মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি প্রচার মাধ্যম ও জনমত গঠন আলোচনা কর। (Discuss the Foreign Publicity Media and Formulation of Public Opinion.)

বিদেশি প্রচার মাধ্যম ও জনমত গঠন
Publicity in Foreign Media and Formation of Public Opinion
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস থেকেই বাংলাদেশের খবরাখবর বিদেশি প্রচার মাধ্যমে স্থান করে নিয়েছিল। তবে ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের খবরাখবর আর পাওয়া যাচ্ছিল না। সাংবাদিকদের মধ্যে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের ২৭ বছর বয়সী সাইমন ড্রিং গ্রেফতার এড়িয়ে ২৭ মার্চ তার আলোকচিত্র নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ান এবং ২০ রোল ছবি তোলেন। কিছু ছবি জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে লন্ডন পাঠানের পর ঢাকা ত্যাগ করেন ।
লন্ডনে ফিরে ডেইলি টেলিগ্রাফে তিনি প্রথম ঢাকার গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন, সারা বিশ্বের মানুষজন প্রথম গণহত্যার খবর জানতে পারে। এরপর নানা বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও বিদেশি সংবাদ সংস্থাগুলো বাংলাদেশের খবরাখবর সংগ্রহ করে ছাপতে থাকে, যা মুক্তিযুদ্ধের সফলতাকে ত্বরান্বিত করে ।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনো না কোনো প্রতিবেদন বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান করে নিত। বিদেশি বেতার কেন্দ্রগুলো বিশেষ করে বিবিসি, আকাশবাণী ও অস্ট্রেলিয়া বেতার বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। বিবিসির মার্ক ট্যালির প্রতিবেদন ও আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রাজনৈতিক ভাষ্য শোনার জন্য বাঙালি উন্মুখ হয়ে থাকত । বিবিসি শুনতে হতো গোপনে ।
এভাবে বিদেশি প্রচার মাধ্যমগুলো বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন করতে পেরেছিল। তাদের প্রচারে ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ বিভিন্ন দেশে নিজ নিজ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দেয়ার জন্য ।
পাকিস্তান সরকারের কঠোর দমন নীতি শুধু দেশি পত্র-পত্রিকার জন্যই প্রযোজ্য ছিল না। বিদেশি মিশনের প্রকাশনা দপ্তর ও বিদেশি পত্রিকার জন্যও তা সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর পরই পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশি সংবাদদাতাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বন্দী করে এবং প্রথম সুযোগেই তাদের বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে। এসব বহিষ্কৃত সাংবাদিকের মাধ্যমেই ঢাকায় সংগঠিত গণহত্যার সংবাদ বিশ্ববাসী জানতে পারে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সেদিন প্রায় ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। তাদের মধ্যে ২ জন মিশেল নরেট ও লুই হেরেন গোপনে থেকে যান। যদিও ২ দিন পর গ্রেফতার হন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস, ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং, অবজারভার (লন্ডন)-এর প্রতিবেদক কলিন স্মিথ প্রমুখ অপারেশন সার্চলাইটের তথ্য সংগ্রহ করেন। মে মাসে সানডে টাইমস-এর পাকিস্তানস্থ প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এসব সাংবাদিকদের লেখায়- (১) গণহত্যা, (২) অবরুদ্ধ ঢাকার জীবনযাত্রা ও (৩) বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এসব বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় ।
১. ব্রিটিশ গণমাধ্যম ও জনমত গঠন (British Mass Media and Formation of Public Opinion) ভারতের পরই আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ছিল গ্রেট ব্রিটেনের গণমাধ্যমের বিশেষ করে বিবিসি এবং ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকাও জোরালো বক্তব্য রেখেছিল। ব্রিটেনের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর বিভিন্ন উপস্থাপনা পশ্চিমা বিশ্বকে এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। ব্রিটিশ কমন্সসভার অধিবেশনে ব্রিটিশ নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং ব্রিটেনের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার তৎপরতা ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রকাশের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে এক বিশাল ভূমিকা রাখে ।
