বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া আলোচনা কর। (Discuss the Constitutional Making Process of Bangladesh.)

সংবিধান প্রণয়ন Making of the Constitution ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে মৌলিক আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এ সনদ ছিল আইনের মূল সূতিকাগার এবং সরকারের সকল কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উৎস। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর দেশের সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিল দেশের সংবিধান। এ সনদে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির বিধান করা হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের শাসনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। উক্ত ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পরের দিন ১১ জানুয়ারি (১৯৭২) ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' জারি করেন। অস্থায়ী সংবিধান আদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এটি ছিল জনগণকে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ ছিল দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কারণেই ২১, ৬ ও ১১-দফায় এবং ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় পদ্ধতির দাবি করেছে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া Preparation Process of the Constitution of Bangladesh
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গঠিত হয় রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য থাকে একটি শাসকগোষ্ঠী তথা সরকার। প্রচলিত অর্থে একটি দেশে সরকার বলতে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকেই বোঝানো হয়ে থাকে। সরকারের এ বিভাগসমূহের ক্ষমতা বণ্টনের নিয়ম, কার্যপরিচালনা পদ্ধতি, রাষ্ট্রের সাথে সেই রাষ্ট্রের নাগরিকের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে কতিপয় নিয়মকানুন থাকে। আর এসব নিয়মকানুনগুলোই সংবিধান ।
স্বাধীন বাংলাদেশের 'অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' বলেই ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান এ.এস.এম. সায়েমকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও কামরুজ্জামানসহ মোট ১২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি । সেই সভায় কয়েকটি মৌলিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । যেমন— ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস থেকে প্রচলিত বাংলাদেশের পতাকার নকশা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্র তুলে সবুজের মাঝখানে শুধু লাল গোলক রেখে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অনুমোদন করা হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' কবিতার প্রথম ১০ লাইন নির্ধারণ করা হয়।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল' গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদ আদেশ (Assembly Order)
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ ‘গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান তৈরির প্রথম পদক্ষেপ। সরকারি ঘোষণায় বলা হয় যে, এ আদেশ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। ১৯৭০-৭১ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ জন; সর্বমোট ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে 'গণপরিষদ' গঠিত হয়। উল্লেখ্য ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়েছিলেন ৪৬ জন এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন ২ জন (নূরুল আমিন ও রাজা ত্রিদিব রায়) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি নিয়েছিলেন ১ জন। ফলে অবশিষ্ট ৪০৩ জন সদস্য নিয়েই 'গণপরিষদ' গঠন করা হয়। এদের মধ্যে ৪০০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের, ১ জন ন্যাপের (মোজাফ্ফর) এবং অপর ২ জন নির্দলীয় ছিলেন।
যে, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন বাংলাদেশের সংবিধান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে যাতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার মতো মৌলিক নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সংবিধানের কাঠামো সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন যে, 'সংবিধানে দেশের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকবে। এতে আপামর জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে এবং সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।'
বঙ্গবন্ধুর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন
First Meeting of Bangabandhu Assembly
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মাত্র ১১৬ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। গণপরিষদ নেতা ও আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদের অধিবেশনে ঘোষণা দেন যে, ‘গণপরিষদ সর্বাধিক কম সময়ে একটি সংবিধান রচনা করবে, যার জন্য দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ গৌরব বোধ করবেন।' অধিবেশনের প্রথম দিনেই গণপরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক শাহ আবদুল হামিদ স্পিকার হিসেবে এবং মোহাম্মদ উল্লাহ ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হন । অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে আইন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট 'খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি' গঠন করা হয়। এ কমিটির ৩৩ জন সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় গণপরিষদ সদস্য এবং ১ জন সদস্য ছিলেন ন্যাপ (মোজাফ্ফর) নেতা শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এছাড়া একজন মহিলা (রাজিয়া বানু) গণপরিষদ সদস্যকেও এ ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি'তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
খসড়া সংবিধান কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১৭ এপ্রিল ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে। কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন উপস্থিত সদস্যদের নিকট খসড়া সংবিধান সংক্রান্ত নথি পেশ করে-এর ওপর প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেন। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮ মে-র মধ্যে খসড়া সংবিধান সম্বন্ধে জনমত আহ্বান করা হয়। কমিটি বিভিন্ন স্তরের জনগণ ও সংগঠনের কাছ থেকে ৯৮টি প্রস্তাব ও সুপারিশ পায় ।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন কমিটি প্রাথমিক খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করে। এটি প্রণয়ন করতে তাদের ৪৭টি বৈঠকে মোট ৩০০ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। এরপর কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশ সফর করে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং সংবিধান রচয়িতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। ড. কামাল দেশে ফিরে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মিলিত হয়ে খসড়া সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। ১১ অক্টোবর (১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ) কমিটির সর্বশেষ আলাপ আলোচনার পর ৪ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ খসড়া সংবিধান চূড়ান্তরূপে গৃহীত হয় ।
বঙ্গবন্ধুর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন
Second Meeting of Bangabandhu Assembly
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। ১৮ অক্টোবর সংবিধান কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ৯১ পৃষ্ঠার খসড়া সংবিধানটি বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবিধানিক বিলটির ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন যে, ‘এ সংবিধান শহিদের রক্তে লিখিত।' তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এ
সংবিধান দেশের আপামর জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক রূপে বিবেচিত হবে বলে আশ্বাস দেন এবং সংবিধানে যে কোনো ধরনের সংশোধনী প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হবে। ড. কামাল হোসেন বিলটি উত্থাপনকালে বলেন, 'এই সংবিধান গণতান্ত্রিক উপায়ে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে- এমন এক সমাজব্যবস্থা যাতে আইনের শাসন, মৌল মানবিক অধিকার এবং স্বাধীনতা, সাম্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার সকল নাগরিকের জন্য অর্জিত হবে।' ১৫৩টি অনুচ্ছেদ সংবলিত খসড়া সংবিধান বিল নিয়ে তিন সপ্তাহব্যাপী আলাপ আলোচনা চলে। অবশেষে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর বেলা ১টা ৩০ মি. ৪০ সেকেন্ডের সময় বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যে গণপরিষদ কর্তৃক তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'একটি জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাসে এ প্রথমবারের মতো তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সংবিধান প্রণয়ন করা হলো।' বঙ্গবন্ধু আরোও ঘোষণা করেন যে, এ বিধিবদ্ধ সংবিধানের অধীনে বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে।'
এরপর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে গৃহীত সংবিধানে স্বাক্ষর করার জন্য গণপরিষদ সদস্যগণ পুনরায় মিলিত হন। ঐ দিন স্পিকার মোহাম্মদউল্লাহ সংবিধানের মূল বাংলা ও-এর ইংরেজি লিপিতে স্বাক্ষর করেন। অতঃপর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, মন্ত্রিবর্গ ও অন্যান্য গণপরিষদ সদস্য সংবিধানে স্বাক্ষর দান করেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধানে স্বাক্ষর দান করা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ ও কার্যকর হয়।
খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা
Discussion on the Draft Constitution
আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান বিলটি গণপরিষদে পেশ করেন। ১৮ অক্টোবর বিলটি উত্থাপিত হবার পর থেকেই শুরু হয়-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা। খসড়া সংবিধানটি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় এবং জনগণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ সম্পর্কে অবহিত হয়। অবশ্য পূর্বেই ৯ ও ১০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায়ও খসড়া সংবিধানের কপি বিলি করা হয়েছিল। এ খসড়া সংবিধানের ওপর যেসব দল, গোষ্ঠী, ছাত্র সংগঠন তাদের বক্তব্য রাখেন ও সমালোচনা পেশ করেন সেগুলোকে আলোচনার সুবিধার্থে নিম্নোক্ত চারটি গ্রুপে বিভক্ত করা চলে; যেমন-
গ্রুপ-১ : ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী), বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র ইউনিয়ন ।
গ্রুপ-২ : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (রব গ্রুপ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল।
গ্রুপ-৩ : ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন । গ্রুপ-৪ : আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (সিদ্দিকী গ্রুপ)।
উৎস : Abul Fazal Huq, "Constituiton Making in Bangladesh, " Published in Emajuddin Ahmad (ed), Bangladesh Politics, Centre for Social Studies (CSS), Dhaka University (Arts Building), September, 1980.
গ্রুপ-১ : প্রথম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত দল ও সংগঠনগুলো মূলত মার্কসবাদী বামপন্থী বলে পরিগণিত। তারা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। এদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যাপারে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে তবে সবগুলো দলই বৈপ্লবিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। তারা খসড়া সংবিধানকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) পক্ষ থেকে মওলানা ভাসানী খসড়া সংবিধানের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং বলেন, তদানীন্তন পাকিস্তানের আইনগত কাঠামো আদেশের অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য সদস্যগণ নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সাথে উক্ত নির্বাচনও বাতিল হয়ে গেছে এবং সে সাথে গণপরিষদও তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কোনো অধিকার এ গণপরিষদের
নেই বললেই চলে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করে মওলানা ভাসানী বলেন যে, দেশের সংবিধান সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা উচিত। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) খসড়া সংবিধানের ওপর সর্বদলীয় সভার দাবি করে শ্রী অমল সেন, পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন যে, খসড়া সংবিধানে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কোনো বিধান নেই। তিনি সংবিধান রচনার পদ্ধতিকে অগণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করেন। এ দলের পক্ষে থেকে আরও বলা হয় যে, খসড়া সংবিধান সমাজতান্ত্রিক নয়।
বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র ইউনিয়ন-এ দুটো ছাত্র সংগঠনই ছিল ভাসানী ন্যাপের ছাত্র অঙ্গসংগঠন। তারা উভয়েই দেশের সবগুলো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের প্রতি সংবিধান বিরোধী এক গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। গ্রুপ-২ : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (রব গ্রুপ)-এর মতে, খসড়া সংবিধান হচ্ছে 'মূল্যহীন' (Worthless) তবে এ গ্রুপ মনে করে 'A bad constitution is too better than no constitution.' অর্থাৎ 'সংবিধান একেবারে না থাকার চেয়ে মন্দ সংবিধান থাকাও শ্রেয়।' বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আ.স.ম. আবদুর রব বলেন যে, খসড়া সংবিধানে জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় নি। মৌলিক অধিকারের ওপর অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে গণতন্ত্রকে 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে' (Controlled Democracy') পরিণত করেছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও খসড়া সংবিধান সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য পেশ করে। তাদের ভাষ্যমতে, খসড়া সংবিধানে ‘শ্রেণিদ্বন্দ্বের' ('Class-conflict') কোনো উল্লেখ নেই এবং তাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ দূরীকরণের কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। কাজেই এ সংবিধানের মাধ্যমে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় ।
শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলও খসড়া সংবিধানের সমালোচনা করে। দলের আহ্বায়ক খান সাইফুর রহমান, অভিমত প্রকাশ করেন যে, খসড়া সংবিধানে যে ধরনের সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তাকে ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতন্ত্র' (Socialism of Abandoned Property) বলে অভিহিত করা চলে। তিনি আরও বলেন, ‘খসড়া সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের কোনো কথাও বলা হয় নি'। দলের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ‘খসড়া সংবিধান গৃহীত হলে উঠতি পুঁজিপতি ও বুর্জোয়াদের শাসনই সুদৃঢ় হবে এবং সমাজতন্ত্রের নামে শ্রেণিশোষণ অবাধে চলতে থাকবে ।
গ্রুপ-৩ : খসড়া সংবিধানের প্রতি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) যথেষ্ট নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেন যেহেতু তাতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মৌলিক অধিকারের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। দলের সহ- সভাপতি পীর হাবিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য ১৫ অক্টোবর (১৯৭২) এক যুক্ত বিবৃতিতে চাকরির ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা, খাদ্য, গৃহ ও চিকিৎসার সুবন্দোবস্তের দাবি করেন। তারা আরোও বলেন যে, ‘ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক যাতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ উন্মুক্ত হয়'। তাঁরা অভিযোগ করেন যে, ‘আওয়ামী লীগ সরকার খসড়া সংবিধান প্রণয়নকালে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সাথে কোনো রকম আলাপ- আলোচনা, পরামর্শ কিংবা জনমত যাচাই করে নিত ।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মনি সিং) খসড়া সংবিধানকে মোটামুটিভাবে গ্রহণ করেন। তবে এ দল সংবিধানে কতিপয় সংশোধনী আনয়নের প্রস্তাব করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক এক প্রচারপত্র বিলির মাধ্যমে সর্বমোট ১১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে যে, খসড়া সংবিধানটি গ্রহণযোগ্য এবং তা একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দলিল। তবে যেহেতু তা সমাজতান্ত্রিক সংবিধান ছিল না কাজেই যতদিন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন খসড়া সংবিধানটিকে অন্তবর্তীকালীন সংবিধান (Interim Constitution) বলে আখ্যায়িত করা উচিত।
