সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা সম্পর্কে আলোচনা কর। (Discuss the cultural co-ordination and Religious Tolerence.)

সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা Cultural Syncretism and Religious Tolerance
ভূমিকা Introduction
প্রাচীন থেকে আধুনিক সভ্যতা পর্যন্ত সংস্কৃতির গোড়ার কথা বলতে গেলেই চলে আসে শিক্ষাব্যবস্থার কথা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত তাঁবেদার তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে নানা আইনকানুন প্রণয়ন ও কিছু প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। তাই আমাদের চিন্তাচেতনা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক বিনির্মাণের ওপর অনৈতিক প্রভাবকে এনেই বিচার করতে হবে।
জলবায়ু ও প্রকৃতি বাংলাদেশবাসীকে কিছুটা আয়েশি করে তুললেও নদী ও সমুদ্র তাকে দিয়েছে আত্মরক্ষার সহজপ্রবণতা ও প্রতিরোধক্ষমতা এবং মানুষের মনে সৃষ্টি করেছে এক ধরনের ভাবালুতা। রাধাকমল মুখার্জী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, 'বাঙালির এ রক্ত সংমিশ্রণ তাহার প্রধান গৌরব। ইহা হইতেই আসিয়াছে বাঙালির কোমলতা ও ঔদার্য। তাহা ছাড়া বাঙালার মাটির, বাঙালার জলের, প্রতিবেশের প্রত্যক্ষ খুব নিবিড়। বাঙালি তাই সবক্ষেত্রে ভাবুক, উদার ও সেরা বিদ্রোহী। তাই আর্য্য সংস্কৃতি ও বেদ বিরোধী বৌদ্ধধর্ম বাঙালাতে প্রথম ও প্রধান আশ্রয় পাইয়াছিল।'
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলতে পারি যে, পূর্ববঙ্গবাসীদের মনে দুটি পরস্পর বিরোধী সত্তার জন্ম হয়েছিল। ঐতিহাসিক ও ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, অনাদিকাল থেকেই যেকোনো এলাকার জনবসতি গড়ে ওঠার পিছনে প্রভাবক হিসেবে বহুবিধ বিষয়ের মধ্যে প্রধানত কাজ করেছে সেই এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও পেশাগত সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতার বিষয়টি। একথা বিভিন্নভাবেই বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণে নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মানসিকতা তৈরি করেছে। নদীর অনবরত ভাঙন, মহামারি, অত্যাচার ইত্যাদির ফলে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ সব সময় বসতি বদলেছে। এ জায়গায় সে শিকড় গাড়তে পারে নি দৃঢ়ভাবে। সমাজের মেলবন্ধন শক্ত হতে পারে নি, তার দরুন ব্যক্তি প্রবণতা শক্তিশালী হয়েছে। ফলে সেই ব্যক্তি চরিত্রে সৃষ্টি হয়েছে নৈরাজ্যের ।
সংস্কৃতি
Culture
সংস্কৃতি হলো ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট মানসিক অবস্থার রূপ— যা জীবন ও সমাজের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশ পায়। সহজ কথায় সংস্কৃতি হলো শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, রীতিনীতি, প্রকৃতি, পরিবেশ, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, পোশাক ইত্যাদির সামগ্রিক সমন্বয়। তবে কোনো সমাজের সংস্কৃতি বলতে সেই সমাজের জীবনযাপন প্রণালির চূড়ান্ত রূপটিকেই বোঝায় ।
Ralph Linton নামক জনৈক পণ্ডিত সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন যে, "Culture is the mass of behaviour that human begins in any society bears from their elders and pass on to the younger generation." অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো আচরণের সামগ্রিক রূপ যা মানুষ কোনো সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে গ্রহণ করে এবং পরবর্তী বংশধরগণের কাছে তা অর্পণ করে।
আবার অন্যদিকে প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী Tylor বলেছেন, "Culture is that complex whole which includes knowledge, belief and moral law, custom and any other capabilities and habits acquired by man
