পুঁজিবাদ কী? What is capitalism ? পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ লিখ । Write the features of capitalism.

যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত এবং অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহের প্রবণতা বিদ্যমান তাকে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র বলে। উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানাই পুঁজিবাদের ভিত্তি। পুঁজিবাদে ভূমি, খনি, শিল্প কারখানা, কলকব্জা, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকে। এর ওপর শ্রমিকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে পুঁজিপতিদের দ্বারা শ্রমিক শ্রেণি শোষিত হয়। পুঁজিবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ Capitalism | শব্দটি গ্রিক শব্দ Caput থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Caput শব্দটি বলতে নিজস্ব মালিকানায় অর্থের পুঁজিভবনকে বুঝায়। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অর্জিত সম্পদরাজি।
আর্থার ইয়ং ১৭৯২ সালে প্রথমে Capitalism প্রত্যয়টি ব্যবহার করলেও প্রত্যয় হিসেবে পুঁজি ব্যবহৃত হয় ১৮৪৮ সালে। এসময় কার্লমার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস 'Communist Manifesto' গ্রন্থে প্রত্যয় হিসেবে Capital, Capitalist, Capitalism. এর বহুল ব্যবহার করেন। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যথা-
'Oxford Advanced Learner's Dictionary of Current English' এ পুঁজিবাদকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে একটি দেশের ব্যবসায় বাণিজ্য এবং শিল্প কারখানা কোনো পুঁজিপতির ছত্র-ছায়ায় গড়ে ওঠে ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এর প্রধান উপকরণসমূহ হলো এ প্রতিযোগিতা, মুনাফা, যোগান এবং চাহিদা।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী সিডনি ওয়েব-এর মতে, “পুঁজিবাদ হচ্ছে সমাজ উন্নয়নের একটি স্তর যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং শিল্প কারখানা ও শ্রমিকের শ্রম নিয়ন্ত্রণ করে মালিক উৎপাদিত দ্রব্যের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে থাকেন। শ্রমিকগণ উৎপাদন করে কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্যের মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়।”
সমাজবিজ্ঞানী সুমপিটার বলেন, “Capitalism is a scheme of values and attitude toward life, a civilization the civilization inequality and of the family fortune." অর্থাৎ পুঁজিবাদ হলো কতিপয় মূল্যবোধের বিন্যাস, জীবনের প্রতি একটা দৃষ্টিভঙ্গি, একটা সভ্যতা, এটি হলো অসমতা ও পারস্পরিক পারিবারিক সম্পত্তির সভ্যতা। (The march in to
socialism Vol-vi- 1950 P.A.-50)
কার্ল মার্কস (Karl Marx)-এর মতে, উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কলকারখানা বৃদ্ধির মাধ্যমেই পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে। মার্কস মনে করেন যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে কতগুলো শক্তির সমন্বয়ে। যেমন- বাণিজ্য পুঁজির আবির্ভাব। মুদ্রা খাটিয়ে মুদ্রা অর্জনে পুঁজির আগমন। কাঁচামালকে দক্ষতা সহকারে ব্যবহার করে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করার বৃহত্তর সম্ভাবনা সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমান হারে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি মুদ্রার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদি।
অধ্যাপক A. C. Pigou তাঁর Socialism vs Capitalism গ্রন্থে বলেছেন, “পুঁজিবাদ হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের যন্ত্রপাতির মালিক ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার বলে শ্রমিক দ্বারা উৎপাদন করে এবং অবাধ মুনাফা করার প্রবৃত্তি নিয়ে শ্রমিকদের দ্বারা উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
ডি.এম. হেকার তাঁর The Triumph of American Capitalism (1947-p-16 ) গ্রন্থে বলেন, "Fundamentally, capitalism is an economic order based on the profit motive. There fore, its leading characteristics are the private ownership of the means of production their operation for pecuniary gain, their control by private enter prises and wage system.” অর্থাৎ মৌলিকভাবে পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার ভিত্তি মূলে থাকবে মুনাফা প্রাপ্তির প্রবণতা। সেজন্য উক্ত ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য উৎপাদনের উপায়ের ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থ উপার্জনের জন্য এর পরিপূর্ণ প্রয়োগ, ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, লগ্নি পুঁজির ব্যবহার এবং মজুরি ব্যবস্থা।
অধ্যাপক ফিলিস ডিন বলেন, “পুঁজিবাদী ধারণাটি একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার বিশেষ পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত, যার প্রকৃতি স্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে ।
পুঁজিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে R. T. Schaofer and R. P. Larm फাদের Sociology - नলেন, "Capitalism in and Anomic system in which the means of production are largely in private hands and the main incentive for amic activity is the accumulation of profits." জিবা একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের উপায় ব্যক্তির হতে দাত থাকে আর অর্থনৈতিক কর্মের মূল উত্ত হচ্ছে ক্ষত ।
DAM. Wright বলেন, "A system in which on average, much of the greater portion of economic life and
ompetition and allowedly at least under incentive of a hope for profit. " অর্থাৎ পুঁজিবাদ হলো এমন এক ব্যবস্থা খানে অধিকাংশ অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিশেষ করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বেসরকারি উদ্যোগে গৃহীত হয় এবং তা অবान প্রতিযোগিতা
ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়য়।
পুঁজিবাদের সংজ্ঞায় The Encyclopedia American (Vol-5 : 1959 p. 564 ) অনুযায়ী "Capitalism is a term applied
to one of the fundamental systems of distribution of wealth, characterized by private ownership and control of the means of production, a free competitive market for the disposition of goods and services for profit and
feedom of choice by the consumer." অর্থাৎ পুঁজিবাদ শব্দটি এমন একটি ধনসম্পদ বণ্টন পদ্ধতির দ্যোতক যেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এবং যেখানে একটা অবাদ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার যার একদিকে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রী ও শ্রমকে ব্যবহার করে থাকে আর অন্যদিকে ক্রেতাদের জন্য ভোগ্য বস্তু পছন্দ করে নেয়ার স্বাধীনতা অব্যাহত রাখে।
পুঁজিবাদের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ও কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, তিনি বলেন, "Capitalism is the name given to that social system under which the land, factories, instruments etc belong to a small member of landed proprietors and capitalism, while the mass of the people possesses no property or very little property and is compelled to hire itself out and workers." অর্থাৎ পুঁজিবাদ এমন এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা, যেখানে জমিজমা, শিল্পকারখানা, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি মালিকানা কুক্ষিগত থাকে মুষ্টিমেয় জমির মালিক ও পুঁজিপতিদের হাতে এবং অধিকাংশ জনসাধারণের কোনো সম্পদই থাকে না বা নামমাত্র কিছু থাকে। এ সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে মজুরি শ্রমিক হিসেবে, দিনাতিপাত করতে।
উপরোক্ত আলোচনা ও সংজ্ঞাগুলোর ভিত্তিতে সংক্ষেপে বলা যায় যে, পুঁজিবাদ হলো এমন একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি মালিকানায় সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং সে সঙ্গে সুনিশ্চিত হয় উৎপাদনের উপকরণের মালিকের মুনাফা। পুঁজিবাদের প্রধান অস্ত্র হলো শ্রমিকের শ্রম শোষণ ।
পুঁজিবাদের মূলনীতি Principles of Capitalism
সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় পুঁজিবাদ এমন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে তোলার ও ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা মুনাফা লাভের অবাধ স্বাধীনতা থাকে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদ সঞ্চয়ে কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ না থাকায় ব্যক্তি ইচ্ছে মতো সম্পদ সঞ্চয় ও পণ্য উৎপাদন করে। অন্যদিকে পণ্য বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা থাকায় দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। যেকোনো জীবন দর্শন ও অর্থব্যবস্থা কতকগুলো মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। নিচে পুঁজিবাদের মূলনীতিসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. অবাধ প্রতিযোগিতার বাজার : পুঁজিবাদের অন্যতম একটি মূলনীতি হলো অবাধ প্রতিযোগিতার বাজার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাজার ব্যবস্থার অবাধ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। এ অবাধ প্রতিযোগিতা একই শ্রেণির ও মানের বস্ত্রর জন্য সকল উৎপাদনকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে কার্যকর। পুঁজিবাদ বিশ্বাস করে যে, অবাধ প্রতিযোগিতা উৎপাদন বৃদ্ধি কবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটায়। বাস্তবে দেখা যায়, সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা সরবরাহকে খুব দ্রুত নিঃশেষ করে দেয়। তবে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার প্রবর্তকদের ধারণা অনুসারে অবাধ প্রতিযোগিতা হলো দ্রুত ও প্রচুর উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি ।
