অভিন্ন বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ও বর্তমান বাংলাদেশের স্বকীয় সত্তা সম্পর্কে আলোচনা কর। (Discuss the Self Identification of Undivided Bengal in Context of the Then East Bangla & Present Bangladesh.)

অভিন্ন বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশের স্বকীয় সত্তা
Distinctive Identity of Bangladesh in the Context of Undivided Bangla
Introduction
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নিজস্ব সম্পদে সমৃদ্ধশালী একটি প্রদেশ হিসেবে মূলত বাংলার এ অফুরন্ত সম্পদের লোভে বিভিন্ন বিদেশি জাতিগোষ্ঠী এদেশে ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনা করতে আসে এবং এক পর্যায়ে বাংলা বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশে পরিণত হয়। ইংরেজদের ১৯০ বছর এবং পাকিস্তানি শাসকবর্গের ২৪ বছরের শাসনে বাংলা ছিল একটি অবহেলিত ও বঞ্চিত ভূ-খণ্ড। এতদসত্ত্বেও প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ভূ- খণ্ড সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভারতবর্ষে মুসলিম রাজত্বকালে এ এলাকায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে যা পরবর্তীতে পাঠান ও সুলতানদের রাজত্বকালে খাজনা আদায় ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে পরগনা হিসেবে বিভাজিত হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে এত কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল কীভাবে? এটা ঠিক পূর্ববঙ্গে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল তবে যতক্ষণ সম্ভব বাঙালি সংঘাত এড়িয়ে চলেছে। আর রুখে দাঁড়িয়েছে তখন যখন অত্যাচার একেবারে চরমে উঠেছে বা বাঙালির জীবিকার অবলম্বন জমির ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। কৃষি বাঙালির আদি পেশা বা জীবনধারণের উপায় বলেই সে তার জমিভিত্তিক অধিকার ও নিরাপত্তার কারণে বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে, এখনও বাঙালি রুখে দাঁড়ায়। আর এভাবে আমরা দেখি পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুটি পরস্পরবিরোধী সত্তার জন্ম হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছিলেন, উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে ও বাঙালির বাস্তব সভ্যতার রূপ গ্রামীণ ।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বাঙালির সাহসিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া অগ্রগামী ছিল। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবিভক্ত বাংলায় প্রথম সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলন ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ। আজকের মতোই সেদিনও সৈনিক পোশাক গ্রহণ করতো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাই সেদিনের সিপাহি বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে গণমানুষেরই আন্দোলন ছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উল্লাসকর দত্তই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম বোমা তৈরি করে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্লচাকীকে ইংরেজ হত্যার জন্য পাঠায়। পরবর্তীতে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারত সফরে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকাকালে পাঁচ শতাধিক কর্মী গ্রেফতার হয় ।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোগড়া বাজারে বিপ্লবী নারী কমলাসিংহসহ আরো কতিপয় নারীর উদ্যোগে বিপ্লবী উর্মিলা দেবীর সভাপতিত্বে প্রথম ব্রিটিশবিরোধী মহিলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ভারত রক্ষা আইনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হলে ইংরেজ ভারত ছাড় আন্দোলনে প্রথম কারারুদ্ধ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ।
১৯৪৭ পূর্ব অভিন্ন বাংলার স্বকীয় সত্তা
Distinctive Identity of Undivided Bangla Before 1947
ভৌগোলিক, ভাষাভিত্তিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে যে জনগোষ্ঠী বাঙালি এবং ভূ- খণ্ড বাংলা বা বাংলাদেশ নামে পরিচিত, তা মূলত আধুনিককালের সৃষ্টি । প্রাচীন বাংলা হিন্দুযুগের শেষ অবধি অসংখ্য ক্ষুদ্র-
