বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা মূল্যায়ন কর। (Evaluate the Role of India in the Liberation War of Bangladesh.)

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান The Contribution of India in the Liberation War
ভূমিকা Introduction
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ভারতের, বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জনগণ। বাংলাদেশ থেকে অধিকাংশ শরণার্থী গিয়েছিলেন পূর্বভারতের বিভিন্ন অঞ্চল; যেমন- ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ,
আসাম, মেঘালয় প্রভৃতি অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের অনেক মানুষ ছিলেন, যাদের অনেকের আদিবাড়ি পূর্ববঙ্গে, আত্মীয়স্বজনও ছিল অনেকের। এ অঞ্চলের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি প্রায় একই। ফলে এ গণহত্যা নিজ আত্মীয়কে হত্যা হিসেবে তারা ধরে নিয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য দেয়ার জন্য সব রকমের সহযোগিতা তারা করেছিলেন। পার্শ্ববর্তী ভারত সরকার অতটা আবেগে আপ্লুত না হয়ে তারা তাদের নির্ধারিত পরিকল্পনা ধরে এগিয়েছে এবং জনমত সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের পক্ষে থাকায় তাদের সুবিধা হয়েছিল। সরকার এ জনমতকে পুঁজি করে নিজ পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করেছিল এবং ভারতীয় জনগণের এ আবেগ সৃষ্টি না হলে ভারত সরকারের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হতো না। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের আগে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বড় রকমের যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শেষ যুদ্ধের পর তাসখন্দ চুক্তি হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুজিবনগর সরকার গঠনের পরই মোটামুটি একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত হবেই। এপ্রিল থেকেই পূর্ব সীমান্তে মৃদু সংঘাত হচ্ছিল এবং ক্রমেই সে সংঘাতের মাত্রা বাড়ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সরকারি পর্যায়ের ভূমিকা
Role of Indian Government Level in Liberation War
ভারতীয় নীতির প্রথম পর্যায় (এপ্রিল-জুলাই) (First Step of Indian Policy): পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারে কিংবা বাংলাদেশকে সরাসরি সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে ভারতের সরকারি মহল আগ্রহী ছিল না। এ পর্যায়ে (১) ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়, (২) বাংলাদেশ সরকারকে অবাধে ভারতীয় এলাকায় রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দেয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজার হাজার অসহায়, নিরস্ত্র মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। জুন পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লক্ষ । এপ্রিলের শেষ নাগাদ বাঙালি যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া শুরু হয় ভারতের মাটিতে। মে মাসে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় 'মুজিব বাহিনী'। জুনে এদের ট্রেনিং শুরু হয় এবং নভেম্বর পর্যন্ত ট্রেনিং চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এবং শরণার্থীদের আশ্রয়ের পাশাপাশি কলকাতায় প্রবাসী সরকার গঠন ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে এ সরকারের বেতার কেন্দ্র স্থাপনে ভারত সহায়তা করে। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ভারত সফর করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহযোগিতা প্রত্যাহারের অনুরোধ করলে ইন্দিরা গান্ধী তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ভারতীয় নীতির দ্বিতীয় পর্যায় (আগস্ট-নভেম্বর) (Second Step of Indian Policy) : জুলাই মাস থেকে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি নিয়মিত ধ্বংস করার কাজে আত্মনিয়োগ করে। এ মাসে চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান সমঝোতায় পৌঁছলে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ৯ আগস্ট রুশ-ভারত
মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ভারতের নীতি ও কর্মসূচির পরিবর্তন দেখা যায়। ইন্দিরা গান্ধী সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সফর করলে মস্কো-দিল্লি চুক্তির আওতায় ভারতকে সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়। ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান ১০ দিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিলে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ভারতীয় নীতির তৃতীয় পর্যায় (৩-১৩ ডিসেম্বর) (Third Step of Indian Policy): ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তান বিমান হামলা চালালে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেয়। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত অবহিত করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা
