মুজিবনগর সরকারের গঠন ও কার্যাবলি সংক্ষেপে আলোচনা কর। (Discuss the Formation and Activities of Mujibnagor Government in Brief.)

অভ্যন্তরীণ প্রশাসন, বহির্বিশ্বে সরকারের তৎপরতা ও গুরুত্ব Internal Administration, External Activities of Government and Importance
ক. অভ্যন্তরীণ প্রশাসন (Internal Administration)
মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম (Activities of Mujibnagar Government) : মুজিবনগর সরকারের মোট ১৩টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। এ মন্ত্রণালয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় হোসেন তওফিক ইমামের বাংলাদেশ সরকার
১৯৭১ গ্রন্থ হতে । তাঁর গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে মন্ত্রণালয়গুলোর বিবরণ নিচে দেয়া হলো :
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (Ministry of Defence) : প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, সেনাপ্রধান ছিলেন লে. কর্নেল আবদুর রব, উপ সেনাপ্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। বাংলাদেশের সকল যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে ভাগ করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে ৩টি ব্রিগেডও গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Ministry of Foreign Affairs) : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। বিদেশে মিশন স্থাপন, বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা এ বিভাগের কাজ ছিল। এ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় প্রবাসী বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয় এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে ।
অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (Ministry of Finance, Industry and Commerce) : মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটসমূহের অন্যতম হচ্ছে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে সরকার যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন তা যথাক্রমে নিম্নরূপ—
2 বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ,
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুত,
৩. বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন,
8 আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন,
৫ রাজস্ব ও শুল্ক আদায়,
আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন ।

উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকারের) পূর্ণাঙ্গ বাজেট ছিল। আয়-ব্যয়ের হিসাব সংবলিত এ বাজেটে শুধু সরকারের নয়, বিভিন্ন দফতর, অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, জোনাল অফিস, যুব ক্যাম্প, শরণার্থী, বেতার, প্রচারণা ইত্যাদি ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা ছিল।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় (Cabinet Secretariat) : অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং তার অধীনে অল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ।
এ সচিবালয়ের দায়িত্ব ছিল যথাক্রমে
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
১. গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মন্ত্রিপরিষদের নিকট/সভায় পেশ করা;
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ;
বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ;
মন্ত্রিপরিষদের সাথে সম্পর্কিত নয় কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়/বিভাগের আওতাধীনও নয় এমন অন্যান্য বিষয়াদি তদারকি
আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সাধন ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করতেন । এবং
সাধারণ প্রশাসন, সংস্থাপন বিভাগ (General Administration, Establishment Department) : সাধারণ প্রশাসন বিভাগে একজন পূর্ণ সচিব নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সরাসরি প্রধানন্ত্রীর অধীনে কাজ করতেন। এ বিভাগটি সরকারের সংস্থাপন বিষয়ক কাজ করতো। যেমন : প্রবেশন, নিয়োগ, বদলি, পোস্টিং, শৃঙ্খলা, সরকারি নিয়োগের নীতিমালা বাস্তবায়ন, মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তালিকা সংরক্ষণ, নিয়োগের প্যানেল তৈরি, আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের অধীন সকল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে লোক নিয়োগ ইত্যাদি কাজ ছিল। সাধারণ প্রশাসনের দায়িত্ব। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংস্থাপন মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং) নিজ সরকারের অধীন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সকল পদে নিয়োগ দান করতেন ।
আঞ্চলিক প্রশাসন ( Regional Administration) : আঞ্চলিক প্রশাসন সৃষ্টি মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। মূল পরিকল্পনার অধীনে ৫টি অঞ্চল (জোন) সৃষ্টি করা হলেও দেশব্যাপী সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জুলাই মাসে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয় । এছাড়া ১৮টি জেলায় ১৮ জন জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছিল।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ (Health and Welfare Department) : প্রাথমিকভাবে একজন মহাপরিচালকের অধীনে গঠন করা হয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ। পরে মহাপরিচালককে সরকারের সচিবের মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ বিভাগের কার্যাবলি দুটি পৃথক ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছিল। যথা— সামরিক বাহিনীর স্বাস্থ্য চিকিৎসা এবং বেসামরিক ক্ষেত্রে চিকিৎসা ও কল্যাণ ।
তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় (Ministry of Information and Betar) : মুজিবনগর সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ইউনিট ছিল তথ্য ও প্রচার বিভাগ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের খবর এবং পাকবাহিনীর হত্যা ও অত্যাচারের কাহিনী প্রচার করার পাশাপাশি পাকবাহিনীকে ধিক্কার ও বিদ্রূপ করে এম.আর. আখতার মুকুল রচিত ও গঠিত 'চরমপত্র' প্রচার করতো ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Home Ministry) : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন পূর্ণ সচিব নিযুক্ত ছিলেন। তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার নিকট সেগুলো প্রেরণ করা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রধান কাজ। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪টি রেঞ্জের জন্য ৪ জন ডিআইজি এবং প্রতি জেলার জন্য একজন এসপি নিয়োগ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলসমূহের দায়িত্ব পালন করতেন। এ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কাজ ছিল যথাক্রমে—
১. অবমুক্ত এলাকার প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন;
২ ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যু করা;
৩. তদন্ত পরিচালনা ইত্যাদি ।
এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান ।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ (Department of Relief and Rehabilitation) : এটি রিলিফ কমিশনের অধীনে সংগঠিত একটি বিভাগ । সরাসরি স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর অধীনে কাজ করতো। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন কামরুজ্জামান। এ বিভাগের উল্লেখযোগ্য দায়িত্বসমূহ যথাক্রমে—
১ ত্রাণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন প্রকার আবেদনপত্র নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশেষ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি নাগরিকদেরকে সাহায্য করা;
2 আমার এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের কাঠামোর মধ্যে জোনাল রিলিফ অফিসসমূহের ব্যবস্থা করা; বাংলাদেশ শিক্ষকমণ্ডলীর রিলিফের বাবা
भরगानরে শিশুদের উপকারার্থে শিক্ষকদের সেবা কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহযোগিতায় ক্যাম্প-স্কুলসমূহের জন্য একটি স্কিম প্রণয়ন ও আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
সব মাল (Ministry of Parliament Affairs ) : পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী নিজে এটি দেখাশুনা করতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমস্যাদি সমাধানের দায়িত্ব পালন করতো এ বিভাগ ।
ভূমি বিভাগ (Department of Agriculture) : এ বিভাগটি পুরোপুরি সংগঠিত ছিল না। কেবল একজন সচিব নিয়োগ কথা হয়েছিল- যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের নকশা ও পরিকল্পনা তৈরি করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। প্রকৌশল বিভাগ (Engineering Department) : এ বিভাগে একজন প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে জোনাল ইঞ্জিনিয়ারগণ সেক্টর কমান্ডারদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য নিয়োজিত ছিলেন। মুক্ত এলাকার প্রকৌশল বিষয়ক সমস্যাদি সমাধানেও তারা দায়িত্ব পালন করতেন। মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরো কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীন কাজ করতেন, যেমন :
উপদেষ্টা পরিষদ (Advisory Council) : মুজিবনগর সরকারের একটি বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল দলমত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। এজন্য ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং, ন্যাপ (মোজাফফর)-এর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও কংগ্রেসের শ্রী মনোরঞ্জন ধরের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশন (Planning Commission) : ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে এবং ড. খান সরওয়ার মুর্শিদ, ড. মোশররফ হোসেন, ড.এস. আর. বোস ও ড. আনিসুজ্জামানকে সদস্য করে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। দেশের তাৎক্ষণিক পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদানও-এর কাজ ছিল।
শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড (Industry and Commerce Board) : স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বাণিজ্য বোর্ড গঠন করা হয়। এ বোর্ড শুধু আয়ের উৎস হিসেবেই নয়; বরং বাংলাদেশের আর্থিকভাবে টিকে থাকার জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানির বিভিন্ন উৎস অনুসন্ধান করতো।
যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (Youth and Reception Control Board) : এ বোর্ডের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম.এন.এ.। এ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ব্যাপক আকারে যুব ক্যাম্প ইউনিটগুলোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। নিয়মিতভাবে যুব ক্যাম্প থেকে ছেলেদেরকে এনে গেরিলা বাহিনীতে ভর্তি করা হয় ।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি (Relief and Rehabilitation Committee) : এ কমিটির প্রধান ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী । এ কমিটি বাঙালি উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব পালন করতো।
শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড (Refugee Welfare Board) : একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শরণার্থীদের কল্যাণে শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড কার্যকর ছিল।
