মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতন পরিস্থিতি আলোচনা কর। ( Discuss the Situation of Women Repression in Liberation War.)

গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও শরণার্থী Genocide, Repression of Women and Refugees
ভূমিকা Introduction
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের শেষদিকে বাংলাদেশে রাজাকার-আলবদর ও হানাদার বাি অত্যাচার, লুটপাট, নারী নির্যাতন, হত্যা চরম আতঙ্গের সৃষ্টি করে। হানাদার বাহিনীর আগমন ও নির্বিচার হত্যার একই রকম বিবরণ দিয়েছেন। তবে বিবাদের
আছে। ভাবতে অবাক লাগে, স্বজন-পরিজন হারিয়ে কীভাবে পরিব টেলিগ্রাফ ৩১ মার্চ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন ছাে 'আল্লাহ এবং পাকিস্তানের ঐক্যের নামে ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত মাথায় বোমাবর্ষণ এবং গোলাগুলি চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কনসার ৭,০০০ মানুষ হত্যা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার শুরুতেই ভরে যায়। হাজার হাজার মানু দিকে ছুটে পালাচ্ছে। শহরের রাস্তাঘাটগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে এবং প্রশা হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে। সেনাবাহিনী গুলি করে মারছে সাধারণ মানুসকে এবং পু সেনাবাহিনীর এ বর্বর অভিযানকে আন্দাজ করা যাবে বিছানাতে ছাত্রদের সত্তার মৃত্যু সে আগুনে পোড়া নারী ও শিশুর দেহ দেখে। পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজনদের দেখাতে পা গণহারে গুলি করে মারা হয়েছে। বাজার ও শপিংমলগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে পাকসেনারা বাঙালি দমনে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। একই সময়ে বাঙালির প্রতিরোধ স্বাধীনতার যুদ্ধ, যা মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধকে অনেকে স্বাধীনতা যুদ্ধও বলেন। আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছে শব্দ দুটি সমার্থক মনে হলেও অন আছে প্রত্যয় দুটিতে। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটির দ্যোতনা, প্রাক ১৯৭১ প্রজন্মের কাছে যতটা ব্যঞ্জনানয়, স্বাধীনতাযুদ্ধ অতটা বি অন্যদিকে, স্বাধীনতার বিষয়টি সংকীর্ণ অর্থের। মুক্তিযুদ্ধ বলতে বোঝার (বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে) বাঙালির মুক্তি। রাজনীতিবিদরা যেহেতু সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে প্রতিনিধিরূপে ওঠে এসেছেন, তাই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তারা অনুধাবন করেছেন, মুক্তি কেন ছিল প্রধান প্রশ্ন।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা Genocide in Liberation War of 1971
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকার তথ্য পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল দমন ও নির্যাতনমূলক। এ দমনমূলক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাত থেকে 'অপারেশন সার্চলাইট নামে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং সম্পদ ধ্বংসের ঘটনা শুরু করে। আর ১৪ ডিসেম্বর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা করে।
গণহত্যার সংজ্ঞা ও পরিধি (Definition and Scope of Genocide) : গণহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Genocide Genocide শব্দটি (genos) এবং ল্যাটিন শব্দ সাইড (cide)-এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন ২৬০ (৩)-এর অধীনে গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। এ গণহত্যা বলতে বোঝার এমন কর্মকাণ্ড
যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। বা হচ্ছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ২৬০ (৩)-এর অনুচ্ছেদ-২-এর অধীনে যে
কর্মকাণ্ডকে আইনগতভাবে গণহত্যা বিবেচনা করা হয় তা হলো : . পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদেরকে হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ। তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন । পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসসাধনকল্পে এমন জীবননাশী অবস্থা সৃষ্টি করা, যাতে তারা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া, যাতে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবনধারণে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নয়, সেই সাথে তাদের জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকাকে থামিয়ে দেয়া হয় ।
একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্মপরিচয় ও জাতিগত পরিচয়কে মুছে ফেলাকেও গণহত্যা বলা হয় ।
গণহত্যা প্রমাণের বিষয়টি শক্ত হলেও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞগুলোকে গণহত্যা বলে
অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। আর এ প্রেক্ষাপটেই ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিষয়গুলো আরো গভীর পর্যালোচনা ও গবেষণার দাবি রাখে।
ক. গণহত্যার প্রকৃতি (Nature of Genocide)
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় । পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক এ গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন সার্চলাইট' দ্বারা পাকিস্তানি
সৈন্যরা সেনানিবাসে অতর্কিতভাবে বাঙালি সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা পিলখানাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, খিলগাঁওয়ের আনসার সদর দফতরেও সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হাতে বন্দী হয় ৮০০ ইপিআর অফিসার ও জওয়ান। এদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক ইপিআর সদস্য রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ।
পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। আন্দোলনরত জনতাকে প্রতিরোধের জন্য তারা রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বাড়িঘর বিধ্বস্ত করে। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে হামলা করে কয়েক শত ছাত্র ও অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা- কর্মচারীকে হত্যা করে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে ও মর্টার হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে। হত্যাকাণ্ডের শুরুর প্রথম ৩ দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি নর-নারী ও শিক্ষক প্রাণ হারায় । ঢাকার প্রায় ১০ লক্ষ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এ দেশে হত্যাযজ্ঞ ও প চালায়। ২৫ মার্চ 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরুর পূর্বেই বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বের করে দেয়া এ সংবাদ মাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী সপ্তা পরে চলে গণ্য। 67005 পর কিছু সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেয়া হলেও তাদের চলাচলের ওপর সার্বক্ষণিক নি এতদসত্ত্বেও এসোসিয়েটেট প্রেসের মট রোজেনরুম রিপোর্ট করেন প্রায় ১০ লক্ষ লোককে পারি করেছে।' নিউইয়র্ক টাইমস-এর ম্যালকম ব্রাউন লেখেন 'সেনাবাহিনী যতই সাফাই থাক না কেন তারা ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বা কামান দিয়ে ধ্বংস করেছে।' তাঁর মতে, ৬ সপ্তাহে প্রায় ত্যা করা টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ডান কাগিন-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'ঢাকা একটি মুখের শ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ কোনো সরকার কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিগত, ধর্মীয় বা বিনাশ করা। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে 'জেনোসাইড' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। এ গণহত্যা বর্তমানে আর্ক হিসেবে বিবেচিত, যার কোনো ক্ষমা নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। ৩০ লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা করে। এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ আর কোথাও হত্যা করা হয়নি।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী গণগত্যা শুরু করে। রাজাকার, শান্তি বাহিনী ি হওয়ার পর গণহত্যার কার্যক্রম আরো পরিকল্পিতভাবে চলতে থাকে। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণহত্যা শুরু হয় চলে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যা চাপানো হয়েছিল। অনেক জায়গায় এক মৃতদেহ গর্ত করে পুতে রাখা হয়েছে যেগুলোকে আমরা গণকবর বলি। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু স্থানে নিয়েও মানুষ ফেলে রাখা হতো। এগুলো বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যা যেখানে একদিনে ১০ বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এরূপ গণহত্যা চুকনগর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। চুকনগর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া অন্তর্গত। খুলনার উত্তরে যশোর ও ফরিদপুর, পূর্বে ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালি, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বঙ্গোপসাগর। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এ পথ ধরেই মানুষ বাংলাদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে যেতে চেয়েছেন।