গান্ধীর পত্র-
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
8 ডিসেম্বর তারিখে মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি যে বাণী আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তাতে আমার সহকর্মীবৃন্দ ও আমি খুবই অভিভূত হয়েছি। পত্র পাওয়ার পর আপনাদের সাফল্যজনক নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান সংক্রান্ত আপনাদের অনুরোধ ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করেছে। আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার আপনাদের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আজ সকালে আমি পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে একটা বিবৃতি দান করেছি। তার অনুলিপি এতদসঙ্গে পাঠালাম ।
বাংলাদেশের জনগণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালযাপন করছে। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আপনাদের যুব সম্প্রদায় নিঃস্বার্থভাবে আত্মাহুতির মাধ্যমে এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। ভারতের জনসাধারণও একই মূল্যবোধকে রক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি সন্দেহাতীতভাবে বলতে চাই যে, আমাদের মহান উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এ অধ্যবসায়, আত্মদান আমাদের দু' দেশের জনসাধারণের মধ্যে বন্ধুত্বকে আরো সুদৃঢ় করবে। পথ যথই দীর্ঘ হোক না কেন এবং ভবিষ্যতে আমাদের জনসাধারণের যতই ত্যাগ করতে হউক না কেন, বিজয়মালা আমরা বরণ করবই। এ উপলক্ষে আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং আপনার সহকর্মী ও বাংলাদেশের বীর জনতাকে আমার শুভাশিষ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আমি আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করছি।
আপনার বিশ্বস্ত (স্বাক্ষর) ইন্দিরা গান্ধী
ভারত স্থল, নৌ ও বিমান পথে যুদ্ধ শুরু করে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে । পাকিস্তান প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়। ভারতীয় মিত্র ও বাঙালি মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা পৌঁছে। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর অধিনায়ক লে.জে. আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লে.জে. জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বেসরকারি পর্যায়ের ভূমিকা
Role of Indian Non-Government Level in Liberation War
ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অকুণ্ঠ সহানুভূতি প্রকাশ করে। সরকারি দল কংগ্রেস ছাড়াও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সীয়), সোস্যালিস্ট পার্টি, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং জনসংঘ মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য দিয়ে সহায়তা করে সর্বস্তরের ভারতীয় জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বুদ্ধিজীবীরা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি' গঠন করে অর্থ সংগ্রহ ছাড়াও জনমত সৃষ্টিতে অবদান রাখেন।
ভারতের মকবুল ফিদা হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে রোধের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, শ্যামল দত্ত রায়, আর গণেশ পাইনের মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাসের পর মাস বাংলাদেশের ওপর ছবি এঁকে বিক্রি করেছেন এবং ছবি বিক্রির টাকা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী বাঁধন দাস ছবি আঁকা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন তার এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে। অন্নদাশঙ্কর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রণব রঞ্জন রায়, তরুণ স্যানাল, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, নির্মল চক্রবর্তী, ড. ফুলরেনু গুহ, গৌরী আইয়ুব, দিলীপ বসু, ইলা মিত্র, রমেশ মিত্র, আবদুর রহমান, ডা. গণি, গৌতম চট্টোপধ্যায়ের মতো খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। দিল্লির শিল্পী নীরেন সেনগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে আর বিমল দাশ গুপ্তের মতো শিল্পীরা দিল্লি, বোম্বে আর কলকাতায় প্রদর্শনী করে ছবি বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ তহবিলে। এভাবে শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন, গায়কেরা বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছেন, নাট্য কর্মীরা নাটক করেছেন, ঋত্বিক ঘটক, গীতা মেহতারা প্রমুখ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন। এক কথায় ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভেতর এমন ব্যক্তি খুব কমই পাওয়া যায় যারা কোনো না কোনোভাবে তখন বাংলাদেশকে সাহায্য করেন নি।
