১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি ও ফলাফল আলোচনা কর। (Discuss the Background and the Results of the Mass Upsurge in 1969.)

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি Background of the Mass-Upsurge of 1969
Introduction
পাকিস্তানি শাসনামলের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের সময়টা ছিল খুবই বৈচিত্রপূর্ণ, হৃদয়বিদারক ও বেদনাবিধুর। ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ১১-দফা দাবির কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। আর সে আন্দোলন ন পর্যায়ে পৌঁছায় ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই স্বৈরাচারী শাসকচক্রের শাসন, গোসল, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার নিপীড়িত জনগণের আরেকটি তেজোদীপ্ত প্রতিবাদ হচ্ছে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান। আওয়ামী লীগের ৬-দফা দাবি আন্দোলন জনমানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনের সাথে সাথে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার ভীত হয়ে পড়ে এবং আইয়ুব-মোনায়েম চক্র আওয়ামী লীগের এ আন্দোলনকে বাদ করে দেয়ার অভিপ্রায়ে প্রদেশব্যাপী আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদেরকে পাইকারি হারে গ্রেফতার করা শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালি জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল এবং চারদিকে গগনবিদারি শ্লোগান তুলে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলল 'জাগো জাগো বাঙালি জাগো, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো।'
উল্লিখিত আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার চরম অভিব্যাক্তি ঘটে। এ চেতনার মূলমন্ত্রে পরিণত হয় বাংলা এবং 'তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ' শ্লোগান।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি ও কারণ Background and Causes of Mass-Upsurge of 1969
ক. গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি (Background of Mass upsurge)
১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে তা মূলত সাংস্কৃতিক ছিল এবং তাও মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। অধ্যাপক জয়ন্তকুমার রায় ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁদের লেখা 'বাংলাদেশ সিভিল সমাজের আন্দোলনা গ্রন্থে লিখেছেন- 'রাজনৈতিক ফ্রন্টের ঘটনাবলির সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা পূর্ববঙ্গবাসীর বাঙালিবোধকে তীব্র ও সংহত করে তোলে এবং এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা। এখানে লক্ষণীয় যে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে সব সময় একটি আদর্শগত লড়াই চলেছে। বিগত অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল যেসব সরকার তারা সাংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সিভিল সমাজকে দারিয়ে রাখতে চেয়েছে। অন্যদিকে, মধ্যবর্তী সরকাররা সব সময়-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করেছে যাতে সায় দিয়েছে সাধারণ মানুষ। এ লড়াইয়ে প্রগতির ধারা জয়ী হয়েছে এবং বাঙালিবোধকে সব সময় বাঁচিয়ে রেখে রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।'
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য সুপারিশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল। আইয়ুব খানও এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন, যার মূলকথা, 'সকল আঞ্চলিক ভাষা একত্রিত করে যৌথভাবে একটি মহান পাকিস্তানি ভাষা উদ্ভাবন করা। এবারও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বুদ্ধিজীবীসহ অন্যান্যরা প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন। সিভিল সমাজের প্রতিবাদে এবারও পিছু হটে যায় সরকার। এ পটভূমিতে 'লেখক-সংঘ' পূর্বাঞ্চল শাখা ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ, মির্জা গালিব, ইকবাল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কাজী নজরুলের ওপর ৫ দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আবুল হাশিম বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন- 'যাহারা ইসলাম ও পাকিস্তানি আদর্শের নামে রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের ওকালতি করিতেছেন, শুধুই মূর্খ নহেন, দুষ্টুবুদ্ধি-প্রণোদিতও। তাঁহারা না বোঝেন রবীন্দ্রনাথ, না বোঝেন ইসলাম। তাহারা একটা বিশেষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এগিয়ে নিয়েছে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় ১৮ জানুয়ারি। ১৯ জানুয়ারি জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা নেমে আসে রাস্তায়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু করেন ৬-দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে। আরো কিছু ঘটনা এ সময় ঘটে, যা সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। মওলানা ভাসানী হরতালের আহ্বান জানান। ডিসেম্বরে কয়েকটি সফল হরতাল হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় কয়েকজন। এ পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে 'ঘেরাও কর্মসূচি' নামে নতুন এক আন্দোলনের ডাক দেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ডাকসু ও ৪টি ছাত্র সংগঠনের ৭ জন নেতা প্রণীত ১১-দফা কর্মসূচি। প্রতিরোধের সূচনা করে তা ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধানে ভাষা স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে ছাত্র সমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে দুর্বার পরবর্তীতে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলনে স্বৈরশাসক আইয়ুবের প্রণীত 'শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট" ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে বাতিল করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করলে ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে একমত হয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করে এবং সরকার বিরোধী প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। এ অবস্থায় স্বৈরশাসক ক্ষমতাসীন আইয়ুব খান আন্দোলনের গতিধারা রোধ করার জন্য ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামক এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে। ফলে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাছাড়াও এ আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে যে আর্থ-সামাজিক কারণসমূহ বিদ্যমান ছিল তা নিম্নরূপ :
১. ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের সামরিক শাসনের ফলে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিষাক্ত আঁচড়ে পূর্ববাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পর্যুদস্ত হয়। এর ফলে অবরুদ্ধ জনতা স্বৈরশাসক আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়ে এবং সূচিত হয় গণঅভ্যুত্থান ।
২. পূর্ববাংলার বাঙালিদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম ঔদাসীন্য ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালিদের প্রান্তিকীকরণ করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের ।
8 পাকিস্তানি গণবিরোধী ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ক্রমাগত ক্ষমতাবৃদ্ধি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ ইত্যাদি ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্রসমাজের ১১-দফা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ববাংলার বাঙালিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বকীয়তা বজায় রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে, যা কার্যত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মুখ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
খ. ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের কারণ (Causes of Mass Upsurge of 1969) প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে । বাঙালি এবার আবদ্ধ হলো পাকিস্তানি শাসন-শোষণের শৃঙ্খলে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির জীবনের সর্বত্রই অবৈধ হস্তক্ষেপ করেছে। এমনি শাসন-শোষনের চরম পর্যায়ে সূচনা হয় গণঅভ্যুত্থানের । শাসন- শোষণের ভাঙার দৃঢ়তায় বাঙালিরা গণআন্দোলনের ডাক দেয় ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে, যা পরিচিতি লাভ করে গণঅভ্যুত্থান নামে । ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক ও প্রধান কারণ প্রত্যক্ষ শোষণ বঞ্চনার পাশাপাশি আরো বহু কারণ ছিল, যা সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে ।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনাবলিই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি করেছে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের কারণসমূহ যথাক্রমে :
সামরিক স্বৈরশাসন (Military Despotism) : ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে ঘোষিত সামরিক শাসনের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যেভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ভাবধারা এবং ধ্যানধারণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পর্যুদস্ত হয় তার প্রতিবাদস্বরূপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় সূচিত হয় এ গণঅভ্যুত্থান ।
3 পাকিস্তানের দু'অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য (Economic Disparity of Two Parts of Pakistan) : আইয়ুবের শাসনামলে বিদ্যমান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পর্বত সমান আঞ্চলিক বৈষম্য (Regional Economic Disparity) ক্রমে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তি রচনা করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট বৈষম্য দেখা দেয় । পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ ভাগ অথচ উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হতো আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে বাজার ও উন্নয়ন ব্যয় যথাক্রমে ৭০ ও ২৪০ কোটি টাকা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে তা যথাক্রমে ৩৯০ ও ৫২ কোটি টাকা। ১৯৪৯-'৫০ থেকে ১৯৬৯-'৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে হস্তান্তরিত হয় ৩১১৩ কোটি টাকার সম্পদ। আর এ সব অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই সংঘটিত হয় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ।
৩. স্বার্থান্ধদের ক্ষমতার অপব্যবহার (Misuse of Power by Selfish): ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধান অনুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানে গণবিরোধী ও অশুভ শক্তির ক্রমাগত ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে মৌলিক গণতন্ত্রী (Basic Democrats) ও অন্যান্য স্বার্থান্ধ ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতার অপব্যবহার গণঅভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করে ।
৪. আমলাতন্ত্রের অত্যধিক ক্ষমতা বৃদ্ধি (Excessive Increase of Power of Bureaucracy) : পাকিস্তানে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পাশাপাশি সামরিক আমলাতন্ত্রের অত্যধিক ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের গণস্বার্থ বিরোধী তৎপরতা ও ভূমিকার প্রতিবাদ হিসেবে সৃষ্ট হয় এ গণঅভ্যুত্থান ।
৫. ক্ষমতাসীনদের চরম অবহেলা (Extreme Negligence of Powerful People) : পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের চরম অবহেলা ও ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে গড়ে ওঠে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।
৬. বাঙালিদের স্বকীয়তা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা (Originality of Bengali and to Survive Existance) : বাঙালিদের স্বকীয়তা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সূচিত হয় এ গণঅভ্যুত্থান ।
৭. উন্নয়ন দশক উদযাপন (Observance of Development Decade) : ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক স্বৈরশাসক মোহাম্মদ আইয়ুব খান তাঁর শাসনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য জাঁকজমকের সাথে উন্নয়ন দশক উদযাপনে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটায় । গণতন্ত্রকামী জনগণ এ আয়োজনকে গ্রহণ করেন নি।
৮. আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ড. শামসুজ্জোহার শাহাদাৎ বরণ (Passing away of Asad, Sergent Jahurul Haque and Dr. Samsuddoha) : ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ, ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহরারত সৈনিকদের গুলিতে সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শাহাদাৎ বরণ করেন। এর ফলে চলমান আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয় ।
