১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারির পটভূমি ও ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা কর। (Describe the Background and Incidents of 21st February of 1952.)

তমুদ্দুন মজলিশ Tomuddun Mojlisih
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের অব্যবহিত পরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুে পাকিস্তান সরকারের এ নীতির বিরোধিতা ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব বা সংগঠন গড়ে উঠে। তাদের মধ্যে তমুদ্দুন মজলিস প্রথম ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল। |
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজামান এবং অপার সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন। বাঙাি বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্থের পর পাি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় । বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ১ সেপ্টেম্বর তমুদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে সোচ্চার হয়ে উঠে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাহিত্য সাময়িকীতে লেখ ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। এ সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত হয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যার আ বিভাগের শামসুল আলম। তমুদ্দুন মজলিস ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা ভাষা সম্পর্কে স খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' এ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করে। বাইরে বাংলাকে বাংলার শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম, অফিস ও আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হয়। বইটিতে পূর্ব বাংলার প্রথিতযশা সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উপস্থাপন করেন। সংগঠনটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ভাষাভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলা ভ মর্যাদা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ Happenings of Language Movement
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্যায় হচ্ছে, ১৯৪৭-৪৮। এ সময়ে ভাষার প্রশ্ন বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা প্রতিবাদ বিক্ষোভে রূপ নেয়। জিন্নাহর ঢাকা ঘোষণা এবং-এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদ ছিল মুখ্য ঘটনা। দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাপ্রবাহ। এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মাটিত হয় ঐতিহাসিক অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। সম্ভবত বাঙালিরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি যারা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মত্যাগ করেছে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। আর তাদের এ আত্মদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্বের সকল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের স্বীকৃতি এটি। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমানে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয়।
পাকিস্তান-পূর্ব ভাষা বিতর্কের ধারাবাহিকতায় নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজধানী করাচিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে পূর্ববাংলার ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তা সর্বসম্মতভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে পূর্ববাংলায় বিক্ষোভ সমাবেশ, ছাত্র ধর্মঘট, প্রাদেশিক আইন পরিষদ ঘেরাও ইত্যাদি কর্মসূচি শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল।
পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত ছিল না; বরং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের এ অগণতান্ত্রিক, পক্ষপাতমূলক ভাষানীতি ও রাজনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই পূর্ববাংলার ছাত্র, যুবক, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এগিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিভিন্ন সংগঠন। এসব সংগঠনগুলোর মধ্যে কামরুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত গণআজাদী লীগ (জুলাই, ১৯৪৭), তসাদ্দক আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক যুবলীগ (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত তমুদ্দুন মজলিশ (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭), একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে (পরবর্তীকালে শামসুল আলম) আহ্বায়ক করে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (ডিসেম্বর ১৯৪৭) এবং তৎকালীন যুবনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসব সংগঠন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার তারিখ স্থির হয়। এদিকে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবিতে পূর্ববাংলায় বিক্ষোভ সমাবেশ, ঘেরাও কর্মসূচি অব্যাহত থাকে । ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট, ১১ মার্চ ঢাকায় বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘট, ১৩ মার্চ ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। অনেক ছাত্র-যুবনেতা গ্রেফতার হন । এমনই এক পরিস্থিতিতে ১৫ মার্চ পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে একটি ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নাজিমুদ্দিন সরকারের আশু লক্ষ্য ছিল উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জিন্নাহর ঢাকা সফরকে নির্বিঘ্ন করা। ঢাকায় আগমনের পর ২১ মার্চ, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন রেসকোর্সে ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ভাষা-প্রশ্নে জিন্নাহ এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন "Urdu and only Urdu shall be the state Languge of Pakistan."। তার এ ঘোষণার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানানো হয়। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের সমাবর্তনে তিনি পূর্ব ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলে সেখানেও প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় যে ‘সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়েছিল, পরবর্তী কয়েক বছর সে কমিটির কোনো কার্যক্রম থাকেনি। তবে প্রতিবছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপন করা হতো। প্রতিবছরের মতো ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় । নিষ্ক্রিয় সংগ্রাম পরিষদকে সক্রিয় করার জন্য এ সভাতে আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি একটি খসড়া তৈরি করে, যা ২৫ মার্চ তারিখে হাবিবুর রহমান শেলী (সাবেক বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে তা বিবেচিত ও গৃহীত হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হবার পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও এর চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারির শেষের দিকে ভাষা আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন (২৭-১-১৯৫২) এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরূপ ঘোষণা দেন যে, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তির প্রতিবাদে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' ৩০ জানুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ৩০ জানুয়ারির সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে ব্যাপক করার উদ্দেশ্যে ৩১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।' ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও সভার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচির উদ্দেশ্যই ছিল ঐ অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরফ হতে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারে ওপর চাপ সৃষ্টি করা। ১২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ইংরেজি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার' নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে এক মাসের জন্য সমস্ত ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। ১৪৪ ধারা জারি করার অর্থ একসঙ্গে ৪ জনের বেশি লোকের সমাগম, মিছিল, শোভাযাত্রা, সভা ও সমাবেশ করা আইনবিরোধী । সরকারি ঘোষণায় বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় (২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত) ভোটাভুটিতে ১১ জন ১৪৪ ধারা না-ভাঙার পক্ষে এবং ৪ জন ভাঙার পক্ষে ভোট দেন । ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ছাত্ররা, যুবলীগের নেতা ও কর্মীগণ এবং ছাত্রনেতাদের কয়েকজন পৃথকভাবে। (১) একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ (21st February, 1952) ১৪৪ ধারা ভাঙা, না ভাঙার আলোচনা হয় ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত পর্যন্ত, ফলে সভার সিদ্ধান্ত প্রচারিত হওয়ার সময় ছিল না। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার, ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ, ২৪ জমাদিয়ুল আউয়াল ১৩৭১ হিজরি। পূর্ব ঘোষণানুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা জমায়েত হতে থাকে। রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা দুজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে আসে। বেলা ১১টায় ছাত্রসভা শুরু হয়। ১৪৪ ধারা ভাঙার পন্থা হিসেবে ১০ জন ১০ জন করে ছাত্র রাস্তায় মিছিল বের করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ পূর্বরাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত দিলেও ছাত্রসভার সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখিয়ে তা মেনে নেয় এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। খণ্ড মিছিলগুলো যখন ১৪৪ ধারা ভাঙতে রাজপথে নামছিল তখন রাস্তায় অপেক্ষমাণ পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। অবশেষে পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। এতেও মিছিলকারীদের ঠেকাতে না পেরে নিক্ষেপ করে কাঁদুনে গ্যাস। পুলিশী হামলার মুখে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আইন পরিষদের সদস্যবৃন্দ যেন অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সুপারিশ গ্রহণ করেন সেজন্য তাদেরকে অনুরোধ করাও ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল ।
(২) একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদ (Saheeds of 21st February)