ভারতীয় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবি শঙ্কর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লসএঞ্জেলসে বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজন করে ১০ লক্ষ ডলার ভারতের শরণার্থী শিশুদের জন্য দান করেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ‘বাংলাদেশ সেবা সংঘ', 'স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম সহায়ক সমিতি' নামে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারত সরকার শরণার্থীদের খরচ সংগ্রহের জন্য 'শরণার্থী কর' ভারতীয়দের ওপর আরোপ করে বাংলাদেশের প্রতি মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ভারত সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে শরণার্থীদের পেছনে ভারতের খরচ হয় ৩৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার-এর মধ্যে ১৯৭ মিলিয়ন ডলার ভারত নিজে বহন করে। প্রশিক্ষণ, রশদ, অস্ত্র খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল দ্বিগুণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ৪,০০০ ভারতীয় অফিসার ও জোয়ানের আত্মত্যাগ এবং ভারতীয়দের সহমর্মিতা, ভালোবাসার মূল্যমান হিসেবে গণ্য হয়। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের একটি মহল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা নিছক রাজনৈতিক কারণে দেয়া হয়েছিল বলে মনে করেন। এদের যুক্তিসমূহ যথাক্রমে—
১. 'ভারত তার জন্মশত্রু পাকিস্তানকে দু'পাশে রেখে প্রথম থেকেই খুবই অস্বস্তিতে ছিল। কারণ, দুই সীমান্তে প্রতিরক্ষার জন্য ভারতকে বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছিল। যখন পাকিস্তানকে ভাঙ্গার সুযোগ পাওয়া গেছে ভারত সাথে সাথে তা লুফে নিয়েছে'।

‘ভারতের এক ধরনের বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ মনে করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্রমবর্ধমান নকশাল আন্দোলনকে দমন করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন'।
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে নিজ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্যই ইন্দিরা গান্ধী তা করেছিলেন।' ভারতের ভূমিকার কৌশলগত দিকটির মূল গ্রোথিত ছিল পাকিস্তান-বৈরী ধারণার মধ্যে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে উপমহাদেশ বিভাজন ও পাকিস্তানের জন্ম ভারতের কাছে অনভিপ্রেত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ত্বরিত ও সফল পরিসমাপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যে কৌশলগত রূপান্তর হয়েছিল তার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল ভারত। বাংলাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ-নৃশংস গণহত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন শুরু হলে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য দিল্লির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। সে সময় পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে প্রচণ্ড জনমত সৃষ্টি হয়েছিল তা উপেক্ষা করার সাধ্য দিল্লির ছিল না। তাছাড়া 'মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বা দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকলে তা বামপন্থি চেতনায় প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা ছিল।
এভাবে ভারত মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনে সহায়তা করে, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করে। সর্বোপরি, চূড়ান্ত পর্বে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখে। মোটকথা, একমাত্র দেশ ভারত যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে ।
যৌথবাহিনী গঠন ও বিজয়
Formation of Joint Command and the Victory
৯.১১.১. ভূমিকা
Introduction
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এসেছিলেন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও আয়োজিত একটি স্থানীয় জনসভায় বক্তৃতা দিতে। সেখানে এসে তিনি জানতে পারেন যে, পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করেছে। এমনি অবস্থায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী দিল্লিতে ফিরে যান এবং সরকারিভাবেই ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকাশ্য যুদ্ধের ঘোষণা দেন। এ সময় যুদ্ধকৌশল বিবেচনায় ভারত সরকার দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সম্পন্ন করার জন্য ভারত ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে গঠিত হয় যৌথ কমান্ড এবং ভারতের সেনাপতি জেনারেল মানেকশ হন যৌথ কমান্ডের প্রধান। পূর্বাঞ্চলের ভারত সরকার ঘোষিত যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা। এমনি অবস্থায় অচিরেই পাকিস্তান বুঝতে পারে যে, এ যুদ্ধে তাদের টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অপরদিকে, সরকার ও জনমতের যৌথশক্তি নিয়ে পূর্ব সীমান্তে ভারত বাংলাদেশ যৌথবাহিনী দুর্বারগতিতে অগ্রসর হয় ঢাকার দিকে। যৌথবাহিনীর তৎপরতায় মুক্তিযুদ্ধে একটির পর একটি এলাকা মুক্ত হতে থাকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে। পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে তারা ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায় এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর সূচিত হয় চূড়ান্ত বিজয়, সৃষ্টি হয় লাল-সবুজের পতাকার দেশ বাংলাদেশ।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণ
Joint Attack by Freedom Fighters and Mitra Bahini
৩ ডিসেম্বর (১৯৭১ খ্রিঃ) বিকেলে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতীয় বিমান ঘাঁটি অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর ও আগ্রার ওপর অতর্কিতে বিমান হামলা চালালে সেদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশের সাহসী বৈমানিকগণ মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য আকাশ থেকে ভূমিতে গোলাবর্ষণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সামসুল আলম এবং ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ। তারা তাদের 'অটার বিমানের সাহায্যে চট্টগ্রামস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি ডিপোতে আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণের পরে অনেক দূর থেকে তেল শোধনাগারের ডিপোর অগ্নিশিখা দেখা যাচ্ছিল। ঐ একই রাতে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম ভারতের তেলিয়ামুড়া থেকে উড়ে এসে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলস্থ জ্বালানি ডিপোতে সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। সবগুলো ডিপো প্রবলভাবে বিস্ফোরিত হয়। আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে জ্বালানি সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করা।
৪ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। অবশ্য ভারতকে একই সাথে পশ্চিম রণাঙ্গনেও পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। ভারতীয় জঙ্গি বিমান মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালায় ।
৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ পুনরায় ভারতের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানান। ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা সফল হতে পারে- যদি এ ২টি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণও চাইছিল ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করুক। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে ভুটান সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। আন্তর্জাতিক ভুবনে বাংলাদেশের অস্তিত্বের এটাই সূচনা।
৫ ডিসেম্বর পড়াইয়ের তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ প্রায় শত্রুমুক্ত এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় সব বিমান বিত হয়। সারা দিন ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো অবাদে আকাশে উড়ে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলো প্রচণ্ড আক্রমণে অকেজো করে দেয়। ভারতের বিমানবাহিনীর হিসাব মতে, ১২ ঘণ্টায় ২৩২ বারে তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে ৫০ টনের মতো বোমা ফেলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়ের উপরও ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাবোঝাই কয়েকটি লঞ্চ এবং স্টিমারত ধ্বংস হয়।
নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। বিশ্বের সব দেশ বুঝতে পারে, বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার ক্ষমতা পাকিস্তানি বাহিনীর নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানের ধার নেয়া সাবমেরিন গাজি ছিল পাকিস্তানি নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়।
৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর যে সামান্য কটি বিমান ছিল তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। চতুর্দিক থেকে মিত্র বাহিনীর অগ্রগতির খবর পৌঁছতে থাকে ঢাকায়। সেই সাথে পৌঁছায় পাকবাহিনীর বিপর্যয়ের সংবাদ। মিত্র বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন পাক ঘাঁটির যোগাযোগ নষ্ট করে দেয়া এবং পিছনে পাক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করা। নিয়াজি এবং ঢাকার অন্যান্য পাক সমরনায়করা বুঝে নিয়েছে যে, মিত্র বাহিনী শুধু বাংলাদেশের অঞ্চল বিশেষ দখল করতে চায়না তারা সমগ্র বাংলাদেশে পাক বাহিনীকে পরাজিত করতে চায়। নিয়াজি তাই তার অন্যান্য সমরনায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সকল পাক সামরিক ঘাঁটিতে হুকুম পাঠিয়ে দেন-পুল ব্যাক। পুল ব্যাক করে তার জোয়ানদের ঢাকার কাছাকাছি অর্থাৎ পদ্মা-মেঘনার অঞ্চলে ফিরে আসতে বলেন ।
৬ ডিসেম্বর সূর্য ওঠার আগে থেকেই কতকগুলো সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পাকবাহিনীর পিছু হটা শুরু হয়। অবশ্য কয়েকটি সীমান্ত ঘাঁটি থেকে নিয়াজিকে জানানো হয়, পুল ব্যাক করার চেয়ে শক্ত বাঙ্কারে ঘেরা ঘাঁটি থেকে যুদ্ধ করাই শ্রেয়। পুল ব্যাকের নির্দেশ তাই সর্বত্র পালিত হলো না। কোথাও পূর্ণ পুল ব্যাক, কোথাও আধা পুল ব্যাক হলো। আবার কোথাও যেমন ছিল তেমনই রইল।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করেন। এতে পাকিস্তান ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইতোপূর্বে ভুটান স্বীকৃতি প্রদান করলেও ভারতের স্বীকৃতি ছিল বাঙালিদের কাছে বহু প্রতীক্ষিত ।
৭ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে। পাক সেনারা ট্যাংক, কামান এবং ট্রাক-জিপ নিয়ে খুলনায় পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে সিলেট শহরটিও যৌথ বাহিনীর দখলে আসে। প্রথমে খুব ভোরে মিত্র বাহিনীর সেনারা সিলেটের নিকটবর্তী বিমান বন্দর শালুটিকরে নামে। তারপর চতুর্দিক থেকে মিত্র বাহিনী সিলেটের পাক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। দুপুর ২.৩০ মিনিটের মধ্যে সিলেটের পাক অধিনায়ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট চারদিক থেকে অবরোধ করলে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকার দিকে পালানোর কোনো পথ তাদের নেই, একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেয়ারও কোনো উপায় নেই। এ সুযোগে মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা পুরো পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
যৌথ কমান্ডের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তার আত্মসমর্পণের আহ্বান। নানা ভাষায় আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হয়। মানেকশ পাক সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুসারে সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে।
ডিসেম্বর চতুর্দিক থেকে মিত্র বাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো এবং ঢাকার পাকবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। সেদিন বিকেলে মিত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, আমরা এখন ঢাকার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন, পাকিস্তানিরা যদি মাটি কামড়ে ঢাকার লড়াই চালাতে চায় তাহলে আপনি কি করবেন? জবাবে জেনারেল অরোরা বলেন, আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যেই প্রস্তুত আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আর আমাদের পি.টি. ৬৭ ট্যাঙ্কগুলো নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে ।
১০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বিদেশিদের সরিয়ে নেয়ার জন্য বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখা হয়। ঐ দিন ভৈরব শহর মুক্ত করা হয় এবং সেখান থেকে ঢাকা শহর আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয় ।
১১ ডিসেম্বর চতুর্দিকে পাকবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। সে দিন বহু পাক ঘাঁটির পতন হয়। মুক্ত হয় জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরিয়া, পিসপাড়া, দুর্গাদিঘি, বিগ্রাম, চণ্ডীপুর প্রভৃতি অঞ্চল ৷
অবস্থার বেগতি দেখে গভর্নর ডাঃ এ.এম. মালিক ও তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ প্রাণভয়ে ভীত হয়ে সকলেই একযোগে পদত্যাগ করেন । ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে । পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাতে কোনোরূপ সামরিক সাহায্য না আসতে পারে সেদিকে ভারতীয় নৌবাহিনী যুদ্ধের প্রথম থেকেই বিশেষ নজর রাখছিল ।
১২ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত হয় । এদিকে আন্তর্জাতিক বিমানে করে ঢাকার বিদেশিরা কলকাতায় চলে যায় ।
১৩ ডিসেম্বর মুক্ত হয় টাঙ্গাইল । এদিকে ১২ ডিসেম্বরের নির্দিষ্ট সময় থেকে পুনরায় ভারতীয় বিমান ঢাকা নগরীর ওপর হামলা চালাতে থাকে এবং ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে । মিত্র বাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং ঢাকার ওপর বিমান হামলা ততই বাড়ছিল, অবস্থা বেগতিক দেখে পাক জেনারেলরা বার বার ইসলামাবাদের কাছে সাহায্য পাঠাবার আবেদন জানায় এবং তাতে কোনো লাভ হয় না।
