মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর। ( Discuss the Aims and Objectives of Muslim League.)

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের সোইেট পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারোপ নিযুক্ত অন অন্যদিকে, পূর্ববাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যবৃন্দ সংসদীয় পদ্ধতিতে একজন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত নূরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ১২০০ মাইল দূরত্বের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত যার মাঝখানে ভারতের অবস্থান। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সামরিক-রাসারিক আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রের তুলনা বিশ্বের অর কোথাও নেই। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে বিরল কিছু স্মরণীয় ঘটনা থাকে, যা মানুষ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করে। এ জাতীয় দিনগুলো ইতিহাসের পাতায় চিরদিন অক্ষয়-অম্লান হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমনি একটি দিন ২১ ফেব্রুয়ারি বা ৮ ফাল্গুন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে 'ভারত' ও 'পাকিস্তান' নামে ২টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সত্য, তবে তার পাশাপাশি বাঙালিদের জাতীয় সত্তার কথাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক দেখা দেয় তাহলো ‘ভাষা’। মূলত ভাষা-সংস্কৃতির ঐক্যই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত আসে তখন বাঙালি জনগণ বিশেষ করে এদেশের ছাত্রসমাজ-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে তা বাঙালি জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ভাষা আন্দোলন থেকে যেমন বাঙালির মধ্যে নতুন ঐক্যের সৃষ্টি হয়, তেমনি বাঙালি জনগণ যে প্রয়োজনে তাদের জীবন দিয়ে অধিকার আদায় করতে পারে তা প্রমাণিত হয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।
মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, "করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়েও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিম লীগ সদস্যের ও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হলো বাংলা।”
মুসলিম লীগের অপশাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম Misrule by Muslim League and Struggle for Democratic Politics
ভূমিকা
Introduction ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা প্রান্তির সময় যে সকল রাজনৈতিক
সেগুলো হচ্ছে মুসলিম লীগ, জাতীয় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি। স্বাধীনতার পূর্বে অনন্ত বাংলায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাम ১১ আসনের মধ্যে ১১৪টি আসনে জয়লাভ করে। বাকি ৫টি আসনে জয়লাভ করে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের পর অবিভক্ত বাংলায় সরকার গঠন করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়া
গঠন করলে খাজা নাজিমুদ্দিন রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হন। ফলশ্রুতিতে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের অখন্ড বাংলা গঠনের প্রশ্নে ৫ আগস্ট ১৯৪৭ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিতে যে ভোটাভুটি হয় তাতে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববা প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মুসলিম লীগের সরকার বিরোধী অংশের নেতাকর্মীরা দেশভাগের পূর্বে এবং পরে কয়েকটি নতুন দল গঠন করে।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
Background of Creation of Muslim League
ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানরা ছিল মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বেশি অর্থাৎ ভারতের মোট জনসংখ্যা ২৯ কোটি ৪০ লক্ষের মধ্যে মুসলমান ছিল ৬ কোটি ২০ লক্ষ। অথচ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের দায়-দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের প্রতি ব্রিটিশ সরকার কঠোর নীতি অবলম্বন করে। এছাড়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে (১৭৯৩ খ্রি.) তৎকালীন মুসলিম সমাজ চরম দুরবস্থায় পতিত হয়। এমতাবস্থায় মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের আস্থা আনয়নের লক্ষ্যে তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবর্গ মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ও ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকার নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণ করে। মুসলমানদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও সমাজ সচেতন করে তোলার জন্য বরেণ্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে নবাব আবদুল লতিফ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে 'মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি, মুসলমানদের প্রথম সংগঠন 'মোহামেডান এসোসিয়েশন', সৈয়দ আমির আলী ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে 'সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন' স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে 'গাজীপুর বিজ্ঞান সমিতি', ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে 'আলীগড় মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল স্কুল', ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে 'অল ইন্ডিয়ান মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্স', ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান ডিফেন্স এসোসিয়েশন', ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান প্যাটরিওটিক এসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২১-২২ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে ব্যারিস্টার সৈয়দ শরফুদ্দিনের সভাপতিত্বে মুসলমান নেতৃবৃন্দের এক বৈঠকে মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় বিষয় আলোচিত হয়। সভায় ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে উত্তর প্রদেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে সাহারানপুরের জনসভায় মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের দাবি ওঠে। বিশেষ করে, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠনে অনুপ্রেরণা যোগায়। ভারতের মুসলমানদের একটি প্রতিনিধি দল ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেয়। আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট মুসলমানদের প্রতিনিধিদল লর্ড মিন্টোর সাথে বৈঠক করে কিছু দাবিদাওয়া পেশ করেন। তিনি আসন্ন শাসন সংস্কারে মুসলমানদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেন। এখানে মুসলিম নেতৃবৃন্দ একমত পোষণ করেন যে, কয়েক মাস পর ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের সভায় একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। নবাব সলিমুল্লাহ অসুস্থতার জন্য সিমলা বৈঠকে যোগ না দিলেও ডিসেম্বরে আসন্ন ঢাকা সম্মেলনকে সামনে রেখে নভেম্বরে তিনি তাঁর পরিকল্পনা সংবলিত মুসলমান নেতাদের কাছে পাঠান। তিনি এতে মোহামেডান অল ইণ্ডিয়া কনফারেন্স গঠনের যৌক্তিকতা, প্রয়োজনীয়তা ও রূপরেখা তুলে ধরেন ।
. মুসলিম লীগের গঠন, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
Creation, Aims, Objectives and Importance of Muslim League
ক. মুসলিম লীগের গঠন (Creation of Muslim League)
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে নবাব সলিমুল্লাহর বাগানবাড়িতে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের অধিবেশন শুরু হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রায় ৮,০০০ প্রতিনিধি এতে যোগ দেন। নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শরফুদ্দিন উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এ অধিবেশন চলে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৩০ ডিসেম্বর রাজনৈতিক অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন ভিকার-উল-মুলক। অধিবেশনের মূল বক্তা নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে এবং হাকিম আজমল খানের সমর্থনে 'নিখিল ভারত মুসলিম লীগ' গঠিত হয়। আগা খান মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। নবাব সলিমুল্লাহ সহ-সভাপতি এবং নবাব মুহসিন-উল-মুলক এবং নবাব ভিকার- উল-মুলক যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
খ. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives)
নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত মুসলিম লীগের ৩টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন, যা নিম্নরূপ :
১. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য বৃদ্ধি করা এবং ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ভুল ধারণার জন্ম নিলে তা দূর করা।
ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থরক্ষা এবং তাদের অভাব-অভিযোগ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা সরকারের কাছে উপস্থাপন করা।
৩. মুসলিম লীগের উপর্যুক্ত লক্ষ্যের কোনো ক্ষতি না করে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা ।
গ. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব (Importance of Creating Muslim League)
মুসলিম লীগের জন্ম ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। ভারতীয় মুসলমানদের আত্মজাগরণ সৃষ্টিতে, মুসলমানদের সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টিতে, মুসলমানদের দাবি-দাওয়া উপস্থাপনে, হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক স্বতন্ত্রতা গঠনে, মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থায়, লাহোর প্রস্তাব ও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বসমূহ নিম্নরূপ : ১. মুসলমানদের আত্মজাগরণ সৃষ্টি : মুসলিম লীগ মুসলমানদের মধ্যে আত্মজাগরণের সৃষ্টি করে। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গকে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে বিবেচনা করে-এর পক্ষে অবস্থান নেয় এবং এর বিরোধিতা ও বয়কটের নিন্দা করে। কংগ্রেস যেমন বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে, ঠিক তেমনি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলিম লীগ মুসলমানদের সমবেত করে ।
.
