দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন- করুণ, শোকাবহ, লোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমায়
ভাষর।
3. সামাজিক কারণ : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য প্রকট রূপলাভ করেছিল। সরকারের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিকল্পনাগত বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সমাজজীবন ছিল দুই ধরনের। ফলে একই দেশের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের জনগণের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ আহার-বিহার প্রভৃতি জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিজস্ব আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ফলে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসংহত করার জন্য কোনো একক সামাজিক আদর্শ পাকিস্তানে গড়ে উঠতে পারেনি। এটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
২. রাজনৈতিক কারণ : ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক কারণ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বিস্তার রাজনৈতিক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন। এছাড়া ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুটিত হয়নি। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণআন্দোলন এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জনগণ বিষিয়ে উঠে এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
৩ . অর্থনৈতিক কারণ : পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ছিল সবক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। ফলে রাষ্ট্রীয় সকল পরিকল্পনা প্রণীত হতো কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরে। আর এ বিভাগে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি না থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী মহল কৌশলে পূর্ব বাংলাকে ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে । ১৯৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ছিল ৪৬% সেখানে ১৯৬৫-৭০ খ্রিষ্টাব্দে এসে দাঁড়ায় ৬০%। সম্পদ পাচার ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। এসব কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৪. সাংস্কৃতিক কারণ : দুই অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। পূর্ব বাংলার অধিবাসিগণ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট লোকসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ শতাংশ এবং এদের ভাষা বাংলা এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরনো। অপরদিকে, পাকিস্তানের বাকি ৪৪ শতাংশ লোকের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল বিভিন্ন ধরনের এবং এদের মাত্র ৭.২০ শতাংশ লোকের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি পর ক্ষমতাসীন সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে মাত্র ৭.২০ শতাংশের উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ... করার এবং বাঙালির উপর তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সাথে সাথে হাজার বছরের পুরনো বাঙালি জাতির ...... সংস্কৃতি মুছে ফেলার মাধ্যমে বাঙালিদের পাকিস্তানিকরণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যা ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
অভ্যুদয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ।
৫. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মতো প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে বাঙালিরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত সিভিল সার্ভিস ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালির প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকরা তাদের নিজেদের স্বার্থে গড়ে তোলেন ক্ষমতা ব্যবহার ও ভোগকারী একটি এলিট শ্রেণি। যার সিংহভাগই ছিলেন পাঞ্জাবি (তারা ছিলেন মোট জনগোষ্ঠীর ২৯.০২%)। মন্ত্রীদের পরই ক্ষমতাধর ছিলেন এ এলিট শ্রেণিটি। ১৯৬৫-৭০ সাল পর্যন্ত একটি হিসেবে থেকে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদ, পররাষ্ট্র, কৃষি, সংস্থাপন, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, শিল্প, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, তথ্য ও পরিকল্পনা
৬
মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট ৬৯ জন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তার মধ্যে ৪৫ জন্যই ছিলেন পাঞ্জাবি। বাঙালি ছিলেন মাত্র তিন জন। বেসামরিক উচ্চপদস্থ সিএসজি কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৯৪৮-৬৩ পর্যন্ত ৩৪৬ জনের মধ্যে মাত্র ১২৬ জন অর্থাৎ ৩৬.৪% ছিলেন বাঙালি। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানি ছিলেন ২১৮ জন অর্থাৎ ৬৩.৬% । ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মোট ১৯ জন সচিবের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের একজনও ছিল না। ৪১ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে ৩ জন এবং ১৩৩ জন উপসচিবের মধ্যে ১০ জন ছিল বাঙালি। মনস্তাত্ত্বিক কারণ : বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পিছনে অন্যতম একটি কারণ হলো মনস্তাত্ত্বিক কারণ। কারণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে মনের দিক থেকে কোনোদিনই মিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমগণ নিজেদের খাঁটি মুসলিম হিসেবে মনে করত এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের ভারতপন্থি তথা হিন্দু বলে কটাক্ষ করত। এতে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান বিদ্বেষী মনোভাব জোরালো হয়। যা ছিল বাংলাদেশ আবির্ভাবের অন্যতম কারণ ।
৭. শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য : শিক্ষাক্ষেত্রেও বাঙালিরা সুস্পষ্ট বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। পশ্চিমা শাসকচক্র বাঙালিদের অশিক্ষিত রেখে তাদের শাসনকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার মাধ্যমে শাসক ও শোষকশ্রেণি গড়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য। পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষুব্ধ হয় এবং এসব বৈষম্য প্রতিরোধ করার অভিপ্রায় থেকে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
৮. ভৌগোলিক কারণ : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব ছিল ১২০০ মাইলের বেশি। অবস্থানগত এমন দূরত্বের কারণে দুটি দেশকে অখণ্ড রাখা খুবই অসম্ভব ছিল। যার ফলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন : ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অন্যতম কারণ। বস্তুত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত গঠিত হয়। শেষপর্যন্ত বাঙালিরা ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ।
১০. '৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন : ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সমস্ত পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং এ যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত