মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ভূমিকা আলোচনা কর। (Discuss the Role of Occupying Force of West Pakistan in the East Pakistan During the Period of the War of Liberation.)

দখলদার বাহিনী, শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও দেশীয় অন্যান্য সহযোগীদের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বুদ্ধিজীবী হত্যা
The Anti Liberation Activities of the Occupation Army, the Peace Committee, Al-Badar, Al-Shams, Rajakars, Pro-Pakistan Political Parties and Pakistani Collaborators and Killing of the Intellectuals
. ভূমিকা Introduction
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ যখন প্রথমে প্রতিরোধ সংগ্রামে এবং পরে সর্বাত্মক যুদ্ধে ফুঁপিয়ে পড়ে তখন দেশের একটি অংশ বাঙালি নিধনে এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখে। তারা অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার কার্যক্রমে কেউ দলীয় ব্যানারে, কেউ সংগঠনের নামে, কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর সহযোগী হয়। মূলত, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের পর যেসব দল তাদের ভরাডুবি মেনে নিতে পারে নি, তারাই দেশের স্বাধিকার, আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সর্বোপরি স্বাধীনতার বিপক্ষে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস এর বিরোধিতা করে। তাদের কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনা পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারিত হয়ে একাত্তরে ব্যাপক গণহত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের নৃশংস অধ্যায় রচনা করে।
১৯৭১-এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশ যখন উত্তাল, মিছিল সমাবেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন কখনো গোপনে, কখনো ঘরোয়াভাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহমত পোষণ করে। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট'-এর মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে স্বাধীনতা-বিরোধী অংশ প্রকাশ্যে-এর পক্ষে অবস্থান নেয়। পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্বের কারণে সৈন্য ও অস্ত্র সমাবেশ সমস্যা বিবেচনা করে এদেশের ইসলাম পছন্দ' ও তাদের প্রতি সহমত ঘোষণাকারী দল, ব্যক্তি, সংগঠন নিয়ে কিছু সহযোগী বাহিনী ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এ উদ্দেশ্যে এপ্রিল মাসে শান্তি কমিটি, জুন মাসে রাজাকার বাহিনী, সেপ্টেম্বরে আলবদর ও আলশামস বাহিনী ছাড়াও কিছু ছোট ছোট সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ধর্মভিত্তিক দল মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামি এবং বিহারি বলে কথিত উর্দুভাষীরা এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
দখলদার বাহিনীর ভূমিকা Activities of Occupation Army
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ ভাইস এডমিরাল এস.এম. আহসান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। তখন 'ব' অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ছিলেন লে. জে. নিয়াজি। বেসামরিক বিষয়ের সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। ৬ মার্চ (১৯৭১) লে. জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তনের সামরিক আইন প্রশাসক এবং ৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। টিক্কা খান ৭ মার্চ ঢাকায় শপথ করতে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী ৯ মার্চ গভর্নর হিসেবে তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় এবং বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকীই শপথবাক্য পাঠ করান।
২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিক্কা খান উভয় পদের দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনকে কিছুটা বেসামরিকীকরণের উদ্দেশ্যে ৩ সেপ্টেম্বর (১৯৭১) ডা.এ.এম. মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর পূর্বাঞ্চলীর কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজি-কে 'খ' অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তানের) সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। একই দিন মেজর জেনারেল রহিম খানকে 'খ' অঞ্চলের সহকারী সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয় বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী ডা. মালিককে গভর্নর হিসেবে শপথগ্রহণ করান।
টিক্কা খানের ভাবমূর্তি আগে থেকেই খারাপ ছিল এবং তিনি বেলুচিস্থানের কসাই হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে যে অতি কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তার ইঙ্গিত দেন। টিক্কা খান অত্যন্ত কঠোরভাবে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হলে অবশেষে মার্চের ২৫ তারিখে তিনি 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের অভিযান দ্বারা ঢাকায় গণহত্যা শুরু করেন, যা ক্রমান্বয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ রাত ১টা ১০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যায়। সেখানে মিনওয়ালি কারাগারে তাকে বন্দী করে রাখা হয়। ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেন, 'তার একগুঁয়েমী, তার অবাধ্যতা এবং যুক্তিতর্কের পথ অবলম্বন করায় তার অস্বীকৃতি এসবের একমাত্র অর্থ হচ্ছে— এ লোকটি এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু, আর তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে চান। তিনি দেশের ঐক্য ও সংহতিকে আক্রমণ করেছেন-এ অপরাধের শাস্তি দেওয়া হবে।' (মূল ইংরেজি ভাষণ দ্রষ্টব্য : স্বাধীনতার দলিলপত্র, সপ্তম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১-৩)