আত্মসচেতনতা ও জাতীয়তাবাদ : মুসলমানদের আত্মসচেতনতা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ফলে পণ্ডিতরা মনে করেন যে, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদ সুসংহতরূপে আত্মপ্রকাশ করে ।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রবেশ : মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলমানরা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একক সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের এতদিনের অনীহার বদলে গভীর আগ্রহের জন্ম নেয়। আর তখন থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলমানরা একটি সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৪. মুসলমানদের গুরুত্ব বৃদ্ধি : পূর্বে মুসলমানরা দাবি-দাওয়া আদায়ের ব্যাপারে স্মারকলিপি, চিঠিপত্র ইত্যাদি কংগ্রেসের মুখাপেক্ষী হলেও ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে নিজস্ব দলের দ্বারাই সরাসরি সরকারের কাছে দাবি- দাওয়া উপস্থাপন করে। ফলে সরকার মুসলমানদের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠে। তবে মুসলিম লীগ গঠনের পর ভারতের মুসলমানরা এ দলের পতাকাতলে ও হিন্দুরা কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হলে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রবল রূপ নেয়, যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৫. পৃথক নির্বাচনের স্বীকৃতি : ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের মর্লি-মিন্টো সংস্কারের অধীনে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা মেনে নেয়, যা মুসলিম লীগের বড় সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপস্থাপনের ফলে এর সমর্থক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন প্রদেশে এর শাখা গঠিত হয়। যদিও প্রথম অবস্থায় এ দলের নেতাদের মধ্যে নাইট, নবাব, ভূস্বামী অভিজাতদের প্রাধান্য ছিল কিন্তু ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের পর একটি ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থিত দলরূপে গড়ে উঠে।
৬. পাকিস্তান সৃষ্টি : হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের তিক্ততার মধ্যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর “দ্বিজাতি তত্ত্ব' (Two nation Theory) উপস্থাপন করলে এটি মুসলিম লীগের দাবিতে পরিণত হয়। যার চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
৪.১.৪. মুসলিম লীগের অপশাসন ও বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম
Misrule by Muslim League and Political Movement of Bengali
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের দুঃশাসন, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিমাতাসুলভ আচরণ, নেতৃবৃন্দের চরম স্বেচ্ছাচারিতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ নানা ক্রিয়াকর্মের বিরুদ্ধে দলের ভেতরের সচেতন নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদ করেন। মুসলিম লীগের একদল আত্মসচেতন, উদারপন্থি ও অসাম্প্রদায়িক তরুণ বাঙালি রাজনৈতিক কর্মী ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পূর্ববাংলার নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে। পূর্ববাংলার তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দলটির গঠন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, বাঙালির গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রামে দলটি একদিকে যেমন মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আত্মপ্রকাশ করে, অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েই অল্প সময়ের মধ্যে দলটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দলে পরিণত হয়। নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ ক্ৰমান্বয়ে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। মুসলিম লীগের অত্যাচার ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং প্রধানত এ দলের তৎপরতার কারণেই ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের পর মুসলিম লীগ নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়।
ক. মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম (Non-Democratic Activities of Muslim League) মুসলিম লীগ শুরু থেকেই দেশ পরিচালনায় অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক পথ বেছে নেয়। সংবিধান রচনায় বিলম্ব ঘটায়। অন্যদিকে, ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর ভরাডুবির কারণে ১১৭টি আসনের মধ্যে ৩৮টি শূন্য হলেও এসব শূন্য আসনের নির্বাচন ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সোহরাওয়ার্দীর আসনে উপনির্বাচন ঘোষণা করা হলে মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী শহিদুল হককে সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে জয়ী করে । আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ও কৃষক নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলের আসন থেকে পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। করটিয়ার জমিদার মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে তিনি পরাজিত করলেও পন্নী ভাসানীর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণার আবেদন করেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে প্রাদেশিক গভর্নর এ নির্বাচন বাতিল করে। নির্বাচন ব্যয় দাখিল না করায় ভাসানী, পত্নীসহ ৪ জন প্রার্থীকে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। অথচ ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে এ আসনে পুনঃউপনির্বাচন হলে মুসলিম লীগ পন্নীকে প্রার্থী
