১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
Nature and Characteristics of the Constitution of 1972
অধ্যাপক রওনক জাহান (Professor, Rounaq Jahan) লিখেছেন, "The Constitution of Bangladesh is an interesting document since it is an attempt to facilitate political development in Bangladesh according to the Indian model. The constitution incorporates a number of provisions with an eye
to ensure the stability of the system.' অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধান হচ্ছে একটি কৌতূহলোদ্দীপক দলিল, কারণ এতে ভারতীয় মডেল অনুসারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার একটি প্রচেষ্টা। এ পদ্ধতিতে স্থায়িত্বের জন্য সংবিধানে কতিপয় শর্তের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতীয় মডেল অনুসরণ করে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশ সংবিধানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও গণপরিষদ সদস্যবৃন্দ চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সংসদীয় (Parliamentary Democracy), সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি (Socialist Economy), একটি একক কর্তৃত্ব সম্পন্ন (Single Dominant Party) এবং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ (Secular Ideology)। অনেকটা একই ধারা অনুসরণ করে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মৌলনীতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে - গণতন্ত্র (Democracy), সা (Socialism), ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) এবং জাতীয়তাবাদ ( Nationalism) |
প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য (Nature and Characteristics)
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশ সংবিধান স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই রচিত হয়নি,-এর আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলোর অন্যতম। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ যথাক্রমে নিম্নরূপ :
১. লিখিত দলিল (Written Document) : এটি একটি লিখিত এবং অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত দলিল। সর্বমোট ৮৩
পৃষ্ঠার সংবিধানে ১১টি ভাগ, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১টি প্রস্তাবনা ও ৪টি তফসিল রয়েছে।
প্রস্তাবনা : ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের প্রস্তাবনা ছিল নিম্নরূপ :
'আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুি জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহিদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল— জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এ সংবিধানের মূলনীতি হইবে।
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এ সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।'
প্রস্তাবনার প্রধান দিক (Main Point of the Proposal) : সংক্ষেপে, এ সংবিধানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধে জনগণের বীরত্বপূর্ণ লড়াই, সংবিধানের মূলনীতি বা আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় চরিত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যস্থির, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ অঙ্গীকার এবং সংবিধানের প্রাধান্য ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বসহ উল্লিখিত হয় ।
বিষয়
প্রজাতন্ত্র
ভাগ
১ম
২য়
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
৩য়
মৌলিক অধিকার
৪র্থ
৫ম
৬ষ্ঠ
নির্বাহী বিভাগ
আইনসভা
বিচার বিভাগ
অনুচ্ছেদ
২৬ – ৪৭
৪৮ - ৬৪
৬৫ – ৯৩
৯৪ – ৯৭
ভাগ
বিষয়
৭ম
নির্বাচন
৮ম
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক
৯ম
বাংলাদেশ কর্মকমিশন
৯ম (ক) ১০ম
জরুরি বিধানাবলি
সংবিধান সংশোধন বিবিধ
১১ ম
অনুচ্ছেদ
৯৮ - ১২৬
129 - ১৩২
১৩৩ – ১৪১
১৪১ক - ১৪১গ
১৪২
১৪৩ - ১৫৩
সূত্র : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (সর্বশেষ সংশোধনীসহ, তোফাজ্জল হোসেন তপু, প্রথম প্রকাশন, ২০১২, পৃঃ ৪ - ১১। ২. দুষ্পরিবর্তনীয় (Rigid) : সাধারণ আইন তৈরির পদ্ধতিতে একে সংশোধন করা যাবে না। সংশোধন করতে হলে সংসদের দু-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পেশ করলে তিনি ৭ দিনের মধ্যে সম্মতি দিবেন নতুবা ৭ দিন শেষ হলে সংশোধনীটি আইনে পরিণত হবে। এদিক থেকে সংবিধানটি কিছুটা দুষ্পরিবর্তনীয় ।
৩. এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র (Unique State) : সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মতো কোনো অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশের ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে । দেশের ক্ষুদ্র আয়তন এবং সামাজিক ঐক্যের ফলশ্রুতি হলো এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ।
৪. সংসদীয় গণতন্ত্র (Parliamentary Democracy) : সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়। এটি মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা নামেও পরিচিত। এতে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভা হচ্ছে প্রকৃত শাসক । রাষ্ট্রপতি থাকেন নামসর্বস্ব। এ ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মন্ত্রিসভার সদস্যগণ যৌথভাবে আইনসভা বা পার্লামেন্টের নিকট দায়ী থাকেন।
৫. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Unicameral Legislature) : বাংলাদেশে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিধান করা হয়। এর নাম 'জাতীয় সংসদ'। প্রাথমিক পর্যায়ে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ৩০০ জন সদস্য এবং এ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত ১৫ জন মহিলা সদস্য সহ মোট ৩১৫ জন সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত ছিল। পরবর্তীকালে সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সংখ্যা ৫০ জনে উন্নীত হলে বর্তমানে জাতীয় সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা ৩৫০ জন। সদস্যরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন ।
গণতন্ত্র (Democracy) : ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।' (অনুচ্ছেদ-১১)।
৭. সংবিধানের প্রাধান্য (Priority of Constitution) : বাংলাদেশ সংবিধানে সংবিধান বা শাসনতন্ত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেননা, সংবিধানকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা প্রদান করা হয়। বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সংবিধান জনগণের পক্ষে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবে। আবার সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন । অন্য কোনো আইন যদি এ সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য হয় তবে যতখানি অসামঞ্জস্য হবে ততখানি বাতিল বলে গণ্য হবে। সংবিধানের মর্যাদা ও প্রাধান্য রক্ষার দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত করা হয়। কোনো আইন সংবিধানের পরিপন্থী হলে তাকে সুপ্রিমকোর্ট বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারবে। তাছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সংসদ সদস্যদের সম্মতি প্রয়োজন ।