as a member of society." অর্থাৎ তার ভাষায় "সংস্কৃতি হলো- সমাজের একজন সদস্য হিসেবে একজন মানুষ কর্তৃক জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, আইন, অভ্যাস এবং সামর্থ্যের যে সমন্বয় ঘটে তাই।"
অন্যভাবে বলা যায়-সংস্কৃতি হলো একটি সংঘটিত সত্তা যার উদ্ভব ও রূপান্তর ঘটে নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ।
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে সচরাচর কোনো না কোনো সংস্কৃতির ওপর যা কোনো না কোনোভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখতে সক্ষম। একটি দেশ বা প্রদেশ বা জেলা কিংবা কোনো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জনপদ সম্পৃক্ত জনগণ তাদের জীবনধারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের অজান্তেই বিনির্মাণ করে থাকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও অহংকৃত ঐতিহ্য। তাই সংস্কৃতি অনুশীলিত মানবজীবনেরই কোনো না কোনো সময়ের ঘটনা প্রবাহের কালান্তরে টিকে থাকার যোগ্যতাসম্পন্ন ঘটনার সারবার্তা এবং ঐতিহ্য সেই অনন্য অহংকৃত ঘটনা প্রবাহের পরিশোধিত পরিতৃপ্ত সম্পদ।
কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং মননশীল চিন্তাবিদ আবুল ফজল তাঁর 'সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র' গ্রন্থে বলেছেন, ‘একটা সামাজিক সংস্কৃতির মধ্যেই মানুষ জন্ম নেয় আর তাতেই যাপন করে জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনেও সেই সংস্কৃতিটাই হয় রূপায়িত । এই না হলে সংস্কৃতি কথাটা একটা বায়বীয় ব্যাপারই থেকে যায়। পাকিস্তানে হিন্দুকে মুসলিম সংস্কৃতিতে অপরদিকে ভারতে মুসলিমকে হিন্দু সংস্কৃতিতে জোর করে দীক্ষিত করার কুমতলব যদি কোথাও থাকে তা অন্য দশটা কুমতলবের মতোই ব্যর্থ হবে।'
বাঙালি সংস্কৃতি
Bangali Culture
হাজার বছর ধরে নানা নৃ-তাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখাগোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন, পারস্পরিক প্রভাব ও সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। বহু শতাব্দী ধরে সংস্কৃতির বিভিন্ন, এমনকি পরস্পরবিরোধী উপাদানের সহাবস্থান এবং সমন্বয়ের ফলে বঙ্গীয় অঞ্চলে বাঙালিত্বের এমন এক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে, যাকে বলা হয় বাঙালি সংস্কৃতি, এককথায় বঙ্গদেশ ও বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি বঙ্গীয় সংস্কৃতি যেহেতু বাংলাদেশ এবং বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি, সেকারণে 'বাঙ্গালা' নামে একটি স্বাতন্ত্র্য অঞ্চল গড়ে উঠার আগে অথবা বাংলা ভাষা পুরাপুরি বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করার আগেকার আঞ্চলিক সংস্কৃতি থেকে বাঙালি জাতি গড়ে উঠার মুহূর্তে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আরও অনেক আগে থেকেই।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে বাঙালি সংস্কৃতির যথেষ্ট মিল থাকলেও বঙ্গভূমির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এর সংস্কৃতি নিজস্বতা লাভ করেছে। এর অবস্থান দীর্ঘদিনের শাসনকেন্দ্ৰ দিল্লি থেকে শত শত মাইল দূরে ভারতীয় উপমহাদেশের একেবারে একপ্রান্তে। ধর্ম, দর্শন ও ধারণা, সাংস্কৃতিক ধারা ও শাসনকাঠামো যা কিছু এ প্রান্তিক ভূখণ্ডে এসে পৌঁছেছে, তাই অল্পকালের মধ্যে বঙ্গীয় চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। তদুপরি জালের মতো বিস্তৃত নদী-শাখা নদী এবং বনভূমি পরিপূর্ণ বঙ্গদেশ আবার বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে এসব অঞ্চলেও সংস্কৃতি খানিকটা স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। এসব উপসংস্কৃতিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং বহু উপভাষার কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
বাঙালির মনের কেন্দ্রে আছে ধর্ম এবং তা অস্বীকার করার উপায় নেই। হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের জন্যই একথা প্রযোজ্য। এ বোধ থেকে বাঙালি কখনই মুক্তি পায় নি এবং মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে তখন তো বটে, এখনও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রবল ধর্মবোধ। বর্তমান সময়ের পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, আবহমানকাল থেকে বিদেশিরা এখানে এসেছে, তবে পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য তা কখনো বড় রকমের সমস্যার সৃষ্টি করে নি, বা করতে পারে নি। এখানকার সেই আধিপত্যবাদী শাসককুল বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও এক ধরনের সহঅবস্থান ছিল তাদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর। ফলে সবকিছুকে এড়িয়ে যাওয়ার, কোনোকিছুর দায়িত্ব না নেয়ার এক ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়েছে তার মনে ।
প্রাচীনকালে তো এ ভূখণ্ডে হিন্দু-মুসলমান ছিল না। ছিল অনার্য, জৈন, আজীবিক, বৌদ্ধ এবং তারপর বৈদিক প্যাগান ধর্মের আবির্ভাব হয়। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছিলেন, 'প্রাক-আর্য নানা কৌম বা ধর্ম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নানা মত, পথ ও অনুষ্ঠান, বৌদ্ধধর্ম, জৈন ধর্ম প্রভৃতি নানা আদর্শ ও আচার উচ্চ কোটি ও লোকায়ত স্তরের বাঙালি জীবনে প্রচলিত ছিল।'
আহমদ শরীফ তাঁর 'বাঙালির সংস্কৃতি' নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, 'অন্যান্য প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য এই যে. অন্য প্রাণী প্রকৃতির অনুগত জীবনধারণ করে আর মানুষ নিজের জীবন রচনা করে। প্রকৃতিকে জয় করে, বশীভূত করে প্রকৃতির প্রভু হয়ে সে কৃত্রিম জীবনযাপন করে- এ তার সংস্কৃতি সভ্যতা। অতএব এভাবে জীবন রচনা করার নৈপুণ্যই সংস্কৃতি। ফলে একটি নির্দিষ্ট সমাজের সংস্কৃতি বিভিন্ন উপাদান; যেমন: ইতিহাস, ধর্ম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ভৌগোলিকসত্তা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং শিক্ষার স্তর প্রভৃতির মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপলাভ করে। আবার গোলাম মুরশিদ সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিরূপণ করে বলেন- 'সংস্কৃতি বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিশেষ সমাজের সাহিত্য, সংগীত, ললিতকলা, ক্রীড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষসহ আরো অনেক শান্তি ও সৌন্দর্যের সমাহার। এরপরও, ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখলে সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত কীর্তিসমূহ।'
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কর্তৃক শোভা প্রকাশ, ঢাকা থেকে জুন, ২০১৪ মাসে প্রকাশিত তসিকুল ইসলাম রাজা, বোরহান বুলবুল ও অনুপম হাসান সম্পাদিত 'বাংলাদেশ এবং বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি' গ্রন্থে শাহানারা হোসেন তাঁর বাংলার ঐতিহাসিক পরিচয়' শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, 'প্রাচীন বাংলার সঙ্গে উত্তর ভারতের ও দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এ যোগাযোগ রক্ষা হতো স্থলপথ ও জলপথ উভয় পথেই।' আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রসঙ্গে সহজ করে লিখেছেন, 'বাঙালি চরিত্র মোটামুটি ধর্ম নিরপেক্ষ। বাঙালি মুসলমান ব্যক্তিগত জীবনে পাকিস্তানিদের চেয়েও বেশি ধার্মিক কিন্তু তারা ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার তারা অপছন্দ করে। বাস্তবে বাংলাদেশের সমাজ অত্যন্ত উদার, সর্বগ্রাহী এবং এক হিসেবে সর্বজনীন ।
বাঙালি সংস্কৃতিকে নিম্নরূপভাবে উপস্থাপন করা যায় :
