বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর। (Discuss About the Geographical Characteristics of Bangladesh.)

Kographical Features
দ্বীপ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আজকের বাংলাদেশ মোট ৮টি বিভাগের আওতায় ৬৪টি জেলা ও ৪৮৯টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত। উর্বর পলিমাটির দেশ এ বাংলাদেশ, ল বিধায় সময়ের মাপকাঠিতে নবীন। পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদী পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিক থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে একযোগে এ সুবিশাল ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। এ দেশের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমাকে অতি প্রাচীন কিছু উচ্চভূমি ব্যতীত সমগ্র দেশ এক বিস্তীর্ণ বৈচিত্র্যহীন সমভূমি। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড উত্তর-পশ্চিম হাতে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ক্রমশ ঢালু হওয়ায় প্রবাহিত নদনদীসমূহ উত্তর দিক হতে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রবাহিত
NICHOWI
আলোচনার সুবিধার্থে ভূমির বন্ধুরতার পার্থক্য ও গঠনের সময়ানুক্রমিক দিক থেকে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা :
J. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ;
প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ;
উপকূলীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল ।
সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি ও
১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ (Hills of Tartiary Age) : টারশিয়ারি যুগে হিমালয় পর্বত গঠিত হবার সময় এসকল পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছিল বলে এ অঞ্চলকে টারশিয়ারি যুগের পাহাড়িয়া অঞ্চল বলা হয় । রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকাগুলোর সমন্বয়ে এ অঞ্চল গঠিত। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এ পাহাড়গুলোকে আসামের লুসাই এবং মিয়ানমারের আরাকান পাহাড়ের সমগোত্রীয় বলে মনে করা হয়।
টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
ক. উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ : ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার উত্তর ও উত্তর-
পূর্বাংশ এবং মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের দক্ষিণাংশের ছোটবড় বিচ্ছিন্ন পাহাড়গুলো নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এদের মাঝে ময়মনসিংহ এলাকার গারো পাহাড়ের পাদদেশ ৭২ বর্গমাইল, যার গড় উচ্চতা ২০০-৩০০ ফুট। সিলেট শহরের উত্তর-পূর্বদিকে ১৮৬ বর্গ কি.মি, যার গড় উচ্চতা ৬০-৯০ মিটারের বেশি নয়। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-সীমানায় অবস্থিত ত্রিপুরা পাহাড় নামে পরিচিত ভূমির গড় উচ্চতা ৬০-৩১০ মিটার। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক শহরের উত্তরে প্রায় ৪০ কি.মি স্থান নিয়ে গঠিত ছাতক পাহাড়ের গড় উচ্চতা ৪০-৬০ মিটার।
খ. দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ : চট্টগ্রাম জেলার অংশবিশেষ, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত পাহাড়গুলো নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। ৬১০ মিটার গড় উচ্চতাবিশিষ্ট এ অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মাঝে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়)-এর উচ্চতা প্রায় ১,২৩১ মিটার (৪,০৩৯ ফুট) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ক্রেওক্রাডং-এর উচ্চতা ৪,০১২ ফুট। এ অঞ্চলের পার্বত্যভূমি কৃষিকাজের জন্য বিশেষ উপযোগী নয় বিধায় স্থানীয় অধিবাসিগণ জুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে।
২. প্লাইস্টোসিন কালের সোপানসমূহ (Stairs of Plaistochin Age) : প্লাইস্টোসিন যুগের (খ্রিস্টের জন্মের ১৫,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত) আন্তঃবরফ গলা পানিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়ে এসব চতুরভূমি গঠিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। প্লাইস্টোসিন কালের সোপানসমূহকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায় । যথা :
ক. বরেন্দ্র ভূমি : ৯,৩২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট বরেন্দ্র ভূমি প্লাইস্টোসিন কালের বৃহত্তম সোপান হিসেবে পরিচিত। প্লাবন ভূমি থেকে ২০-৪০ ফুট গড় উচ্চতাবিশিষ্ট বরেন্দ্র ভূমি কৃষিকাজের জন্য বিশেষ উপযোগী। এ অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ ফসল ধান।
দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয়
আজানের পর ৪,১০৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এবং উত্তরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ হতে দক্ষিণে প্লাইস্টোসিনকালের দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চভূমি। এ গড়ের পূর্ব ও দক্ষিণাংশের