ব্রিটিশ সরকার, ব্রিটেনের বিরোধী দল, ব্রিটেনের গণমাধ্যম এবং ব্রিটিশ জনগণের ভূমিকা ছিল পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্র্যাক ডাউনের মাত্র ৩ দিন পরই ব্রিটেনের কমন্স সভায় ‘পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি' নিয়ে এক বিতর্ক সভা অনুষ্ঠিত হয় ।
বিবিসি বাংলাদেশের গণহত্যা ও অবরুদ্ধ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার খরব প্রচার করে। বিবিসি ২৬ মার্চ যে খবর প্রচার করে তাতে মার্কিন কনসাল জেনারেলের উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকার বিদ্রোহে কামান ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে। পরের দিন প্রচারিত অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর ঢাকার কর্তৃত্ব গ্রহণ, কারফিউ জারি এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়। ২৮ মার্চ পরিবেশিত বিবিসির অনুষ্ঠান থেকে পাকিস্তান সরকারের মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়। ২৮ মার্চ প্রচারিত বিবিসির প্রতিবেদন থেকেও ঢাকার দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে খাদ্য সঙ্কট সম্পর্কে জানা যায়। এপ্রিল পর্যন্ত বিবিসি এভাবে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখে ।
ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকাও মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশের গণহত্যার কথা ফলাওভাবে প্রকাশ করে। ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, টাইমস, ইকোনমিস্ট, সানডে টাইমস মুক্তিযুক্তের পক্ষে ভূমিকা রাখে। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ গণহত্যা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল 'ট্যাংকম ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান'। সাইমন ড্রিং রচিত এক প্রবন্ধে ঢাকায় ২৫ মার্চ থেকে ২৪ ঘণ্টায় ৭,০০০ লোকের হত্যার খবর প্রকাশিত হয়। আমেরিকার তৈরি এম-২৪ ট্যাংক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ এবং এতে ২০০ ছাত্রের প্রাণহানির খবরও এ প্রতিবেদনে উল্লিখিত ছিল। টাইমস ১৩ এপ্রিল যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাকাণ্ড ও ঢাকার অস্থিতিশীল জীবনযাত্রার চিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। অবজারভার ১২ ডিসেম্বর প্রকাশ করে 'ঢাকা ডায়েরি' শিরোনামের প্রতিবেদন, এতে ৩-১০ ডিসেম্বর ঢাকার চিত্র ফুটে ওঠে। ১৩ ডিসেম্বর টাইমসের শিরোনামে ছিল 'গেরিলাস সেইড টু বি ফাইটিং ইনসাইড ঢাকা' । গার্ডিয়ান একই দিন যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তার শিরোনাম ছিল 'ঢাকা কাউন্টস দি টু ডেস্ট্রাকশন'। এ দুটি প্রতিবেদনে পাকিস্তান বাহিনীর বিপর্যয় ও আত্মসমর্পণের কূটনীতি আলোচিত হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর গার্ডিয়ান প্রকাশিত ‘দি এন্ড ইন ঢাকা' অথবা ওয়ার্কস প্রেস প্রকাশিত, ‘সারেন্ডার এ গ্রেট ভিক্টরি ফর বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে আত্মসমর্পণের প্রকৃত চিত্রটি পাওয়া যায়।
২. মার্কিন গণমাধ্যম ও জনমত গঠন (Markin Mass Media and Formation of Public Opinion) মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কিত অনুভূতির বিষয়ে বিস্তর পার্থক্য ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন প্রতিক্রিয়াশীল ও যুদ্ধের বিরুদ্ধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। মার্কিন পত্রপত্রিকা বিশেষ করে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বাল্টিমোর সান, টাইম ও নিউজউইক ম্যাগাজিন, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ইত্যাদি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জনমত গঠনে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ।
২৫ মার্চের রাতের পর ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি এইচ, শনবার্গকে বহিষ্কার করেছিল। শনবার্গ মুম্বাই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তার চোখে দেখা ঢাকায় বিদ্রোহ দমনের এক ভয়াবহ চিত্র তিনি বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস ২৮ মার্চ তা প্রকাশ করে। শনবার্গের রিপোর্টের মাধ্যমে নিউইয়র্ক টাইমস বিশ্বকে জানিয়েছিল, ঢাকায় কামান ব্যবহার করে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। বিশ্বে এ খবর পাকিস্তানের বিপক্ষে এক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
