সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন সম্পর্কে আলোচনা কর। (Discuss About the Resistance Against Cultural Aggression and Resurgence of Bengali Culture.)

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বরূপ ও প্রতিক্রিয়া Pattern of Cultural Aggression and Reaction
ক. সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বরূপ (Pattern of Cultural Aggression)
পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রথম নির্যাতন শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ ও বাংলা ভাষা পরিবর্তনের অপচেষ্টার মাধ্যমে। পাকিস্তান সরকার ইসলামি রাষ্ট্রের পবিত্রতা রক্ষার্থে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশবিভাগে। পর পরই পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিত্যব্যবহার্য খাম, ডাকটিকেট, রেলগাড়ির টিকেট, বিভিন্ন ধরনের ফরম প্রভৃতি ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখা শুরু হয়। এভাবে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে সরকারের নানা ধরনের নির্যাতন ও রাজনৈতিক নিপীড়নমূল নীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয় রফিক, বরকত, জব্বার প্রমুখ। এখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটা চিত্র তুলে ধরা হলো :
১. বাংলা ভাষার প্রতি আঘাত : পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রথম নির্যাতন শুরু হয়- রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ ও বাংলা ভাষা পরিবর্তনের অপচেষ্টার মাধ্যমে। পাকিস্তান সরকার ইসলামি রাষ্ট্রের পবিত্রতা রক্ষার্থে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশ বিভাগের পর পরই পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিজ ব্যবহার্য খাম, ডাকটিকেট, রেলগাড়ির টিকেট, বিভিন্ন ধরনের ফরম প্রভৃতি ইংরেজি ও উর্দুভাষায় লেখা শুরু হয়। এভাবে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে সরকারের নানা ধরনের নির্যাতন ও রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক নীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয় রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর প্রমুখ ।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের ২য় ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলেও আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পাকিস্তানের জন্য একটিমাত্র ভাষা উদ্ভাবনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল বাংলা ও সমন্বিত করা ও সংশোধিত রোমান হরফে লেখা। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উর্দুকে শিক্ষক ও শিক্ষা সচিব ড. এস. এম. শরীফকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, যা শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ কমিশনের দুটি প্রস্তাব ছিল। যথা :
যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রোমান হরফের উদ্ভাবন ও বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আর্থিক আনুকূল্য দেওয়া ।
মুদ্রণযোগ্য আদর্শ বর্ণমালা নির্ণয় করা, বাংলা বর্ণমালার সংস্কার করা এবং বাংলা উর্দুর উপযোগী রোমান হরফের উদ্ভাবন করার জন্য ভাষাতাত্ত্বিক রোমান হরফের উদ্ভাবন করার জন্য ভাষাতাত্ত্বিকদের নিয়ে কমিটি গঠন করা। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ভাষা ও বানান সংস্কারের জন্য সৈয়দ আলী আহসানের উদ্যোগে ও সভাপতিত্বে একটি ভাষা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঈ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ঙ, ঞ, ম, ষ, ঢ়, হ্ম, ৎ, ণ, ৯, ং, ঃ বর্ণ বাদ দিয়ে 'অ্যা' বর্ণ যুক্ত করার পরামর্শ দেয়। এসব বর্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। যেতেতু সংস্কৃত হিন্দুদের ভাষা, সেহেতু এসব বর্ণ- ইসলামি রাষ্ট্রে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় ।
বাংলা সাহিত্যের ইসলামিকরণ : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সাহিত্যিকদের আরবি ও ফারসি শব্দ ব্যবহারের অনুরোধ করেন। এসময় কাজী নজরুলের বিখ্যাত 'চল চল চল' কবিতার “নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশশ্মান" বদলে দিয়ে লেখা হয় ‘সজীব করিব গোরস্থান।'
প্রচলিত কবিতা এর সংশোধন করা হয় এভাবে-
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন, ভালো হয়ে চলি।”
“ফযরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন আমি যেন, নেক হয়ে চলি।”