খ. বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা (Activities of Mujibnagar Government in Abroad) বিশ্ববিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বের বিশেষ দূত নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বহির্বিশ্বের সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টা করে। এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কতিপয় প্রভাবশালী দেশের সমর্থন লাভে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো হয় । বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন করা। এছাড়া ঐসব স্থানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়। মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের অনেক বাঙালি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ৬ এপ্রিল দিল্লিস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব কে. এম. শেহাবুদ্দিন পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে প্রথম বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বিদেশে কলকাতাতেই প্রথম বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করা হয়। ৩০ জুন বিদ্রোহ করেন। ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তান মিশনের সহকারী হাইকমিশনার হোসেন আলীসহ তার ১০ জন সহকর্মী ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের ইকনমিক, কাউন্সিলর এ. এম. এ. মুহিত, ৪ আগস্ট নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের উপ- স্থায়ী প্রতিনিধি এস. আনোয়ারুল করিম, ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পাকিস্তান মিশনের মোট ১৫ জন বাঙালি কূটনীতিক একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি
ডিরেক্টর অব অডিট ও একাউন্টস লুৎফুল মতিন, ম্যানিলায় নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নীসহ ১৪ জন আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের কূটনীতিক এবং ১৯ আগস্ট ইরাকের রাষ্ট্রদূত এ.এফ.এম. আবুল ফতেহ, নাইজেরিয়ায় নিয়োজিত কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ জায়গিরদার ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন। ৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী প্রকাশ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১১ অক্টোবর লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রথম সচিব রেজাউল করিম, আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানি নিয়োজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন এবং সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তানি দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় ৩৮ জন উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তার পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং বাংলাদেশ মিশনে যোগদান বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয় ।
দূতাবাসে মে মাসের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রতিনিধি। দ্বিতীয় দফায় তিনি সেপ্টেম্বর হতে নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন। তার তৎপরতার ফলে জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানকে নতুন সাহায্যদানে বিরত থাকে এবং ঋণ রেয়াত দিতেও আপত্তি জানায় । ২ অক্টোবর ওয়াশিংটনে দাতাগোষ্ঠীর সভা বসে। এবারও পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান স্থগিত করা হয়। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। ১৬ অক্টোবর হতে ২০ অক্টোবর তারা ওয়াশিংটন সিনেটর কেনেডি পার্সী ও কংগ্রেসম্যান গালাকারসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৭টি দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন । তবে এসব বক্তব্যে গণহত্যা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তেমন কোনো মুখ্য বিষয় বলে বিবেচিত হয়-নি; বরং রাজনৈতিক সমাধানের আবেদনই ছিল মুখ্য। এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি সহৃদয়তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীদের বক্তব্য শোনেন এবং তাদের সরকারকে তা জানাবেন বলে আশ্বাস দেন ।
গ. বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার গুরুত্ব (Importance of Mujibnagar Government in Abroad) বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায়। কারণ এ ধরনের তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর ধর্ষণ, নির্যাতন ও গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির প্রতি বিশ্বব্যাপী যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতারই ফল। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন, কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভের চেষ্টা, বিদেশে তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি ছিল বহির্বিশ্বে তৎপরতার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব তৎপরতার ক্ষেত্রে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি এবং নিউইয়র্ক ও লন্ডন দূতাবাসের প্রধান। তাছাড়া বহির্বিশ্বে তিনিই ছিলেন মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত। বহির্বিশ্বে তৎপরতার ফলে এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা শরণার্থী সমস্যা নয়; বরং এটা ছিল শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম। চিনের বাধার কারণে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বক্তৃতা করতে না পারলেও এ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী বাঙালির স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে পেরেছিল। এমনকি সেপ্টেম্বর মাসে শেখ মুজিবের বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে জনমত গড়ে উঠেছিল সে জনমতের চাপে পাকিস্তানের শাসকবর্গ শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছিল । সর্বোপরি, বাংলাদেশ ও বাঙালির সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন ও আবেদন সৃষ্টি করেছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতারই ফল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]