৩০ মার্চ নিউইয়র্ক পোস্ট বিশ্বকে জানায়, কেমন করে ট্যাংক দ্বারা একটি শহরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। নিউজউইক ৫ এপ্রিল ‘পাকিস্তান প্লাংস ইনটু সিভিল ওয়ার' শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন করে ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি উদ্ধৃতি প্রকাশ করে । এতে ইয়াহিয়া-মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'দি ম্যান অ্যান্ড হিজ পার্টি আর এনিমিজ অফ পাকিস্তান',
নিউজউইক শেখ মুজিবুর রহমানকে মহিমান্বিত করে 'পোয়েট অব পলিটিক্স' নামে একটি আলাদা ফিচার করে। টাইম ৩ মে অন্যদিকে মুজিবের উদ্ধৃতিতে ছিল' সেভ দি কান্ট্রি ফ্রম দি বুঝলেস ডিকটেটরশিপ অফ ওয়েস্ট পাকিস্তানিজ। এ সংখ্যাতেই
ঢাকার গণহত্যার যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তার শিরোনাম ছিল 'ঢাকা, সিটি অফ দি ডেড' (মৃতের শহর ঢাকা)।
মার্কিন গণমাধ্যমের এসব রিপোর্ট ঢাকা থেকে বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা বিশ্ববাসীর কাছে আয়নার মতো পরিষ্কার করে তোলে। মার্কিন ও চিনের অস্ত্র পাকিস্তানে রফতানির বিরুদ্ধে বিবৃতি আসতে থাকে। আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের নীতি এবং মার্কিন গণমাধ্যম এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল পরস্পরবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকারের ভূমিকা ও তৎপরতা ছিল দস্যুতামূলক, কিন্তু মার্কিন গণমাধ্যমের সহনশীল ও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কারণেই মার্কিন জনগণ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল। মার্কিন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন জনগণের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকলেও মার্কিন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রথম থেকেই নেতিবাচক। প্রকৃতপক্ষে শুধু মার্কিন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া বরাবরই ছিল অনেকটা ষড়যন্ত্রমূলক। এ প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অকার্যকর করার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকারে ভাঙন ধরানোরও চেষ্টা করে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ৮ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের বিবদমান সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করে যে বিবৃতি দিয়েছিল ('পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার') তত্ত্বের এ নীতি মার্কিন সরকার মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত - অনুসরণ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস, নিউজইক, ওয়াশিংটন পোস্ট, বাল্টিমোর সান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহু সংবাদ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখে। গণহত্যার শুরুতে মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ বিভিন্ন প্রতিবেদনে ঢাকাসহ বাংলাদেশের গণহত্যার চিত্রটি তুলে ধরেন। এপ্রিলে টাইম 'পাকিস্তান টপলিং ওভার দি ব্রিংকা (পাকিস্তান : পতনের পদধ্বনি) নিউইয়র্ক টাইমস 'ব্লাড গেড ইন বেঙ্গল' (বাংলার রক্তবন্যা), নিউজউইক পাকিস্তান দেখ অফ এন আইডিয়াল' (পাকিস্তান : একটি আদর্শের মৃত্যু), সেন্ট লুই পোস্ট ক্রাম্বলিং ড্রিম ইন পাকিস্তান' (পাকিস্তা একটি ভগ্নপ্রায় স্বপ্ন) শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। টাইম ৩ মে ঢাকা সিটি অফ ডেড' শিরোনামের প্রতিবেদনে ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিল জুড়ে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অবরুদ্ধ ঢাকার জীবনযাত্রা, পাকিস্তানি সরকারের কর্মকাণ্ড ও নীতি বর্ণনা করে। এতে বলা হয়, বাংলায় এ যাবৎ ১০,০০০ লোক পাকিস্তান বাহিনীর হত্যার শিকার হয়েছে। জনজীবন প্রায় অচল, খাবার জিনিসের দাম ৫০% বেড়ে গেছে। ঢাকায় ১৮০টি বাজারের মধ্যে ১৪০টি ধ্বংস করা হয়েছে। ২২ মে নি স্যাটারডে রিভিউ পত্রিকা 'জেনোসাইড ইন ইস্ট পাকিস্তান' শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারিবাজার, রমনা কালিবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হত্যাযজ্ঞের খবর পরিবেশিত হয়। ঢাকায় গেরিলাদের অপারেশন সম্পর্ক নিউজউইক ১৯ জুলাই যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, বাঙালি গেরিলাদের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে বোমা অভিযানের ফলে ৬ ঘণ্টা ঢাকা অন্ধকার থাকে। গেরিলাৱা গুলিস্তানের সামনে গ্রেনেড মারলে ১ জন নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। এছাড়া এতে বলা হয়, মার্কিন সরকারের পাকিস্তানে সরবরাহের প্রতিবাদে ধানমন্ডিস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের বাসগৃহের সামনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ৩. ভারতীয় গণমাধ্যম ও জনমত গঠন (Indian Mass Media and Formation of Public Opinion) বিশ্বের গণমাধ্যমের মধ্যে তখনকার পাকিস্তানের বাইরে ভারতের গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে জোরালো। বিশেষ করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের পত্রপত্রিকা থাকত বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন রকম সংবাদে ভরা। ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভারতবাসী ও ভারত সরকারের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলেই সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ভারতীয় গণমাধ্যমের মধ্যে অমৃতবাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্তান টাইমস, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালায়। আকাশবাণীর দিল্লি এবং কলকাতা কেন্দ্র নিয়মিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নানা রকম সংবাদ, কথিকা, পর্যালোচনা করে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। এসব পত্রিকা ২৫ মার্চের পর থেকেই ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গণহত্যার খবর ফলাও করে প্রকাশ করে। অমৃতবাজার পত্রিকার সাংবাদিক নারায়ণ চৌধুরীর লেখায় ১৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাডে
বিতারিতভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাক-ভারত সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এপ্রিলের সময় জুড়ে ২ দেশের কূটনীতিকদের নিয়ে যে কূটনীতি চলছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় আনন্দবাজার পত্রিকা, বিয়ার স্টেটসম্যান ও ফ্রন্টিয়ার থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় উভয় দেশের কূটনীতিকদের দেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান হয়, যা পত্রিকাগুলো থেকে জানা যায়। ঢাকার যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা ভারতীয় পত্রিকাগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে।
৪. সোভিয়েত গণমাধ্যম ও জনমত গঠন (Soviet Mass Media and Public Opinion)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ ঢাকায় 'ক্র্যাক ডাউন'-এর মাত্র ৭ দিনের মাথায় সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে যে বার্তা পাঠান তা রাষ্ট্রীয় দৈনিক প্রাভদা গুরুত্বের সাথে প্রচার করে। বার্তার ভাষা ছিল কঠিন ও কঠোর এবং এতে ছোটখাট 'ধমক'ও ছিল :
ঢাকার আলোচনা ভেঙে যাওয়ার খবর এবং সামরিক প্রশাসন চূড়ান্ত ব্যবস্থা অবলম্বন প্রয়োজন মনে করে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বল প্রয়োগ করেছেন— এ মর্মে খবর সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।
এ ঘটনার ফলে পাকিস্তানের অগণিত মানুষের প্রাণহানি, নিপীড়ন ও দুঃখ-কষ্টের খবরে সোভিয়েত জনগণ বিচলিত না হয়ে পারে না। মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দী করায় এবং নির্যাতন করায় সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ অনুভব করছে।
পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের ওপর নিপীড়ন অবসানের জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি।
বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েত গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ সমর্থনের পরও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে একটি ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন' এমন স্বীকৃতি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণা আসে ৯ নভেম্বর (১৯৭১) তারিখে। নয়াদিল্লি সফররত সোভিয়েত সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ভি. কুদরিয়াভেৎসেত ভারতীয় গণমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশে যে সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন' ।