করে। প্রাদেশিক গভর্নর তার বিশেষ ক্ষমতাবলে পত্নীর প্রার্থিতা অনুমোদন করেন। নূরুল আমিন সরকারের এ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্লজ্জ দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে সমগ্র প্রদেশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকা কঠোর ভাষায় মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। ভাসানীর প্রার্থিতা অবৈদ থেকে যাওয়ায় তরুণ নেতা শামসুল হককে পত্নীর বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হয়। নির্বাচনে বিপুল ভোটে শামসুল হক জয়ী হলেও নির্বাচনের পরের দিন তাে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাইব্যুনাল শামসুল হকের নির্বাচনকে বাতিল ঘোষণা করে। এ নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের নেতা মনজুর আলম বলেন, 'মুসলিম লীগের এ পরাজয় খুবই অর্থপূর্ণ। মুসলিম লীগ আর সকল মুসলমানদের
প্রতিনিধিত্ব করে না, এ নির্বাচনই তার প্রমাণ করেছে।'
খ. মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতি (Suppression Policy of Muslim League Government ) আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলে মুসলিম লীগের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং সরকার নতুন দলের কর্মীদের হয়রানি ও গ্রেফতার শুরু করে। নতুন দলের যেকোনো সভায় বাধা সৃষ্টি ছাড়াও সভা-সমাবেশে মুসলিম লীগের উচ্ছৃঙ্খলদের লেলিয়ে দেয়া হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন নতুন দলের সমালোচনা করে বলেন, "আমরা জেনেশুনে বৃহৎ বাংলা আন্দোলনের নেতাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে দিতে পারি না। কঠোর হস্তে ষড়যন্ত্র দমন করা হবে।” ১৬ জুলাই প্রাদেশিক মুসলিম লীগের আলোচনা সভায় সভাপতি আকরম খাঁ নতুন দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নির্দেশ দেন। বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। মওলানা ভাসানী, সামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশেষ ক্ষমতা অধ্যাদেশ ও জননিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ১৯৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে বার বার গ্রেফতার করা হয়। এ সময় শেখ মুজিবকে দু'বছর কারাগারে আটক রাখে। সোহরাওয়ার্দীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনেক প্রগতিশীল ছাত্রনেতার ছাত্রত্ব বাতিল, জরিমানা, মেয়াদি বহিষ্কার করে মুসলিম লীগ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলে নতুন দল গঠন জরুরি হয়ে পড়ে।
গ. মুসলিম লীগের দেশ শাসনের ব্যর্থতা (Failure of Muslim League in Ruling of the Country) মুসলিম লীগের ভ্রান্ত ও বৈষম্যমূলক নীতির কারণে দেশে চরম দুর্ভোগ দেখা দেয়। মুসলিম লীগের দেশ পরিচালনায় সুষ্ঠু নীতির অভাবে পূর্ববাংলায় কোনো উন্নতি হয়-নি। কম অর্থ বরাদ্দে শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমে ভেঙে পড়ে, শরণার্থী পুনর্বাসন বাধাগ্রস্ত হয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। দক্ষ প্রশাসনের অভাবে বিভিন্ন বিভাগের কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। মওলানা ভাসানী ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ পূর্ববাংলার ব্যবস্থাপক সভায় বক্তৃতায় মুসলিম লীগ সরকারের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেন।
ঘ. মুসলিম লীগের ত্যাগী নেতাদের প্রতি অবহেলা (Negligence of Dedicated Leaders of Muslim League) পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙালিদের প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও আত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ চরম বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব দেখায়। তাদের সাথে যোগ দেন ঢাকার নবাব পরিবারের প্রতি অনুরক্ত কতিপয় বাঙালি নেতা। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের উদ্ভাবক এ.কে. ফজলুল হক, ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে মুসলিম লীগের সাফল্যের নায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকারের রোষানলে পড়েন। পরিকল্পিতভাবে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাঙালিদের বাদ দেয়া হয়। ৭ জন মন্ত্রীর মধ্যে শুধু দু'জন বাঙালি ছিলেন। কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আকরম খাঁ হন দলের সভাপতি। ইউসুফ আলী চৌধুরী, নূরুল আমিন এ কমিটির সদস্য হন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন । অথচ প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সভাপতি পদে আসীন শীর্ষস্থানীয় দু'জনেরই পাকিস্তান আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে তেমন অবদান ছিল না। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের সময় আকরম খাঁ স্বাস্থ্য রক্ষায় মধুপুরে অবকাশ যাপন আর খাজা নাজিমুদ্দিন রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে লন্ডনে বাস করছিলেন।
সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হকের মতো আরও এক ত্যাগী নেতা আবুল হাশিমকেও কোণঠাসা করা হয়। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি কট্টর আচরণ করে সরকার। দুই বাংলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে সোহরাওয়ার্দীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে।
