পাকিস্তান কি প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক প্রকৃতির ছিল? আলোচনা কর।

ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন গৃহীত হয়। এ আইনে ভারতে দু'টি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিধান সৃষ্টি করা হয়। যার ফলাফল ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম। হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী উভয় রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়' বহাল রাখা হয়। স্বাধীনতা আইনের ৮নং অনুচ্ছেদে ভারত-পাকিস্তান উভয় নতুন রাষ্ট্র দু'টিকে সাময়িকভাবে চালানোর সাময়িক বিধান বলবৎ করা হয়। এ বিধানে উল্লেখ থাকে যে, উভয় রাষ্ট্রের আইনসভা স্ব-স্ব রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গণপরিষদ হিসেবে আইন প্রণয়ন করবে। ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনের ৮(২) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত ছিল যে, গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইনসমূহ ভারত শাসন আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে, তা পরিপূর্ণরূপে রাষ্ট্রসমূহের উপর বলবৎ করা যাবে। সে যাহোক, আমাদের এ আলোচনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক প্রকৃতির রাষ্ট্র ছিল কিনা তা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃতি : পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা স্বরূপ নির্ধারণের পূর্বে রাষ্ট্রের বা সরকারের স্বরূপ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্ণয়ে সরকারের স্বরূপই প্রধান আলোচ্য বিষয়। রাষ্ট্রসমূহের স্বরূপ নির্ণয়ে রাষ্ট্রসমূহের কাঠামো, সরকারের গঠন, বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলির আলোচনা সাপেক্ষে তা নির্ণয় করা যায়। সাধারণত যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণে রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্ণয় করা হয়। তা হল সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সরকার গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক কিনা, গণতান্ত্রিক হলে তা সংসদীয় অথবা রাষ্ট্রপতি শাসিত কিনা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো এককেন্দ্রিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কিনা প্রভৃতি । রাষ্ট্রের স্বরূপ বিশ্লেষণে উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের সাথে রাষ্ট্রের নানাবিধ কার্যাবলির বিশ্লেষণেও কোন রাষ্ট্রের স্বরূপ বা প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় । পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে, ১৯৪৫ সালের ৮ নভেম্বর এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার প্রতিনিধিকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ বলেছেন, 'পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে এবং এর প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হবে। USA, Canada ও Australia এর মত পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো হবে এবং মুদ্রা, জাতীয় প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হবে ।
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান : ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের জন্ম ছিল অভূতপূর্ব ও প্রায় অবাস্তব। এর দু'টি অংশ ছিল পরস্পর থেকে ১৫০০ মাইল বিদেশী অঞ্চল দ্বারা বিচ্ছিন্ন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অনুসরণে একটি ফেডারেল কাঠামোতে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে এবং ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান (সাময়িক সংবিধান) আদেশ বলে পাকিস্তান ফেডারেশন গঠন করা হয়। পাকিস্তান ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত ছিল চারটি প্রদেশ। যথা : ১. পূর্ব বাংলা, ২. পশ্চিম পাঞ্জাব, ৩. সিন্ধু ও ৪. উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। পাকিস্তান ফেডারেশন গঠনের ব্যাপারে পরবর্তীতে কোন বিতর্ক না থাকলেও ফেডারেশনের সফলতা সম্পর্কে সংকট ও বিতর্ক পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনীতির গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করে।
পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্বরূপ ও বাস্তবতা : পাকিস্তান নিজেকে গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদীয় প্রকৃতির সরকারের বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ রাষ্ট্রের অধিকারী বলে দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রাষ্ট্রগুলোতে সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্টভাবে বণ্টন করার বিধান রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে এ ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে USA, Canada ও অস্ট্রেলি পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র গঠনের কথা প্রচার করলেও স্বাধীনতার পরবর্তী পাকিস্তানে একথার বাস্তবতা প্রত যায় নি। তত্ত্বগতভাবে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর যথাযথ প্রয়োগ কখনও যায় নি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রথম থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কুক্ষিগত ছিল। অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।