শিক্ষা সংকোচন নীতি : ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ছাত্রসমাজ পুড়িয়ে দিলে আইয়ুব খান নতুন একটি কমিশন গঠন করেন, যার নাম "Commission on Student Problems and Welfare." নতুন গঠিত কমিশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে টঙ্গীতে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ ও শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়। এতে পূর্ব বাংলার ছাত্ররা প্রতিবাদ জানালে সরকার ৭৪টি কলেজ ও ১৪০০ বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং ছাত্রদের গ্রেফতার করে। রবীন্দ্র বিরোধী প্রচারণা এবং রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা : পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প ও উপন্যাস নিষিদ্ধ করে এবং ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এছাড়াও ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, যদিও পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের চাপে তা সীমিত আকারে অনুমোদিত হয়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সংসদ অধিবেশনে খান -এ সবুর তাঁর বক্তৃতায় রবীন্দ্রসংগীতকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলে আখ্যা দেন এবং গণপরিষদের ২২ জন সদস্য তা সমর্থনও করে। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন রবীন্দ্রসংগীত প্রচার কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন এবং ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ প্রচার বন্ধ করার ইঙ্গিত প্রদান করেন।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ৪০ জন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দেন যে, “রবীন্দ্রসংগীতের ভাব, ভাষা ও সুরের কোনোটার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের তৌহিদবাদী জনসাধারণের তিলমাত্র যোগাযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বর্য ও কৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানি তমুদ্দুনের সম্পূর্ণ বিপরীত।”
উপরিউক্ত কতিপয় বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনে সরকার আশাবাদী হয়ে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে (১৩৭৪ সনের ২২ শ্রাবণের পূর্ব মুহূর্তে) পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়, যদিও পরবর্তীকালে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার উক্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল ।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবর্তন : শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়, যা ১৯৬১-এর কালাকানুন নামে পরিচিত। এতে ছাত্রদের রাজনীতি করা এমনকি রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়াও উক্ত রিপোর্টে কলেজ স্তরেও ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
৬. প্রকাশনাসমূহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি : আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালনের অপরাধে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইত্তেফাকসহ প্রগতিশীল প্রত্রিকাগুলোর প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় লিখিত বিভিন্ন পুস্তক বাজেয়াপ্তসহ এগুলোর প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ।
৭. বাংলা নববর্ষ উৎসব নিষিদ্ধকরণ : মুঘল সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও আইয়ুব সরকার এটিকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ হিসেবে উল্লেখ করে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।
খ. সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া (Reactions of Cultural Aggression) পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসন বাঙালি জাতি কখনো নীরবে সহ্য করে-নি। ক্ষমতাসীন সরকার যখনই অবৈধ হস্তক্ষেপ করেছিল বাঙালি জাতি তখনই তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আর পূর্ববাংলায় ভাষার সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, রোমান হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি এরই প্রমাণ বহন করে। উল্লেখ্য, সরকার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী (জন্মদিন) উদ্‌যাপন, পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপন ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও বাঙালিরা মুখ বুজে সব সহ্য করে নি; বরং তারা সরকারের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ এবং এগুলো উদ্‌যাপন করেছে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে সংগীত শিল্পী সানজীদা খাতুনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব খানের প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলো তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। পরিষদ তাদের ১১-দফা দাবি নিয়ে পূর্ববাংলায় শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে ।
• উদযাপনে অনাগ্রহ ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সর্ববৃহৎ উৎসব পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা, ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্র জন্ম শতবার্গিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ প্রগতিশীল বৃদ্ধিজীবী মহল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
চট্টগ্রামের 'সংস্কৃতি সংসদ' এবং 'প্রান্তিক' নামে দুটি সংগঠন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। 'কুমিল্লা প্রগতি মুসলিম' অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী সাহিত্য চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ঢাকার কারিগরি মিলনায়তনে 'হাজার বছরের বাংলা গানের আসর' ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। এর অন্যান্য
নিয়মিত অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল রবীন্দ্র নজরুল জন্মতিথি, নববর্ষ, বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব ও বসন্ত উৎসব পালন।
পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন
Resurgence of Bengali Culture from Pakistan's Cultural Aggression
পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে একটি সূক্ষ্ম জাতীয়তাবোধের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল মূলত সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট-এ কথা বোধকরি বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মানুষের সামাজিক পরিচিতি হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো নিরন্তর সংস্কারের মাধ্যমে প্রাপ্ত মানবগুণ। যেকোনো সমাজে প্রচলিত সামগ্রিক সামাজিক আচরণ ও কার্যকলাপের মার্জিত রুপই সংস্কৃতি। অন্যকথায় শিক্ষাদীক্ষা, বিচারবুদ্ধি, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, প্রথা-বিশ্বাস, শিল্পকথা, বিশ্বাস— এসব উপাদানের মার্কি বা সমাজ অনুমোদিত রূপই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি সামাজিক জীবনবোধ থেকে উদ্ভূত একটি সামাজিক প্রপঞ্চ। বাংলাদেশের সংস্কৃতি তৃণমূল পর্যায় থেকে উৎসারিত। গ্রামীণ সংস্কৃতিই বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি লালিত হে হাজার বছরের বাংলার মানুষের কথা, কাজ, বিনোদন, ধর্মীয় আচার-আচরণ এসবের সমিষ্টবদ্ধ চিন্তাচেতনা থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য যত বিস্তৃত-এর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও তত পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি সম্পর্কে সব সময় হীন ধারণা পোষণ করেছে।
অভিন্ন ভাষার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে প্রায় একই ধরনের সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল। তারা বলত যে, পূর্ব পাকিস্তানের এ সাংস্কৃতিক ধারা সংশোধন করা দরকার। এটা করার জন্য তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করেছে ।
বিস্তারিত অর্থে বলা যায় যে, কোনো জনগোষ্ঠী যখন কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করে তখন তাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণগত বিষয় যেমন ঐতিহ্য এবং লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি একটি সম্মিলিত ধারণাপ্রসূত হয়ে চলতে থাকে। এসব কিছু মিলেই একটি সংস্কৃতি গঠিত হয়, যা বসবাসকারী সকলেই মেনে চলে। সাধারণ মানুষ যখন কোনো একটি ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে তখন সে একই রকম বা পূর্ব আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না। তাই পশ্চিম পাঞ্জাব এবং পূর্ববাংলা একই রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে থাকলেও এবং একই ধর্মের অনুসারী হলেও সংস্কৃতি কিন্তু একই রকম হতে পারে নি ।
ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য অনেক উপাদান সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ একই ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের মধ্যে একই রকমের সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্ব গড়ে উঠতে পারে নি তারা ধর্ম একই নিয়মে পালন করতো কিন্তু সাংস্কৃতিক পার্থক্যটাও ছিল সুস্পষ্ট। আর সাংস্কৃতিক মনোভাব এক না হতে পারলে সেভাবে এগিয়ে চলা যায় না, তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রমাণ করেছিল। তারা কখনো পাকিস্তানের দু অংশের জনগণকে একজাতীয় মনে করতে পারে নি, ভেবেছে দুই রকম। কারণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কারণে উভয় অঞ্চলের জনগণের মধ্যে একই রকম জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় নি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য এত বড় ছিল যে, দুই অঞ্চলের ভাগাভাগির ক্ষেত্রে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। ভাষার মাধ্যমেই একটি সমাজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হয়। ভিতরে ভিতরে এ দুয়ের সম্পর্কটা এমনভাবে গ্রন্থিত হয় যে, সংস্কৃতির ওপর কোনো দমনপীড়ন করা হলে আপনা থেকেই তা . ভাষার ওপর গিয়ে পড়ত। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঠিক তেমন কাজটিই করতে চেয়েছিল। তারা বাংলা ভাষার গলা টিপে ধরে স্বতন্ত্র বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল ।
পহেলা বৈশাখ এদেশবাসীর জীবনে এক বিশেষ দিন। বাঙালি সংস্কৃতির এক প্রাচীন রীতি এ দিনটি উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছিল। জনগণের চাপের মুখে প্রাদেশিক সরকার পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দেন। এতে এদেশবাসীর মনে সাংস্কৃতিক একটি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি বাঙালি সংস্কৃতির গাণ, এ যেন বাঙালি সংস্কৃতি পরিমণ্ডলের এক দামি নিয়ামক। একইভাবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবি ফররুখ আহমদ, কবি বেনজীর আহমদ এবং অন্যান্য বাঙালি কবি একই ধরনের ফল্গুধারা সৃষ্টি করেছে এদেশবাসীর জীবনাচরণে। এ সময় 'নজরুল একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
