ভাষা আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর । (Discuss the Background of Language Movement.)

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি Background of Language Movement
ভাষা আন্দোলনের মতো একটি গণমানুষ সম্পৃক্ত প্রতিবাদ-সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি এবং তা হতেও পারে না। অবশ্যম্ভাবী গণমানুষ সম্পৃক্ত এ অনন্য ঘটনার পিছনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা তাই অত্যাবশ্যক । এম আর আখতার মুকুল তাঁর 'ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা' শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ প্রশ্নটি পাকিস্তানের জন্মের আগেই তৎকালীন রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও মনীষীদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।' ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত'র ইংরেজি বক্তৃতার একটি সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়। ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮-এর দৈনিক 'ভোরের কাগজ'-এ প্রকাশিত সরদার ফজলুল করিমের ‘আসুন আর একবার ঐ পথে হেঁটে আসি' শীর্ষক আলোচনায়। সেটি এরূপ : 'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, স্যার, আমি প্রস্তাব করি রুল ২৯-এর সাবরুল (১)-এর ২য় লাইনে 'ইংরেজি' শব্দটির পর ‘অথবা বাংলা' শব্দ দুটি বসানো হউক । আমার নামে যে প্রস্তাব এ সংসদে উত্থাপিত হয়েছে,-এর ব্যাপারে এ প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারি যে, প্রাদেশিকতার কোনো দৃষ্টিভঙ্গি হতে আমি এটি উত্থাপন করি নি। আমার মনোভাব এরূপ যে, যেন সদস্যবর্গ গভীরভাবে বিষয়টি বিবেচনা করেন।'
'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এ কথা আমি জানি, বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখব যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা হচ্ছে বাংলা। কাজেই প্রাদেশিক হলেও যেহেতু রাষ্ট্রের অধিকাংশের ভাষা বাংলা, সেই কারণে বাংলা ভিন্ন মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি now at মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ অধিবাসী বাংলা বলে। এ যদি অবস্থা হয় তাহলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী
'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি জানি, আমার এ মনোভাব দ্বারা আমি আমাদের প্রকাশ করছি। এ প্রসঙ্গে মিস্টার প্রেসিডেন্ট, একটি তথ্য আমি আপনাকে প্রদান করতে চাই যে, পূর্ব যেখানে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের বাস, সেখানেও একজন সাধারণ মানুষ যদি একটি র্ডার করতে যায়, তখন সেখানে সে কেবল উর্দুতে কিংবা ইংরেজিতে লিখিত একটি ফরম পায়। বাংলায় লিখিত কোনো ফরম নয়। প একজন গরিব কৃষক, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তার ছেলেটি পড়ে, তার নিকট টাকা পাঠানোর জন্য গ্রামের একটি অ গেলেন। তিনি টাকা প্রেরণের একটি ফরম চাইলে তাকে উর্দু ভাষায় লিখিত একটি ফরম দেয়া হলো। সঙ্গে তিনি কিছু বুঝবেন না। তাকে আরও দূরবর্তী কোনো শহরে যেতে হবে। সেখানে কারও দ্বারা এই ফরমের অনুবাদ করাতে পরেই মাত্র দরিদ্র এ কৃষকের পক্ষে তার ছেলের নিকট টাকা পাঠানো হবে।
'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, মনে করুন, একজন দরিদ্র কৃষক কিছু জমি বিক্রয় করলেন কিংবা ক্রয় করালেন এবং এর জন্য তিনি স্ট্যাম্প ভেন্ডারের নিকট গেলেন। স্ট্যাম্প ক্রয়ের জন্য টাকা দিলেন। কিন্তু তার পক্ষে বোঝা সহ ा ঠ স্ট্যাম তাকে দেয়া হয়েছে কিনা। কারণ স্ট্যাম্পের মূল্য বাংলায় লেখা নয়। স্ট্যাম্পের মূল্য উর্দু এবং ইংরেজিতে । সাধারণ মানুষের ইহাই অভিজ্ঞতা। একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা এমনি হওয়া উচিত, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। *আমাদের ৪ কোটি ৪০ লক্ষ সাধারণ মানুষ এ সংসদের কার্যবিবরণীর কিছু বুঝতে অক্ষম। কারণ যে ভাষায় ইহা পরিচালিত হয় সে ভাষা তাদের অজানা। ২৯ নং রূপে ইংরেজির সম্মানজনক উল্লেখ আছে। তাই যদি হয়, ২৯ নং বুলে বাদি লিখিত থাকতে পারে যে, সংসদের কার্যবিবরণী উর্দু অথবা ইংরেজিতে পরিচালিত হবে, তাহলে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের মুখে ভাষার একটি সম্মানজনক রুল নং ২৯-এ কেন থাকতে পারবে না?'