৮. নাগরিকত্ব (Citizenship) : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৬নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক 'বাঙালি' বলে পরিচিত হবে এবং তাদের এ নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ ... ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য দেয়া হয় ।
প্রজাতন্ত্র (Republic) : বাংলাদেশ সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় বর্ণিত প্রজাতন্ত্রের প্রস্তাবনা অনুসারে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা 'গণপ্রজাতন্তী বাংলাদেশ" নামে পরিচিত। প্রজাতন্ত্রের প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, 'স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে যেসব এলাকা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল স্বাধীনত পর সেসব এলাকা নিয়েই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠিত হবে।
১০. মৌলিক অধিকার (Basic Rights ) : নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ উন্মুক্ত করার তাগিদে বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৬-৪৭ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মোট ১৮টি মৌলিক অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়। সার্বভৌম সংবিধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত এসব অধিকার হচ্ছে সাম্যের অধিকার, চলাফেরা, সভা-সমিতি, চিন্ত বিবেকের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি অত্যাবশ্যক ও স্বাভাবিক মানবিক অধিকার। এসব মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো আইন পাস করা যাবে না। যদি পাস করা হয় তবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। এসব মৌলিক অধিকারের অভিভাবক ও সংরক্ষণকারী হলো সুপ্রিমকোর্ট।
১১. নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান (Powerless President) : ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হবেন একজন
নামসর্বস্ব বা নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি সংসদ সদস্যদের ভোটে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন।
১২. জনগণের সার্বভৌমত্ব (Sovereignty of People ) : সংবিধান অনুসারে গণপ্রজাতন্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সকল
ক্ষমতার মালিক হলো জনগণ (অনুচ্ছেদ-৭)। জনগণের পক্ষে সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট
প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ, জনগণ প্রত্যক্ষভাবে ও প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা রাখে। ১৩. সর্বজনীন ভোটাধিকার (Universal Suffrage) : বাংলাদেশ সংবিধানে ১৮ বছর বয়স্ক প্রত্যেক নাগরিককে
ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে।
১৪. ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা (Secularism and Independence of Religion) : ১৯
খ্রিস্টাব্দের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার নিষিদ্ধ এবং ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলোপ করার ব্যবস্থা সংবিধানে করা হয়েছে। অনুপরি এ সংবিধানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সাহায্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে শোষণমু সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে। সংবিধানে আরও বর্ণিত আছে যে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানা (State Ownership), সমবায় মালিকানা (Co-operative Ownership) ও ব্যক্তিগত মালিকানা (Private Ownership)-এ তিন প্রকার মালিকানা থাকবে। তবে শেষোক্ত দুধরনের মালিকানা থাকবে আইন দ্বারা সীমিত। ১৫. বিচার বিভাগের প্রাধান্য (Priority of Judiciary) : সংবিধানে বিচার বিভাগের প্রাধান্য রক্ষা করার ওপর যথেষ্ট
গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের নামকরণ করা হয় 'বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট গঠিত হবে। বিচার বিভাগকে যতদূর সম্ভব স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখার ব্যবস্থা সংবিধানে গৃহীত হয়েছে। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (Independence of Judiciary) এতটুকু ক্ষুণ্ণ না হয়।
১৬. দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা (Protecting Partisan Discipline) : ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের অপর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এর দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার বিধানটি। সংবিধান জাতীয় সংসদের দলীয় শৃঙ্খলা কঠোরভাবে রক্ষা করতে প্রয়াসী হয়। কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন লাভ করে এবং তারপর নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে যদি কোনো সংসদ সদস্য উক্ত দল ত্যাগ করেন বা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন তাহলে তার জাতীয় সংসদের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য, এটা ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের একটি অভিনবত্ব (Novelty of the constitution)।
১৭. প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল (Administrative Tribunal) : সাধারণ বিচার বিভাগ ছাড়াও বাংলাদেশ সংবিধানে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বিধান রয়েছে। সংবিধানের ১১৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের কর্মের শর্তাবলি, নিয়োগ, বদলি, বরখাস্ত, পদোন্নতি, দণ্ড ও কর্মের মেয়াদ, রাষ্ট্রের উদ্যোগ ও সম্পত্তি পরিচালনা এবং
ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিষয়সমূহের ওপর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার থাকবে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের ওপর সুপ্রিমকোর্টকে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা দেয়া হয় নি। আপিলের বিধানও করা হয় নি। সুতরাং ১১৭ অনুচ্ছেদ
[ কোর্টের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
১৮. ন্যায়পাল (Ombudsman) : বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৭নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের (Ombudsman) বিধান রয়েছে।
সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয় সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করতে পারবেন এবং ন্যায়পাল যেকোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ অন্যান্য ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। ন্যায়পাল তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত করবেন।
