পাকিস্তানের সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য আলোচনা কর। (Discuss the Socio-political Disparity of Pakistan.)

সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য
Socio-Political Disparity
বাঙালির বহু ত্যাগ আর আন্দোলন-সংগ্রামে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তার পূর্বাঞ্চলের বাঙালি মুসলমানরাই আবার আটকে পড়ে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের জনগণের সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে। তাই পাকিস্তানের মতো বহু ভাষাভাষী এবং ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকার ও ভৌগোলিকভাবে দুই খণ্ডে বিচ্ছিন্ন নাগরিকদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সৃষ্টি ও তা কার্যকর করতে তাদের মধ্যে ‘একজাতি-একরাষ্ট্র' এ চেতনা সৃষ্টি করা দরকার। ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তানের সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই-এর এক অংশ (অর্থাৎ পূর্ববাংলা) থেকে অভিযোগ ওঠে যে, তার ওপর অন্য অংশ (অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান) সামাজিক-রাজনৈতিক, উৎপাদন-অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। ফলে পাকিস্তানের পূর্বাংশের জনগণের মধ্যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবোধের চেয়ে বাঙালি জাতীয়তাবোধ অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে বিধায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৃহত্তর সমস্যার চেয়ে পূর্ববাংলার সমস্যা প্রাধান্য লাভ করে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংঘাতের জন্ম দেয় ।
ব্রিটিশ ভারতকালে ব্রিটিশদের আনুকূল্যে কলকাতায় বেশিরভাগ শিল্পকারখানা স্থাপিত হলেও সেসব শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ হতো কৃষি সম্পদ সমৃদ্ধ পূর্ববাংলা থেকে। কলকাতায় ব্রিটিশ শাসককুলের রাজধানী স্থাপিত হবার ফলে সেখানে নগরায়ণে সরকারি বিনিয়োগ বেশি হয়েছে। আর পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের সময় সেই কলকাতা চলে যায় ভারতের হাতে। পাক সিভিল সার্ভিসের বাঙালি মুসলমান ছিল না বললেই চলে। এমনকি পূর্ববাংলার প্রশাসনেও হিন্দুদের আধিক্য ছিল । উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক প্রভৃতি পেশাতেও হিন্দুরাই ছিল সংখ্যায় বেশি। সুতরাং দেশবিভাগের পর পূর্ববাংলা থেকে বেশিরভাগ হিন্দু ডাক্তার, উকিল-মোক্তার, শিক্ষক, বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ভারতে গমন করলে এ প্রদেশে দক্ষ প্রশাসন ও পেশাজীবী শ্রেণির অভাব দেখা যায় ।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা থেকে পাকিস্তানের নামে প্রাপ্ত স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালির মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। এমতাবস্থায় পূর্ববাংলা প্রদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা
ধারণার জন্মলাভ করে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কাঠামোতে তারা কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে সমানাধিকার পাবে না। ধীরে ধীরে প্রশাসনিক-রাজনৈতিক, উৎপাদন-অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যগুলো পূর্বাঞ্চলের বাঙালি প্রথম পর্যায়ে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার প্রশ্নে বাঙালিরা তাদের ন্যায়সংগত অধিকার সচেতন হয়। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে জনগণকে পুষ্প করে। একপর্যায়ে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়, যা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্যগুলো পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখা বিদ্যমান সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সম্প ছিল না।
ক. জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য (Disparity in Living Standard) :
পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ছিল চরম অসম্মানজনক। প্রথম থেকেই দুই অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র ফুটে ওঠে দুই অংশের জনগণের মাথাপিছু আয়ের প্রকট বৈষম্যের ভিতর দিয়ে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ২৫ টাকা বেশি হলেও দু'বছরের ব্যবধানে তা ৬৩ টাকা দাঁড়ায়, ১৯৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ২৮৮ টাকা, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৩৫১ টাকা। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের অনুপাত ছিল ২১.৯%। অথচ ২০ বছরের ব্যবধানে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে যেখানে ৩২১ টাকা তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ৫৩৩ টাকা। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ব্যবধান হয়েছে ২০২ টাকা এবং বৈষম্যের অনুপাত ছিল ৬১.০% ।
সারণি-১২ : মাথাপিছু আয় (Per-Capita Income ) disparity per capita income bd
