১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের সামরিক শাসন জারির কারণ বর্ণনা কর। (Describe the Causes of Declaring Military Rule in 1958.)

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন জারির কারণ Causes of Declaring Martial Law in 1958
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের সহযোগিতায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন। সামরিক শাসন জারির পর প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তাঁর এক ভাষণে সামরিক শাসন জারির কারণ ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এ বক্তব্যে তিনি বারবার সরকার পরিবর্তন এবং তাঁর অস্থায়িত্ব, অবাধ দুর্নীতি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যকার কোন্দল ও বিভেদ, সংবিধান অকার্যকর হওয়া, নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটার সম্ভাবনা না থাকা প্রভৃতি বিষয়কে সামরিক শাসন জারির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে-এর সাথে এটাও সত্য যে, সামরিক শাসন জারির পেছনে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ক্ষমতা লিপ্সাও ক্রিয়াশীল ছিল। এছাড়া দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রতো ছিলই। নিম্নে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের সামরিক শাসন জারির কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সংবিধান কার্যকর না হওয়া (Having no Effectiveness of Constitution): প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারির পেছনে সংবিধান অকার্যকর হওয়াকে প্রধানত দায়ী করেন। তাঁর ভাষায় এতে পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট হওয়ার বীজ নিহিত ছিল। একথা সত্য যে, অনেক বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। এ সংবিধানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিন রাজনৈতিক দলগুলো গণপরিষদ বর্জন করেছিল। তাই বলা যায়, ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধান কার্যকর না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। তবে সামরিক শাসন জারির জন্য এটি কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছিল না ।
২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Political Instability) : ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয় । খাদ্য সংকট, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যকার কোন্দল ও দলাদলির কারণে কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে বারবার সরকারের পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫৪-১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সাতবার মন্ত্রিসভার রদবদল হয়। কেন্দ্রেও বেশ কয়েকবার সরকারের পরিবর্তন ঘটে। এরূপ অবস্থায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দোহাই দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয় ।
৩. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব (Lack of Chain of Command within Party) : ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাঙন, দলাদলি ও উপদলীয় কোন্দল বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন জারির পূর্বে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখা যায়নি । নতুন দল গঠন, দল পরিবর্তন, রাতারাতি নতুন দলে যোগদান তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় পরিষদের ৮০ জন সদস্যের মধ্যে স্বতন্ত্র সদস্যসংখ্যা ছিল ৬ জন এবং অবশিষ্ট ৭৪ জন ৭টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে যেখানে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বতন্ত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ৯ জন এবং অবশিষ্ট সদস্যগণ ১০টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে । প্রাদেশিক পরিষদগুলোতেও বিশৃঙ্খলা চূড়ান্ত মাত্রায় গিয়ে পৌঁছে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মারামারিতে আহত হয়ে পরিষদের ডেপুটি স্পিকার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যখন এরূপ বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল তখন সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর ইন্ধনে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয় ।
৪. সেনা কর্মকর্তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা (Military Officer's High Ambition) : ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন জারির পশ্চাতে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সেনাবাহিনী বিভিন্নভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ভারতের সাথে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়িয়ে পড়ায় সেনাবাহিনীর পক্ষে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এমতাবস্থায়, রাজনৈতিক সুযোগে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সহজ হয়। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল মূলত আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলশ্রুতি।
৫. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি (Corruption and Nepotism) তৎকালীন পাকিস্তানি সমাজে নৈতিকতার চরম অবনতি দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, অর্থনৈতিক দুর্দশা, দেশত্যাগ প্রভৃতি কারণে সমাজজীবনে এক করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অত্যধিক ক্ষমতালিপ্সা, দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি রাজনৈতিক কলুষিত করে তোলে। তাছাড়া তখন চোরাচালান, মজুদদারি ও মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যের ফলে মানুষ প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জার ব্যক্তিগত ক্ষমতালিপ্সা (President Eskander Mirza's Personal Grout to খুবই ক্ষুণ। এরূপ অবস্থার জন্য তারা রাজনীতিকদের ওপর ছিল বীতশ্রদ্ধ। এর ফলশ্রুতিতে সামরিক শাসন জারি
Power): ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পেছনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উ মির্জা ক্ষমতালিপ্সা ছিল অন্যতম কারণ। সোহরাওয়ার্দী ও ফিরোজ ान নূন (মী লীগ- গ)-এর মধ্যে আন্ডারে ফলে প্রেসিডেন্ট মির্জা বুঝতে পেরেছিলেন তার পক্ষে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সা নয়। এর ইস্কান্দার মির্জা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সামরিক শাসন জারি করতে প্রলুত হন ৭. নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সম্ভাবনা (Possibility of Awami League to Win the Election) :
খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। উক্ত নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল তাই পরি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং তাদের প্রতিভু ইস্কান্দার মির্জা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগেরই জয়ের উজ্জ্বল সন্তাবনা ছিল। অবস্থায় আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে এবং নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য সামরিক শাসন জারি জরুরি হয়ে পড়ে বস্তুত, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা, ক্ষমতালিপ্সা, ষড়যন্ত্র এবং চরম রাজনৈতিক অস্থিরতাই শাসন জারির অন্যতম কারণ। মনে করা হয়, পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ মদদ ছিল। এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে এবং সুযোগসন্ধানী সেনা অফিসারদের প্ররোচনায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন এবং সামরিক শাসন জ দিনের মাথায় তৎকালীন সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন।
সামরিক শাসন জারি ফলাফল
Results of Declaring Martial Law
একনায়কতান্ত্রিক শাসন : ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসন নিযুক্ত করলেও ২৭ অক্টোবর মাত্র ২০ দিনের মাথার তিনি ইস্কান্দার মীর্জাকে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দেন। তিনি পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র পাকিস্তানে অচল বলে ঘোষণা দিয়ে একনায়তান্ত্রিক শাসন চালু করেন।
সংবিধান বাতিল : অনেক লড়াই-সংগ্রামের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির প্রাক্কালে এক ঘোষণায় সেই সংবিধান বাতিল বলে ঘোষণা করেন ।
গণতন্ত্রের সমাধি রচিত : ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। এ সময় পাকিস্তানে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
মৌলিক গণতন্ত্র সৃষ্টি : জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে দেশে মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক অভিনব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেন। মামলা মোকদ্দমা ও নির্যাতন : সামরিক শাসন জারির পর জাকির হোসেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন। শত শত রাজনৈতিক নেতাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাস সৃষ্টি করেন। মওলানা ভাসানী, শেষ মুজিব, আবুল মনসুরসহ বহু নেতা কারারুদ্ধ হন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]