পর এভাবে মুসলিম লীগের গণমুখী চরিত্র পাল্টে যায়। দলটি সরকারের সমর্থক কর্মকান্ডের ও পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যক্তিস্বার্থের প্রতিভূতে পরিণত হয়। পূর্ববাংলার নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দেয়, যার ফলশ্রুতিতে পূর্ববাংলায় বাঙালিরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সকল আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে।
৫. মুসলিম লীগের দলীয় অন্তর্ধ্বন্দ্ব (Internal Conflict of Muslim League)
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এক ধারায় খাজা নাজিমুদ্দিন, আকরম খাঁ অন্য ধারায় ও হাশেম নেতৃত্ব দেন। প্রথমটি সরকারি মুসলিম লীগ আর দ্বিতীয়টি বিরোধী মুসলিম লীগ হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী ছিল। বাংলার মুসলিম লীগ এ দু'ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। দ্বিতীয় ধারা সমর্থক সংস্কারপন্থিরা শামসুল হককে প্রার্থী ঘোষণা করে। সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেন, টাঙ্গাইলের জয়ের মাধ্যমে আমরা এখন থেকে শুভ সূচনা করলাম। পশুন ডেইলির মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য, "It is not only a victory of Mr. Shamsul Haq but it is a threatening to the re-actionary Government of the world over." মুসলিম লীগ নবাববাড়ির দলে পরিণত হয়। সংস্কারপন্থিরা জনগণের কাছাকাছি যেতে থাকেন। আর মুসলিম লীগ দুর্বল সংগঠনে পরিণত হয়।
চ. কেন্দ্রীয় নেতাদের কর্তৃক সংস্কারপন্থিদের অবমূল্যায়ন (Disregard of Reformists by Central Leaders) ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠকরা খসড়া ঘোষণাপত্র রচনায় ব্যস্ত। মুসলিম লীগের বিদ্রোহীদের তৎপরতা সম্পর্কে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামান উদ্বোধনী দিনের বক্তৃতায় বলেন, 'পাকিস্তানের কিছু লোক অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। ক্ষমতা না পেয়ে তারা গোপনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন 'আওয়ামী মুসলিম লীগ'কে ছ'মাসের দল হিসেবে তিরস্কার করেন। ফলে বাঙালিরা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামে একটি নতুন প্লাটফর্মে উপনীত হয়।'
ছ. পূর্ববাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব (Discriminatory Intention to East Bengal)
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলা ভাষা তথা সংস্কৃতির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ ছাড়াও দু'অংশের মধ্যে প্রশাসন, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। ফলে পূর্ববাংলায় বাঙালিদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রথম থেকেই লক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যনীতি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো ছিল। পূর্ববাংলার অবাঙালিদের স্বার্থরক্ষায় সরকার বেশি তৎপর ছিল। এ কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগ পাটসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি জানায়।
জ. দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতা (Failure of Government to Prevent Famine)
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের গোড়া থেকেই পূর্ববাংলায় খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১৯৪৮-৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮-১৯ জুন মুসলিম লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে খাদ্যাভাবের কথা স্বীকার করা হয়। মুসলিম লীগ সরকার দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান ঢাকা এলে সারাদেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার জন্য প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ায় মওলানা ভাসানী, শামসুল হকসহ ১১ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে; যা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।
ঝ. বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা (Negligence to Bengali Language)
পাকিস্তানের বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ঐক্য বন্ধন সৃষ্টির জন্য প্রথম থেকেই শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপপ্রয়াস চালায়। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন এমনকি ক্ষমতার মোহে বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানসহ মুসলিম লীগের ক্ষমতাশালী নেতারা উর্দুর পক্ষে ছিলেন। মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামান পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক মাস আগে (১৭ মে, ১৯৪৭) উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব দেন তা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এগিয়ে নিয়ে गान। আলী ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় পরিষদে বক্তৃতা এবং পরের মাসে জিন্নাহ পূর্ববাংলায় এসে উর্দুকে
পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা করার ঘোষণা দেন ।
মুসলিম লীগের পূর্ববাংলার নেতাদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। ড. রঙ্গলাল সেন পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগের ৪টি উপদলের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে নাজিমুদ্দিন-আকরম খাঁ গ্রুপ, সোহরাওয়া আবুল হাশিম গ্রুপ, ফজলুল হক গ্রুপ, মওলানা ভাসানী গ্রুপ। প্রথম গ্রুপ ছাড়া সকলেই বাংলা ভাষাকে পূর্ববাংলার অন্যত
রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে ছিলেন।