সূত্র : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক জরিপ, মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা (অনুবাদ : জগলুল আলম), ঢাকা, এপিএল ২০১০, পৃঃ ৬৯ ।
খ. সমাজকল্যাণমূলক বৈষম্য (Social Welfare Related Disparity ) :
পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে সমাজকল্যাণমূলক বৈষম্যও প্রকট রূপলাভ করেছিল। সরকারের অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগত বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানে দু'অঞ্চলের সমাজজীবন ছিল দু'রকমের। শাসক মহলের উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালিদেরকে অভাব- অনটনে আর রোগগ্রস্ত রাখতে পারলে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারবে না। এজন্য কৌশলে পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে জনসংখ্যা, ডাক্তার, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র ইত্যাদিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে।
আবার বিভিন্ন সমাজে কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল পশ্চিমাদের সেবার লক্ষ্যে। যুব সমাজের উন্নতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। ফলে সার্বিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল।
গ. রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য (Political and State Discrimination) :
ব্রিটিশ শাসনামলের শেষপ্রান্তে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা বাংলাকে দুটো অংশে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে আগস্ট, ১৯৪৭ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিন ৭৫-৩৯ ভোটে সোহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। তাই খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পূর্ববাংলার প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করলে স্যার ফ্রেডারিক বোন পূর্ববাংলার প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন। সর্বশেষ ব্রিটিশ প্রশাসনের সমাপ্তির পর আসে আরেক দ্বিজাতি তত্ত্বের শাসন। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রশাসনে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ২৩শ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র একবার (১৯৪৭- '৫১) পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ লাভ করা সম্ভব হয়েছিল অনেকটা দৈবগুণে। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে (১৯৪৮) পূর্ব পাকিস্তান থেকে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করলেও খাজা নাজিমুদ্দিনের সময় দেশের প্রশাসনিক প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। আবার লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার পর (১৯৫১) খাজা নাজিমুদ্দিন যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ (পাঞ্জাবি) হন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। এক কথায় পশ্চিম পাকিস্তানের হাতেই থেকে যায় ক্ষমতা।
পূর্ব পাকিস্তানি খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হিসেবে যেমন প্রকৃত ক্ষমতা পান নি তেমনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও তার হাতে প্রকৃত সরকারপ্রধানের ক্ষমতা আসেনি। এটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানি কারো হাতে (তা তিনি অবাঙালি পূর্ব পাকিস্তানি হন না কেন) ক্ষমতা না-দেওয়ার চক্রান্ত। বাঙালি বীরের জাতি হলেও আন্দোলন সংগ্রামে ব্রিটিশদের তাড়াতে পারলেও স্বধর্মের শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে বাঙালি নিষ্কৃতি পায়নি ।
পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্রে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৭ জন। তার মধ্যে ৪ জন ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে ৩ জন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেবলমাত্র হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীই বাঙালির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বাকি ২ জন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলী নিজেদের পদ রক্ষার্থে পাকিস্তানি তাঁবেদার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থরক্ষাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। যা লক্ষ্য করা যায় এ সময়ের মন্ত্রীসভাতেও।
১৯৪৭–'৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তানের সকল সরকার প্রধানের সময়েই পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি নিম্নোক্ত বৈষম্য বিরাজমান ছিল। যেমন -
৩.৩.৪. শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বৈষম্য
Educational-Cultural Disparity
ক. শিক্ষাখাতের বৈষম্য (Disparity in Educational Sector) :