বৃহৎ জনপদে বিভক্ত ছিল। মধ্যযুগের শুরুতে তথা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলার উপর মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় । মধ্যযুগে বাংলা দিল্লির অধীনস্থ থাকলেও পরবর্তীতে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁও থেকে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পরবর্তীতে দুইশ বছর স্বাধীন সুলতানি আমলের সূচনা ঘটে। আবার চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে অর্থাৎ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লখনৌতি, সোনারগাঁও, সাতগাঁও কে একত্রিত করে বাঙালা নামে অভিহিত করেন এবং নিজে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ, শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান ও সুলতান-ই-বাঙ্গালা নামে উপাধি ধারণ করেন। পরবর্তীতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে বাংলা একটি দেশবাচক নাম হিসেবে আন্তর্জাতিক মণ্ডলে পরিচিতি পায়।
১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট আকবরের বাংলা জয় ও ক্রমান্বয়ে বারো ভূঁইয়াদের পরাজিত করে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলাকে মুঘল সুবাহ বাংলায় অন্তর্ভুক্ত করেন, যার মধ্যে আরও ছিল বিহার ও উড়িষ্যা। এ সময় সুবাদারি ও নবাবি শাসনামলে বাংলার গৌরব অক্ষুণ্ণ থাকে।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলা পরাজিত হলে 'সুবাহ বাংলা' ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যায়। কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার দেওয়ানি লাভ ও পরবর্তীতে সরাসরি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ডালহৌসি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে বাংলা প্রেসিডেন্সি গঠন করেন। পরবর্তীতে লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ ও আসাম নিয়ে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ' গঠন করেন যার রাজধানী ছিল ঢাকা। অপরদিকে, কলকাতাকে রাজধানী করে পশ্চিমবঙ্গ নামে আরেকটি প্রদেশ গঠিত হয়। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্বে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের অনেক উন্নতি সাধিত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রবল বিরোধিতা ও আন্দোলন সংগ্রামের ফলে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন। ফলে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ পুনরায় একীভূত হয়। তবে বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে পৃথক করা হয়।
প্রাচীন বাংলার বিশেষ করে উনিশ শতকে সম্পূর্ণভাবে কৃষিভিত্তিক পূর্বভঙ্গ পরিণত হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাঁচামালের আড়ত হিসেবে। জনৈক ইংরেজ কর্মচারী বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গ ভারত সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দর প্রদেশ হওয়া সত্ত্বেও একে উপেক্ষা করা হয়েছে প্রশাসনিক দিক থেকে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়। এমনি অবস্থাতে প্রাচীন পূর্ববঙ্গবাসীর মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিল, যা বর্তমানেও বিদ্যমান আছে। আবার সমাজ কাঠামোর অসম ঐক্য সংস্কৃতি প্রসারণের গতি রুদ্ধ করে দিয়েছে, সেজন্য আঞ্চলিকতা বাংলার গ্রামীণ সমাজের বৈশিষ্ট্য হিসেবে থেকে গেছে। বাঙালি জনগোষ্ঠীর এ বৈশিষ্ট্যটাই তার স্বকীয়তা।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের বিভক্ত পূর্ববঙ্গের স্বকীয় সত্তা
Distincitve Identity of Divided East Bengal in 1947
ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তিতে ভারত বিভাগের প্রাক্কালে অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২৭ এপ্রিল ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে 'স্বাধীন অখণ্ড রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা করেন। এ উদ্যোগের সাথে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জ্যেষ্ঠভ্রাতা শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় সমর্থন দিলেও তা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের হাইকমান্ডের তীব্র বিরোধিতার কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।