কিন্তু পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রদেশ, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা তার অধিকার ও ন্যায্য পাওনা থেকে সব সময়ই বঞ্চিত ছিল। প্রাদেশিক গভর্নর আইনসভার গঠন প্রভৃতির ক্ষেত্রে অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রের মত পাকিস্তান প্রদেশগুলোর অবাধ ও নিরঙ্কুশ অধিকার স্বীকার করা হয় নি। এসব ক্ষেত্রে সবসময়ই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বজায় রাখা হয়েে ফেডারেল সরকারের বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণের প্রশ্নেও অঞ্চল ভিত্তিক অথবা সংখ্যা সাম্যনীতি কোনটাই গ্রহণ করা হয় নি। এককথায় বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে সামান্যই পরিলক্ষিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র ও পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ধরন : প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ধরন সংসদীয় বলে ঘোষণা করা হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থা সংসদ অর্থাৎ আইনসভাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারত ও পাকিস্তান তাই ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা নিজ নিজ রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণ করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রথম উদ্ভব ঘটে ব্রিটেনেই। ব্রিটেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তান যে সংসদীয় গণতন্ত্র নিজ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সূচনাকাল থেকেই জন মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় একজন প্রতিকী রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন। তাঁর নামে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হলেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেন না ৷
সরকার পরিচালনার প্রকৃত দায়িত্ব পালিত হয় একটি মন্ত্রিপরিষদ দ্বারা। মন্ত্রিপরিষদ আবার আইনসভার দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে। মন্ত্রিপরিষদ বা পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা অর্থাৎ শাসন বিভাগ এবং আইনসভা বা সংসদের সাথে গভীর যোগাযোগ থাকে বলেই একে সংসদীয় সরকার বলা হয়। এখন প্রশ্ন আসে, ১৯৪৭ এ প্রবর্তিত পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্রের এরূপ কোন বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব আদৌ ছিল কিনা। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রায় পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার কিছু অভিজ্ঞতা থেকে স্বাধীনতা উত্তরকালে পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করে। এ সময়ের প্রথমার্ধে গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আধিপাত্যের আধিক্য প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ করেছিল।
সংসদীয় সরকারে গভর্নর জেনারেল যেখানে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠা প্রধানের ভূমিকা পালন করেন, সেখানে জিন্নাহর প্রভূত ও প্রকৃত ক্ষমতা-চর্চা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃতির সঠিক রূপায়ণে বিজ্ঞ মহলে অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তানের স্রষ্টা হিসেবে তাঁর (জিন্নাহ্র) অসাধারণ নেতৃত্ব নতুন রাষ্ট্র গঠনে জনগণের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল বিধায় মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় তাঁর আধিপত্য ও ক্ষমতায় হস্তক্ষেপকে সহজে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অবর্তমানে ক্ষমতালিলু গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এর হাতে পাকিস্তানের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে এবং এ সময় থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য চরম আকার ধারণ করে। পাকিস্তানের রাজনীতির প্রারম্ভ থেকেই বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ এরূপ ধারণা পোষণ করেছেন যে, পাকিস্তান আদৌ কোন সুস্থ রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন পরিচালিত হয় নি। সূচনা থেকেই ভৌগোলিকসহ নানান প্রকার অসামঞ্জস্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের আন্তঃকোন্দলের কারণে সেখানে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র নেপথ্যে থেকে রাজনীতির কলকাঠি ঘুরাবার সুযোগ গ্রহণ করেছে। ফলে পাকিস্তানে প্রকৃতপক্ষে, “রাজনীতির নামে ছিল রাজনীতিহীন রাজনীতি।”
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চরিত্রকে ব্যাহত করলেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর প্রদর্শিত পথ তাঁর উত্তরসূরীরা অবলম্বন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমাধি রচনার পথ সৃষ্টি করেছে। যার পরিণতিতে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রের সর্বগ্রাসী আঁতাতে পড়ে ১৯৫৮ সালে চিরদিনের মত পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে বিদায় গ্রহণ করে।
উপসংহার : ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পাকিস্তানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রকৃতি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কখনো যথার্থরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সুতরাং এর কার্যকারিতার প্রশ্নও অবান্তর।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]