আইয়ুব খানের পতনের কারণসমূহ আলোচনা কর। (Discuss the Causes of Fall of Ayub Khan.)

আইয়ুব খানের পতন Fall of Ayubkhan
আইয়ুব খান ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বিলোপ সাধন করেন। আইয়ুব খানের এক দশকের স্বৈরশাসনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের বীজ নিহিত ছিল। শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা দখল করেই তিনি তার সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় বিরোধী দলের উপর দমনপীড়ন, গ্রেফতার, হয়রানি এবং ছাত্র নির্যাতন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আইয়ুব সরকার যেকোনো সরকার বিরোধী আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। নির্যাতনে অতিষ্ঠ জাতি ক্ষেপে উঠে এবং আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠন করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে। আইয়ুব খানের পতনের কারণসমূহ নিম্নরূপ :
রাজনৈতিক অধিকার খর্ব : স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেন। এতে বাংলার আপামর জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পেতে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে আইয়ুব সরকারের পতনের পথ অনেকটা প্রশস্ত হয়।
শরীফ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন : আইয়ুব সরকারের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন। আইয়ুব সরকার যে নতুন শিক্ষা রিপোর্ট পেশ করে তাতে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ ব্যয়ভার ছাত্রদের বহন করতে বলা হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ দরিদ্র হওয়ায় তাদের পক্ষে এ ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা এ শিক্ষা রিপোর্টের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। যা দিন দিন জনগণের মনে আইয়ুব বিরোধী ক্ষোভ তৈরি করে ।
সীমাহীন বৈষম্য : আইয়ুব সরকারের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সরকারি চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বৈরশাসকের অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায় । যা আইয়ুব খানের পতনের পথ প্রশস্ত কর ।
গণমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ : আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য সকল গণমাধ্যমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় পত্রিকা 'দৈনিক ইত্তেফাক' নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব : আইয়ুব খান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে আদালতের উপর তার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। তিনি নিজের ইচ্ছামত বিভিন্ন অধ্যাদেশ জারি করেন। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাধারণ জনগণ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, যার ফলশ্রুতিতে আইয়ুব সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
৬. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : শরিফ শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে আইয়ুব খান ইংরেজিকে প্রাধান্য দিয়ে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা ও বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তাছাড়া নববর্ষ উদযাপন ও রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ভারতীয় বই ও চলচ্চিত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এতে দিনের পর দিন আইয়ুব বিরোধী ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, যার ফলশ্রুতিতে আইয়ুব খানের পতন ত্বরান্বিত হয় ।
৭. সংবিধানবিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ আইয়ুব খান নতুন সংবিধান ঘোষণা করেন। এ সংবিধান ছিল এককেন্দ্রিক । এতে কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা সংকুচিত করে আইয়ুব খান নিজের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। ভোটাধিকার হরণ করে মৌলিক গণতন্ত্রী নামে একটি চাটুকার শ্রেণি সৃষ্টি করা হয়। এ সংবিধানকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। এ সংবিধানের বিরুদ্ধে জনগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে আইয়ুব খানের পতন ত্বরান্বিত হয় ।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন : আইয়ুব সরকার ক্ষমতায় এসে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে । তাই সামরিক জান্তার বিপক্ষে আন্দোলন করার মতো একক কোনো দল ছিল না । ফলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সকল দলের সমন্বয়ে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (NDF) গঠন করা হয়। এনডিএফ নেতৃবৃন্দ শপথ করেন যে, তারা কেউ আইয়ুবের অধীনে কোনো পদ গ্রহণ করবেন না । এনডিএফ-এর আন্দোলনে আইয়ুব সরকারের ভিত্তি প্রকম্পিত হয়।
পাক-ভারত যুদ্ধ : কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে পূর্ব বাংলা অরক্ষিত বা নিরাপত্তাহীন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বুঝতে পারে আইয়ুব সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তাই তারা নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তীব্র আন্দোলন করে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটায় ।
১০. ৬-দফাভিত্তিক আন্দোলন : শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন শুরু হলে এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকার দমনপীড়ন চালায়। কিন্তু এতে আন্দোলন স্তিমিত না হয়ে তা আরও বেগবান হয়। ফলে আইয়ুব সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
১১. আগরতলা মামলা : বাঙালির প্রাণের দাবি ৬-দফা আন্দোলন নসাৎ করার জন্য আইয়ুব খান পরিকল্পনামূলক মামলার আশ্রয় নেন । ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। শেখ মুজিবসহ তাঁর সহযোগীদের মুক্তির লক্ষ্যে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণ এক অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার ফলে আইয়ুব খানের পতন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ।
১২. ১৪৪ ধারা জারিকরণ : গণআন্দোলনে দেশের আপামার জনসাধারণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলে দিন দিন পুলিশের গুলিতে শহিদ হলে আন্দোলন আরও তুঙ্গে ওঠে। সরকার এ গণআন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ১৪৪ গণআন্দোলন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়। এরপর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান ধারা জারি করে। কিন্তু তবুও উক্ত গণঅভ্যুত্থান দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণআন্দোলনে ১০০ জন পূর্ব পাকিস্তানি নিহত হয়।
১৩. সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার : ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এক বৈঠকে মিলিত হন। ৩০ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি সফরে গেলে তাকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রজনতা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে, যা আইয়ুব খানের পতনের সূচনা ঘটায়।
১৪, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান : ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ডাকসু সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয় । আইয়ুব খানের ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা ত গণআন্দোলন গড়ে তোলে। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয়।
১৫. আইয়ুব খানের চূড়ান্ত পতন : ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ আইয়ুব খানের হাতে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা এবং ১১ দফা দাবির খসড়া আসলে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। কারণ জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানকে ভেঙে ৪টি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে। এমতাবস্থায় তিনি ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করেন এবং ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন পাকসেনা ইয়াহিয়া খান। এভা পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]