ব্রিটিশ শাসন কিংবা নিকট পাকিস্তানি আমলেও কেন্দ্র থেকে পূর্ববঙ্গের অবস্থান ছিল সব সময় দূরে। পূর্ববঙ্গের অবস্থানগত কারণেই সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক কেন্দ্রে শাসন করেছে দূরের ও কাছের বিদেশিরাই। ফলে প্রত্যক্ষভাবে সেই শাসককুলের গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। তাই পূর্ববঙ্গবাসী তার কৃষি ও গ্রামীণ সভ্যতার মধ্যে আবর্তিত ছিল। এক ধরনের চলনসই প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল মাত্র তাদের ওপরে। ঔপনিবেশিক কারণে পূর্ববাংলার সমাজ গঠনে শ্রেণিবিন্যাস তৈরি হয়েছিল বিদ্যমান সমাজ কাঠামোকে ভিত্তি করে। ফলে শ্রেণিবিন্যাসের বিপরীতে সামাজিক মেলবন্ধন লাভ করেছে অতিরিক্ত প্রাধান্য এবং সেজন্যই সমাজের মধ্যে শ্রেণি সম্পর্ক নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ সমাজ কাঠামোর সম্পর্কহীনতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন আন্দোলনে।
ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল বাংলা বিভক্তির ব্যাপারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যকার মতানৈক্য দেখে তিনি ঘোষণা করেন যে, কেবল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐকমত্য স্থাপিত হলেই তিনি বঙ্গভঙ্গ রোধ করবেন, অন্যথায় নয় । লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা বিভক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যকার সঠিক সীমানা নির্ধারণ করার জন্য একটি সীমানা কমিশন গঠিত হয়। গভর্নর জেনারেল ২৬ ও ২৭ জুন অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন কেবিনেট সভার বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আলাপ আলোচনা ও মতামতের পর র‍্যাডক্লিফকে বাংলা ও পাঞ্জাব কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে জিন্নাহ ও নেহেরু কমিশনের স্বীয় দলের সদস্য প্রতিনিধির নাম ভাইসরয়ের নিকট জমা দেন। সীমানা কমিশনের মনোনীত সদস্যরা ছিলেন- মুসলিম লীগ মনোনীত
১. বিচারপতি আবু খ্রিষ্টাব্দেহ মোহাম্মদ আকরাম (কলকাতা হাইকোর্ট)
বিচারপতি এস. এ. রহমান (পাঞ্জাব হাইকোর্ট)
কংগ্রেস মনোনীত সদস্যরা ছিলেন
১. বিচারপতি সি.সি. বিশ্বাস (কলকাতা হাইকোর্ট)
২. বিচারপতি বিজন কুমার মুখার্জী (কলকাতা হাইকোর্ট)
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩০ জুন, ১৯৪৭ তারিখে বাংলা ও পাঞ্জাব কমিশনের সদস্যদের এবং ৪ জুলাই চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফের নাম ঘোষণা করেন। স্যার র‍্যাডক্লিফ ৮ জুলাই দিল্লি পৌঁছেন এবং অনতিবিলম্বে ভাইসরয়, কমান্ডার ইন চিফ এবং লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন এবং এ ধারণা পান যে, ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-এর মধ্যেই সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ করতে হবে।
জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সীমানা নির্ধারণ করলে অন্তত কয়েক মাস সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু র‍্যাডক্লিফ তার দিল্লির অফিসে বসে টেবিলের ওপর ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মাইলের সীমানা চূড়ান্ত করেন। এভাবে বাংলা বিভক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ *১৮ জুলাই, ১৯৪৭-এর ভারত স্বাধীনতা আইনে' বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে পশ্চিম বাংলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত এবং পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের অংশ বলে ঘোষণা দেন ।
বাংলা সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবগঠিত পূর্ববাংলা অবিভক্ত বাংলার মোট আয়তনের ৬৩.৮০% এবং মোট জনসংখ্যার ৬৪.৮৬% লাভ করে। বৃহত্তর বাংলার মুসলমান জনসংখ্যার ৮৩.৯৪% এবং অমুসলমান জনসংখ্যার ৪১.৭৮% পূর্ববাংলাভুক্ত হয়। নবগঠিত পূর্ববাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ৭০.৮৩ ঃ ২৯.১৭% । নবগঠিত পশ্চিম বাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ২৫.০১ ঃ ৭৪.৯৯% ।