সরকারের মদদে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ আলী আহসানকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি বাংলা ভাষার সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পরামর্শ দেয় যে, সকল সংস্কৃত শব্দের আরবি, উর্দু ও ফারসি প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে হবে। ঢাকা একাডেমিক কাউন্সিলে এ সুপারিশ গৃহীত হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং অন্যান্য সচেতন নাগরিকদের তরফ থেকে-এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মন্তব্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছিলেন- 'আদালতে ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে আরবি ভাষায় রূপান্তরের অর্থ হবে বাঙালিদের জন্য রাজনৈতিক ভূমিদাস হওয়া। এটি শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈপরীত্য তৈরি করবে তা নয়; বরং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মতবাদ এবং আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তা স্পষ্ট হবে।' বাঙালি মুসলমানরা এ অবস্থায় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। তারা নিজেদের দিক থেকে ভাষা, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ করে তা সংরক্ষণের চেষ্টা করে যার অর্থ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করা।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিরোধ এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক উজ্জীবনে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল :
১. ভাষা কমিটির মাধ্যমে প্রতিবাদ (Protest by Language Committee) : পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভাষা কমিটি, পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ইকবাল হল, জগন্নাথ কলেজ ও ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদ প্রতিবাদ জানায় । ২. পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস (Pakistan Tamuddun Mojlish) : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপক, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানায় ।
৩. সংস্কৃতি সংসদ (Cultural Association) : ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সংস্কৃতি সংসদ । প্রথমে তারা সারওয়ার মুর্শিদ ও পরে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চেতনায় সামন্তবাদের সমাপ্তি ও ধনতন্ত্রবাদের পতনে নাটক, গান ও গণসংগীতের অনুষ্ঠান করেন।
৪. ভাষা আন্দোলন ( Language Movement) : বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন একটি অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে ভাষার বিতর্কের জের ধরেই ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার বীজ বপন
৫. সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলন (Literature-Cultural Conference) : পূর্ববাংলায় প্রথম সরকারি উদ্যোগে ও পরে আর ৪টি সাংস্কৃতিক সম্মেলন বেসরকারিভাবে অনুষ্ঠিত হয়, যা পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে ভূমিকা রাখে ।
৬. পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন (East Pakistan Cultural Conference) : পূর্ববাংলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি এবং ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে শিক্ষা ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহারকে জোরদার করা হয়।
দেশবিভাগের পর চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীরা ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন, যা মানুষের কল্যাণের জন্য সাহিত্য ও সত্যের প্রতি বাঙালি সমাজকে বিশ্বাসী করে তোলে ।
৭. ইসলামিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন ( Islamic Cultural Conference) : পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ঢাকায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭-২০ অক্টোবর ইসলামি সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনটা পাকিস্তান সরকারের ইসলামের নাম ভাঙিয়ে শাসন করার নিন্দা করা হয়, যা পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের
প্রতিরোধের অংশ।
৮. কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন (Cultural Conference of Kagmari ) : কাগমারীতে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা নিজস্ব সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে
ভূমিকা রাখে ।
সাহিত্যের ভাষা নির্ধারণ (Ascertaining Language of Literature ) : ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে আবুল মনসুর আহমদের সভাপতিত্বে পাক-বাংলা ভাষা ও কালচার অধিবেশনে প্রবন্ধ পাঠ করেন কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, আজহারুল ইসলাম ও সুলতান আহমদ ভূঁইয়া, যাতে মধ্যবিত্তের মুখের ভাষার প্রাধান্য পায় ।
১০. ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা (Creation of Chayanot) : রবীন্দ্র রচনা ও গানের মূল্যায়নে বেগম সুফিয়া কামালকে সভাপতি ও ফরিদা হাসানকে সাধারণ সম্পাদিকা করে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধের প্রচেষ্টা চালানো হয় ।
১১. প্রেস অ্যান্‌ড্ পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবি (Demand of Cancelling Press and Publications
Ordinance) : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ গণবিরোধী অডিন্যান্স বাতিলের দাবি জানানো হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]