(২০ ফুট) এবং পশ্চিম ও উত্তর দিকের উচ্চতা ৩০ মিটার (৯৮ ফুট)।
লালমাই পাহাড় : ৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট লালমাই পাহাড় কুমিল্লা শহরের ৮ কি.মি দক্ষিণে লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত বিস্তৃত। এর গড় উচ্চতা ২১ মিটার। এ পাহাড়ের পাদদেশে আলু, তরমুজ ইত্যাদি চাষ হয়।
সাম্প্রতিকালের প্লাবন সমভূমি ( Recent Flood Land) : বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি এক অপরূপ সাজে সজ্জিত। কোথাও উচু, কোথাও নিচু আবার কোথাও সমান। টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ এবং প্লাইস্টোসিন কালের সোপানসমূহ ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ নদীবিধৌত এক বিস্তীর্ণ সমভূমি, যার আয়তন প্রায় ১,২৪,২৬৬ বর্গকিলোমিটার। এ সময় সমভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকার স্তর খুব গভীর ও ভূমি অতি উর্বর এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী।
এ অঞ্চলটি সর্বত্র একইরূপ নয় বলে একে আবার পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
ক. কুমিল্লার সমভূমি : ৭,৪০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এ সমভূমি কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধিকাংশ এবং নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর ও হবিগঞ্জ জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর গড় উচ্চতা ৩-৬ মিটার। বর্ষাকালে এ অঞ্চলটি প্রায়ই ডুবে যায়।
খ. সিলেট অববাহিকা : বৃহত্তর সিলেটের ২,৮০০ বর্গমাইল জুড়ে অনেকগুলো নিচু জলাশয় বা হাওর নিয়ে এ অঞ্চল
গঠিত, যার গড় গভীরতা ৩০-৪০ ফুট।
গ. পাদদেশীয় পলল সমভূমি : হিমালয় পর্বত থেকে আনীত পলল দ্বারা গঠিত এ সমভূমি বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর
জেলার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিস্তৃত। ধান, পাট, ইক্ষু এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়।
ঘ. গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা প্লাবন সমভূমি : বাংলাদেশের মূল প্লাবন সমভূমি নামে পরিচিত এ অঞ্চল জামালপুর, .
শেরপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা ও দিনাজপুরের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত।
চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী সমভূমি : চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল নিয়ে এ সমভূমি
গঠিত। প্রায় ১৫৫ কি.মি দীর্ঘ পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার সৈকত এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এছাড়াও পতেঙ্গা ও টেকনাফ সৈকত এ অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ।
৪. উপকূলীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল (Coastal Delta Area) : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সমভূমিকে সাধারণত ব-দ্বীপ বলা হয়। উপকূলীয় ব-দ্বীপ অঞ্চলকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
ক. সক্রিয় ব-দ্বীপ : পূর্বে মেঘনা নদীর মোহনা থেকে পশ্চিমে গড়াই মধুমতি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ব-দ্বীপ সমভূমির
পূর্বাংশকে সক্রিয় ব-দ্বীপ বলা হয় ।
খ. মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ : বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলীয় সমভূমির মধ্যে গড়াই ও মধুমতি নদীর পশ্চিমাংশকে মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ বলা হয়।
গ.
স্রোতজ সমভূমি : এ সমভূমি অঞ্চলের অধিকাংশ স্থান জুড়ে ম্যানগ্রোভ বনভূমি বিদ্যমান, যা সুন্দরবন নামে পরিচিত। এর আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের ভূমিরূপ ক্রমপরিবর্তনশীল। প্রতিবছর ১,৭০০ মিলিয়ন টন পলি বিভিন্ন নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এখানে সঞ্চিত হয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূমিরূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরের মধ্য সোপান এলাকায় প্রায় ৪০,000 বর্গমাইল নয়াভূমির উত্থান। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে M. Harunur Rashid যথার্থই বলেছেন- "The geographical position of Bengal is peculiar. Though an integral part of the sub continent, Bengal has none of its well kown physical features such as deserts, mountains, plateaus and valley's. Except the highland margins in the north and along the Eastern and Western borders, it is almost entirely flat-surfaced and alluvial, intersected by a tragled network of rivers channels that drains almost the whole of northern India. It contains perhaps the largest delta in the world."