আধুনিক বিশ্বে যেকোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তী ২০ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়ে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে স্কুলগামীর সংখ্যা বাড়লেও প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমেছে। অথচ একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সারণি-১৪ : ১৯৪৭-'৪৮ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সময়কালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষার অগ্রগতি (Progres in Education of East and West Pakistan from 1947-48 to 1968-'69) disparity education in east west
উৎস : Bangladesh Documents, P. 19
তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষার অগ্রগতি সংক্রান্ত এক রিপোর্টে দেখা যায় যে, ১৯৪৮-৫৫ সময়কালে শিক্ষা খাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে যেখানে বরাদ্দ দেয়া হয় ১,৫৩০ কোটি টাকা, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়া হয় ২৪০ কোটি টাকা (১৩.৫% মাত্র)। ১৯৫১-৬১ সময়ে শিক্ষা খাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মাথাপিছু বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৫.৬৩ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য তা ৮.৬৩ টাকা।
খ. সাংস্কৃতিক খাতের বৈষম্য (Disparity in Cultural Sector) :
সংখ্যা ১৮.৪% এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১.৫%। পশ্চিম পাকিস্তানের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ইরান, পাকিস্তানের দুই অংশে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে) ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার পার্থক্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অমুসলিমদের
আফগানিস্তানেও ইসলাম রক্ষণশীল। এসব দেশের সাথে গভীর সংশ্লিষ্টতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জীবনযাপন গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে এ রক্ষণশীলতার কারণে সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানে অমুসলিমদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। অন্যদিকে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসমষ্টির সংখ্যা যেমন বেশি ছিল, তেমনি এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধধর্মের সংমিশ্রণে গড়ে উঠা সংস্কৃতি। দুই অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ পার্থক্য পাকিস্তানে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু বড় প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে নি; বরং সাংস্কৃতিক নানা বৈষম্যেরও সৃষ্টি করেছে।
3
সাধারণ জাতীয় চেতনার অভাব (Lack of Common National Spirit) : পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানের বৃহত্তম জাতিসত্তা এবং মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৪ ভাগ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দীর্ঘ পরিসরে বসবাসের অভিজ্ঞতা বা অভিন্ন কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকার দীর্ঘকালীন অভ্যাস ছিল না। ফলে তাদের মধ্যে কোনো সাধারণ জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হয়নি। তাছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেনি কোনো স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অঞ্চল। দুই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে শুধু বিদ্যমান ছিল সাধারণ ইসলামি মূল্যবোধ এবং ছিল হিন্দু আধিপত্যের ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র মুসলিম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের কিছু অভিজ্ঞতা ।
২. সাংস্কৃতিক দূরত্বের ব্যাপকতা (Intensity of Cultural Distance) : পাকিস্তানের দুটি অংশ শুধু যে ভৌগোলিক দিক থেকে ভিন্ন অবস্থানে ছিল তা নয়, দুই অংশের জনগণের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল ব্যাপক সাংস্কৃতিক দূরত্ব। তাদের ভাষা ছিল স্বতন্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল ভিন্ন। তাদের আহার্যও ছিল ভিন্ন। তারা বসবাস করছে ভিন্ন প্রকৃতির সরকারের অধীনে। তারা অভ্যস্ত ছিল ভিন্নরূপ পীড়ন ও নির্যাতনে। এমনকি তারা দেখতেও এক রকম ছিল না। লম্বা-চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভিন্নতা (Difference in Political Culture) : ইসলামি ঐতিহ্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির গভীর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে ‘ইসলামের নিরাভরণ অথচ অনমনীয়' নীতি সমৃদ্ধ আদলে এবং হিন্দুধর্মের উদার ও গ্রহণযোগ্যতার তীর ঘেঁষে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির প্রকৃতি ছিল অনেকটা গোঁড়া ও একত্ববাদী । পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রধানত রাজনৈতিক এবং ভাষাসংক্রান্ত সমস্যায় সহসা বিচলিত হয়ে উঠতেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ আন্দোলিত হতেন মূলত ধর্মীয় ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে ।
