. মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অবদান মূল্যায়ন কর। (Evaluate the Contribution of Women Community in Liberation War. )

ভূমিকা
Introduction
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি প্রত্যয়ী জনগোষ্ঠী তথা ছাত্রসমাজ, নারী ও সাধারণ মানুষের ওপর সীমাহীন আস্থাশীল ছিলেন বলেই সেই ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রসমাজ, নারী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও অবদান অনস্বীকার্য। মেজর (অব) এ. এস. এম. সামছুল আরেফিন এর 'মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও রণাঙ্গন' শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সংগ্রাম যেখানে শেষ, যুদ্ধ সেখানে শুধু আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এমনি একটি ধারায় প্রবাহিত। '৪৮, '৫২, '৬২, '৬৬, ৬৯, ৭০ বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মাইলফলক। '৭১ স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র অধ্যায়। চূড়ান্ত এ যুদ্ধে নেমেছিল বাংলার ৭ কোটি মানুষ ৫০ লক্ষ ছাত্র, কৃষক, জনতার সাথে সমন্বিত হয়েছিল সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণ। প্রকৃত অর্থেই এটি ছিল জনযুদ্ধ বা গণযুদ্ধ।
. ছাত্র সমাজের অবদান
Contribution of Student Community
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে ছাত্র-সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মূলত ছাত্র-সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট গঠনের পেছনে ছাত্রদের চাপ ছিল। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষা আন্দোলন, সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর জনতার গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন ও ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি প্রতিটি সংগ্রামে এদেশের ছাত্র সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিরোধ দেশের প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ কর্তৃক গড়ে ওঠেছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে সকল প্রতিরোধ ভেঙে গেলে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গমন করে এবং মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের দীর্ঘ ৯ মাস ধরে পর্যায়ক্রমে যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তাদের প্রায় ৪০% এপ্রিল মাসেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল ।
গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১৯০ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎ গ্রহণে দেখা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের ৭৪.৬% ছিল ছাত্র এবং ৭০.১% মুক্তিযোদ্ধার বয়স ছিল ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। মুক্তিবাহিনীতে ছাত্রদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের মধ্যে ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সামরিক সংগঠন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে- যেমন : সেকশন কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার ও কোম্পানি কমান্ডার পদে ছাত্রদের প্রাধান্যই ছিল বেশি। বিএ, এমএ শ্রেণিতে পাঠরত ছাত্রদের মধ্য থেকে কোম্পানি কমান্ডার নির্বাচন করা হয়েছিল। প্লাটুন কমান্ডারগণ ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র। সেকশন কমান্ডারগণ ছাত্র-অছাত্র উভয় গ্রুপ থেকে ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের পরোক্ষ ভূমিকাও ছিল। ছাত্রদের মধ্যে যারা সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কেউ শরণার্থী শিবিরে, ইয়োথ ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছে, কেউ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উজ্জীবিত রেখেছে, কেউবা ফুটবল টিমের খেলোয়াড় হিসেবে ভারতে জনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে।
নারী সমাজের অবদান Contribution of Women Community
১৯৭২ যোদ্ধা হিসেবে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহকারী রূপে, কেউবা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আশ্রয় দিয়ে,
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। কেউ
খাবার রান্না করে, অনুপ্রেরণা যুগিয়ে, তথ্য সরবরাহ করে, সেবাদান করে ইত্যাদি নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিটি নারী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার মা, বোন ও স্ত্রী-এর যেকোনো একটি। সে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় । নিন্মে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ (War by Taking Arms ) : মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে অনেক নারী যুদ্ধ করেছেন- সে তথ্য পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার পদ্মপুকুর ও পার্ক সার্কাস-এর মধ্যবর্তী এলাকার কাছাকাছি গোবরা এলাকায় প্রায় ৪00 জন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। গোবরা ক্যাম্পটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। আগরতলার লেম্বুচোরা ক্যাম্পে মহিলা গেরিলা স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর ট্রেনিং হয় । যেখানে ৮ জন মহিলা অংশগ্রহণ করেন। এ দলের নেত্রী ছিলেন মিসেস ফোরকান বেগম। রণাঙ্গনে অস্ত্রহাতে যারা যুদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বরিশালের করুণা বেগম, শোভারানী, বীথিকা বিশ্বাস, শিশির কণা, সাহানা, শোভা; গোপালগঞ্জের আশা লতা বৈদ্য, মেহেরুন নেছা; পটুয়াখালীর মনোয়ারা বেগম, যশোরের খ্রিষ্টাব্দেহা বেগম, সুনামগঞ্জের পেয়ার চাঁদ, কুড়িগ্রামের তারামন বিবি প্রমুখ। তারামন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্নাবান্নার কাজের ফাঁকে ফাঁকে অস্ত্র চালানো শিখেন এবং ১১নং সেক্টরের অন্তর্গত রাজীবপুর, মোহনগঞ্জ, আবরতলী প্রভৃতি স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি 'বীর প্রতীক' খেতাবে ভূষিত হন।
২. বিনা ট্রেনিংয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে (Participation in the Battle Field Without Training) : মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন কিছু মহিলা ছিলেন যাদের কোনো অস্ত্র ট্রেনিং না থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট গোলাবারুদ পৌঁছে দেয়া, বাংকারে খাবার পৌঁছে দেয়া, অস্ত্র পরিষ্কার করে দেয়া প্রভৃতি কাজ করেছেন। ত্রিপুরার কাকন বিবি, পাবনার ভানু নেছা, গোপালগঞ্জের আমেনা বেগম ও মোমেনা বেগম প্রমুখ যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোগী যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন । এমন অসংখ্য নারী যোদ্ধা রয়েছেন যাদের নাম উল্লেখ নেই ।
৩. মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাত্রী ও অস্ত্র সংরক্ষণকারী রূপে (As Shelterer of Freedom Fighters and Arms Preserver) : মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গেরিলা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এজন্য তাদের প্রয়োজন ছিল নিরাপদ আশ্রয়ের। বাংলার শিক্ষিত-অশিক্ষিত গৃহবধূরা, তিনি শহুরে হন আর গ্রামীণ, মুক্তিযোদ্ধাদের তারা নিরাপদ আশ্রয় দেন । নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তারা অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিজের শোবার ঘরে, রাথরুমে বা গোলাঘরে লুকিয়ে রাখে পাকসেনা, রাজাকারদের রোষানল থেকে। এমনকি তারা আশ্রয়প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবারও সরবরাহ করতেন। অস্ত্র সংরক্ষণের দায়িত্বও মহিলারা পালন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র অতিযত্নে চালের পাত্রে, মুরগির খোয়াড়ে, বিছানার নিচে, মাটির তলায়, বাথরুমে, আলমারিতে প্রভৃতি স্থানে লুকিয়ে রাখতেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতেন।
সেবা শুশ্রুষাকারিণীরূপে (As Nurse) : অসুস্থ কিংবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নার্সিং-এর দায়িত্ব নারীরাই পালন করতেন । সীমান্ত অঞ্চলে কিংবা মুক্তাঞ্চলে যেসব অস্থায়ী হাসপাতাল চালু করা হয়েছিল সেখানে নারীরাই সেবামূলক কাজ করতেন। কোনো নার্সিং ট্রেনিং ছাড়াই রোগীর সেবা করতে আসা নারীর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা সিএমএইচ-এ কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত বিশ্রামগঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালে যোগদান করেন । তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘বীর প্রতীক' খেতাবপ্রাপ্ত হন।
ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে ও ট্রেনিং ক্যাম্পে চিকিৎসা ও সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
এছাড়াও চট্টগ্রামের ডা. নুরুন্নাহার জহুর, ডা. শামসুন্নাহার কামাল, ডা. রেণুকণা বড়ুয়া, ডা. যোবায়দা প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রীরাও বিভিন্ন ফিল্ম হাসপাতালে সেবাব্রত পালন করেছিলেন। নার্স ছাত্রীরাও ফিল্ড হাসপাতালে নার্সিং পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ, এম.এন.এ বেগম রাফিয়া আক্তার ডলি, এম.এন.এ
বেগম সাজেদা চৌধুরী, এম. এন. এ ও মমতাজ বেগম।
তথ্য আদান-প্রদান কাজে (Giving and Taking of Information) : যুদ্ধের সময় তথ্যের আদান-প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং কাজটি ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অনেক সাহসী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে, নটরডেম কলেজের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে লিফলেট ছাপানো হতো। কলাবাগানের এক বাড়িতে ডুপ্লিকেটিং মেশিনে 'মুক্তিযুদ্ধ' নামক পত্রিকা ছাপানো হতো। এসব ছাপানো ও বিতরণের কাজে (ঢাকার ভিতরে এবং ঢাকার বাইরে) পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবীদের চিঠিপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেয়ার কাজেও নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
জনমত গঠনে (Formulation of Public Opinion) : বাংলাদেশের ভিতরে এবং বাংলাদেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে অনেক স্বাধীনতাকামী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশি-বিদেশি নারী (লন্ডন প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয় নারী), মহিলা সংগঠন (বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি, লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মহিলা সমিতি) বিভিন্ন সভা আয়োজন করে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে জনমত সংগঠন করতে থাকে ।
মিসেস নূরজাহান মোর্শেদ এম.এন.এ বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য হিসেবে বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি, লক্ষ্ণৌ সফর করে সেসব স্থানের পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তা তাদেরকে অবহিত করেন। প্রতিটি স্থানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের ফলে পাকিস্তান সরকার ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। তিনিই একমাত্র মহিলা যাকে পাকিস্তান সরকার তার অনুপস্থিতিতে বিচার করে ১৪ বছর জেল দেয়। এমন আরও অসংখ্যা নাম না জানা নারীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
৭. অনুপ্রেরণাদানকারিণী রূপে (Inspiration Creator) : মুক্তিযুদ্ধে নারীর অনুপ্রেরণা ছিল মুক্তিকামী মানুষের বড় শক্তি। মা হিসেবে, বোন হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে নারীর যে ত্যাগ তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক মা স্বেচ্ছায় তার ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার জ্বলন্ত উদাহরণ। জাহানারা ইমাম এবং শরীফ ইমাম তাদের বড় ছেলে রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে তাকে দেশের নামে উৎসর্গ করেছিলেন। শহিদ হয়ে রুমী সত্যিই উৎসর্গিত হয়েছিলেন দেশের জন্য। জানাহারা ইমামের মতো অসংখ্য মা ছিলেন, যারা তাদের ছেলেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে পাঠিয়াছিলেন।
৮. প্রচার মাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে (In Publicity Media and Cultural Activities) : মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা তথা সকল মুক্তিকামী জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে, তাদের মনে বিজয়ের আশার আলো জাগিয়ে তুলতে বেতার মাধ্যম, পত্রিকা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বেতারে প্রচারিত হতো দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কথিকা ইত্যাদি প্রোগ্রাম। এসব প্রোগ্রামে দেশের জনপ্রিয় মহিলা সংগীত শিল্পী, নাট্যকর্মী, সংবাদ পাঠিকা অংশগ্রহণ করেছেন। সংবাদ পাঠিকাদের মধ্যে পারভিন হোসেন, জারিন আহমেদ, নাট্যশিল্পীদের মধ্যে সুমিতা দেবী, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, লায়লা হাসান, করুণা রায়, সংগীত শিল্পী সানজিদা খাতুন, কল্যাণী ঘোষ,