ধর্মীয় বিশ্বাস : বাংলাদেশের মুসলমান, সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রে রয়েছে ধর্ম। তবে প্রাচীনকালে এ ভূ-খণ্ডে অনার্য নরগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। যেমন- সাঁওতাল, নাগা, মুণ্ডা, কৰুকী প্রভৃতি। পরবর্তীতে বাঙালি জাতি যুগে যুগে জৈন, বৌদ্ধ, সনাতন, খ্রিষ্টান, ইসলাম প্রভৃতি ধর্মের সংস্পর্শে এসেছে এবং ধর্মান্তরিত হয়েছে। কিন্তু বাঙালি জনগণ তাদের প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়নি। তাবিজ-কবজ, ঝাড়- ফুঁক, যাদু-টোনা, বান-বশীকরণ, তুক-তাক ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাঁওতাল, নাগা, মুণ্ডা, বুকী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মনিপুরীদের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির মিল আজও খুঁজে পাওয়া যায়। আজও বাঙালি শকুন-পেঁচা-কাককে অমঙ্গলের চিহ্ন মনে করে, তিথি-নক্ষত্রে বিশ্বাস করে, দিন-ক্ষণ-মাসের হিসাব করে শুভ-অশুভ বিচার-বিবেচনা করে এবং অশরীরী ভূত-প্রেত-ডাইনীকে ভয় পায় ।
খাদ্যশস্য : অস্ট্রিক-দ্রাবিড়দের প্রভাব বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির উপর বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মাছে ভাতে বাঙালি'-এ প্রবাদটির জন্মও সেই প্রাচীনকালেই ।
রন্ধন শিল্প : ভোজন রসিক বাঙালি জাতি প্রাচীনকাল থেকেই রান্নায় বিভিন্ন ধরনের মসলা, হলুদ, তেল ব্যবহার করত। বাঙালির আহারে ৬৪ রকমের ব্যঞ্জনের কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
পোষাক-পরিচ্ছদ : প্রাচীনকাল থেকেই পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য চর্চা ছিল বাঙালিদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এদেশীয়দের প্রধান বস্ত্রের মধ্যে ছিল-লুঙ্গি, ধুতি, শাড়ি, ওড়না, পাঞ্জাবি ও চাদর।
অলঙ্কার ও প্রসাধনী : প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বাঙালিরা সৌন্দর্যপ্রিয় ছিল। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তারা বালা, দুল, চুড়ি, হার, নূপুর ইত্যাদি অলঙ্কার ছাড়াও চোখে কাজল, কপালে চন্দনের ফোঁটা, ঠোঁটে আলতা ও মাথায় সুগন্ধি তেল ব্যবহার করত।
বিবাহ : আর্য সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রসারের ফলে অতীতে প্রচলিত বহুবিবাহ ও তালাকের উপর কোনো কোনো সময় নিষেধাজ্ঞা নেমে এলেও বাল্যবিবাহ এখনও গ্রামে প্রচলিত ।
জীবনাচার : এতদাঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠীর একাধিক জীবন বিশ্বাস থেকেই পরবর্তীতে সনাতন হিন্দুধর্মে পুনর্জন্মাবাদের প্রচলন ঘটে ।
সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা
Cultural Harmony
সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা সমাজের মানুষের জীবনধারাকে বৈচিত্র্যময় ও সহনশীল করে তোলে। সাংঘাতিক পরিস্থিতি এড়িয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে খাপ খাইয়ে এসব সংস্কৃতিকে মেনে নিয়ে মানুষে-মানুষে, সমাজে সমাজে, জাতিতে জাতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করাকে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা বলে। সংস্কৃতি মানবসম্পদের একটি মিশ্র রূপ । কোনো সমাজের সংস্কৃতি বলতে সে সমাজের মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালিকে বোঝানো হয়। রাফিউল আজম (Rafiul Azam) বলেছেন, “সংস্কৃতি হলো মানবসমাজের সেইসব আচরণসমূহের রূপরেখা, যা সমাজবদ্ধ মানুষ তাদের পূর্ববর্তীদের নিকট থেকে গ্রহণ করে এবং পরবর্তীদের নিকট অর্পণ করে যায়।” অর্থাৎ সংস্কৃতির রূপ ও এর প্রকৃতি সদা পরিবর্তনশীল । একটি দেশের ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ুকে কেন্দ্র করেই সে দেশের সংস্কৃতি গড়ে উঠে। বাঙালিরাও এর ব্যতিক্রম নয়। নদীমাতৃক এ বাংলার ভূ-প্রকৃতি ধান চাষের উপযোগী হওয়ায় ভাত বাঙালিদের প্রধান খাদ্য। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাছ ৷ এজন্য বাঙালিদের বলা হয়-“মাছে ভাতে বাঙালি।” আর সমন্বয়বাদিতার কথা বলতে গেলে বলতে হয়- শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ বঙ্গ-ব-দ্বীপ যেমন গড়ে উঠেছে উজান থেকে আসা পলিমাটি দিয়ে, মানুষের সংস্কৃতির অনেকটাই গড়ে উঠেছে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে। লক্ষণীয় যে, নানা জাতি ও নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সাথে বাংলার সংস্কৃতির সংস্পর্শের ফলে কখনোই দৃশ্যত কোনো সংঘাত ঘটেনি, কোনো সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যও তৈরি হয়নি। সবসময় দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণে তৈরি হয়েছে একটি তৃতীয় মাত্রার অভিনব সংস্কৃতি, যা পুরনো সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে নির্মাণ করেছে এর নতুন গতিধারা। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী যেমন- মৌর্য, গুপ্ত, রাজা শশাঙ্ক, পাল, সেন অতঃপর মুসলিম শাসনামলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে এদেশের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে। কালক্রমে, দেশি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বিদেশি সংস্কৃতির উপাদানগুলো গ্রহণ, বর্জন, সংশ্লেষণের মাধ্যমে সবসময়ই একটি মিশ্র সংস্কৃতির নকশা তৈরি করেছে। যার ফলে দৃশ্যত কোনো সংঘাত ছাড়াই ঐ মিশ্র সংস্কৃতির ধারা নির্মাণ করেছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঢেউয়ের নকশা। ফলে এ মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বিদ্যমান একদিকে যেমন বহুমাত্রিকতা অপরদিকে ঐকতানও। আর এর প্রবাহমানতা থেকেই তৈরি হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা। বাংলাদেশে হিন্দুদের সত্যপীরের পাঁচালি পাঠ এবং মুসলমানদের দরগায় বাতি জ্বালানো, বিয়ের অনুষ্ঠানে গায়ে হলুদ, বাসি বিবাহ, গান-বাজনা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এদেশীয়দের সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতারই প্রমাণ বহন করে ।
ধর্মীয় সহনশীলতা
Religious Tolerance
নিজ ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও অন্য ধর্মকে মেনে নেওয়ার মানসিকতাই হলো ধর্মীয় সহনশীলতা, যা উক্ত ভূ-খণ্ডের জনগণ অর্থাৎ বাঙালির মাঝে উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয় । প্রাচীনকালে এ বাংলা ভূ-খণ্ড আর্য জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল না, ছিল অনার্য নরগোষ্ঠী যেমন-সাঁওতাল, নাগা, মুণ্ডা, বুকী প্রভৃতির বসবাস। অতঃপর এ ভূ-খণ্ডে সর্বপ্রথম আর্য জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। তারা হলো মৌর্য বংশ (খ্রিস্ট, পূর্ব, ৩২৪-১৮৫ অব্দ)। মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য । মৌর্যরা এদেশে রাজধর্ম হিসেবে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন ঘটায়। পরবর্তীকালে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এদেশে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৩২০-৫২০ খ্রিষ্টাব্দ) গোড়াপত্তন করে এবং গুপ্ত রাজাদের আমলে এদেশের রাজধর্ম হয়ে যায় সনাতনী হিন্দু । গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময় (৬০৬-৬৩৭ খ্রি.) আবার উক্ত অঞ্চলের রাজধর্ম হয়ে যায় বৌদ্ধ ৷ ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত
পাল বংশের শাসনামলে (৭৫০-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ) রাজধর্ম বৌদ্ধই ছিল। কিন্তু ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেন বংশের শাসনামলে (১১২৫-১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ) এদেশের রাজধর্ম হয়ে যায় সনাতনী হিন্দু। অতঃপর ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে এতদঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে এবং বর্তমান পর্যন্ত এদেশীয়দের প্রধান ধর্মরূপে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত আছে। সুতরাং দেখা যায়, এ দেশে রাজার পরিবর্তনের সাথে সাথেই রাজধর্মের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু প্রজাদের মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। রাজা যে ধর্মের লোকই হোকনা কেন, তিনি কল্যাণমুখী ও প্রজাদরদি হলে প্রজারা তাকে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে। এবং শ্রদ্ধাও করেছে। ঠিক তেমনি শাসকও সকল ধর্মের প্রজাদের সমন্বয়েই প্রশাসনব্যবস্থা গতিশীল রেখেছে। যার দরুন সেসময়ে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি, বরং সকল ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সম্ভাব বজায় ছিল।
বর্তমানেও মাজারের প্রতি হিন্দু-মুসলমানদের প্রায় একই বিশ্বাস। তন্ত্রমন্ত্র, কবচ-তাবিজে সব বাঙালিরই কমবেশি আস্থা আছে। হিন্দু-মুসলমান সবার বিয়ের অনুষ্ঠানেই গায়ে হলুদ-আল্পনা আছে এবং সকল সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রীতিভোজের ব্যবস্থা প্রায় একই রকম। এই যে, সকল ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এ সংস্কৃতিকেই ধর্মীয় সহনশীলতা নামে অভিহিত করা হয়েছে।
যুগে যুগে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা
Cultural Harmony and Religious Tolerance in Periods
বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহনশীলতার বিকাশধারার চরিত্র ও প্রকৃতি নির্ণয় করতে গেলে লক্ষ করা যায়, যুগে যুগে বারে বারে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে সংস্কৃতি ও ধর্মের সকল বিভাগে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আর্যদের আগমন থেকে শুরু করে প্রতিটি বিদেশি শক্তি দেশ শাসন করেছে এর নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুশাসন অনুসারে। এর মানে প্রতিটি নতুন রাজশক্তির সাথে সংস্পর্শ ও সংঘাত ঘটেছে বাঙালি সংস্কৃতির এবং সংঘাতে টিকে থাকতে হয়েছে নানা সমঝোতা ও মিশ্র প্রক্রিয়ার কৌশলের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিদেশি সংস্কৃতির সাথে সাংস্কৃতিকভাবে আপস করা যেন এক রকম একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে ।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেবার পরই যেমনি উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সমাজ কাঠামোতে সংঘাত সৃষ্টি করতে প্রয়াস চালিয়েছে তেমনি সেই শুরু থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে এ ধর্মীয় বিভাজনকেও । হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রে বাঙালি পরিচয়টাই প্রাধান্য পেয়েছে বা এ বোধের কারণেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বদলে বাঙালিত্বের বিভিন্ন উপাদান রক্ষার ব্যাপারে যৌথ লড়াই হয়েছে। এ উপাদানগুলোকে বরং সমন্বিত ধর্মীয় উপাদান বলা যেতে পারে। আবার এ বোধকে অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতাও বলতে পারেন। তবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বলাই বোধ হয় শ্রেয় এবং বাঙালির জাতি রাষ্ট্র গঠনে তা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই অনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার প্রতিরোধযোগ্য।
বাঙালির সমাজের স্বকীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বর্তমান অবস্থানে আসতে বিভিন্ন যুগের নানাবিধ পরিবর্তন-পরিবর্ধনের স্তর পার হতে হয়েছে। এসব পরিবর্তনের কিছু তথ্য আলোচনা করা হলো । যেমন-
ক. প্রাচীন যুগ (Ancient Period)
বাঙালি আজ যে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহনশীলতার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, তার ভিত্তি প্রোথিত আছে অনেক গভীরে, কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের বুকে। আবহমানকাল ধরে প্রবহমান অনার্য ও আর্য সংস্কৃতির প্রাচীন ধারা বহু বিচিত্র প্রভাব, প্রতিবন্ধকতা দ্বারা স্বদেশের মাটিতেই আপন পরিবেশে লালিত ও পরিপুষ্ট হয়েছে। সংস্কৃতিতে সমন্বয়ধর্মিতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বঙ্গদেশে এসে বিদেশি সব ধর্ম ও সংস্কৃতিই খানিকটা বঙ্গীয় আদল পেয়েছে । প্রাচীন যুগ ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১. অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ (Mixing of Non-Arja Culture ) : বাঙালি সংস্কৃতিতে অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কেননা বাঙালি সংস্কৃতির মূল উৎস ও ভিত্তি ছিল প্রাচীন অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, ক্রিয়াকর্ম, খাদ্যাভ্যাস, চালচলন, ধর্মীয় অনুরাগ ও মানব সংস্কৃতি। বাঙালির মননে এবং অধ্যাত্মবুদ্ধিতে সংখ্যা, যোগ ও তন্ত্রের প্রভাব বরাবর প্রবল। সর্বপ্রাণবাদে তথা জড়বাদে এবং জাদুতে তার আস্থা অবচেতন ও নিঃসঙ্গ মনে ক্রিয়াশীল থেকেছে চিরকাল। বাঙালির চেতনায়, স্নায়ুতে রক্তধারায় তা মিশে আছে। বাঙালি বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, ইসলাম প্রভৃতি ধর্ম গ্রহণ করে নানা সম্প্রদায়ের রূপলাভ করেছে বটে কিন্তু কখনো সে সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রের প্রভাব ছাড়তে পারে নি।
২. আর্য-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ (Mixing of Arja Culture ) : আর্যরা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে উত্তর ভারতে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল। বাংলায় তাদের বিস্তারের গতি ছিল ধীর এবং তারা বাংলায় বসবাসকারী অনার্য অস্ট্রিক, দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোকদের অসুর, দস্যু ও পাপী বলে মনে করত। প্রাচীন বাংলার সমাজ, সংস্কৃতিতে আর্য প্রভাব ছিল প্রবল। তবে প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি আর্যদের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিল। ৩. ধর্মীয় ভাবধারার সংমিশ্রণ (Mixing of Religious Thought) : বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন, পৌরাণিক, হিন্দুধর্ম, লোকায়ত ধৰ্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, চৈতন্য ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, নাথধর্ম, ব্রাহ্মধর্ম প্রভৃতি প্রাচীন বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের উৎপত্তিস্থান বঙ্গভূমি থেকে বহু দূরে বিধায় ধর্মের কোনোটাই তার আদি এবং অকৃত্রিম রূপে এ অঞ্চলে পৌঁছায় নি। সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং লিখেছেন যে, তিনি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় লোকদের ধর্মীয় দর্শন, আচার-আচরণ এবং সামাজিক রীতিনীতিতে অনেক সাদৃশ্য দেখেছেন। সমাজের কাঠামোতে, জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। বাংলায় স্থানীয়দের প্রথাসমূহ, অনার্যদের বিশ্বাস, রীতি, আচারাদি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বিদ্যমান ছিল। সুফি-দরবেশদের মাজার, দরগা জিয়ারত, দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধা, তান্ত্রিক আচারাদির প্রতি ঝোঁক প্রভৃতি লোকজ সংস্কৃতি আজও জনগণের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।
খ. মধ্যযুগ (Mediaeval Period)
বাংলার মধ্যযুগ প্রধানত মুসলিম শাসনের যুগ। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমদের বাংলা বিজয়ের পরে বাঙালি সংস্কৃতি, ধর্মীয় জীবনাচরণে ও সামাজিক কাঠামোতে আবার পরিবর্তন দেখা দেয় এবং ইসলাম ধর্মের প্রভাবে এক নতুন সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে।