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ববাংলা নামে পরিচিতি লাভ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান' নামকরণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে, পূর্ব পাকিস্তানের (১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ ১৪ আগস্ট) সর্বত্র মুসলমানেরা আজানের ধ্বনি দিয়ে এ নতুন জাতি ও রাষ্ট্রের জন্মকে স্বাগত জানিয়েছিল। চল্লিশের দশকের একজন তরুণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ তাঁর দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন যে, ঢাকা শহরের সকল মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার অধিবাসীরা সারা দিনরাত স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের জন্য তোরণ নির্মাণ এবং সাজসজ্জা প্রভৃতি প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত ছিল। সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহ আলোকসজ্জিত করা হয়েছিল এবং জ্বালানো হয়েছিল আতশবাজি। জনগণের আনন্দোল্লাসে মুখরিত ছিল পথঘাট এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ ট্রাকে, কেউ বা হাতিতে চড়ে আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়েছিল। স্টেটম্যান পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী এ দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল হিন্দু- মুসলমানদের একটি সম্মিলিত মিছিল, যা ভিক্টোরিয়া পার্কে এসে জমায়েত হয়েছিল এবং সেখানে প্রধান প্রধান দলের নেতৃবৃন্দ ভাষণ দিয়েছিলেন।
সাবেক পূর্ববঙ্গ ও পরিবর্তিত নাম পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত বিভাগ ও জেলাসমূহ ছিল নিম্নরূপ :
বিভাগের নাম
অন্তর্ভুক্ত জেলাসমূহ (১৭টি)
ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর।
ঢাকা (প্রাদেশিক রাজধানী)
চট্টগ্রাম
রাজশাহী
খুলনা
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী ।
রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা ।
খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও বাকেরগঞ্জ (বরিশাল) ।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা থেকে কেটে নিয়ে নতুন একটি জেলা টাঙ্গাইল সৃষ্টি করে ঢাকা বিভাগের সাথে সংযুক্ত করা হয় এবং বাকেরগঞ্জ জেলা থেকে কেটে নিয়ে নতুন একটি জেলা পটুয়াখালী সৃষ্টি করে খুলনা বিভাগের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
. বর্তমান বাংলাদেশের স্বকীয় সত্তা
Distinctive Identity of Present Bangladesh
বাঙালি সংস্কৃতির উৎস ও ভিত্তি ছিল অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মোঙ্গলীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান তত্ত্ব ও মনন। বাঙালির মননেও আধ্যাত্মিক বুদ্ধি, সংখ্যা, যোগতন্ত্রের প্রভাব বার বার প্রবল রয়েছে। এখনও দেখেছি চট্টগ্রামের বায়েজীদ বোস্তামীর দরগায় হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে গাছে সুতো বেঁধে মানত করছে। এখনও বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান পঞ্জিকা ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে। আমাদের চলমান সমাজে সভ্যতার বিকাশে আধুনিকতার কারণে-এর প্রভাব দিনে দিনে কমতে থাকলেও একেবারে থেমে যাবার সম্ভাবনা নেই । এটিই প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি চলে আসা বাঙালিদের স্বকীয় সত্তা। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই পূর্ববাংলায় চলতে থাকে ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণ । প্রতিবাদী বাঙালি নিশ্চুপ থাকে নি । ফলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মাধ্যমে (১৯৪৭-’৫২) ভাষার জন্য আত্মত্যাগের নজির স্থাপনের দ্বারা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্মলাভ করে তা কালক্রমে, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন, ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬-দফাভিত্তিক তীব্র আন্দোলন, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন ও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ।
রাজনৈতিক পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত- 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্তিশালী করেছে কেন্দ্রীয় শোষণ।' অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এ বাংলা ভূ-খণ্ডের উপর শাসন ও শোষণের মাত্রা যখনই বৃদ্ধি পেয়েছে; ঠিক তখনই বাঙালি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বকীয় সত্তার প্রমাণ রেখেছে।
একনজরে বর্তমান বাংলাদেশ পরিচিতি
Introduction to the Present Bangladesh in a Birds Eye View
সরকারি নাম (Government Name ) : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। (বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে)।
রাজধানী (Capital) : ঢাকা ।
সরকার ব্যবস্থা (Government system) : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা; রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