১.১.৬. প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক বিভাজন
Geographical and Natural Classification
জনগোষ্ঠীর তথা মানবমনে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক বিষয়াদির প্রভাব সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই একটি প্রমাণিত সত্য বলে চিহ্নিত হয়ে আসছে। একটি জনপদকে বিভিন্ন বিষয় বিচারে বিভাজন করা যেতে পারে। সেই এলাকার ভূমির গঠন- প্রকৃতি, পাহাড়-টিলার বিস্তৃতি, জনবসতির ধরন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় আঞ্চলিকভাবে বিভাজন করার পদ্ধতিও কার্যকর আছে। আবার সেই জনবসতির ব্যবহৃত ভাষা-সংস্কৃতির কথাও আসতে পারে আঞ্চলিক বিভাজনের বিচারে। এখানে পূর্ববঙ্গকে যে বিচারে বিভাজন করা হয়েছে তা হলো সেই এলাকার প্রকৃতি ও নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন পূর্ববঙ্গকে প্রকৃতি ও নৈসর্গের বিচারে ২টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে; যথা—
ক. উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের পর্বতমালা ও
খ. বিস্তৃত পলিমাটির সমতল ভূমি।
ক. উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের পর্বতমালা (North-East and South East Mountains)
বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বে সিলেট ঘিরে তার উত্তর এবং পূর্বে আছে ছোটবড় পাহাড় বা টিলা। এসব পাহাড়-টিলা উচ্চতায় সাধারণত ১০০ থেকে ২০০ ফুট। আরো কিছু টিলা আছে সুরমা এবং কুশিয়ারার মাঝে গোলাপগঞ্জ ও মধুগঞ্জের কাছে। কুশিয়ারার দক্ষিণে ২টি পাহাড়ের সারি রয়েছে যেগুলো সমুদ্র থেকে খুব বেশি হলে ৮০০ ফুট উঁচু। এসব পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাথারিয়া, বাংলা, রাজকান্দি, কালিমারা, সাতগাঁও এবং রঘুনন্দন। নদী ও প্রশস্ত সমতলভূমির পরিবর্তন বৈচিত্র্য এনেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাতেও। এখানে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা প্রায় ৪,০০০ ফুট। এখানকার ১০টি পর্বতমালা-বাসিতাং, মারাঙ্গা, কায়ানারাং, বিলাইছড়ি, ভাঙ্গামুরা, বাটি, মইন, ধরকল, সিতা-পাহাড় ও ফটিকছড়ির অবস্থানও বৈচিত্র্যময়। চট্টগ্রামের উপকূল ঘিরে আছে সীতাকুণ্ড ও চন্দ্রনাথ পাহাড়। বাংলাদেশের এসব পাহাড়ি এলাকা বিদেশি পর্যটকদের বেশ আকর্ষণ করে বিধায় পর্যটন শিল্পের বিকাশের সুযোগ রয়েছে এখানে ।
বর্তমান বাংলাদেশের বিশেষ করে উত্তরে, উত্তর-পূর্বে, পূর্বে এবং পূর্ব-দক্ষিণে রয়েছে ছোটবড় বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড়। এ পাহাড়ি প্রকৃতি মানব চরিত্রে পরিশ্রমসাধ্য জীবনধারার সৃষ্টি করে থাকে। আর এ কারণেই সমতল ভূমির মানুষের তুলনায় পাহাড়ি নারী-পুরুষ হয়ে থাকে কষ্টসহিষ্ণু এবং কঠোর পরিশ্রমী ।
বাংলাদেশের পাহাড়ে ও সমতলভূমিতে বসবাস করে বেশকিছু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এক সময়কার উপজাতি পরিচিতি থেকে পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের কাছে আদিবাসী হয়ে ওঠে। সম্প্রতি সরকার সংবিধান সংশোধন করে এদের নামকরণ করেছেন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রব্যবস্থায় এদের যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন বাংলাদেশে বসবাসকারী এরা জাতি হিসেবে বাঙালিদের থেকে আলাদা। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি, জীবন ও জীবনধারাও ভিন্নতর ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সিলেটের একাংশে বাস করেন বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। সিলেটের প্রধান গোষ্ঠীগুলো হলো- খাসিয়া, মিথেরি, পাথর এবং ত্রিপুরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে মগ, চাকমা, তংচাঙ্গা, ত্রিপুরা, শক, মুরং, গারো, খিয়াং বনযোগী, পাংখো এবং খাসি। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও দিনাজপুর অঞ্চলে আছে গারো এবং সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সমতল ভূমির অধিবাসীদের মতোই তারা গ্রামের বাসিন্দা। এদের অনেকে গ্রহণ করেছেন বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্ট-ধর্ম। ময়মনসিংহের গারোদের সঙ্গে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় অনেক দিনের। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলেন। বর্তমানে সমতল ভূমির সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী আরো বেশি পরিচিত হচ্ছেন। তবে সমতল ভূমিকে ভয়ের চোখে দেখেন পার্বত্য অধিবাসীরা। আর এ ভীতির কারণ সমতল ভূমি দ্বারা তারা শোষিত হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রথমে একটি প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে ধরা হয়েছিল যা আজো এ ভিন্ন নামে পরিচিত ।
সাধারণত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিকূলতার সাথে টিকে থাকার উদ্দেশ্যেই কষ্টসহিষ্ণুতার মাপকাঠিতে জীবনধারাকে প্রবাহিত করে থাকেন। তাই সচরাচর এরা বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর ওপর তেমন একটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় না, বরং ওরাই প্রভাবিত হয়ে কিছুটা বদলে নিতে চেষ্টা করে জীবনধারাকে।
প্রত্নতাত্ত্বিক মি. ব্রদেল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সমুদ্রতটবর্তী সভ্যতার সঙ্গে পার্বত্যবাসীদের সম্পর্কহীনতার কথা বলেছেন। পার্বত্যবাসীরা সব সময় নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত দেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল এবং ব্রিটিশ সরকার কোনো সময় তাদের ওপর খুব বেশি প্রশাসন চাপিয়ে দিতে চায়নি। পূর্ববঙ্গে বসবাসরত নৃ- গোষ্ঠীরা সমতলভূমিকে প্রভাবিত করতে পারেনি, সমতলভূমি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
খ. কিস্তৃত পলিমাটির সমতল ভূমি (Extended Silt Land)
বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণের পাহাড়ি এলাকা বাদে বাকি সকল এলাকাই সমতল ভূমি। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় বাংলাদেশকে যে সকল এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে তা করা হয়েছে কিছু কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য বিচারে। প্রচলিতভাবে এসব বিভাজনকে পরিচিত করে তোলা আজ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। আর তা না করতে পারলে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।
পূর্ববঙ্গের বদ্বীপ সমভূমিকে ৩টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে :
১. পশ্চিম বদ্বীপ সমভূমি (কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের উত্তরাংশ ও খুলনার উত্তরাংশ)
পূর্ব বদ্বীপ সমভূমি (মধ্য ও দক্ষিণ ফরিদপুর এবং বরিশাল)
বদ্বীপে মোহনা বা সুন্দরবন এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বরিশাল ।
নফিস আহমদ (১৯৫৮) লিখেছেন যে, যদি ফরিদপুর শহরের উত্তর থেকে সাতক্ষীরার দক্ষিণ পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর একটি কাল্পনিক রেখা টানা যায় তাহলে এ রেখার উত্তর এবং পশ্চিম হবে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর এলাকা। অন্যদিকে, পূর্বে আছে সজীব নদী দ্বারা গড়ে ওঠা অঞ্চল। নফিস আহমদের এ মন্তব্য আমাদের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকেই প্রকাশ করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা তথা একক বাংলা ভাষার বন্ধনে একটি নির্দিষ্ট ভাষা-সংস্কৃতির জীবনধারার এ এলাকার সমতল ভূমির বৈশিষ্ট্য নদীনালা আর খালবিলের জলাশয়ের পাশের উর্বর কৃষি এলাকা। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনার পাশে সমতল ভূমি হলো ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, কুমিল্লা এবং সিলেটের কিছু অংশ। আর উত্তরে পুরনো পাললিক এলাকায় পড়ে দিনাজপুরের কিছু অংশ, রংপুর, বগুড়ার কিছু অংশ এবং রাজশাহী । তাই কৃষির কার্যকর প্রযুক্তিতেও রয়েছে ভিন্নতা ।
বাংলাদেশের এ একঘেঁয়ে দিগন্ত-বিস্তৃত সমতল ভূমিতে খানিকটা বৈচিত্র্য এনেছে ৩টি সুস্পষ্ট পুরনো এলাকা। এগুলো হলো— মধুপুর, বরেন্দ্র এবং লালমাই। এসব স্বকীয় এলাকার জনজীবনও অনেকাংশে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের ।
মধুপুরের আয়তন প্রায় ১৬,০০০ বর্গমাইল। এলাকার বিস্তৃতি ময়মনসিংহ জেলার কেন্দ্র থেকে ঢাকার উত্তরাংশ পর্যন্ত এবং এ অঞ্চলের মাটি রক্তিম। ময়মনসিংহের উত্তরাংশ, জয়দেবপুর, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর জুড়ে আছে দীর্ঘ গজারির জঙ্গল আর- এর ধার ঘেঁষে আছে যমুনা, পুরনো ব্রহ্মপুত্র এবং ধলেশ্বরী ।