পরবর্তীতে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন (১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ)-কে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উল্লেখ ঘটে তা-ই ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। বাঙালির গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হয় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান লাভের মাধ্যমে।
মুসলিম লীগের অবক্ষয়
Degradation of Muslim League
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের পর পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে করাচিতে। আর সেই কাউন্সিল অধিবেশনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ বিভক্ত করে পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাকিস্তান মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হলে কমিটি কর্তৃক প্রণীত গঠনতন্ত্র ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমোদিত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জীবদ্দশায় মুসলিম লীগ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর লিয়াকত আলী খান নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই মুসলিম লীগ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাই পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের মোট ৪৬৫ জন সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিল মাত্র ১৮০ জন। ফলে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে (১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল) প্রধানমন্ত্রী পদাধিকার বলে সভাপতি নিযুক্ত হবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
পশ্চিম পাকিস্তানে মানকী শরিফের পীরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ (মে, ১৯৪৯) এবং পূর্ববাংলায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ (২৩ জুন, ১৯৪৯) গঠিত হয়। পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ দুর্বল হয়ে পড়ে, যা ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে প্রমাণিত হয়। মুসলিম লীগের পরাজয় নিশ্চিত জেনে সরকার পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অন্য ৩৪টি আসনের উপনির্বাচনের আয়োজন করেনি এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা হয়। পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পদত্যাগ করলে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিল অধিবেশনে নূরুল আমিন পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন । ভাষা আন্দোলনে মুসলিম লীগ জনপ্রিয়তা হারালে-এর প্রভাব পড়ে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময়। নির্বাচনের পর নূরুল আমিন ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন ।
নূরুল আমিনের পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিত ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন বসে। সেখানে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগের ধস নামে। নূরুল আমিনের সঙ্গে আরও পদত্যাগ করেন পার্টির সহ-সভাপতি খাজা হাবিবুল্লাহ, ট্রেজারার এম.এ. সলিম, যুগ্ম-সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান ও মঈনুদ্দিন চৌধুরী এবং প্রচার সম্পাদক সবুর খান। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮-২৯ জানুয়ারি পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আবদুর রব নিশতার সভাপতি নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা মুসলিম লীগ থেকে কিছু গণপরিষদ সদস্যদের নিয়ে রিপাবলিকান পাটি (মে, ১৯৬৫) গঠন করলে পাকিস্তানে মুসলিগ লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর এই প্রথমবার মুসলিম লীগ কেন্দ্ৰীয় ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয় ।
সামরিক আইন চলাকালীন (১৯৫৮-৬২) সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সামরিক আইন তুলে দেয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। আইয়ুব খান-এর অভিপ্রায় অনুযায়ী চৌধুরী খালিকুজ্জামান ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর করাচিতে মুসলিম লীগের কনভেনশন আহ্বান করেন এবং 'কনভেনশন মুসলিম লীগ' গঠন করেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুব খান কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, মোনায়েম খান কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ঘোষিত মেনিফেস্টোর শিরোনাম দিয়েছিলেন 'মাই মেনিফেস্টো' অর্থাৎ একটি দলের নয়, তা ব্যাক্তি আইয়ুবের মেনিফেস্টো ছিল।
এমনি অবস্থায় মুসলিম লীগের প্রাক্তন নেতারা ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর ঢাকায় গঠন করেন কাউন্সিল মুসলিম লীগ। কাউন্সিল মুসলিম লীগ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৬৫-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ দল মিস ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করেছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ দল মাত্র একটি আসন লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ একটি পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী ভূমিকা পালন করে। এমনকি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল গঠিত শান্তি কমিটি'র আহ্বায়ক হয়েছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রধান খাজা খয়েরউদ্দিন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]