৫ সময়কালে প্রদেশদ্বয়ের উন্নয়ন খরচ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উক্ত সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকার যেখানে মাত্র ৫১৪.৭ মিলিয়ন টাকা উন্নয়ন খাতে খরচ করেছে, সেই একই সময়কালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার উন্নয়ন খাতে খরচ করেছে ১,৪৯৬.২ মিলিয়ন টাকা। এভাবে দেখা যায় যে, ১৯৪৭-'৫৫ সময়কালে দুই প্রদেশের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ১৯৫১-৫২ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে ছিল ১৮%, ১৯৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৪%।
গ. পাকিস্তানের সামরিক খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় (Excessive Expenditure in Military Sector of Pakistan) পাকিস্তানের সামরিক খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পূর্ণরূপে স্থবির হয়ে পড়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম এক দশকের মোট রাজস্ব ও সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বিন্যাসের একটি বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়।
সারণি-৬-ক : পাকিস্তানের সামরিক খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়
(Excessive Expenditure in Military Sector of Pakistan)
Source: A.M.A. Muhith-Bangladesh Emergence of A Nation, Dhaka, Bangladesh Books International Ltd. 1978, p. 64.
পাকিস্তানের সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ ও সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, উক্ত অর্থবছরগুলোতে সামরিক খাতে ব্যয় বরাবরই ৫০ শতাংশের বেশি ছিল। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো অতি জরুরি খাতসমূহ অবহেলিত হওয়ার কারণে জন্মলগ্নেই পাকিস্তান একটি বিকলাঙ্গ শিশুতে পরিণত হয়। ঘ. প্রাদেশিক শিক্ষাখাতে ব্যয় বৈষম্য (Expenditure Disparity in Provincial Education Sector) : ১৯৪৮-'৫৫ সময়কালে শিক্ষাখাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে যেখানে বরাদ্দ দেয়া হয় ১,৫৩০ কোটি টাকা, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়া হয় মাত্র ২৪০ কোটি টাকা (১৩.৫%)। অপর এক তথ্য অনুযায়ী ১৯৫১-'৬১ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাখাতে পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য মাথাপিছু বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৫.৬৩ টাকা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য তা ৮.৬৩ টাকা অর্থাৎ ব্যবধান ৫৩% এরও বেশি। তাছাড়া Colombo Plan, Ford Foundation, Commonwealth Aid প্রভৃতি প্রোগ্রামের আওতায় যে সকল বৈদেশিক বৃত্তি দেয়া হয় তার সুযোগ-সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভোগ করে। পূর্ব পাকিস্তানের যোগ্য প্রার্থীরা অনেক সময় এসব বৃত্তির সন্ধানই পেত না ।
৫. প্রাদেশিক খাতে আমদানি-রপ্তানি আয়-ব্যয় বৈষম্য (Income Expenditure Disparity in Provincial
Export-Import Sector) :
পাকিস্তানের দুই অংশ তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি খাতে বৈষম্যের সৃষ্টি করে সরকার।
উল্লিখিত তথ্যমতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ৪৯২৪.১ মিলিয়ন টাকা এবং সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যে ঘাটতি ১৬,৬৩৪.৬ মিলিয়ন টাকা। ১৯৪৭-'৬৬ মেয়াদে পাকিস্তানের মোট রপ্তানিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ ৪২% হলেও মোট আমদানির অংশ ছিল ৬৯%। ব্যাংকিং সেক্টরে পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত থাকে। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তফসিলি ৩৬টি ব্যাংকের মোট ১,১৩০টি শাখার মধ্যে
পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৩৬২টি (৩২%)।
চ. বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ বণ্টনে বৈষম্য (Disparity in Foreign Aid and Debt Distribution) : ১৯৪৭-'৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান ৭,৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে মাত্র ২,০২৪ মিলিয়ন ডলার বা ২৬.৬%। অবশ্য এ ঋণের ৬,৪৩৯ মিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান পায় ১,৯৪১ মিলিয়ন ডলার বা ৩০% ।
বৈদেশিক সাহায্যের এ বণ্টন কাগজে কলমে থাকলেও সমকালীন দলিলের কোনো বাঙালি অর্থনী পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার ২১%-এর বেশি না বলে মা । অথচ
বৈদেশিক উন্নয়নের ব্যয়ের জন্য সে পেয়েছে ২০% ২৬%, যা টের দশকে এসে কিছুটা পড়ে 35% % দাঁড়িয়েছে। যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের ঘাটতির মাত্র ৬৪% বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে পুথি দেয়া যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এ খাতে দেয়া হয়েছে ৯২% অর্থ নিচের সারণিটি দেখলে বিষয়টি
ছ. পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈষম্য (Disparity in Five year Plan) :