খ. গণহত্যার বিচারের অপরিহার্যতা (Necessity of Judgement for Genocide)
গণহত্যা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গণহত্যা যেখানেই ঘটুক, যখনই ঘটুক তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। মানবতাবিরোধী এ অপরাধের বিচারের কোনো সময়সীমা নেই। গণহত্যার ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও প্রমাণ নির্ণয় এবং যাচাই বিচারের অপরিহার্য অংশ। এমন ন্যায়বিচার আধুনিক রাষ্ট্র ও সভ্যতার সর্বজনীন সময়ের দাবি। এ ন্যায় ও সত্যের উন্মোচন কেবল বিরোধী পক্ষ বা অপরাধীর persecution-এর জন্য নয়। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, মানব মর্যাদা, মূল্যবোধ সভ্যতার আকাঙ্ক্ষাটি সকলের অনুভবে আনার জন্য গণহত্যা ও মানবতাবরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়টি অতীব জরুরি। গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের সত্য উন্মোচন ও বিচারের মধ্য দিয়ে যেমন সমঝোতা ও শান্তির দুয়ার খুলতে পারে তেমনি নির্মিত হতে পারে জাতির ন্যায়সঙ্গত অধিকার, অহংকার আর মানব মর্যাদা। তাই যেকোনো গণহত্যার মতো বাংলাদেশের ১৯৭১-এর গণহত্যার যৌক্তিক বিচার আজ সময়ের ঐতিহাসিক যৌক্তিক দাবি। গণহত্যার বিচারের যৌত্ত্বিকতা ও অপরিহার্যতা আজ সর্বজন স্বীকৃত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার মাধ্যমে যাঁরা তাদের আপনজনদের হারিয়েছেন তারা সুদীর্ঘ সময় নিরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতেই পার করে দিয়েছেন ৪০ বছর। অবশেষে সেই স্বজন কেড়ে নেওয়া গণহত্যার বিচারের চলমান বাস্তবতায় তারা এখন কিছুটা হলেও শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের প্রত্যাশ গণহত্যার মতো ঘৃণ্যতম অপরাধীদের উপযুক্ত বিচার হবে, শহিদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতন
Repression of Women in Liberation War of 1971
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল দমন ও নির্যাতনমূলক। এ দমনমূলক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তান ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাত থেকে 'অপারেশন সার্চলাইটের' নামে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে।
নির্যাতিতা নারীরা সব সময় অবমাননার শিকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি প্রহর তাদের কেটেছে আতঙ্কে, যারা নির্যাতিত পুনর্বাসন করতে চেয়েছিলেন। ডা. জিওফ্রে ডেভিস ঐ সময় বাংলাদেশে এসেছিলেন নির্যাতিতা নারীদের সেবা প্রদানের হয়েছে তাদের ভাগ্য তখনই নির্ধারিত হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু এদের 'বীরাঙ্গনা' অভিধায় ভূষিত করে সমাজে সম্মানের সফো দিয়েছেন- 'ধর্ষিতাদের চিকিৎসার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। সরকারি হিসাব মতে জন্য। তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা ৪ লক্ষের কম নয় এবং সেই হিসেবে তিনি একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ধর্ষিতা মহিলাদের আনুমানিক সংখ্যা ২ লক্ষ এবং ডা. ডেভিস বলেন, অন্তঃসত্তা মহিলার সংখ্যাই ২ লক্ষ।
অন্তঃসত্তা মহিলাদের সাহায্য সংক্রান্ত কর্মসূচি শুরু হবার আগেই দেড় লক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজার মহিলা গর্ভপাত করেছেন। অবশিষ্ট ৩০ হাজারের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ তাদের শিশুদের নিজের কাছে রাখার
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।
ধর্ষিতা মহিলাদের যে হিসাব সরকারিভাবে দেয়া হয়েছে ডা. ডেভিসের মতে তা সঠিক নয়। সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জেলাওয়ারি হিসাব করেছেন। সারা দেশের ৪৮০টি থানা ২৭০ দিন পাক সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে ২ জন করে নিখোঁজ মহিলার সংখ্যা অনুসারে লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লক্ষ। এ সংখ্যাকে চূড়ান্তভাবে নির্ভুল অক্ষরূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ক. নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ধরন (Various Types of Women Repression)