ইয়াহিয়া খান তার ভাষণেই আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সংবাদপত্রের ওপর পূর্ণ সেন্সরশীপ আরোপের ঘোষণা দেন এবং ‘পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের কর্তব্য পালন করতে' যে নির্দেশ দিয়েছেন তা দেশবাসীকে অবহিত করেন। টিক্কা খান ১৯ এপ্রিল বেতার ভাষণ দিয়ে ২৫ মার্চ থেকে তার গৃহীত ব্যবস্থাবলির যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেন ।
২৭ এপ্রিল ১৪৮নং সামরিক বিধি জারি করে- এ বিধিতে সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়। ১৪ মে এক ঘোষণায় কর্নেল ওসমানীকে ২০ মে উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সকল সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দকে ১ জুন (১৯৭১) কাজে যোগদানের জন্য এবং ২ আগস্ট থেকে ক্লাস শুরু এবং বেসরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দকে ১ জুলাই থেকে কাজে যোগদান এবং আগস্ট থেকে ক্লাস শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ক
এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জীবনযাত্রা সচল করার নিষ্ফল প্রয়াস চালানো হয়। যাদের সামরিক আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয় তারা তখন মুক্তিযুদ্ধের নানা কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত। বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে একজন বেসামরিক ব্যক্তি (ডা. এ. এম. মালিক) কে এ প্রদেশের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। ডা. মালিক ১৮ সেপ্টেম্বর যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তার সদস্যদের নাম ও দপ্তরের নাম নিচে দেয়া হলো :
নাম
ক্রমিক নং
আবুল কাশেম
2
আব্বাস আলী খান
8
আখতার উদ্দিন আহমদ
এ.এস.এম. সোলায়মান
৫. আউং শু পু

9

মওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক
নওয়াজিশ আহমদ
৯. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ মজুমদার
10. অধ্যাপক শামসুল হক
অর্থ শিক্ষা
দপ্তর
বাণিজ্য ও শিক্ষা এবং অস্থায়িভাবে আইন ও পার্লামেন্ট। শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা
বন, সমবায় ও মৎস্য এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক
রাজস্ব এবং অস্থায়ীভাবে পূর্ত, বিদ্যুৎ ও সেচ দপ্তর মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন
খাদ্য ও কৃষি
স্বাস্থ্য
সাহায্য ও পুনর্বাসন দপ্তর এবং প্রত্যাগত ও গৃহত্যাগী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন বিষয়াবলি ।
বাঙালি ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তন বাহিনী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে, সকল বাঙালিই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক নয়। এসব বিশ্বাসঘাতক বাঙালিরা পাকিস্তান প্রেমের প্রমাণ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টাও করে। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সরকারের বাইরে থেকেই তারা সৃষ্টি করেছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস
বাহিনী।
। ওরা জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘর লুণ্ঠন ইত্যাদি বর্বরতা চালায়।
শান্তি কমিটির ভূমিকা Activities of Peace Committee
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কতিপয় ডানপন্থি রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধ প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের ঘোষণা দেয়। ৪ এপ্রিল নূরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ জন নেতার সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল 'ছ' (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারিগণ নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। ৭ এপ্রিল জনাব আব্দুস সবুর খান টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। এরই সূত্র ধরে ৯ এপ্রিল ঢাকায় ডানপন্থি বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ এক সভায় মিলিত হয়ে ১০৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করে।
১৪ এপ্রিল কমিটির নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় 'পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি'। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি তাদের কাজ দ্রুত ও যথোপযুক্তভাবে চালিয়ে যাওয়া ও তাদের নীতি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন করার জন্য নিম্নলিখিত ২১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠন করে।
3
আহ্বায়ক সৈয়দ খাজা খয়ের উদ্দিন,
জনাব একিউএম শফিকুল ইসলাম,
অধ্যাপক গোলাম আযম,
8
জনাব মাহমুদ আলী,
C.
জনাব আবদুল জব্বার খন্দকার,

মওলানা সিদ্দিক আহমদ,

জনাব আবুল কাসেম,
b.
জনাব মোহন মিয়া,
d.
মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম,
১০. জনাব আবদুল মতিন,
১১. অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার,
১২. ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন,
১৩. পীর মহসীন উদ্দিন,
১৪. জনাব এ.এস.এম. সোলায়মান,
১৫. জনাব এ.কে. রফিকুল হোসেন,
১৬. জনাব নূরুজ্জামান,
১৭. জনাব আতাউল হক খান, ১৮. জনাব তোয়াহা-বিন-হাবিব, ১৯. মেজর আফসারউদ্দিন, ২০. দেওয়ান ওয়াবাসাত আলী, ২১. হাকিম ইরতেয়াজুর রহমান ।
কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির অফিস স্থাপন করা হয় মগবাজারস্থ ৫নং এলিফেন্ট লেনে। জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটির শাখা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
শান্তি কমিটিকে বলা হতো 'পিস' কমিটি। সাধারণ মানুষের কাছে 'পিস' কমিটি নামটিই বেশি পরিচিত। পিস কমিটির সদস্যদেরকে দালাল বলা হয়। মানুষ রাজাকারের চেয়ে দালালদেরকেই বেশি ঘৃণা করার কারণ হলো— রাজাকার বাহিনী গঠন, রাজাকারদেরকে পরিচালনা, রাজাকারের অপকর্মকে সম্মতি দেয়া এবং রাজাকারকে দিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা, যুবতী মেয়েদেরকে ধরে আনা এসব কাজ দালালরাই করেছে।
আলবদর বাহিনীর ভূমিকা Activities of Al-Badar
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা দান এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত আধা-সামরিক বাহিনী পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজির পৃষ্ঠপোষকতায় সেপ্টেম্বর মাসে আলবদর বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। ইসলামের ইতিহাসে বদর
যুদ্ধকে আদর্শ করে এ বাহিনী গঠিত হয়। মূলত জামায়াতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন “ছাত্র সংঘকেই” আল বদর বাহিনীতে রূপান্তরিত করা হয়। রাজাকার বাহিনী গঠনের অব্যবহিত পরেই প্রতিষ্ঠিত হয় আলবদর বাহিনী । আলবদর বাহিনীকে মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। রাজাকারদের কার্যকলাপের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য ছিল আলবদর বাহিনীর। রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে। আর আলবদর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের হত্যার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। আলবদররা ঢাকার রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আলবদর বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় আলবদর বাহিনী সম্পর্কে নিম্নলিখিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। 'আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এদেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদরযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদরযুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এ
স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেইসব গুণাবলি আমরা আলোচনা করেছি। আলবদর তরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইন্‌শাআল্লাহ, সেসব গুণাবলি আমরা দেখতে পাব। পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকরা এবারের বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই বদর দিবসের কর্মসূচি দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানরা সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ইন্‌শাআল্লাহ আলবদর যুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম। তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।'
আলবদর বাহিনী শেষ পর্যন্ত 'হিন্দুস্তানকে খতম' করতে না পারলেও অনেক হিন্দু-মুসলিম বুদ্ধিজীবী খতমের' সঙ্গে তাদের নাম জড়িয়ে রেখেছে।
আলশামস বাহিনীর ভূমিকা Activities of Al-Shams
অবাঙালিদের (বিহারি) নিয়ে আলশামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল । এ বাহিনীও ছিল পাক-হানাদার বাহিনীর অন্যতম দোসর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই বিহারি সম্প্রদায় পাক-বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। পাকিস্তানি বাহিনী এদের হাতেও অস্ত্র তুলে দেয় এবং বাঙালি নিধনে অবাধ অধিকার দেয়। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিবারের সম্পত্তি লুটপাটের পাশাপাশি আলশামস বাহিনীর সদস্যরা মেধাবী ছাত্র, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষকদের হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষক, চিকিৎসক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক এবং পেশাজীবী অনেককে চোখ বেঁধে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। ঢাকার মিরপুর এবং রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে এদের অনেকের দেহাবশেষ হাত-পা চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়।
আলশামস বাহিনী সম্পর্কে মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন যে, আলশামস আরবি শব্দ,-এর আভিধানিক অর্থ সূর্য। সূর্যসৈনিক অর্থে এ নামকরণকে তাৎপর্যময় করা হয়েছে। আলশামসের সদস্যরা ছিল অতি দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী । ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আলশামস বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে।
রাজাকার বাহিনীর ভূমিকা Activities of Rajakar