গ্রুপ-৪ : আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উভয়েই খসড়া সংবিধানকে একটি উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক দলিল বলে অভিহিত করে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মতে, 'খসড়া সংবিধান বিলটি অতিশয় ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ'। তারা বলেন যে, 'সংবিধান বিলটি রচনা করা হয়েছে চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এবং তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে'। তাঁদের মতে, 'খসড়া সংবিধানটি দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে'। গণপরিষদের সংবিধান রচনার অধিকার আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বন, আর গ সরকার দেশের ধान চার অধিকার রাখে। কে ১৯৭০ মের মাধ্যমে জনগণ প্রদান করেছে। শুধু ত আওয়ামী লীগই প্রবাসী ीামকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।' বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (সিদ্দিকী গ্রুপ) আওয়ামী লীগের ছাত্র অংশ नরী কমিটির এক সভায় খসড়া
সংবিধান প্রণয়ন করাকে গণপরিষদের উত্থাপন করাকে অভিনন্দন জানায় । সড়া সংবিধানকে
জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক বলে বর্ণনা করেন। তাঁদের মতে, 'সংবিধানটি ছিল 'কৃষক শ্রমিক রাজ' প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রে একটি সুদৃঢ় পদক্ষেপ। এবং তা দেখে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে বলে তারা দৃঢ় প্রত্যয় বার করেন। তে তারা অভিমত প্রকাশ করেন যে, খসড়া সংবিধান করি ছোটখাটো সংশোধনী আনয়ন করা প্রয়োজন ।
এভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী খসড়া সংनিদানের ওপর তাঁদের পরনা ও অভিমত প্রকাশ করে'। প্রকৃতপে কোনো দলই-এর পক্ষে বা বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুকঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। পড়া সংবিধানের সমালোচনা কেবলমাত্র সংবাদপত্রের মাঝেই সীমানা ছিল। কোনো কোনো দল তাদের দলীয় নির্বাহী কমিটিতে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা ও প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। সর্বোপরি সমগ্র দেশে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল যেন সংবিধানটি জনগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের (Badruddin Umar) একটি বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, "The opposition parties have failed to mobilize public opinion against the constitution, apparently feeling that they had completed their responsibility by issuing statements and holding press conferences.' (Quoted in the Bangladesh Observer, November 2, 1971.)
বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংবিধান লাভ করেছে। সংবিধান পাতের চারটি প্রধান পদ্ধতি আছে; যথা: মঞ্জুরি, সুপরিকল্পিত রচনা, ক্রমবিবর্তন ও বিপ্লব। কোনো কোনো দেশে স্বৈরাচারী রাজা রাষ্ট্র জীবনের বিশেষ পর্যায়ে বা যুগসন্ধিক্ষণে জনমতের চাপে বা অন্য কোনো কারণে নিজের ক্ষমতা পরিচালনার নিয়মপদ্ধতি নির্ধারণ ও জারি করেছেন এবং এভাবে সেই সকল দেশে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন : জাপানের ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের মেজি সংবিধান। আবার কোনো কোনো দেশ স্বাধীনতা লাভের পর গণপরিষদের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। যেমন : ভারতের সংবিধান। কোনো কোনো দেশের সংবিধান আচার, প্রথা ও অভ্যাসকে ভিত্তি করে ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছে। যেমন : ব্রিটিশ সংবিধান। আবার কোনো কোনো দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে পুরাতন শাসক ও শাসন পদ্ধতিকে উৎখাত করা হয়েছে এবং বিপ্লবের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য নতুন শাসকগণ নতুন সংবিধান প্রদান করেছেন। যেমন : সোভিয়েত রাশিয়া ও গণচিনের প্রথম সংবিধান।
উল্লিখিত চারটি পদ্ধতির কোনোটিই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশে সংবিধান প্রতিষ্ঠা পদ্ধতির একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার উদ্দেশ্যে একটি গণপরিষদ নির্বাচিত হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার এ গণপরিষদকে সংবিধান রচনা করার সুযোগ দিতে অস্বীকার করে। বাঙালি জনগণের স্বার্থ ও নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই বাংলাদেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ জনপ্রতিনিধিগণ বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। সুতরাং বিপ্লবের সফল পরিসমাপ্তির পর সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশকে কোনো বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি। স্বাধীনতা লাভের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একটি গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। অতএব, এ পদ্ধতিকে বিপ্লব ও সুপরিকল্পিত রচনার সংমিশ্রণ বলা যেতে পারে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]