শেফালী ঘোষ, নমিতা ঘোষ, ঝুমু খান এবং আরও অনেকে, কথিকা পাঠিকা হিসেবে বেগম মুশতারী শফী, আইভি রহমান, ড. নুরুন্নাহার জহুর প্রমুখ অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা গঠিত হয়। মহিলা শিল্পীরা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করতে সাহায্য করেছেন। তাছাড়া সাংস্কৃতিক দল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছেন। এভাবে আমরা দেখি যে মুক্তিযুদ্ধে নারী সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রশংসনীয় অবদান ছিল
সুতরাং বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধে নারীকে কেবল নির্যাতিতা হিসেবেই চিহ্নিত করা উচিত না, মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি
নারীর অবদান যেকোনো অংশেই কম ছিল না, যা উপরের আলোচনায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
সাধারণ মানুষের অবদান (গণযুদ্ধ)
Contribution of General People (Public War)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সেই ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত নির্দেশনা পেয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী তথা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দৃঢ় প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের গণমানুষের অকুণ্ঠচিত্ত সমর্থন ও সার্বিক অংশগ্রহণ এর অনুপম দৃষ্টান্ত। এমন জনযুদ্ধ পৃথিবী আর দেখে নি। জনযুদ্ধের বহুমাত্রিকতায় সর্বোচ্চ আগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষ। এ আমজনতাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক। অপরদিকে, সশস্ত্র বাহিনী, ইপআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যরা যারা প্রশান্ত বুকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়েছেন তাদের কাহিনীও অনুপমেয় অহংকারের। এ যুদ্ধ করেছে সাধারণ মানুষ। এমন সাহসী ও প্রত্যাশী হওয়ার জন্য সাধারণ হতে অসাধারণ গুণাবলির প্রয়োজন। বস্তুত, প্রায় ১,২০,০০০ গণযোদ্ধা আর জনগণের সাথে মিশে পেশাদার সৈনিকরাও জনযুদ্ধের গণযোদ্ধাই হয়ে গিয়েছিল ।
রাজনৈতিক বিবর্তন ছাড়া যুদ্ধ অনিবার্য হয় না। কোনো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বকথন গণমানুষের বঞ্চনার ইতিহাস, ইংরেজিতে যাকে বলে 'Deprived psychosis'। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসঙ্গে বলতে বা লিখতে গেলে জনগণের ভূমিকা সম্বন্ধে সচরাচর যা বলা হয় তাহলো- বাংলাদেশের ছাত্র, কৃষক, জনতা, পেশাজীবী, শ্রেণি গোত্র নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। তারপর আলোচনার চরিত্র ক্রমাগত সীমিত হয়ে আসে অল্প কিছু রাজনৈতিক নেতা, কিছু সামরিক ব্যক্তিত্ব, কিছু বুদ্ধিজীবী এবং আরও অল্প কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির মধ্যে। ৭ কোটি ৫০ লক্ষ জনগণের জন্য বরাদ্দ রইলো ওই একটি লাইন, কখনোবা বড়জোর একটি প্যারাগ্রাফ অথচ বহু বিদ্বান ব্যক্তি এ যুদ্ধে মাঠে নামতে পারেন-নি । পারেননি কারণ এ যুদ্ধ কেবল বিদ্যা ও বুদ্ধির যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধ ছিল নিরেট দেশপ্রেম, বাধভাঙ্গা সাহস আর সুতীব্র আবেগের এক কঠিন সংমিশ্রণ । কলমের কাজ অস্ত্র দিয়ে হয় না। তেমনি তার উল্টোটাও সত্য। আর যখন এ রক্তের ডাক এলো তখন যুক্তি দেয়া হলো- সবাই যদি রাইফেল হাতে যুদ্ধে যাবে, তবে এ বৃহত্তর সংগ্রামের মেধার যোগান আসবে কোত্থেকে। শেষমেষ রাইফেল হাতে নিবার দায়িত্ব পড়ল এ আমজনতার ওপর। এরা অসাধারণভাবে সাধারণ। জনযুদ্ধের এরাই নায়ক-এরাই গণযোদ্ধা। যুক্তিনির্ভর অনুমান অনুযায়ী প্রশিক্ষিত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ১,২০,০০০ সেনাবাহিনী-৬,০০০ ইপিআর-১১,০০০ এবং পুলিশ ও আনসার-১০,০০০ মোট ২৭,০০০ বাদ দিলে, বাকি ৯৩,০০০ হাজার ছিল গণযোদ্ধা, ছাত্র এবং গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। এ সাধারণ মানুষ তাদের সর্বস্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে
পরিশেষে বলা যায় যে, চিন, ভিয়েতনাম ও কিউবায় জনযুদ্ধ (Peoples War) সংগঠিত হয়। তবে এদের যুদ্ধ ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। অকমুনিস্টরা তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়-নি, স্বভাবতই । আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধই প্রকৃত জনযুদ্ধ। সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]