বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর। (Discuss the Origin and Evolution of Bangla Language.)

ভাষা Language
ভূমিকা
Introduction
প্রাচীন থেকে আধুনিক সকল পর্যায়ে ভাষার প্রকাশই মানবগোষ্ঠীকে অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বকীয় ও পৃথক বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। আর সেই ভাষার মাধ্যমেই মানুষ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পূর্ণাঙ্গ মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে। এ ভাষার কার্যকর প্রকাশে মানুষ পারিবারিক-সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক-রাজনৈতিক উৎপাদন-অর্থনৈতিক তথ্য আদান-প্রদান শিখেছে। তাই ভাষা আর সাহিত্য দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিধায় চলতি পরিচ্ছেদে সাহিত্য শব্দটিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের আলোচনার মূল কাঠামো থাকবে ভাষাকে কেন্দ্র করেই এবং তা করাই পাঠ্যক্রমকে মেনে চলা। প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, 'মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।' ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশে পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা বাংলা। বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় একমাত্র এবং ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহৃত প্রধান ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা এবং দেশের ১৬ কোটি লোকসহ বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এ বাংলা ভাষাতেই ‘গীতাঞ্জলি' কাব্যের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বে একমাত্র বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার জন্যই জাতিসংঘের ইউনেস্কো ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে, যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অহংকৃত অর্জন । পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২,৫০০ ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে যার ব্যবহারও ঘটেছে।
বাংলা ভাষার উদ্ভব
Origin of Bangla Language
মানবসভ্যতার চলমান সময়ের সেই প্রাচীনকালে ভাষার উদ্ভব প্রথমে কীভাবে হয়েছিল তা পুরাপুরি জানা না থাকলেও বিভিন্ন সম্ভাব্য তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে সাত হাজার বছর পূর্বেকার সময়ে অর্থাৎ প্রায় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এশিয়া ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে। এ ইন্দো ইউরোপীয় মূল ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার মূল ভাষাগোষ্ঠীর জন্ম। ইন্দো- ইউরোপীয় মূল ভাষা দুই ভাগে বিভক্ত। যথা-
i. কেন্তুম,
ii. শতম।
উক্ত শতম শাখা থেকেই আর্য ভাষার উদ্ভব। আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের পর তাদের বৈদিক ভাষা কালক্রমে উচ্চারণের অপপ্রয়োগ ও স্থানীয় অনার্যদের ব্যবহৃত শব্দের মিশ্রণের ফলে ভাবগাম্ভীর্য হারায়। পরবর্তীতে পাণিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতকে এ ভাষা সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন করেন। কালক্রমে আর্যদের ব্যবহৃত এ ভাষাও দেশীয় মিশ্রণের শিকার এবং ‘প্রাকৃত ভাষা' অর্থাৎ প্রকৃতি বা জনগণের ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আবার প্রাকৃত ভাষার কোনো ব্যাকরণবদ্ধ রূপ না থাকায় এর অপপ্রয়োগ ঘটে এবং নানারূপ অপভ্রংশের উদ্ভব ঘটে। আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক জর্জ আব্রাহাম গিয়ারসন-এর মতে, 'পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃতজাত মাগধী অপভ্রংশ থেকে খ্রিষ্টীয় ৭ম শতকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
বাংলা ভাষার উদ্ভবের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে তিনটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে যুগ বিভাগ অনুযায়ী । যথা-
প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)
মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) ও
৩. আধুনিক যুগ (১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ- বর্তমান)
নিচে এদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
১. প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষা (Bengali Language in Ancient Period) : কয়েক হাজার বছরের মানবসমাজের ইতিহাসের সঞ্চয় থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই মূলত বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে উল্লেখযোগ্যভাবে। এ সময়ের অর্থাৎ প্রাচীন যুগের প্রধানতম সাহিত্যিক নিদর্শন হচ্ছে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে সংগ্রহকৃত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধন সংগীত, বাংলা ভাষার প্রথম কবিতা সংকলন 'চর্যাপদ'। যদিও এর ভাষা ও বিষয়বস্তু দুর্বোধ্য কিন্তু প্রাচীন যুগের এ ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সুলতানি আমলে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার উদ্ভবে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়।
২. মধ্যযুগে বাংলা ভাষা (Bengali Language in Mediaeval Period) : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রথমদিকে অর্থাৎ ১২০১-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত বাংলা ভাষায় তেমন কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি বিধায় এ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের 'অন্ধকার যুগ' বলে অভিহিত করা হয়। সময়ের বিচারে ১৩৫০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪৫০ বছরে বাংলা ভাষার উদ্ভব অধিকতর গতিশীলতা পায়, প্রধানত রাজা-বাদশাহ আর বুদ্ধিজীবী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যের পরিবেশে। এ সময় বাংলা কাব্যের দু'টি প্রধান ধারা দেখা যায় । যথা—
ক. কাহিনি কাব্য,
খ. গীতিকাব্য ।
মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন হলো চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় দ্বিদবল্লভ কর্তৃক উদ্ধারকৃত বড়ু চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য। এ সময় বাংলা ভাষার পদ্ধতিগত উন্নয়ন ঘটে।
আধুনিক যুগে বাংলা ভাষা (Bengali Language in Modern Age ) : ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষার উদ্ভবে বিদেশি ভাষা-সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য সংমিশ্রণ ঘটে, যার মাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। এ সময় রাম রাম বসু প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' (১৮০১ খ্রি.) ও প্যারিচাঁদ মিত্র প্রথম উপন্যাস 'আলালের ঘরের দুলাল' (১৮৫৮ খ্রি.) রচনা করেন এবং বাংলা গদ্যে যতি চিহ্নের ব্যবহার করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। পরবর্তীতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক এ আধুনিক বাংলার সৃষ্টি । এ যুগে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব পরিধি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদার্পণ করে ।
বাংলা ভাষার বিকাশ
দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয়
Development of Bangla Language
ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক-প্রশাসনিক মাপকাঠিতে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অতি প্রাচীনকাল থেকেই অভিজাত এবং শাসকগণ এ অঞ্চলে নিজেদের ভাষা চালু করেছিলেন। আর সে এলাকার ভাষা সচেতনতা কিংবা ভাষাপ্রীতির কারণেই এভাবে সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে শাসকশ্রেণির ভাষা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। যেমন- সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি এবং কিছুদিন আগে উর্দু (১৯৪৭-৭১ খ্রি.)। এটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ আধিপত্যবাদী শাসকশ্রেণির ভাষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে নিজেদের ভাষার মাধ্যমে সমাজের ঐক্য তৈরি করেছেন। ভাষাকেন্দ্রিক এসব বিভিন্ন জীবনাচার বা সাংস্কৃতিক উপাদান আবার রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের কঠিন পথেও পর্যাপ্ত আত্মশক্তি যুগিয়েছে সংগ্রামী জনগোষ্ঠীকে । বাংলা ভাষার বিকাশ কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়েছে। যেমন-