২. উপার্জন ও ভোগ করার স্বাধীনতা : পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো মানুষের সহজাত ও স্বাভাবিক দাবি সম্পূর্ণ করা। এছাড়া এটিকে বাস্তব রূপদান করার জন্য এটি ব্যক্তিকে উপার্জন এবং এর ফল ভোগ ও সঞ্চার করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। পুঁজিবাদের মূলনীতি অনুযায়ী মানুষকে সেচ্ছাধীনে অর্থোপার্জনের সুযোগ না দিলে তারা কখনই অর্থোপার্জনে আগ্রহী হবে না। আর এ জন্য পুঁজিবাদ সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে অর্থোপার্জন, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগকে যেমন অবাধ করেছে তেমনি তাকে দিয়েছে সম্পদ ভোগ করার পুরোপুরি স্বাধীনতা। এর বাস্তবতায় ভোক্তা সাধারণত কোনো নৈতিক বা মানবিক বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে সীমাহীন ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে। আর তাই পুঁজিবাদে বিশেষ শ্রেণিভুক্ত থেকে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে এবং অন্যরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে ধনী গরিবের বৈষম্য ক্রমশই বাড়তে থাকে ।
৩. বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন পুঁজিবাদী অর্থনীতির আলোচিত ও সমালোচিত মূলনীতি। বর্তমান বিশ্ব একটি বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত
হয়েছে। বলা যায়, গোটা বিশ্বই এখন পুঁজিবাদীদের ব্যবসা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদীরা নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রী পুরাবিশ্বে বিক্রয় করে মুনাফা সংগ্রহ করেছে। ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি দিন দিন সুগঠিত হলেও তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে।
৪. ব্যক্তির সীমাহীন স্বাধীনতা : সম্পদের মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সীমাহীন স্বাধীনতাকে পুঁজিবাদের প্রধান মূলনীতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। পুঁজিবাদী জীবন দর্শন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি যেকোনো পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার স্বাধীনতা ভোগ করে। সম্পদের মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। এছাড়া পুঁজিবাদে সম্পদের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ভোক্তা স্বাধীনতা ভোগ করে। কোনো ধরনের নৈতিক স্বীয় ধর্মীয় বিধি বিধান ব্যক্তির আয়, ...... সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে না। এখানে ব্যক্তি নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র স্ব-অধিকারে রাখার সুযোগ লাভ করে এবং সকল প্রকার উৎপাদনের উপকরণ ও যন্ত্রপাতির স্বেচ্ছাধীনে ব্যবহার ও প্রয়োগের ক্ষমতাও ব্যক্তির থাকে। এ ব্যবস্থায় অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনভাবে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে। ফলে দেখা যায় শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সুযোগ সৃষ্টি হয় তেমনি শ্রমিকদের শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ার ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদ কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। ফলে সীমাহীন ব্যক্তিগত স্বত্তাধিকার সমাজে সম্পদের ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করে। কাজেই পুঁজিবাদে নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা ও সামাজিক কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভের দিকে মনোযোগ বেশি থাকে।
৫. সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন : সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূলনীতি হওয়ায় এ ব্যবস্থায় মানুষের সার্বিক কল্যাণের দিকে লক্ষ রাখা হয় না। কীভাবে কতটুকু পুঁজি বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা যাবে সেটাই পুঁজিবাদীদের প্রধান লক্ষ্য। ব্যক্তির অধিকহারে মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। যেসব দ্রব্য উৎপাদনে মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা বেশি থাকে পুঁজিবাদীরা যেসব দ্রব্য উৎপাদনের দিকেই বেশি আগ্রহ দেখায়। এজন্য প্রায় ক্ষেত্রেই তারা নীতি, আদর্শ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে থাকে। ফলে এ ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়িত শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। মুনাফাই প্রধান লক্ষ্য বলে পুঁজিপতিরা সাধারণ মানুষের চেয়ে ধনাঢ্য শ্রেণির ব্যবহার্য সামগ্রী উৎপাদনে অধিক আগ্রহী থাকে।