ঐতিহাসিক ধারায় ভিন্নতা (Difference in Historical Stream) : প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে আধিপত্য স্থাপনকারী বিজয়ীদের সিংহদ্বার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রান্তভূমি হওয়ায় এবং দূরবর্তী অবস্থান থেকে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থেকেছে অধিককাল। শুধু মুঘল শাসনামলেই দীর্ঘকালীন পরিসরে এ অঞ্চল চলে আসে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তাদের প্রতি এটিও এক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগের অধিবেশনে আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে যে ভূখণ্ড চিহ্নিত করেন, তাতে ছিল না বাংলার কোনো স্থান। চৌধুরী রহমত আলী পাঞ্জাবের P, আফগানিস্তানের A, কাশ্মীরের K, সিন্ধু প্রদেশ (INDUS) এর I এবং বেলুচিস্থানের STAN নিয়ে যে PAKISTAN বা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেন, তাতেও বাংলার বিষয়টি অনুপস্থিত থেকে যায়। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাতে
ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের (States) কথা বলা হয়। এ পর্যায়ে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলার মুসলমানরা একদিকে শোষিত হয়েছে ব্রিটিশ শাসক দ্বারা, অন্যদিকে শোষিত ও নির্বাচিত হয়েছে হিন্ জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই তথা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন তাই পূর্ববাংলার জনগণের চেতনায় ছিল এক ধারাবাহিক সংগ্রাম।
৫. জীবনযাপন পদ্ধতিতে ভিন্নতা (Difference in Life Style) : আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল যন্ত্র অর্থনৈতিক সমস্যা। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল পানির স্বল্পতা। ফলে কৃষিকাজের জন্য সেখানে প্রয়োজন হয় ব্যাপক সেচব্যবস্থার। অপরদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে বড় সমস্যা ছিল বন্যার উপদ্রব এবং শীতকালে পানির স্বল্পতা। ফলে এ অঞ্চলে অপরিহার্য হয়ে পড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং শীতকালে পানিসেচ ব্যবস্থার। এ ভিন্নতার কারণে দুই অঞ্চলের শস্য উৎপাদন, গৃহায়ণ, খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল ভিন্ন। স মিলিয়ে দুই অঞ্চলে জীবনযাপন পদ্ধতি ছিল স্বতন্ত্র।
৬. ভাষাগত দ্বন্দ্ব (Language Related Conflict) : পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে যোগাযোগের কোনো সাধারণ ভাষা ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানে অপরিচিত ছিল। অপরপক্ষে, পূর্ববাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত ভাষা উর্দুতে কথা বলার মতো মানুষ ছিল খুবই নগণ্য। পূর্ববাংলার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতির তুলনায় উন্নত হওয়া সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী মনে করতো যে, পূর্ববাংলার ভাষা ও সাহিত্য যদি হিন্দু আধিপত্যের পশ্চিম বাংলার সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করে চলে তাহলে তা পাকিস্তানের আদর্শিক ঐক্য ব্যাহত করবে। মূলত, সে কারণেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে একমাত্র উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় বাঙালিদের ওপর। তবে বাঙালি তা সহজে মেনে নেয়-নি। পরবর্তীকালে রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হলেও ততদিনে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অনেক দূর এগিয়ে যায়।
বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় প্রতিবন্ধকতা (Constraints in Practising Bengali Culture ) : স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে রোমান হরফে বাংলা লেখার জন্য 'ভাষা সংস্কার কমিটি' গঠন করেন এবং এর অব্যবহিত পরে ১৯ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বেতারে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও বাঙালির সংস্কৃতির চর্চা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় নি; বরং এ সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিচ্ছিন্নতার পটভূমিকে ক্রমশ অনিবার্য করে তোলে ।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের জন্মলগ্নে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ‘জাতীয় ঐক্যের জন্য কম বক্তৃতা করেননি। কিন্তু দেশটির জন্মলাভের সাথে সাথেই শাসনকারী অভিজাত গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সংগত দাবিসমূহ বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রত্যয়সমূহের প্রতি কোনো রূপ সম্মান প্রদর্শন করেননি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি ও কাঠামোগত বৈচিত্র্য দুই অংশের মধ্যকার বিরাজমান ব্যাপক বৈষম্যকেই প্রতিফলিত করে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অনুভূতির প্রতি তাদের উদাসীনতা, এখানকার জনগণের বাস্তব সমস্যা উপলব্ধিতে অনীহা এবং এ অঞ্চলের প্রতি হীন আচরণ শেষপর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের উচ্ছেদের দাবি পর্যন্ত এগিয়ে যায়। আর-এর চরম পরিণতি ঘটে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]