এদিকে মার্কিন সপ্তম নৌবহর যে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে এ খবর ৪/৫ দিন আগে থেকেই জানা গিয়েছিল। গোটা পৃথিবীতে তখন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে আগমন নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে। সকলের মনে প্রশ্ন জাগে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি ইয়াহিয়ার রক্ষার্থে মার্কিন নৌবহর নামাবেন? ঠিক কী উদ্দেশ্যে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেছিল এবং কেনই বা তারা কিছু না করে ফিরে গেল তা আজও অজানা রয়ে গেছে। নিয়াজি সপ্তম নৌবহরের সাহায্য আশা করছিলেন ১৩ কিংবা ১৪ তারিখে। নিয়াজি বুঝে নিলেন যে, সপ্তম নৌবহর তাকে সাহায্য করতে আসলেও নামবে না । এমনি অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দোসর আলশামস ও আলবদর বাহিনী প্রদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বাঙালিদের ওপর চরম প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক ও অন্যান্য অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেদিন মিত্র বাহিনী যদি দ্রুত পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশ দখল না করতো, তাহলে বাংলার আরো অনেক কৃতিসন্তানকে হারাতে হতো।
১৪ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী ঢাকার মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। ঐদিন সকাল থেকেই নিয়াজি ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। শোনা যায়, নিয়াজি মার্কিন দূতাবাসের কাছ থেকে এ আশ্বাস পেয়েছিলেন যে সপ্তম নৌবহর তার লোকজনকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। তাই মার্কিন দূতাবাস ও মার্কিন সরকার যে এ সময় বাংলাদেশের যুদ্ধের ব্যাপারে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল তাতে সন্দেহ নেই। ঢাকার অন্য কয়েকটি দূতাবাস নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়েছিল। নিয়াজি এবং তার সমরনায়করাও ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় পাকিস্তানি ১৪ ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে ভারতীয় জেনারেল নাগরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও কাদের সিদ্দিকী সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করেন।
৯.১১.৩. পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়
Surrender of Pakistani Army and Fina
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিকেল ৫টা ১ মিনিটে পাক হানাদার বাহিনীর নিয়াজি ৯৩ হাজার সহযোগী সৈন্য নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ ঢাকার রেসকোর্স ও ভারতের সম্মিলিত মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেন আত্মসমর্পণ করেন।
চিত্র-২২ : মুক্তিযুদ্ধের যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস
আত্মসমর্পণের দলিলটি ছিল নিম্নরূপ : (অনূদিত) পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পূর্ব রণক্ষেত্রে ভারতীয় এবং বাংলাদে আত্মসমর্পণে সম্মতি প্রদান করেছে। এ আত্মসমর্পণে বাংলাদেশে অ সকল সদস্য, সকল আধাসামরিক এবং অসামরিক অস্ত্রধারী সৈনিক ও আছেন সেইভাবে অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন এবং তাদের নিকটস্থ জেন করবেন। এ দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্ব হবে। তার আদেশের বরখেলাপ আত্মসমর্পণ চুক্তি ভঙ্গের শামিল হ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ আত্মসমৰ্পণ চুি জেনারেল অরোরা এ মর্মে পবিত্র আশ্বাস প্রদান করেন যে, যারা অ যথাযোগ্য সম্মান ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হবে। লে. জেনা নাগরিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক না
স্বাক্ষর
জগজিৎ সিং অরোরা
লে. জেনারেল
জি ও সি এবং পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয়
বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক
16.12. ১৯৭১
আি
লে.
সাম
পাি
১৬
আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন পরাজিত সেনানায়ক নিয়াজি এবং বিজয়ী সেনানায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুফ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর নায়ক কাদের সিদ্দিকী (বাঘা সিদ্দিকী)। এ প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ উল্লেখ করেছেন যে, ‘পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সাথে সাথে সারাদেশে এবং বিশেষ করে ঢাকা শহরে উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। 'ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য কমপক্ষে ১০ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ রাজপথে নেমে আসেন। পাকবাহিনীর সুদীর্ঘ ৯ মাসের অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি লাভের আনন্দে তারা ছিলেন উদ্বেলিত। এ কারণেই বিজয়ী সশস্ত্র বাহিনীর পতি তাদের অভিনন্দন ছিল পুরোপুরিভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। এভাবে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয় এবং বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র 'বাংলাদেশ।'
পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ
Damaging by Pakistani Army