২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় শহিদদের সংখ্যা ও পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ লক্ষ করা যায়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর পরই নেতৃবৃন্দের আত্মগোপন করার কারণে লাশের পরিচয় ও সংখ্যা সম্পর্কে তারা অনেকেই অজ্ঞাত থাকেন। সকলেই যে ২১ ফেব্রুয়ারিতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা নয়, আহতদের কেউ কেউ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন- খ্রিষ্টাব্দাম মৃত্যুবরণ করেন ৭ এপ্রিল (১৯৫২)। আবার ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি যে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েও কেউ কেউ শহিদ হন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় উক্ত দিন ও পরে কমপক্ষে ৫ জন যে শহিদ হয়েছিলেন সে বিষয়ে সরকারি বিবরণী অনুযায়ী নিশ্চিত হওয়া যায় ।
শহিদ রফিক উদ্দিন আহমেদ : ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম শহিদ হলেন রফিক উদ্দিন আহমেদ। তখন তাঁর বয়স ছিল ঊনিশ বা বিশ । তিনি মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে আই.কম, ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে অরক্ষিত এলাকায় দাফন করা হয়েছে।
শহিদ আবুল বরকত : শহিদ আবুল বরকতের জন্ম ১৬ জুন, ১৯২৭ মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলাতলে। পিতার নাম শামসুজ্জোহা। 'স্থানীয় তালিবপুর হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পূর্ববাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় তার মামা (এসএনজি বিভাগের এ্যাসিস্টেন্ট একাউন্ট অফিসার) মাপেক সাহেবের বাসায় পুরানা পল্টন লাইনের 'বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে' ওঠে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত থাকেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অনার্স পরীক্ষায় ২য় শ্রেণিতে ৪র্থ স্থান পান। মালেক সাহেবের প্রচেষ্টায় 'রাত ১০টার দিকে বরকতের লাশ হাসপাতাল থেকে কড়া পাহারায় বের করে আজিমপুর গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সমাধি এখনো আজিমপুর গোরস্থানে আছে।
শহিদ শফিউর রহমান : শহিদ শফিউর হাইকোর্টের একজন কর্মচারী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত কোন্নগর গ্রামে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি তার জন্ম। কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আইকম পাস করার পর তিনি চাকরি নেন। দেশ বিভাগের পর তিনি স্ত্রী আকিলা বেগম ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ঢাকায় আসেন এবং হাইকের্টে চাকরি পান। তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি অফিসে যাওয়ার পথে নবাবপুর রোডে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর সমাধি আজিমপুর গোরস্থানে রক্ষিত আছে। :
• শহিদ আবদুল জব্বার : শহিদ আবদুল জব্বার ছিলেন একজন দর্জি। গফরগাঁওয়ের পাঁচাইয়া গ্রামের আবদুল কাদেরের পুত্র। শহিদ অহিউল্লাহর বয়স ছিল মাত্র ৮/৯ বছর। ‘রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে (অহিউল্লাহ) ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে হঠাৎ মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে নিহত হন এবং তার লাশ অপসারিত হয় ।' শহিদ আবদুল সালাম : শহিদ আবদুস সালাম ২১ শে ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে শাহাদত বরণ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজে (ইডেন বিল্ডিংয়ে) পিয়নের কাজ করতেন। তাঁর মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ফজিল মিয়া। শহিদ আবদুস সালাম-এর বাড়ি নোয়াখালি জেলায়।
(৩) ২১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী ঘটনাবলি (Happenings after 21 February) ২১ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে এবং কমপক্ষে ২ জন মৃত্যুবরণ করে। ২১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি চারদিন 'ঢাকা বেতার কেন্দ্রে' পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। একুশের ঘটনার প্রতিবাদে দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। গভর্নর ও স্পিকারের কাছে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি লেখেন :
'বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নূরুল আমিন সরকারের আমিও একজন সমর্থক- এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকিতে । লজ্জাবোধ করিতেছি।'
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল হয় ঢাকার সাথে সমন্বয় রেখে আন্দোলনের মিছিল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সামিউল আহমদ খান (ফটিক) কাচারী ভবনে ওঠে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পতাকা পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম নামাবার ইতিহাস সৃষ্টি করেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহিদদের স্মরণে একটি শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাতনামা দুই রাজমিস্ত্রি শহিদ মিনার নির্মাণ করে । শফিউর রহমানের পিতা ২৪ তারিখে শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন।