প্রাচীন ভারতে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল ভাষা। পালি ও অর্ধমাগধি ভাষা ছিল বৌদ্ধ ও জৈনদের। এদের ধর্মীয় আলোচনা ও সংস্কৃতির বাহন ছিল ভাষা। প্রাচীন বাংলার সময়ে বেশকিছু বাংলা ভাষাভাষী কবি- সাহিত্যিক ছিলেন (জয়দেব, উমাপতিধর, বোধন, আচার্য প্রমুখ) যাঁদের মাধ্যমে বহু তৎসম ও অন্যান্য প্রভাব বাংলা ভাষার বিকাশে সহায়ক হয় ।
বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের পর (ত্রয়োদশ শতকে অর্থাৎ ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের পর) আরবি-ফারসি ও তুর্কি ভাষার প্রভাবে বাংলা ভাষার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
মুসলিম শাসনামলে (১৪/১৫ শতকে) ফারসি রাজভাষা হওয়ায় সেই ভাষা সম্পৃক্ত সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা ভাষার বিকাশের পথ সুগম হয়ে উঠে ।
মুসলমান শাসকগণ ‘জবান-এ বাংলা'র পৃষ্ঠপোষকতা করলে পণ্ডিতগণের কথিত 'গৌড় ভাষা' সমৃদ্ধ হয়ে বাংলায় তৎসম শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় ।
মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি শব্দাবলির ব্যবহার সমৃদ্ধি আনে।
১৭ শতকে বিদেশি বণিকদের আগমন বৃদ্ধিতে চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি ছাড়াও নানাবিধ বিদেশি শব্দ সংযুক্ত হয় ।
১৮/১৯ শতকে ব্রিটিশদের উদ্যোগে শিক্ষার উন্নয়নে ভাষার বিকাশ ঘটে ।
১৯ শতকে রাজা রামমোহন রায়, ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার বিকাশ সাধিত হয়।
বিগত কয়েকশত বছরের পর্যালোচনায় আমাদের এ অঞ্চলের চলমান রাজনীতিতে, আন্দোলন-সংগ্রামে জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত ভাষা রাজনৈতিক একক হিসেবে কাজ করেছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ও মতাদর্শ তৈরির পটভূমি হিসেবে। তাই একথা স্বীকার করতেই হবে যে, একাত্তরের স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তি ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসার মৌলিক চেতনা থেকে এসেছে।
ভাষাবিশেষজ্ঞ গ্রীয়ারসন (১৯২৭) বাংলা ভাষাকে দুটি প্রধান শাখায় পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত করেছেন। পূর্বাঞ্চলীয় ভাষার কেন্দ্র হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ঢাকা জেলাকে । তাঁর মতে, এ অঞ্চলের ভাষার বৈশিষ্ট্য প্রথমে নজরে পড়ে খুলনা এবং যশোরে । গাঙ্গেয় বদ্বীপের পূর্বেও তা বিদ্যমান। তারপর তা প্রসারিত হয়েছে উত্তর-পূর্বে। মাগধী, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের রূপ ৪টি— রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, বাঙালি ও কামরূপী। বাংলাদেশে প্রচলিত বাঙালি ও বরেন্দ্রী এখনও তাই আছে। বরেন্দ্রীর ওপর প্রভাব বেশি বাঙালির।
গ্রীয়ারসনের এ মন্তব্যের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে, প্রমাণ রয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের বরেন্দ্র এলাকার জনগোষ্ঠীর ভাষার প্রকাশে। পশ্চিমবঙ্গের চলমান সংস্কৃত রীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল সাধুভাষা। আবার এরই পাশে বর্তমানে গড়ে উঠেছে একটি ভাষা যা কলকাতার “শিষ্টজনের মৌখিক ভাষা'। এ বৈশিষ্ট্যটাকেও বিদ্যমান পাওয়া যায় বর্তমান কলকাতার চলমান জীবনাচারে। আবার এর বিপরীতে হচ্ছে পূর্ববঙ্গের মৌখিক ভাষার একক যা পূর্ববঙ্গে সকল
সম্প্রদায়ের জীবনচর্চায় ছিল সক্রিয়। বর্তমানেও তা সক্রিয় রয়েছে রাষ্ট্রীয় সাহায্যে বা বর্তমান ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক তাই একথা আবারও প্রমাণিত হতে পারে যে, ভাষার প্রভাব যেমনি জনগোষ্ঠীর জীবনাচারে দেখা যায় তেমনি দেখা
রাজনৈতিক-প্রশাসনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত আচার-অনুশীলনেও।