মুসলিম শাসকরা বাংলায় মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম জনসাধারণের ধর্মে পরিণত হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, এ হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানীয় লোকদের ধর্মান্তরিতকরণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ বা তলোয়ারের মাধ্যমে হয় নি, বরং তা হয়েছে সুফি-দরবেশদের ধর্মপ্রচারের কারণে। তাছাড়া মুসলিম শাসকগণ শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্য ধর্মের প্রতি উদার মনোভাবী ছিলেন। পনেরো ও ষোলো শতকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছিল। বাংলার রাজদরবারে শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, মনসা বিজয়, পদ্মপুরাণ এবং কৃষ্ণমঙ্গল চর্চা হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, বাংলার মুসলিম শাসকগণ স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি উদার ছিলেন।
শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) কর্তৃক বৈষ্ণববাদের বিস্তার বাংলার লোকদের সাংস্কৃতিক আবহমণ্ডলে নতুনধারা প্রবাহিত করেছিল। মুসলিমরাও বৈষ্ণববাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল।
মধ্যযুগীয় সুলতানগণ হিন্দুদেরকে ধর্মীয় আচারাদি পালনে বাধা দিতেন না। হিন্দুরা প্রকাশ্যে অথবা মন্দিরে দেব-দেবীর পূজা করতে, পশু বলি দিতে, ধর্মীয় মিছিল করতে, প্রকাশ্যে মঞ্চে কীর্তন করতে পারত। এছাড়াও দেখা যায় যে, হিন্দুরা প্রকাশ্যে শবদাহ কর্ম সম্পন্ন করতো, মদ বিক্রি করতো, শূকর ও কচ্ছপের মাংস খেত।
পরিশেষে বলা চলে, ধর্মীয় আসক্তির চেয়ে বহিরাগত শাসকদের চিন্তাচেতনার সাথে স্থানীয় সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের সংমিশ্রণ বাংলায় বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতায় ও ধর্মীয় সহনশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। মধ্যযুগ ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
গ. আধুনিক যুগ (Modern Period)
সতেরো শতকে ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে বাংলার সংস্কৃতিতে একটি নাটকীয় পরিবর্তন সূচিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজকাঠামোতে পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায়সমূহের জীবন পদ্ধতির অবসান হয়। বাংলায় পর্তুগিজ, দিনেমার, ফরাসি, ব্রিটিশ বণিক ও ব্যবসায়ীদের আগমনে বাঙালি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। আর আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারতে ব্রিটিশদের উপনিবেশ স্থাপনের ফলে বাংলাসহ পুরো উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক বিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে বাঙালিরা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা (তথা বর্তমান বাংলাদেশি) ধর্মের নামে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও স্বতন্ত্র বাঙালি সংস্কৃতিতে সারাবিশ্বে সমাদৃত। তবে জনসাধারণের মধ্যে সংখাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম ও বাকি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তাদের মধ্যে বিরাজমান। এ কারণে তাদের সাংস্কৃতিক জীবনাচরণে মিশ্রধারা দেখা যায়। বিভিন্ন উৎসব, যেমন— ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবসসহ ঈদ, মহররম মিছিল, খ্রিষ্টীয় নববর্ষ, বড়দিনের উৎসব, কালী, দুর্গা, সরস্বতী পূজা, মাজার-দরগা পরিদর্শন অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে উদ্‌যাপিত হয়। ফলে বলা চলে, বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনে ও ধর্মীয় সহনশীলতায় বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আধুনিক যুগের বিস্তৃতি ১৮০১ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]