“মিস্টার প্রেসিডেন্ট, তাই আমার এ প্রস্তাব দ্বারা লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের অনুভূতিকেই প্রকাশ করছি এবং সে কারে আমাদের রাষ্ট্রে 'বাংলা' একটি প্রাদেশিক ভাষা নয়। বাংলা ভাষাকে 'রাষ্ট্রের' ভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করতে হবে এবং সে কারণে জনাব সভাপতি, আমি প্রস্তাব করছি, 'ইংলিশ' শব্দের পরবর্তীতে 'বেঙ্গলি' এ শব্দটিও ২৯ নং বুলে অন্তর করা হউক।'
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি সরকার এ স্লোগানের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বভাবতই ধর্মই ছিল পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। সামাজিক-রাজনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় শক্তিশালী অনুঘটক ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে সেখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাছাড়া ধর্মীয় দ্বিজাতি তে ভিত্তিতে সৃষ্ট দুই খণ্ডের পাকিস্তানের বেশিরভাগ জনগণ কোন ভাষায় কথা বলেন তাও বিচারে আনা হয়নি। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ৯৭% এবং পূর্ববাংলার ৮০% অধিবাসী ছিল মুসলমান। অধিকাংশ অধিবাসীর ধর্ম এক হলেও তাদের ভাষা ছিল ভিন্ন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তান জনগণের শতকরা হার ছিল যথাক্রমে নিম্নরূপ : bangla language census 1952 বি.দ্র. এখানে ১০২.১১ হওয়ার কারণ অনেকে নিজেকে দ্বিভাষী বলে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন বা ব্রিটিশ ভারতের বহু ভাষাভাষীর দেশ পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার উত্থাপিত প্রশ্নটি স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। এ সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী তৎকালীন পাকিস্তানের অযৌক্তিক একগুঁয়েমী শাসকগোষ্ঠী। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য চৌধুরী খালিকুজ্জামান ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মে তারিখে দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।' আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত এ বিষয়ে পৃথক বিতর্ক শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর 'পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা' শীর্ষক নিবন্ধে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলার দাবিকে অগ্রগণ্যতায় রেখে বলেন, 'যদি-এর পরেও অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন আসে, শুধু তা হলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে।' ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রতি বহু প্রখ্যাত, স্বল্পখ্যাত এবং অখ্যাত লেখক তাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে করাচিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সুপারিশ করেন যে, 'উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।'
এমনি পরিস্থিতিতে পূর্ববাংলার শিক্ষিত সমাজ এবং ছাত্রসমাজের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে একটি প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও বাংলা ভাষার যৌক্তিক দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর 'পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যুবলীগের' এক কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় :
বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছেড়ে দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হউক । আরও একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমুদ্দুন মজলিশ' ভাষার প্রশ্নে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ সংগঠন ছাত্র-শিক্ষক মহলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা-বাংলা না উর্দু' শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের উর্দুর প্রস্তাব সমর্থন করলেও কুমিল্লা জেলার (পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া) কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর এ প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন যে, ‘প্রাদেশিকতার মনোভাব নিয়ে তিনি এ প্রস্তাব করেননি। যেহেতু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মাতৃভাষা বাংলা, সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।' গণপরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মন্তব্য করেন যে, ‘একটি সাধারণ ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবন্ধনের যে প্রয়াস চালানো হচ্ছে তা বানচাল করার জন্যই বাংলা ভাষার প্রস্তাব করা হচ্ছে। উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের দাবির ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে। পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তাই পাকিস্তানের ভাষা মুসলমানদের ভাষা হওয়া উচিত। যেহেতু পাকিস্তানের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা উর্দু, অতএব উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয় ।' অনুষ্ঠিত বিতর্কের পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত প্রস্তাব ভোটে দেয়া হলে তা অগ্রাহ্য হয়।
পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭.২% ভাগ লোকের মাতৃভাষা উর্দু হলেও উর্দুকেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছিল। পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাকটিকেট, মানি অর্ডার ফরম রেলের টিকেট, স্ট্যাম্প প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দুভাষার ব্যবহার ছিল। তাছাড়া পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়া হয় এবং পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্বাচন করা হয়। পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি মুসলমান সদস্যগণ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন। বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় পূর্ববাংলায় গণআন্দোলনের সূচনা হয়। পাকিস্তান গণপরিষদে দেয়া লিয়াকত আলী খানের ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ববাংলায় ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিকসহ সকল বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন ।
উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ঢাকার ছাত্রবৃন্দ ধর্মঘট পালন করেন এবং ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বাংলা ভাষার সমর্থনে স্লোগান দিতে দিতে রমনা এলাকায় মিছিল করে। মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শেষ হলে সেখানে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করে তমুদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাশেম। সভায় বক্তারা পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে প্রস্তাব করেছেন তা কোনো সাম্প্রদায়িক চিন্তা নয় বরং বাংলা ভাষাভাষীদের যৌক্তিক দাবি বলেই বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন।
বাংলা ভাষার সংগ্রামকে সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ২ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয় এবং নিম্নলিখিত হল ও সংগঠনের প্রত্যেকটি থেকে দুজন করে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংগঠন ও হলসমূহ যথাক্রমে- তমুদ্দুন মজলিশ, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হলসহ অন্যান্য ছাত্রাবাস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। কমিউনিস্ট দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম।
বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে সংগঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ (১৯৪৮) পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে সেক্রেটারিয়েটের বাইরে সমবেত হয় এবং তাতে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করলে কমপক্ষে ৫০ জন ছাত্র গুরুতর আহত হয়। উক্ত সমাবেশে ছাত্ররা প্রাদেশিক গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিনের ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের কড়া সমালোচনা করে গণপরিষদ থেকে পূর্ববাংলার সদস্যদের পদত্যাগের আহ্বান জানায়। ১১ মার্চের পরবর্তী দিনগুলোতে ছাত্রসমাজের এ আন্দোলন আরও জোরদার হতে থাকে এবং সাধারণ জনগণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছে যে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ১৫ মার্চ আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। উক্ত আলোচনা সভায় ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয় । এ চুক্তিনামার শর্তসমূহ যথাক্রমে নিম্নরূপ (Conditions of this Agreement is Given below Accordingly)
২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষা প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে ।
পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন ।
১৯৪৮-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে ।
এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা । তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে। আন্দোলনে যাঁহারা অংশগ্রহণ করিয়াছে তাঁহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না। সংবাদপত্রের ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে ।
২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে ।
সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে এ আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই ।
খাজা নাজিমুদ্দিন আলোচনা সভায় স্বীকার করেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কোনো স্বদেশবিরোধী চকা । আন্দোলনকারীদের দাবি যথার্থ বলেই তিনি চুক্তিনামায় নিজহাতে লেখেন যে, 'He was satisfied that the movement inspired by enemies of the state' সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মুদি ी করেছেন তা জানার জন্য ছাত্ররা ১৭ মার্চ (১৯৪৮) প্রাদেশিক পরিষদের সভাকক্ষের দিকে মিছিল সহকারে অগ্রসর হে পুলিশ লাঠিচার্জ ও বন্দুকের ফাঁকা গুলি করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে নাজিমুদ্দিন অনন্যোপায় হয়ে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী পূর্ববাংলা সফরে আসার আহবান জানান। এমনি পরিস্থিতিতে গভর্নর জেনারেল ১৯ মার্চ পূর্ববাংলা সফরে আসলেও ভাষার প্রশ্নে তিনি স্বৈরাচারী মনোভাব বজায় রাখেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ তিনি ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এ বিশাল জনসভায় দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করেন যে, "Urdu and only Urdu shall be the state Languge of Pakistan." জিন্নাহর এ ঘোষণায় সভার কোনো কোনো অংশ থেকে মৃদু 'নো, নো' ধ্বনি উচ্চারিত হয়। তিনদিন পর মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের 'পঞ্চমবাহিনী' রূপে অভিি করেন যে, 'বাঙালিরা তাদের প্রদেশের সরকারি ভাষারূপে যেকোনো ভাষা নির্বাচিত করতে পারে, তবে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা অবশ্যই উর্দু হবে।' জিন্নাহর এ উক্তির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে উপস্থিত গ্রাজুয়েটবৃন্দ 'না না' উচ্চারণ করে। একই দিনে অর্থাৎ ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে সা করে একটি স্মারকলিপি পেশ করে যাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তিগুলো জানা যায়।
ব্রিটিশ আমলে সরকারি ভাষা হিসেবে ফারসি পরিত্যক্ত হলে উর্দুর প্রচলন বেড়ে যায় এবং উচ্চস্তরের মুসলমানগণ উর্দুকে ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। ভারতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা হিন্দিকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তুতি নিলে মুসলিম লীগের মুসলমান নেতৃবৃন্দ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আলোচনা শুরু করে। তাঁরা বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি করেন। পাকিস্তানের মাত্র ৭.২% নার মাতৃভাষা অন্য ভাষাভাষীরা উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং সেখানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দুর প্রচলন করা হয়। প্রশাসনিক, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, যোগাযোগ প্রভৃতি সকল বিভাগের সদর দফতর পশ্চিম পাকি অবস্থিত হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা এমনিতেই অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল, তার ওপর উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করায় সেখানকার উর্দুভাষীদের জন্য সুবিধা হয় ।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষা আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধী ও ইসলামবিরোধী চক্রান্ত বলে অভিহিত করে বাংলা ভাষাকে ইসলামিকরণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাকে আরবি কিংবা রোমান অক্ষরে পরিবর্তিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর তা দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন (১৯৪৯) কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং তাঁর উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা পুনর্গঠন কমিটি গঠন করে। তবে পূর্ব পাকিস্তানে-এর কড়া প্রতিবাদ হলে এ কমিটির রিপোর্ট ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। সরকার আর রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ হলে অবশ্যই কিছু যুক্তি থাকে। পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনকারীদের বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পেছনে অনেক কার্যকর যুক্তি ছিল, যা পাকিস্তান সরকার জেনেও মানেনি। বাংলা ভাষা ছিল পাকিস্তানের ৫৪.৬০% লোকের মাতৃভাষা। পাকিস্তানের প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে ও অর্থনৈতিক সেক্টরে বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। তারপরও যদি উর্দুকে সরকারি ভাষা করা হয় তাহলে ভাষা সমস্যার কারণে বাঙালিদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়বে। সুতরাং, বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায় উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন তা ক্রমান্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের উৎপাদন-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপলাভ করে। আর সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।
ভাষার প্রতি ভালোবাসায় যখন বাঙালি তীব্র আন্দোলনে উজ্জীবিত তখন সেই অবস্থায় ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাঙালি হয়েও বাংলা বর্ণমালাকে আরবিকরণে তাঁর পরিকল্পনায় ৯ মার্চ (১৯৪৯) মওলানা আকরম খাঁ-এর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ববাংলা ভাষা কমিটি গঠিত হয়। এমনি পরিস্থিতির প্রতিবাদে ঢাকা করেন। ৩১ ডিসেম্বর (১৯৪৮) ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব সমালোচনা করেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কমিটি এ ডিম্ব (১৯৫০) লেখার বিরোধিতা করলে সরকারের উর गा।
অন্যদিকে, পাকিস্তান গণপরিষদের সাংবিধানিক মূলনীতি কমিটি ১ গণপরিষদে পেশ করে, যাতে উর্দুকে পাকি ঢাকায় গঠিত সংগ্রাম কমিটি (১৯৫০) কী সাংবিধানিক মূলনীতি সম্পর্কে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাতে রাষ্ট্রভাষা সারা ও বাংলাকে করার দাবি করা হয়। সংগ্রাম কমিটি ১২ নভের পূর্ববাংলায় বিক্ষোভ প্রদর্শ উক্ত রিপোর্ট প্রত্যাহার করেন। এমনি অবস্থায় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মতিনকে আ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এ কমিটি আন্দোলন-সামে নতুনত্ব থাকে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]