এভাবে আমরা দেখি, উভয় বঙ্গের ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও ভাষা ব্যবহারে দু' অঞ্চলের পার্থক্য বিদ্যমান। সতেরো পূর্ববঙ্গের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন-
'যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুগায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যায়।
উপরিউক্ত পক্তিগুলোতে ভাষাপ্রীতি থেকেও আরো সোচ্চার হয়ে উঠেছিল অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙ্গ প্রতিবাদ। ভাষা কাজ করে তখন রাজনৈতিক একক হিসেবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ববঙ্গের কথাই বিবেচনায় এনে পর্যালোচনা করা যাক। পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর, উর্দুভাষী শাসকশ্রেণি ও তাদের সহযোগিরা বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের ওপর জোর দিয়ে সাংস্কৃতিক আধিপত্য চাপিয়ে নিয়ে চেয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের নবীন সাহিত্যিকরা পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন তাঁদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। এ সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) বলেছিলেন, “স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বাধীন নাগরিকরূপে অন্ত আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্বশাখায় সমৃদ্ধ এক সাহিত্য। ঐ সাহিত্য হবে মাতৃভাষা বাংলায়।” ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনিই আবার বলেছিলেন, “বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষাকে পূর্ববঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদই ন প্রয়োজনবোধে বিদ্রোহ করতে হবে । কেননা এটা পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য জেনোসাইড বা গণহত্যার শামিল।” ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি, তখন তিনি তার কনিষ্ঠ পুত্রকে বলেছিলেন, “নিজের মাতৃভাষার জন্য যদি তোমার প্রাণও যেত আমার কোনো দুঃখ থাকত না।” এভাবে দেখি, ভাষা পূর্ববঙ্গে শুধু আর সাংস্কৃতিক একক হিসেবেই থাকে না, রূপান্তরিত হয় রাজনৈতিক এককেও এবং পূর্ববঙ্গের সাহিত্যে প্রকাশিত এ আশা-আকাঙ্ক্ষাও কাজ করেছিল ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের পিছনের শক্তি হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অবদান তুচ্ছ করার মতো নয় এবং তা পরে প্রেরণা যুগিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনে। ভাষার প্রতি যেকোনো আক্রমণ পূর্ববঙ্গের জনগণ গ্রহণ করেছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। তাই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দুই একক বিচার করলেও দেখব বাংলা ভাষা এ অঞ্চলের জনগণকে বেঁধেছে এক কঠিন বাঁধনে যা ছিন্ন হবার নয়। তাই হয়ে থাকে সকল পর্যায়েই।
ব্রিটিশ শাসককুল ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতের অংশের স্বাধীনতা প্রদানকালে পাকিস্তানের সাথে অনেকটা চাতুরতার পরিচয় দিলেও পাকিস্তান সরকার মার্কিনী প্রভাব বলয় থেকে ৬ বছর পরও মুক্ত হতে পারি নি। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অলি আহাদ তাঁর ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫' গ্রন্থে বলেছেন, ‘১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের ১৯ তারিখে করাচিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স কেনেথ ইমারসন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করিয়া দেশবাসীর ওপর দাসত্ব-শৃঙ্খল চাপাইয়া দেয়।'
কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং মননশীল চিন্তাবিদ আবুল ফজল তাঁর 'সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র' গ্রন্থে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার ওপর হামলাই হচ্ছে মানুষের তৈয়ারি সবচেয়ে বড় সংকট। আমাদের তরুণরা সে সংকটের সম্মুখীন হয়ে জাতির জন্য নতুন করে মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বকে আবিষ্কার করে দিয়ে গেছেন।'
আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনার ভিত্তি রচনা হয়েছিল উৎপাদন-অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক শোষণ থেকে একথা যেমনি সত্যি তেমনি সত্যি তার মৌলিক শক্তি নিহিত ছিল ভাষাকেন্দ্রিক।
বাংলা ভাষার ব্যবহার
Use of Bangla Language
আজকের আধুনিক সভ্যতায় ভাষার ভিন্নতা সত্ত্বেও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদি আদান-প্রদানে ভাষার কোনো বিকল্প নেই। পারিবারিক-সামাজিক, রাজনৈতিক-কূটনৈতিক, উৎপাদন-অর্থনৈতিক যেকোনো বিষয়ে ভাবের আদান-প্রদানে ভাষার ব্যবহার সবখানেই। ভাষার গঠন-কাঠামোর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে, তবে এক সফল ব্যবহারকারীর কাছে এর কার্যকারিতা নিয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। আজকের আধুনিক সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্প্রসারণে, পারিবারিক- সামাজিক সমন্বয়-সৌহার্দ রক্ষায়, সম্ভাব্য রাজনৈতিক-কূটনৈতিক, উৎপাদন-অর্থনৈতিক বিষয়েই ভাষার প্রয়োজনীয় ব্যবহার রয়েছে।
আধুনিক বিশ্বে ২০ শতকে প্রমথ চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাস, জসিমউদ্দীন এবং আরো অনেকের মাধ্যমে কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে ব্যবহার করার ফলে বাংলা ভাষার উন্নয়ন সাধিত হয় । বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে প্রথম পাতায়ই লেখা হলো— 'প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা'। এ বৈশিষ্ট্যও খুব কম দেশের সংবিধানে আছে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও মনে করেন, এখন বাংলা ভাষার কেন্দ্র বাংলাদেশ এবং সে কেন্দ্রই অটুট থাকবে। দেশ গঠনে এ ভাষারবোধ প্রবল ভূমিকা পালন করেছে এবং এ পরিপ্রেক্ষিতেই দেখি, বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি বাংলাকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বেছে নিয়েছে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে। শুধু তাই নয়, বিবিসির জরিপে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে এ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরই সাধারণ মানুষ স্থান দিয়েছেন তাঁকে।
এই ভাষার কার্যকারিতা হতে পারে বিভিন্ন প্রকারের; যেমন— সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মতাদর্শগত। সামাজিক- রাজনৈতিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যম হিসেবে ভাষার কার্যকারিতা বহুভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার বিকাশ ও উদ্ভব কিংবা সমৃদ্ধিকরণের যতগুলো উপাদান রয়েছে তার মধ্যে ভাষার কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। ভাষার মাধ্যমে মানবগোষ্ঠীর এক গোত্র থেকে অন্য গোত্রের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হয়ে থাকে এবং ভাষার মাধ্যমে সভ্যতার বিকাশের প্রয়োজনীয় জ্ঞানভাণ্ডার থেকে মানুষ তার চাহিদানুযায়ী জ্ঞান অনুসন্ধান ও আয়ত্ত করে থাকে ।
পূর্ববাংলার ক্ষেত্রে বলতে গেলে বলতে হয় যে, যে সময় থেকে পূর্ববাংলা ঐতিহাসিক পর্যায়ে একটি রাজনৈতিক একক হিসেবে উদ্ভব লাভ করেছে সে সময় থেকেই ভাষার মধ্য দিয়ে কিংবা ভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলার সুনির্দিষ্টতম আত্মপ্রকাশ ঘটেছে চলমান সংস্কৃতিতে, বিদ্যমান মানবসমাজে, অনুশীলিত জীবনাচার কিংবা মতাদর্শে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকাশিত পূর্ববাংলার বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে বা সেই জনগোষ্ঠীর মৌখিক ব্যবহারে, নিত্যদিনের জীবনধারণে, বিশ্বাসিত মতাদর্শে, প্রচলিত প্রবাদে কিংবা সম্ভাব্য ছড়ায় এ ভাষাভিত্তিক নির্দিষ্টতা সোচ্চার ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে । এ নির্দিষ্টতার অন্যতম উপাদান ভাষার রাজনৈতিক একক হিসেবে ব্যবহার। আর এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল পশ্চিমা শাসককুলের ভাষাভিত্তিক প্রশাসনিক-রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। ভাষার বোধগম্যতা আর সমাজবদ্ধতা থেকেই গোত্রে গোত্রে যতটা সম্পৃক্ততা আর সহমর্মিতার সৃষ্টি হয়ে থাকে, ধর্মের মাধ্যমে ততটা নয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]