বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকারের ভূমিকা আলোচনা কর। (Discuss the Role of USA's Government in the War of Liberation of Bangladesh.)

মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিসমূহ ও মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা
The Role of Superpowers and the Muslim States in the Liberation War
ভূমিকা Introduction
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এমন একটি সময়ে যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় মোড় পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। সত্তর দশকের সূচনায় দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বিগত প্রায় আড়াই দশকের স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পাচ্ছিল। অপরদিকে, বিশ্ব রাজনীতির আরো বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, ২ সমাজতান্ত্রিক শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্বের পরিণতিতে পারস্পরিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ও বিশ্বের তৃতীয় শক্তি হিসেবে চীনের আত্মপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এমনি প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বাইরের বড় ও ছোট বেশ কিছু দেশ এ যুদ্ধের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা বিশেষ করে তৎকালীন ২ পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং উদীয়মান শক্তি হিসেবে বিবেচিত ভারত ও চিনের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। উল্লিখিত শক্তিসমূহের মধ্যে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন ছিল বিরোধী পক্ষ।
মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা Role of USA in Liberation War
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও বিতর্কিত। মার্কিন সরকারি নীতি পাকিস্তানপন্থি হলেও কংগ্রেস এবং সিনেটের বিপুল সংখ্যক সদস্য, সরকারি কতিপয় আমলা ও বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। মার্কিন গণমাধ্যম, জনমতও ছিল বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে তৎকালীন নিক্সন, রোজার্স ও ড. কিসিঞ্জার প্রশাসন পুরো ৯ মাস পাকিস্তানের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সমর্থন যুগিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতির ৪টি পর্যায় ছিল।
মার্কিন নীতির প্রথম পর্যায় (First Step of Markin Policy) (মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত) : এ সময় মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার' হিসেবে অভিহিত করে। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কীটিং ওয়াশিংটনের এ দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে ১৫ এপ্রিল বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারের অজুহাতে সারা বিশ্ব দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতে পারে না। পত্রপত্রিকার প্রতিবাদ ও প্রবল জনমতের চাপে ৭ মে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র সরবরাহ ও আর্থিক সাহায্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । এছাড়া ১২ জুন, ১৯৭১ নিক্সন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। তবে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ থাকলেও প্রচুর মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের জন্য ২৫ মার্চের আগেই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। জুনের শেষ নাগাদ মার্কিন সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে ৪.৩ মিলিয়ন ডলারের ২টি চুক্তি করে, যে অর্থ বাঙালি হত্যাযজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। তবে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো সত্ত্বেও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাহায্য পাঠানো অব্যাহত রাখে। মে মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের শরণার্থীদের জন্য ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার সাহায্য দেয়। অবশ্য-এর উদ্দেশ্য ছিল হোয়াইট হাউস বিরোধী সমালোচনার তীব্রতা কমিয়ে আনা এবং সাহায্য অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
মার্কিন নীতির দ্বিতীয় পর্যায় (Second Step of Markin Policy) (জুলাই থেকে আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত) : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় জুলাই মাসে। এ পর্যায়ে মার্কিন নীতির দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
রাশিয়াকে প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ উদ্দেশ্যে হেনরি কিসিঞ্জারের হঠাৎ করে বেইজিং সফরের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে জুলাই মাসে রুশ-ভারত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। তাই এ পরিকল্পনা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র তৎপর হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু কোনোটিই সম্ভব হয় নি। কাজেই দ্বিতীয় পর্যায়েও মার্কিন নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় ।
মার্কিন নীতির তৃতীয় পর্যায় (Third Step of Markin Policy) (সেপ্টেম্বর ৩-ডিসেম্বর, ১৯৭১) : এ পর্যায় নিক্সন প্রশাসন আরও বেশি পাকিস্তানপন্থি নীতি অবলম্বন করে। কলকাতায় অবস্থানকারী বাঙালি নেতৃবৃন্দের একাংশের সঙ্গে (খন্দকার মোশতাক আহমদপন্থি) শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে। এছাড়াও পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দেয়। যদিও মুজিবনগর ও ভারত উভয় সরকার মার্কিন এ উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে।
মার্কিন নীতির চতুর্থ পর্যায় (Fourth Step of Markin Policy) (ডিসেম্বর, ১৯৭১) : ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ভারত বিরোধী ও পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করতে থাকে। পাকিস্তানকে যাবতীয় নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনদানের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন হেনরি কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দেন। নিক্সনের এ নীতিকে 'Tilt Policy' নামে অভিহিত করা হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য ৮৬.৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। ৭ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক সম্মেলনে কিসিঞ্জারও ভারতকে আক্রমণকারী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত করেন। দিল্লি ও মস্কোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্র 'এন্টারপ্রাইজ' নামে পারমাণবিক জাহাজের নেতৃত্বে ৮টি জাহাজের একটি ‘টাস্কফোর্স' বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এটা ‘টাস্কফোর্স-৭৪' নামে পরিচিত। একই সঙ্গে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে জাতিসংঘ মার্কিন কূটনীতি সক্রিয় থাকে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৮ জানুয়ারি মার্কিন ‘টাস্কফোর্স-৭৪' ভারত মহাসাগর ত্যাগ করে। এভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতি একদিকে যেমন বাংলাদেশ বিরোধী ছিল । তেমনি নিজ দেশের জনগণ কর্তৃকও নীতিটি পরিত্যক্ত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি পর্যায়ে ভূমিকা (Role of US Non-Government Steps in Liberation War) : নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মার্কিন সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় সর্বস্তরের মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছিল। এমনকি অনেক আমলাও বাঙালির সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জর্জ হ্যারিসনের 'বাংলাদেশ কনসার্ট' ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট অনুপ্রেরণা। এভাবে মার্কিন শিল্প, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। আমেরিকার নাগরিকরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে গঠন করে বিভিন্ন সংগঠন। তাদের বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা পাকিস্তানপন্থি মার্কিন প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। মার্কিন রাজনীতিবিদ বিশেষ করে কয়েকজন সিনেটর যারা বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ও বক্তব্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে সাক্সবে, সিনেটর কেইস, কংগ্রেসম্যান গ্রাস হেলপান ও গালাকার, সিনেটর হ্যারিস, সিনেটর ফার্সি, সিনেটর মাস্কি, ওয়াল্টার মনডেল ও এডওয়ার্ড ব্রুক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সুতরাং দেখা যায় যে, মার্কিন রাষ্ট্রে সরকারি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা হলেও বেসরকারি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল ব্যাপক সহানুভূতি। কংগ্রেস, সুশীল সমাজ ও প্রচার মাধ্যমের সতর্কতা এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানের যতটা সমর্থন ও সহযোগিতা করতে চেয়েছিল ঠিক ততটা করতে সক্ষম হয়নি।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]