৬. রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অনুপস্থিতি : পুঁজিবাদের মূলনীতিতে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। মূলত পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কোনো পরিকল্পনা থাকে না। উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ও বণ্টনই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার চালিকা শক্তি। এখানে উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিমাণ প্রকৃতি পরস্পরের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সৃষ্ট বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
৭. সুদভিত্তিক লেনদেন : সুদভিত্তিক লেনদেন পুঁজিবাদের একমাত্র মূলভিত্তি। এ অর্থব্যবস্থায় যেকোনো ধরনের ঋণ গ্রহণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ, যোকোনো ধরনের সেন্যসহ যাবতীয় লেনদেন ও অর্থনৈতিক কার্য পরিচালিত হয় সুদের ভিত্তিতে। আর এ সুদের হার ঠিক করা হয় প্রয়োজনের তীব্রতা ও ভবিষ্যৎ লাভের সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে। এ ব্যবস্থায় সুদই যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণ। এখানে সুদ মুনাফা অর্জনের বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সাধারণত কোনো নীতি ও আদর্শ কাজ করে না।
রাষ্ট্রের নিম্ফল ভূমিকা : পুঁজিবাদের মূলনীতিতে দেখা যায় যে, পুঁজিবাদে যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন, উৎপাদন বণ্টনকার্যে রাষ্ট্রের ভূমিকা একেবারেই নিম্ফল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাষ্ট্রের কাজ শুধু জনগণের কাজের অবাধ সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এখানে সম্পদের মালিকানাও থাকে অবাধ। পুঁজিপতিরা তাদের অর্থনৈতিক কার্যাবলি অবাধে সম্পন্ন করে। এখানে জনগণের কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্র খুব সামান্যই ভূমিকা পালন করে। এ অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র বাজার শক্তির উপর উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার প্রতিযোগিতা ও তুলনামূলক মূল্য সুবিধা ছেড়ে দেয় ।
পেশা নির্বাচনের অধিকার : পুঁজিবাদের অন্যতম মূলনীতি হলো এখানে ব্যক্তির পেশা নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। যেহেতু পুঁজিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত তাই পেশা নির্বাচনে ব্যক্তির স্বাধীনতা অবারিত থাকে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে যেখানে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রবলভাবে বিদ্যমান, সেখানে এ স্বাধীনতা কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না । এছাড়া পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা কখনো উপার্জনের ক্ষমতা বয়ে আনে না । ১০. গ্রাইভেটাইজেশন বা ব্যক্তিমালিকানাকরণ : সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া পুঁজিবাদের একটি অন্যতম মূলনীতি। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে লাল ফিতার দৌরাত্ম ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, জটিলতা এবং দায়িত্বে অবহেলার কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যক্তির আগ্রহে যথার্থ পর্যবেক্ষণের ফলে সুষ্ঠুভাবে কাজকর্ম সম্পাদিত হয়। এজন্য পুঁজিবাদে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে ক্রমাগত ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়।
১১. সম্পদ বা মুনাফা অর্জনই মূল লক্ষ্য : সম্পদ বা মুনাফা অর্জনই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মালিকরা শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে স্বার্থ চেতনতা সৃষ্টি হওয়ার ফলে এবং শ্রমিক ও মালিক বিপরীত অবস্থানে থাকার কারণে এ দুই শ্রেণির মধ্যে বিরোধ চরমে উঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপাদনের সকল উপকরণ এক শ্রেণির অসাধু লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে এবং তারা মালিকে পরিণত হয়। অপর শ্রেণি শুধু পরিশ্রমই করে যায় এবং তারা মেহনতি শ্রেণিতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মালিক শ্রেণি নিজ দায়িত্বে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে এর মুনাফা নিজেরাই ভোগ করে বলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটে না। পুঁজিবাদীরা নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে যে, যেহেতু পুঁজি বিনিয়োগ, পণ্য উৎপাদন, পণ্যবিক্রি এসব ব্যাপারে সকল ঝুঁকি সরকারের নিকট থেকে তারা নিজেরা গ্রহণ করে, তাই মুনাফা হলে সেটি তাদেরই প্রাপ্য। পুঁজিবাদীদের এ নীতির ফলে শ্রমিক শ্রেণি শোষিত হতে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সম্পদ ও মুনাফা অর্জনের অবাধ স্বাধীনতা পুঁজিবাদকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। একশ্রেণি ক্রমাগত ধনী এবং এক শ্রেণি ক্রমাগত গরিব হওয়ার ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দুটি শ্রেণি জন্ম লাভ করে। এ দুই শ্রেণির পারস্পরিক বিরোধ ও সংঘর্ষ সমাজজীবনকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। এমনকি এটি সমাজকে ধ্বংসও করে দিতে পারে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]