লে. জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে 'পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ‘৭১' জারি করেন। এ অর্ডিন্যান্স জারির পর ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ‘রাজাকার' শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির সময়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশ ভাগের সময় হায়দারাবাদ রাজ্যটি ভারতভুক্ত হয় এবং ঐ
রাজ্যের নিজাম বাহাদুরের ইচ্ছে ছিল হয় স্বাধীন থাকা, নয়তো পাকিস্তানর্ভুক্ত হওয়া। তিনি হায়দারাবাদকে স্বাধীন ঘোষণা করে বাহিনী গঠন করেন এবং ঐ বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন 'রাজাকার'।
হায়দারাবাদ রাজ্য রক্ষার জন্য রাজাকার নামের যে বাহিনী গঠিত হয়েছিল সেই রাজাকার আর '৭১-এ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক গঠিত রাজাকার বাহিনী এক ছিল না। '৭১-এ পাকিস্তান হানাদার গোষ্ঠী 'রাজাকার' বাহিনী গঠন করেছিল বাংলাদেশের জন্মকে অস্বীকার করে পাকিস্তান রক্ষা করতে।
'৭১-এর মে মাসে মওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ ৯৬ জন জামায়াতমকর্মীর সমন্বয়ে খুলনার আনসার ক্যাম্পে 'রাজাকার বাহিনী' গঠন করেন। পরবর্তীকালে অর্ডিন্যান্সে এ নাম গ্রহণ করা হয়। ইসলামি ছাত্র সংঘের প্রধান মোঃ ইউসুফ রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন।
রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিল গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ। রাজাকার হলে মাসে মাসে বেতন পাওয়া যাবে এবং এক সময় চাকরিটা স্থায়ী হবে, এ প্রলোভন তাদের সামনে ছিল। আদর্শিক কারণে রাজাকার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত কম। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ইসলামি ছাত্র সংঘের কর্মী, সমর্থকরা রাজাকারে যায় নি- তারা যোগ দিয়েছে আলবদর, আলশামস বাহিনীতে। মাদরাসার কিছু গরিব ছাত্র (অবশ্য তখন মাদরাসার প্রায় সকল ছাত্রই ছিল গরিব পরিবার থেকে আগত) রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তারা বিবিধ উদ্দেশ্যে রাজাকার হয়েছে। প্রথমত, চাকরির সম্ভাবনা, দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান রক্ষার আদর্শ। রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সংগ্রামের চেয়ে লুটপাট, ছিনতাই, নারী ধর্ষণ এসব কাজে মগ্ন থেকেছে। এর বিনিময়ে তারা হানাদার বাহিনী এবং পাকিস্তানপন্থি দালালদের অনুগত থেকে তাদেরকে কিছু সেবা দান করেছে। যেমন— মুক্তিযোদ্ধার অনুসন্ধান দেওয়া, হানাদার বাহিনীকে তাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেওয়া, গ্রাম থেকে গরু-ছাগল-মুরগি ধরে এনে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে সরবরাহ করা, গ্রাম থেকে যুবতী নারী ধরে এনে আর্মি ক্যাম্পে সরবরাহ করা ইত্যাদি। প্রভাবশালী স্থানীয় দালালরা রাজাকার দিয়ে ভারতগামী হিন্দু শরণার্থী দলের সর্বস্ব লুট করিয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া যায়। এভাবে দেখা যায় সেসব অপকর্মের সঙ্গে রাজাকাদের নাম জড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল ও দালালদের ভূমিকা
Role the Political Parties and Helper Who were Hasotile in the War of Liberation of Bangladesh
ইসলাম নিয়ে বা ধর্মের নামে যে সকল রাজনৈতিক দল রাজনীতি করেছিল সেসব দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ, নেজামে ইসলামী, পিডিপি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের অবস্থান সংহত করে ফেলল তখন ইসলামপন্থী দলগুলো তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। কেননা, এ সমস্ত রাজনৈতিক দল অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিল। তাঁদের কৌশল ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের দৃঢ়হস্তে দমন করা। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করা এবং যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে সেই স্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা।
২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপ তাদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানি নীতি নির্ধারকদের মতো তারাও মনে করতেন, কয়েক হাজার মানুষ হত্যার পর বাঙালি স্তব্ধ হয়ে যাবে। তখন পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে তারাই ক্ষমতায় আসবেন ।
পাক হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দালাল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পাকিস্তানি আদর্শ ও কেন্দ্রের সেনাবাহিনীর শক্তি ছিল অজেয়। তারা মনে করতেন যে, বাংলাদেশের আদর্শ জয়ী হলে তাদের স্থান হবে বিপন্ন। যে রাজনীতি করে তারা ক্ষমতার অংশীদার বা কায়েমী স্বার্থের অংশীদার হয়েছিলেন সেটি থাকবে না। নতুন বাংলাদেশে তাদের স্থান থাকবে না। এর চেয়ে বরং পাকিস্তানের অধস্তন হিসেবে ক্ষমতার সহযোগী হওয়াই তাদের কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল। এ সমস্ত দালাল নেতৃত্বের মধ্যে অবস্থানগত কারণে আবার বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র এবং ফ্যাসিষ্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল জামায়াতে ইসলাম এবং তার অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]