৫. চিনা গণমাধ্যম ও জনমত গঠন (Chinese Mass Media and Formation of Public Opinion) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিক্রিয়া আগাগোড়াই ছিল পাকিস্তানপন্থি। চিন বরাবরই পাকিস্তানি ভাষা দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং-এর ফলে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও অন্য একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনের সুযোগ থেকে চিন বিরত থাকে। ফলে রাষ্ট্র প্রভাবিত চিনের গণমাধ্যমও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ‘পাকিস্তান' শব্দে ছিল অন্ধ । ১১ এপ্রিল (১৯৭১) চিনের প্রধান সংবাদপত্র পিপলস ডেইলি এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশের ঘটনাকে ‘পাকিস্তান'স ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স' বলে অভিহিত করে। ৭ নভেম্বর পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে পিকিং-এর এক ভোজসভায় চিনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চ্যাং প্যাক অ্যাঙ্কড ‘পাকিস্তান টু সিক এ রিজনেবল সেটেলমেন্ট অন দি বাংলাদেশ ইস্যু।' বাংলাদেশ প্রশ্নে চিনের এ ন্যায়সঙ্গত সমাধান চাওয়ার প্রেক্ষাপট যা-ই থাকুক এতদিন পরে হলেও চিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বাস্তবতা সামান্য হলেও অনুধাবন করতে পেরেছিল বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চিন এভাবে বিরোধিতা করে এবং অস্ত্র পাঠিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধনযজ্ঞে শুধু অংশীদারই হয় নি, সবশেষে বাঙালির স্বাধীনতাকেও অপমানিত করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য যখন উদিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময় চিনের প্রধান তাত্ত্বিক পত্রিকা ‘পিকিং রিভিউ' রাষ্ট্রীয় বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে 'তথাকথিত বাংলাদেশ' রাষ্ট্রের (চিনের ভাষ্য মতে) সৃষ্টিতে রাশিয়া ও ভারতের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে। পরিসমাপ্তিতে বলা যায় যে, ঢাকায় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, দেশ ও বিদেশে তার প্রতিক্রিয়ার একটি বিশেষত্ব হলো, অতিদ্রুতই তা সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছিল। বিশ শতকের সত্তর দশকের শুরুতে বিশ্ব মিডিয়া আজকের মতো এত উন্নত ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ছিল না। তা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ দেশি-বিদেশি সকল প্রকার পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিধ্বংসী আচরণ, বেপরোয়া গণহত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্তির হাত থেকে হেফাজত করেছিল।
সুতরাং একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ব্রিটিশ গণমাধ্যম, মার্কিন গণমাধ্যম, ভারতীয় গণমাধ্যম, সোভিয়েত পদমাধ গণমাধ্যম ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও প্রচারণায় কার্যকর ও সফল ভূমিকা রাখে। আর এসব বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকার মাধ্যমেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে अঠ, যার ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের কাজ
হয়। তাই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ এসব গণমাধ্যমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাঙালিদের অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ় সাংগঠনিক কার্যক্রম দেশ-বিদেশে সকল ক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। বিশেষ করে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে পাকিস্তানিদের বি
প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যে প্রতিক্রিয়া হয় তার প্রতিফলন এভাবে বিদেশেও দেখা দেয়। আর এর ফলেই একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হয়েও 'বাংলাদেশ' সমগ্র বিশ্বে এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]