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৫৫-৫৯) বৈষম্য (Disparity in 1st Five year Plan (1955-69)
একটি রাষ্ট্র বা দেশের উন্নয়ন সমৃদ্ধির পরিচালিকা শক্তি হচ্ছে সেই রাষ্ট্র বা দেশের বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক কিংবা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যার মাপকাঠিতে পরিমাপ করা হয়ে থাকে সরকারের কার্যক্রম। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যকরী হয় জুলাই ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। এ পরিকল্পনায় মোট বাজেট ছিল ৪,৯৬৪ মিলিয়ন টাকা, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় মাত্র ৯৮৩ মিলিয়ন টাকা (মোট ব্যয়ের মাত্র ১৬.৫%)।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬০-'৬৫) বৈষম্য [ Disparity in 2nd Five year Plan (1960-65) ] পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ মেয়াদের যে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নেয় তাও দেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিতকরণে সহায়ক ছিল না। পাকিস্তানের এ পরিকল্পনাতে দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও তা বাস্তবায়ন করার দিকনির্দেশনা তাতে ছিল না। অন্যদিকে, বিনিয়োগের হার পশ্চিম পাকিস্তানের বেশি নির্ধারণ করা হয় (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য মাথাপিছু যথাক্রমে ১৯০ ও ২৯২ টাকা)। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে ৪৪% এ দাঁড়ায়। তাই পাকিস্তানের দুই প্রদেশের বৈষম্য দিনে দিনে বাড়তেই থাকে।
The Economic Survey of East Pakistan ১৯৬৪-৬৫ থেকে জানা যায় যে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রকল্প পরিকল্পনা ছিল তার মাত্র ৩৭% অর্জিত হয়েছিল, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জন ছিল ১০০%। পরিকল্পনাধীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু বিনিয়োগ যেখানে ছিল ২০৫ টাকা, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে এ পরিমাণ ছিল মাথাপিছু মাত্র ৮০ টাকা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য ১৯৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪% থেকে বেড়ে ১৯৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দে ২৯% হয়। সুতরাং এ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সংগত অধিকারকে হরণ করা হয়েছে।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৫-৭০) বৈষম্য (Disparity in 3rd Five year Plan (1965-70) পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ ১৯৭০ মেয়াদে দুই প্রদেশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কিছু পরিকল্পনায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ ধার্য করা হয় ২৭,০০০ মিলিয়ন টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ২৫,০০০ মিলিয়ন টাকা। পাবলিক সেক্টরে মোট বরাদ্দ ছিল পূর্ব পকিস্তানের ১৬,০০০ মিলিয়ন টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১০,০০০ মিলিয়ন টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ২য় ও ৩য় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় Indus Basin Development Works-এর জন্য বরাদ্দের অতিরিক্ত ৯,০৪৩,৩৮ মিলিয়ন টাকা এবং লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পে অতিরিক্ত ৫,৯০০ মিলিয়ন টাকা খরচ করলেও পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ খাতে (যা অতি জরুরি ছিল) অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের সুযোগ রাখা হয় নি।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে ২৭,০০০ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও বাস্তবে ব্যয় করা হয় ১০,৯৭০ মিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ মোট বরাদ্দে পাবলিক সেক্টরে ৪৩% এবং প্রাইভেট সেক্টরে ৩৫% মাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। ফলে মেয়াদ শেষে ২৩% বৈষম্য বৃদ্ধি পায় ।
পাকিস্তানের রাজধানী করাচি শহরকে গড়ে তুলতেই ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যয় হয় ৫,৭০০ মিলিয়ন টাকা, যা পাকিস্তান সরকারের মোট ব্যয়ের ৫৬.৪%। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে মোট সরকারি ব্যয়ের শতকরা হার ছিল মাত্র ৫.১০% ।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক সরকার প্রথমে রাওয়ালপিন্ডিতে এবং পরে ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানাস্তরের অছিলায় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামাবাদ-এর উন্নয়নে ৩,০০০ মিলিয়ন টাকা ব্যয় করা হলেও ঢাকার উন্নয়নে করা হয় মাত্র ২৫০ মিলিয়ন টাকা। পাকিস্তানে ১৯৪৭-'৬৫ সময়কালে প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয় ৪,৫৬৫.৭ মিলিয়ন টাকার মধ্যে মাত্র ১৬৭.২ মিলিয়ন টাকা পূর্ব পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২,৫৬৩.৯ মিলিয়ন টাকা।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]