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের দ্বারা নারী নির্যাতন ছিল বিশ্বের স্মরণকালের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ। একাত্তরের এসব অপরাধের বিষয়ে মনোযোগী হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সকলের এগিয়ে আসা সময়ের দাবি।
একাত্তরের নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনের কতিপয় অত্যাচার সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরা হলো :
১. ধর্মান্তরিত করা (Converted to other Religion) : পাকিস্তানি দখলদার সেনা ও তাদের দোসররা নারী
নির্যাতনের সাথে সাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো কোনো নারীকে ধর্মান্তরিত হতেও বাধ্য করেছে।
২. যৌনদাসী ( Sex Slave) : একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা হিন্দু বা স্বাধীনতার পক্ষের মুসলমান
নারীদের নির্যাতনের পাশাপাশি সেই ক্যাম্পে রেখে যৌনদাসীও বানিয়েছে।
পালাক্রমে ধর্ষণ (Rape by Turns) : পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা হিন্দু ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মুসলমান নারীদের ক্যাম্পে এনে সবাই মিলে পালাক্রমে ধর্ষণের বর্বর কাজটিও করেছে।
৪. হত্যা (Killing) : পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা কোনো কোনো সময় নানাবিধ নির্যাতনের পর নিরাপত্তার
অযুহাতে নির্যাতিতা নারীদের জবাই করে বা অন্য উপায়ে হত্যা করেছে।
৫. অপহরণ (Abduction) : পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা কোনো কোনো বাঙালি নারীদের অপহরণ করে
অজানা ঠিকানায় নিয়ে যেত।
৬. নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা হওয়া (Pregnant by Repression) : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক নারী পাকিস্তানি
সেনা ও তাদের দোসরদের নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় বলে প্রচুর তথ্য আছে।
৭. উলঙ্গ অবস্থায় আটকে রাখা (Keeping Detained without any Clothes) : একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা হিন্দু-মুসলিম বিভিন্ন বয়সের নারীদের নির্যাতনের পর উলঙ্গ করে রেখে আনন্দ উপভোগ করেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়।
খ. নারী নির্যাতনের কতিপয় উদাহরণ (Some Examples of Women Repression)
বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' নামে দু'খণ্ডে এ সম্পর্কে তিনি গ্রন্থও রচনা করেছেন। তাঁর বিবরণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের নারী নির্যাতনের অনেক বিবরণ আছে। যেমন- 'আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন মেয়ে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাই আমাদের পরনে শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ।'
বীভৎস চিত্র পাওয়া যায়। তার বিবরণ মতে, 'পাঞ্জাবি সেনারা, রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল, কলেজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে রাবেয়া নামক এক নারীর বিবরণ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের নারী নির্যাতনের ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙালি যুবতী, রূপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জিপে, মিলিটারি ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে জমায়েত করতে থাকে। আমি কেন্টিনের ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম। দেখলাম আমার সম্মুখ দিয়ে জিপ থেকে আর্মি ট্রাক থেকে লাইন করে বহু বালিকা, যুবতী ও মহিলাকে এস এফ কেন্টিনের মধ্য দিয়ে ব্যারাকে রাখা হলো। বহু মেয়েকে হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং-এর ওপর তলার রুমে নিয়ে যাওয়া হে অবশিষ্ট মেয়ে যাদেরকে ব্যারাকের ভিতরে জায়গা দেওয়া হলো না তাদেরকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা অধিকাংশ মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখলাম, অনেক রূপসী যুবতীর দেহে অলঙ্কার দেখলাম। তাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছিল। এরপরই শুরু হয়ে গেল সেই বাঙালি নারীদের ওপর বীভৎস্য ধর্ষণ। লাইন থেকে পাঞ্জাবি সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে উন্মুক্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে প্রবেশ করতে লাগল। এ ব্যারাকে প্রবেশ করে প্রতিটি যুবতী, মহিলা ও বালিকার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেে ফেলে দিয়ে বীভৎস ধর্ষণে লেগে গেল। আমি ব্যারাকের ড্রেন পরিষ্কার করার অভিনয় করছিলাম আর ওদের বীভনে পৈশাচিকতা দেখছিলাম। ওদের উন্মত্ত উল্লাসের সামনে কোনো মেয়ে কোনো শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি।
অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের অসার রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দু'জনে দু'পা দু'দিকে টেনে ধরে চড়চড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল। আমি দেখলাম সেখানে বসে, আর ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম। পাঞ্জাবিরা মদ খেয়ে সবসময় সেখানকার মেয়েদের যার যাকে পছন্দ হতো তাকেই ধর্ষণ করতো। শুধু সাধারণ পাঞ্জাবি সেনারাই বীভৎস পাশবিক অত্যাচারে যোগ দেয়-নি, সকল উচ্চপদস্থ পাঞ্জাবি সামরিক অফিসারও মহিলাদের ওপর পর্যায়ক্রমে ধর কাজে লিপ্ত থাকত। কোনো মেয়ে, মহিলা বা যুবতীকে এক মুহূর্তের জন্যও অবসরও দেয়া হয়নি। ওদের উপর্যুপরি ধর্ষ ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা সেখানেই কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। পরের দিন এর মেয়ের লাশ অন্যান্য মেয়েদের সম্মুখে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত। এসব মহিলা বালিকা ও যুবতীদের নির্মম পরিণতি দেখে অন্যান্য মেয়েরা আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত এবং স্বেচ্ছায় পশুদের ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতো। যেসব মেয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য ওদের সাথে মিল দিয়ে ওদের অতৃপ্ত যৌন ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য সর্বোতভাবে সহযোগিতা করে তাদের পেছনে ঘুরে বেড়িয়েছে তাদের হাসি তামাশায় দেহদান করেছে তাদেরকেও ছাড়া হয় নি ।
অন্যদিকে উলঙ্গ মেয়েদের হেডকোয়ার্টারে দোতলা, তেতলা ও চারতলায় দাঁড় করে রাখত এবং গরুর মতো লাথি মারতো ও পেটাতো। পাঞ্জাবি সেনারা চলে যাওয়ার সময় মেয়েদেরকে লাথি মেরে আবার কামরার ভিতর ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে চলে যেত । এছাড়া বহু যুবতীকে হেডকোয়ার্টারের ওপর তলার বারান্দার মোটা লোহার তারের সাথে তাদের চুল দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং প্রতিদিন পাঞ্জাবিরা সেখানে যাতায়াত করতো। সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ যুবতীদের কেউ এসে তাদের উলঙ্গ দেহের কোমরের মাংস বেয়নেট দিয়ে উন্মত্তভাবে আঘাত করতে থাকত, কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেত কোনো মেয়ে এসব অত্যাচারে কোনো প্রকার চিৎকার করার চেষ্টা করলে তাকে তৎক্ষণাত হত্যা করা হতো। প্রতিটি মেয়ের হাত বাঁধা ছিল পিছনের দিকে। তাদেরকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেক সময় পাঞ্জাবি সেনারা সেখানে এসে সেই উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাতাড়ি বেদম প্রহার করে যেত। প্রতিদিন এভাবে বিরামহীন প্রহারে মেয়েদের দেহের মাংস কেটে রক্ত ঝরত, মেয়েদের কারও মুখের সম্মুখের দাঁত ছিল না। মুখের দুদিকের মাংস কামড়ে টেনে ছিড়ে ফেলে দিত। লাঠি ও লোহার রডের অবিরাম পিটুনিতে প্রতিটি মেয়ের আঙুল ভেঙে, হাতের তালু থেতলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত পাঞ্জাবি সেনারা এ সকল নিরীহ বাঙালি মহিলা, যুবতী ও বালিকাদের ওপর এভাবে নির্মম পাশবিক অত্যাচার ও বীভৎসভাবে ধর্ষণ চালিয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মিত্র বাহিনী ঢাকায় বোমা বর্ষণের সাথে সাথে পাঞ্জাবি সেনারা আমাদের চোখের সামনে মেয়েদের নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। রাজারবাগ হেডকোয়ার্টার অফিসের ওপর তলায় সব কক্ষের বারান্দায় এ নিরীহ মহিলা ও বালিকাদের তাজা রক্ত জমাট হয়েছিল। ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বীর বিক্রমে প্রবেশ করলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল পাঞ্জাবি সেনা আত্মসমর্পণ করে।'

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]