মার্চ (১৯৫২) শহিদ আবুল বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসনাত ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসটি ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মহকুমা হাকিমের এজলাশে মামলা দায়ের করার চেষ্টা করেন। ফৗজদারি দণ্ডবিধি ১০৭ ১০ ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি উচ্চপদ অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গ্রহণ করা যায় না- এরই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগটি খারিজ করে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও মিলিটারি কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পান করায় তীব্র ाিन । রাজনীতিবিদ এতদিন ভাষা আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন তারা (যেমন এ. কে. ফজলুল गী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ) ২৩ ফেব্রুয়ারি 'সিভিল লিবার্টি কমিটি' বা ব্যক্তিস্বাধীনতা কমিটি' গঠন করে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৪ নুয়ারি হোস্টেলে এক সভা অনুষ্ঠিত করে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সরকারকে ভাষার দাবি পূরণের জন্য ৫ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয় এবং ঐ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে নতুন আন্দোলনের কর্মমুটি দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়।
সরকারও জেল-জুলুমের নীতি অবলম্বন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষককেও (প্রক্টর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. বি. সি চক্রবর্তী, অজিত কুমার গুহ প্রমুখকে) গ্রেফতার করে। গ্রেফতার জেল-জুলুমানের জন্য অনেক রাজনৈতিক নেতা আত্মগোপন করেন। আন্দোলনকারীদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার একটি সুপারিশ পাকিস্তান গণপরিষদের বিবেচনার জন্য প্রেরণের একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন।
পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদ বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় গণপরিষদের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করলেও গণপরিষদের অধিবেশনে সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধার সম্মুখীন হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও প্রফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী উক্ত প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তব্য পেশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য সরদার শওকাত হায়াত খান (পাঞ্জাব), সরদার আসাদুল্লাহ জামান খান (উ.প.সী.প্র) এবং শেঠ শুরুদের (সিন্ধু) বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তান সংবিধানের মূলনীতি কমিটির যে চূড়ান্ত রিপোর্ট গণপরিষদে উত্থাপন করেন তাতেও ভাষা প্রশ্নটি অনুল্লেখ থাকে। এর ফলে পূর্ববাংলার অধিবাসীদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ আরও বেড়ে যায় ।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষে পূর্ববাংলার জনগণ ভাষা, স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন দাবির প্রশ্নে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনি মেনিফেস্টো হিসেবে যে ২১ দফা নির্বাচনি ওয়াদা ঘোষণা করে তার অন্যতম ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অঙ্গীকার, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে ঘোষণা, ২১ ফেব্রুয়ারির শহিদদের জন্য একটি শহিদ মিনার নির্মাণ ও শহিদদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান। এছাড়া একই বছর গণপরিষদে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দু ও বাংলা এবং পার্লামেন্টে ইংরেজি ছাড়া ও উর্দু ও বাংলায় বক্তব্য রাখার বিধান করা হয়। গণপরিষদের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । এভাবে বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে ।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে সামরিক আইন জারি করা হলে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি আইয়ুব খানকে ভাষার প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করে কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু আইয়ুব খান তাতে কর্ণপাত করেন নি; বরং ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষিত তার সংবিধানে তিনি বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বহাল রাখেন (আর্টিকেল-২১৫)। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্নও জড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের বৈরী মনোভাবের কারণে এ দল থেকে গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি নতুন নতুন দলের সৃষ্টি হওয়ায় পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগের প্রাধান্য খর্বিত হয়। ফলে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এ দলের চরম পরাজয় ঘটে।
ভাষা আন্দোলন ছাত্রসমাজকে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ছাত্ররা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের মাত্র দুই মাসের মধ্যেই (এপ্রিলে) পূর্ববাংলায় ছাত্র ইউনিয়ন নামে ছাত্রসংগঠন জন্মলাভ করে। পরবর্ত আন্দোলনসমূহে তাই দেখা যায় ছাত্রসমাজই ছিল মূলশক্তি। যেকোনো সরকারের যেকোনো অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলি প্রতিবাদ উচ্চারণ করে ছাত্রসমাজ ।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে স্কুল-কলেজের ছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ছাত্রীদের বোরখা পড়ার অভ্যাস কমে যায়। পরবর্তীতে সভা-সমিতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণের ধারা সৃষ্টি হয়। রাজনীতিতেও মেয়েরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকে । ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল।
. শহিদমিনার নির্মান Building of the Shaheed Minar