প্রাচীন বাংলা কিংবা বর্তমান বাংলাদেশের ভূমির বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বলতে গেলে এ বরেন্দ্র এলাকা দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পৃথক বা ভিন্নতর।
বরেন্দ্রের আয়তন প্রায় ৩,৬০০ বর্গমাইল। বরেন্দ্রের অন্তর্গত হলো রংপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, দক্ষিণ দিনাজপুর, বগুড়ার উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং রাজশাহীর দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ। মাটির রং হলদে থেকে লাল এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু জলাজংলা আর বিশাল বৃক্ষ। তাই এখানকার কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনাও অনেকাংশে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের।
বৃহত্তর কুমিল্লার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের অল্প কিছু জায়গা লালমাই'র অন্তর্গত। লালমাই পাহাড় নামে এ এলাকা পরিচিত, যদিও উচ্চতা কোথাও ২০ থেকে ৪০ ফুটের উর্ধ্বে নয়। মাটি এখানকার রক্তিম। বৃহত্তর কুমিল্লার লালমাই পাহাড়, এখানে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক স্থাপত্যকলার নিদর্শন। শালবন বিহার এ লালমাই পাহাড়ি এলাকার আরেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। মানুষ সব সময় সমতল ভূমি জয় করতে চেয়েছে, কারণ সমতলভূমির জয় মানুষের আজীবনের স্বপ্ন। প্রত্নতাত্ত্বিক মি. ব্রদেশ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, সমতল ভূমি মানেই প্রাচুর্য, সম্পদ আর স্বাচ্ছন্দ্য নয়। ইংরেজ সিভিলিয়ানদের রিপোর্ট, বই-পত্র, অনেক ঐতিহাসিকের রচনা বা লোকগাঁথা ইত্যাদি পড়লে মনে হবে, বাংলার সমতলভূমির সাধারণ মানুষ অর্থাৎ কৃষকরা সুখেই কালাতিপাত করেছেন। বাংলাদেশের মানুষকে এ সমতল ভূমি জয় করতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল বন্যা ও মহামারি। জমি উদ্ধার করেই বাঙালি কৃষক বাংলা/বাংলাদেশকে শস্য শ্যামল করে তুলেছিলেন। আমাদের স্বাধীনতার আগেও কয়েকটি বড় শহর ছাড়া, অধিকাংশ জেলা শহর ও বর্ধিষ্ণু গ্রামের মধ্যে তফাৎ ছিল কম।
প্রাচীন বাংলাই হোক আর বর্তমান বাংলাদেশই হোক এখানে রয়েছে নানাবিধ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকলার নিদর্শন, যা বর্তমান আর আগামী প্রজন্মের জানার দরকার রয়েছে। তাই এসব বিষয়াদির সম্পৃক্ততার গুরুত্ব অনেক।
আবহমানকাল থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল এবং সাগরপাড়ের দেশ থেকে ইংরেজ, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, আরব, আর্মেনিও প্রভৃতি বিদেশিরা এসেছিলেন বাংলাদেশে। বসতি স্থাপন করেছেন তবে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। আর এ সম্প গড়ে না ওঠার কারণেই আমাদের চলমান জীবন সংস্কৃতিতে-এর প্রভাব পড়ে নি। ঐতিহাসিকগণ এটাকে চিহ্নিত করলেও তা অপ্রতুল।
উনিশ শতকে ঢাকায় কৃষি বিষয়ক এ ধরনের একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা যায়, রিপোর্টে বলা হয়েছিল ২৫ বিঘা জমির মালিক এক সম্পন্ন পরিবারের কথা। সফিউদ্দিন জোয়ারদার রাজশাহীর ওপর এ ধরনের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ৫ বিঘা জমি আছে এমন কৃষকের বার্ষিক ঘাটতি ১০৬ রুপি। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী সকালে এদের নাস্তা ছিল ভাতের সঙ্গে বাসি ডাল বা তরকারি অথবা শুধু নুন বা লংকা, দুপুরে ও রাতে ভাত, তরকারি ও ডাল। ডিম বা মুরগি ছিল বিলাসিতা। বাঙালির জীবনধারাতে কষ্টের কাহিনী যেমনি রয়েছে তেমনি রয়েছে ভোগ বিলাসিতার দৃষ্টান্তও। বাণিজ্যের নামে এদেশে এসে শাসক হয়ে বসা ব্রিটিশের কাছ থেকে ১৯০ বছরের উৎপাদন-অর্থনৈতিক শোষণের পর পাকিস্তান নামে যে বছর স্বাধীনতা লাভ করে এ এলাকার মানুষ, সেই বছরটির প্রাকৃতিক, প্রশাসনিক ও উৎপাদন- অর্থনৈতিক বিষয় জানা দরকার। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগেও বাংলাদেশের অনেকাংশ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ ও পতিত। এর আগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা গ্রামের আশপাশে কিছু খেতখামার ছাড়া সমতল ভূমির প্রায় অধিকাংশ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেও চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা হয়ে ঢাকা যাওয়ার রাস্তা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]