আয়তন ও সীমা (Area and boundaries) : আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার। পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়; পূর্বে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম এবং সেই সাথে মায়ানমার; এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর । আন্তর্জাতিক স্থলসীমার দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৪০০ কি.মি. এর মধ্যে ৯২ শতাংশ ভারতের সথে এবং বাকি ৮ শতাংশ মায়ানমারের সাথে। উপকূলীয় সীমারেখার দৈর্ঘ্য ৪৮৩ কিলোমিটারের অধিক। ভূখণ্ডগত সমুদ্রসীমা ১২ নটিক্যাল মাইল (২২.২২ কি.মি) এবং অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল (২৭০.৪০ কি. মি.) পর্যন্ত বিস্তৃত ।
প্রশাসনিক একক (Administrative Unit) : বিভাগ ৮ : ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ; জেলা ৬৪টি; উপজেলা ৪৮৯; থানা ৬৩৭; পৌরসভা ৩২০; ইউনিয়ন ৪৫৫০; মৌজা ৫৯,৯৯০; গ্রাম ৮৭,৩১৬; সিটি কর্পোরেশন ১১ : ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ ।
নদীনালা (Rivers) : প্রধান নদীগুলোর শাখা ও উপনদীসহ মোট প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। এ নদীগুলো আবার তিনটি বৃহৎ নদীপ্রণালির অন্তর্ভুক্ত : গঙ্গা-পদ্মা নদীপ্রণালি, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালী ও সুরমা মেঘনা নদীপ্রণালি। গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা, কর্ণফুলি, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তিস্তা, আত্রাই, গড়াই, মধুমতি, কপোতাক্ষ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নদী।
জলবায়ু (Climate) : বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি ধরনের। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা শীতকালে যথাক্রমে ২৯° সে. ও ১১°সে, এবং গ্রীষ্মকালে যথাক্রমে ৩৮°সে. ও ২১°সে.। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১,১৯৪ থেকে ৩,৪৫৪ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০ থেকে ১০০% (আগস্ট-সেপ্টেম্বর)-এর সর্বনিম্ন আর্দ্রতা ৩৬% (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ)।
পর্যটন কেন্দ্র (Tourist Centre) : কক্সবাজার, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী), সুন্দরবন (খুলনা)। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উভয় দৃশ্যই অবলোকন করা যায়।
সমুদ্রবন্দর (Sea Port) : চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্রবন্দর।
বিমান বন্দর (Airport) : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, ঢাকা; আমানত শাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রাম; ওসমানী বিমান বন্দর, সিলেট; কক্সবাজার বিমান বন্দর; বরিশাল বিমান বন্দর; রাজশাহী বিমান বন্দর ইত্যাদি।
জাতীয় দিবস (National day) : ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস' এ দিনটি এখন 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এটি পালিত হয়; ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস; ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস; পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ ।
জাতীয় বিষয় (National theme) : জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় গাছ আম গাছ, জাতীয় মাছ ইলিশ, জাতীয় প্রাণী বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। এর একটা বর্ণনা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল ১৯৭২-'৭৫; খন্দকার মোশতাক আহমদের শাসনামল ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫; প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামল ১৯৭৫-'৮১; বিচারপতি সাত্তারের শাসনকাল, ৩০ মে, ১৯৮১-২৪ মার্চ, ১৯৮২; জেনারেল এরশাদের শাসনামল ১৯৮২-৯০; বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল ১৯৯১-'৯৬, শেখ হাসিনার শাসনামল ১৯৯৬-২০০১, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোটের শাসনামল ২০০১-০৬, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল ২০০৬-'০৮, শেখ হাসিনার শাসনামল ২০০৯-..... বর্তমান সময় পর্যন্ত। এসব শাসনামলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়ে আজ বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]