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যখন তাদের পরাজয়ের ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখনই তারা সম্পদ ও স্থাপনা ধ্বংসের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দালালদের পরামর্শ অনুযায়ী পাকিস্তানি শাসক-শোষকের নির্দেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী মরণপণ কৌশলে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় সকল প্রকার স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ
ধ্বংস করতে থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৯ মাস। এ স্বল্প সময়ে এদেশে যে ভয়াবহ ধ্বংস লীলা সংঘটিত হয়েছে তা পৃথিবীর যেকোনো যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। যদিও ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল মাত্র ২ সপ্তাহ, কিন্তু বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে। পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসররা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে ।
নিচে এ ধ্বংসযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো :
১. কৃষি ক্ষেত্রে (Agriculture Sector) : পাকিস্তানি বাহিনী সরকারি গুদামে সংরক্ষিত সকল বীজ, সার ও কীটনাশক নদীতে ফেলে নষ্ট করেছে। গভীর ও অগভীর নলকূপ ধ্বংস করেছে। ১ লক্ষ পাকিস্তানি সৈন্য ও প্রায় ৩০,০০০ রাজাকার মিলে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে প্রায় ১ লক্ষ গবাদিপশু জবাই করে খেয়েছে। ফলে হালের গরুর সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
২. বসতবাড়ি (Residence) : মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ৪৩ লক্ষ বসতবাড়ি, ১৯,০০০ হাটবাজার, ৩,০০০
সরকারি ভবন, ৬,০০০ হাইস্কুল, ১৮,০০০ প্রাইমারি স্কুল ও মাদ্রাসা এবং ৯০০ কলেজ ভবন পুড়িয়ে দেয়।
যোগাযোগ ক্ষেত্রে (Communication Sector) : সে সময় সারা দেশে ২৭৪টি ছোটবড় সেতু ধ্বংস করা হয়। হাইওয়ের অসংখ্য স্থান কেটে ফেলা হয়। অনেকটি রেলসেতু ধ্বংস করা হয়। প্রায় ৪৫ মাইল রেল লাইন উপড়ে * ফেলা হয়। ১৫০টি বগী ও অনেক রেল ইঞ্জিন ধ্বংস করা হয়। রেল কারখানার ক্ষতিসাধন করা হয়। সরকারি ৬৫টি বাস ও ৯০টি ট্রাক ধ্বংস করা হয়। সারা দেশে প্রায় ৩,০০০ মালবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হয়। শতকরা ৮৫ ভাগ জলযান ধ্বংস করা হয়। বিমান বন্দর রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় ।
8. শিল্প প্রতিষ্ঠান (Industrial Institution) : দেশের ২৩৭টি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ১৯৫টি অকেজো করা হয়। শিল্প
প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল ও স্পেয়ারপার্টস লুট করা হয়।
৫. বিদ্যুৎ ব্যবস্থা (Electricity System) : সারাদেশে ১১,০০০ বিদ্যুৎ পোল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কাপ্তাই বিদ্যুৎ-এর
সিদ্ধিরগঞ্জ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

টেলিফোন ব্যবস্থা (Telephone System) : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের টেলিফোন ব্যবস্থাও বিধ্বস্ত হয়। আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকবাহিনী টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলো ধ্বংস করে দেয় ।
१. भूদ্র (Currency) : পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বে যেখানেই সুযোগ পেয়েছে ব্যাংকে গচ্ছিত ১০ টাকা, ৫০ টাকা ও ১০০ টাকার নোট পুড়িয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল নবীন বাংলাদেশ সরকারকে অচল করে দেয়া। তাছাড়া ব্যাংকে গচ্ছিত সোনা পাকবাহিনী লুট করে, যার কিছু ১৬ ডিসেম্বরের পর তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়।
৮. চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর ধ্বংস (Destruction of Chittagong and Chaina Port ) : এ ২ টি বন্দরে মাইন পাতা
হয়। দেশের সবগুলো নদী বন্দর বিধ্বস্ত হয়।
এভাবে দেখা যায় যে, ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার যখন ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে সে সময় তারা হাতে পায় এক যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। তখনকার বাংলাদেশের বর্ণনা দিয়েছেন মঈদুল হাসান যা নিম্নরূপ:
প্রায় ৯ মাস দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সারা দেশের প্রশাসন, অর্থনৈতিক অবকাঠামো, কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তখন বিপর্যস্ত অবস্থা বিরাজমান। দেশের অফিস-আদালত ছিল জনমানবশূন্য, ডাক বিভাগ সম্পূর্ণ বন্ধ, তার বিভাগ প্রায় অচল, অসংখ্য সেতু বিধ্বস্ত হওয়ায় রেল ও সড়ক পথে যোগাযোগ প্রতিপদে বিঘ্নিত। সচল সামরিক বাস ও ট্রাক, যান্ত্রিক জলযান প্রায়শই জলমগ্ন অথবা বিধ্বস্ত, ব্যাংক বন্ধ, কলকারখানা সব বন্ধ, বন্দর অচল ও বহির্বাণিজ্য নিশ্চল, মোট প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ৩ কোটি লোকের পুনর্বাসনে (দায়িত্ব) খাদ্যশস্যের ঘাটতি ৪০ লক্ষ টন স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের দিগন্ত ছিল এমনই ঘোর মেঘাচ্ছন্ন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]