শহীদ স্মৃতি অমর হোক এ স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্ররা শহিদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য প্রথম শহিদ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ লক্ষ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার নাম দুজন ছাত্র শহিদমিনারের জন্য নকশা আঁকেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভবন সম্প্রসারণের জন্য মেডিকেল কলেজ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ইট, বালি, রড ও সিমেন্ট ছিল। ছাত্ররা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য এ সব সামগ্রী ব্যবহার করেন এবং অজ্ঞাতনামা দু'জন রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে তারা শহিদমিনার নির্মাণ করান। এ শহীদ মিনারটি ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া ছিল। ঐ স্থাপত্যের নাম দেওয়া হয়েছিল 'শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ'। ২৩ ফেব্রুয়ারী রাতের মধ্যে তাদের শহিদমিনার নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি একুশের শহিদ শফিউর রহমানের পিতা মতিউর রহমান নবনির্মিত শহিদমিনার উদ্বোধন করেন ।
মানুষের কাছে এটি “শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ” নামে পরিচিতি লাভ করে। সাধারণ মানুষ বেদীতে ফুল দিয়ে তাদের এন্থা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন । আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ ফেব্রুয়ারী আবুল কালাম শামসুদ্দিন এ শহিদমিনারটি উদ্বোধন করেন। সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি এ শহিদমিনারটির প্রতিটি ইটের টুকরো পর্যন্ত তুলে নিয়ে যায়।
. ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী ভাষা সৈনিকদের পরিচিতি Identification of the Participants of the Language Movement
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা শহিদদের মতো ভাষা সৈনিকদের প্রতিও রয়েছে আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধা। ভাষা সৈনিকদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য তারা হলেন শামসুল হক (আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, যিনি বিশেষকরে, টাঙ্গাইলের খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে আইনসভার সদস্যপদ লাভ করে ছিলেন), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ছয়দফা দাবী উপস্থাপনকারী, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে বিজয়ের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও বাঙালি জাতির জনক), গাজীউল হক, আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন হিসেবে সমধিক পরিচিত), অলি আহাদ (পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা), অধ্যাপক আবুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক), অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক), কাজী গোলাম মাহবুব (কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংঘের ভি.পি), আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক এবং একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'র রচয়িতা), মাহবুবুল আলম চৌধুরী (একুশ নিয়ে প্রথম কবিতা রচনাকারী, চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংবাদিক), নঈমুদ্দিন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক), মোহাম্মদ তোয়াহা (কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা), আবুল মনসুর আহমদ (রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থের রচয়িতা), ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (বহু ভাষাবিদ), তাজউদ্দিন আহমদ (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), আব্দুল ওদুদ (তৎকালীন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি), খালেক নেওয়াজ খান (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনকে পরাজিত করে পূর্ব বাংলা করে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন), খান সাহেব ওসমান আলী (নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট পার্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, ব্রিটিশ সরকার জনহিতকর কাজের জন্য খান সাহেব উপাধি প্রধান করেন), শাহাবুদ্দিন আহমদ (সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা), হাবিবুর রহমান শেলী (সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা), এম. আর. আখতার মুকুল (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র পাঠকারী), হাসান হাফিজুর রহমান (বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক), আবুল মাল আবদুল মুহিত (বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী), জাফর ওবায়দুল্লাহ (কবি ও সাহিত্যিক), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি), জিল্লুর রহমান (বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি), আবদুল হামিদ (বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি), বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক, শওকত আলী (মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ১৫০ নম্বর মোগলটুলী হাউজের মালিক) প্রমুখ । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভাষা সৈনিকদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ ছিলেন। এদের অধিকাংশ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]