৯. রাজনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন (Political Disparity and Repression) : পাকিস্তানের শাসনভার হাতে নিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নানাবিধ শোষণ চালাতে থাকে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জারি করে সামরিক শাসন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের মৌলিক গণতন্ত্র আরেক শোষণের হাতিয়ার। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলে জনগণ-এর প্রতিবাদ করে। রাজনৈতিকভাবে ৬-দফা ও ১১-দফার মাধ্যমে গণসচেতনা বৃদ্ধি পেলে জনগণ দৃঢ়তার সাথে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিও গণঅভ্যুত্থানের পথে জনগণকে সাহসী করে তোলে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির আশায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয় ।
১০. সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং প্রতারণা ও দুর্নীতি (Social and State Disparity and Cheating and সর্বস্তরের জনগণকে ধীরে ধীরে প্রতিবাদী করে তোলে এবং গণঅভ্যুত্থানের পথে নিয়ে যায়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের Corruption) : আইয়ুব খানের শাসনামলে সমাজে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে স্থানীয় টাউট গোষ্ঠীর দৌরাত্ম সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানের তাঁবেদার আমলাদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলে বঞ্চিত নিপীড়িত জনগণ মুক্তির আশায় আন্দোলনে নামে। তাছাড়া আইয়ুব খানের শাসনের সময় দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটলে গণমানুষ মুক্তির আশায় গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করে।
১১. বিবিধ ঘটনাবলি ( Other Happenings ) : ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূল্যায়ন না বাঙালির স্বকীয় সাংস্কৃতিক সত্তায় আঘাত, জরুরি সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি ইত্যাদি কারণে থাকা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকার ও নিরাপত্তা বৈষম্য, সামরিক ও বেসামরিক আমলা গোষ্ঠীর গণবিবর্তন
গণমানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থান অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে ।
গণঅভ্যুত্থানের বহুবিধ কারণের মধ্যে নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখযোগ্য—
১. ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে ঘোষিত সামরিক শাসনের প্রতিবাদ হিসেবে পরবর্তীকালে সূচিত হয় এ গণঅভ্যুত্থান । ২. আইয়ুব শাসনের ফলে সৃষ্ট পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের প্রতি এক আন্দোলন সৃষ্টির জন্য এ গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় । ৩. মৌলিক গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য স্বার্থান্ধ ব্যক্তিবর্গের অশুভ ক্ষমতাকে প্রতিহত করার মানসে সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থান। ৪. পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের গণবিরোধী ভূমিকার প্রতিবাদ হিসেবে সৃষ্টি হয় এ গণঅভ্যুত্থান । ৫. পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যের নীতির প্রতিবাদস্বরূপ গড়ে ওঠে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সিদ্ধান্ত
Aims, Objectives and Decisions of Mass - Upsurge in 1969
(ক) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives)
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সূচিত হয়েছিল সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১ গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন ।
2 স্বায়ত্তশাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা ।
3 পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণ ।
8 সকল গণবিরোধী ও অশুভশক্তির মূলোৎপাটন।
৫ সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব খর্ব করা।
উল্লিখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গণঅভ্যুত্থানের তীব্রতা শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সংগ্রামী জনতার উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে ক্ষমতাসীন সরকারের ভীত কেঁপে উঠল। আইয়ুবের শাসনামলে যারা সরকারি অনুকম্পা লাভ করেছিল তাদের জানমালের নিরাপত্তা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হল। ছাত্রজনতা তাদের কারও ঘরবাড়ি ঘেরাও করে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় ২ জন প্রাদেশিক মন্ত্রী, প্রাদেশিক কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন (১৮৯৯–১৯৭৭) ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস.এ রহমানের বাসভবনে। প্রধান প্রধান শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জনতার হাতে। গ্রামে গণআদালত গঠন করে মৌলিক গণতন্ত্রীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। অবস্থাদৃষ্টে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী হাঁপিয়ে উঠল। ক্রমে ক্রমে তারা নিষ্ক্রিয় হতে থাকল, সরকার সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা সেন্ট্রাল ল' কলেজের ছাত্র এ.এম. আসাদুজ্জামান (আসাদ)- এর মৃত্যু, ২৪ জানুয়ারি পুলিশের বুলেটে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান, মকবুল, রস্তম আলীর মৃত্যু, ২৫ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও কেমিক্যালস ওয়ার্ক-এর কর্মচারী আনোয়ারা বেগমের মৃত্যু, ১৫
ফেব্রুয়ারি বন্দী অবস্থায় আগরতলা ষড়য্যা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হকের গুলিবিশ্ব হয়ে নিহত হওয়া, ১৮ ফেব্রুয়ারি ইপিআরের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু ইত্যাদি মর্মান্তিক ঘটনা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। উপায়ন্তর না দেখে মোহাম্মদ আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দেন। তিনি সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি মেনে নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। এমনকি আইয়ুব খান ভবিষ্যতে আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে না দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]