বাংলাদেশে ন্যায়পাল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। তিনি শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। তিনি আইনসভার নিকট দায়ী এবং কেবলমাত্র আইনসভার উপদেশ বা আবেদনক্রমে তাকে অপসারণ করা যাবে। তার প্রধান কর্তব্য শাসন বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ শ্রবণ করা। আইনসভার সদস্য বা যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুরূপ অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবেন। ন্যায়পাল অভিযোগ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য কোনো
মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা কর্তৃপক্ষের কার্য তদন্ত করবেন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণাদি গ্রহণ করবেন।
সরকারি যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের কাজের নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য তথা তাদের জবাবদিহিতা অধিকতর নিশ্চিতকরণকল্পে ন্যায়পালের ভূমিকা গণতান্ত্রিক সফলতায় অসীম । তবে বিধান থাকলেও আজ পর্যন্ত ন্যায়পাল পদটি কरॉक করা হয় নি।
১৯. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি (Basic Principles of Governing State) : বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে (অনুচ্ছেদ ৮-২৫) রাষ্ট্র পরিচালনার ৪টি মূলনীতি লিপিবদ্ধ রয়েছে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সকল আদর্শ এ সংবিধানের মূলনীতি হবে।
ক. জাতীয়তাবাদ ( Nationalism) : জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা। জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে বাংলাদেশ সংবিধানে (অনুচ্ছেদ-৯) বলা হয়, ভাষা ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।' অর্থাৎ আমাদের জাতীয়তাবাদ হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
খ. সমাজতন্ত্র (Socialism) : মানুষের ওপর মানুষের শোষণের অবসান এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে উৎপাদন যন্ত্র ও উপকরণ এবং বণ্টন ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ন্যস্ত করা হয়। সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ১০) বলা হয়, “মানুষের শোষণের অবসানসহ একটি ন্যায়ানুগ ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা হবে।' সংবিধানের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয় যে, উৎপাদন যন্ত্র ও উপকরণ এবং বণ্টন ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তির মালিকানা থাকবে।
গণতন্ত্র (Democracy) : গণতন্ত্র হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্মতির ভিত্তিতে পরিচালিত। গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে বাংলাদেশ সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ১১) বলা হয়, 'প্রজাতন্ত্র (বাংলাদেশ) হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা এবং মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্য এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকবে।' ঘ. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) : ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে কোনোরূপ রাজনৈতিক মর্যাদা দান না করা, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ এবং (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ বা নিপীড়ন না করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
ঙ. অন্যান্য মূলনীতি (Other Principles ) : রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতি ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার আরও যেসব নীতি সংবিধানে স্থান পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে কৃষক শ্রমিক ও জনগণের অনগ্রসর অংশের সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি; অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, এক ও অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি, নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম সমর্থন ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য ।
২০. সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্ঠা (Establishment of Supreme Court ) : সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের আওতায় প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিগণ স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। সংবিধানে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
২১. জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান (Provision of Declaring Emergency ) : ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশ সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো বিধান ছিল না। পরবর্তীকালে তা অন্তর্ভুক্ত হয় ।
২২. সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার (Commitment of Founding Socialism) : ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে 'সর্বহারাদের একনায়কত্ব' প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয়কেই মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বহু ক্ষেত্রে সংসদের প্রাধান্য স্বীকার করা হয় এবং সংসদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি জাতীয়করণ ও দখল করার অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয় ।
২৩. মানবাধিকার সমুন্নত রাখা (Dignified Human Rights ) : সংবিধানে 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' অংশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
২৪. প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির ব্যবস্থা (System of Elected Representative in all Stages of Administration) : সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে ।
২৫. অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা (Unique Education System) : বাংলাদেশ সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে,
একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১৭)।
২৬. নির্বাচন কমিশন ও কর্মকমিশন গঠন (Formulation of Election Commission and Public Survice Commission) : স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগের জন্য কর্মকমিশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
২৭. ইংরেজি পাঠের প্রাধান্য (Priority of Reading English) : বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে ইংরেজি ও বাংলা
পাঠের মধ্যে কোনো বিরোধ বা পার্থক্য দেখা দিলে বাংলা পাঠ অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
২৮. মহিলা নাগরিকদের অবস্থান ( Status of Women Citizen ) : বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয় জীবনের সর্বত্র মহিলা নাগরিকদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। সংবিধানের ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।' ২৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।' ৬৫(৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এ ধারার অধীনে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত