পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ Features of Capitalism

পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ Features of Capitalism
পুঁজিবাদ একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম, যেখানে ব্যক্তিমালিকানা ও মুনাফার নিশ্চয়তা থাকে । এ সমাজব্যবস্থা চিরন্তন বা শাশ্বত নয়। এটা বিকাশ লাভ করে বা গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইংল্যান্ডে এর পূর্ণ বিকাশ লক্ষ করা যায়। এরপর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে এর বিস্তৃতি ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশাকারে তা বিশ্বকেই প্রায় গ্রাস করে ফেলে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আকৃতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে কতকগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-
১. ব্যক্তিগত মালিকানা (Private ownership) : পুঁজিবাদে উৎপাদনের উপকরণ (Means of production) ব্যক্তি মালিকানায় থাকে। ফলে উৎপাদনের মূল সুফলটি ভোগ করে ব্যক্তি। এক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তি অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করে ফেলে এবং অবাধ মুনাফা লাভের সুযোগ গ্রহণ করে বিপুল পরিমাণ পণ্য (Commodity) উৎপাদন করে প্রভূত লাভবান হয়।
২. বাজার অর্থনীতি (Market Economy) : পুঁজিবাদী অর্থনীতির অপর নাম বাজার অর্থনীতি। এ অর্থনীতি মূলত বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের সূত্রের দ্বারা কার্যকর থাকে। এ বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা যেমন আকাশ চুম্বি, তেমনি লোকসানও
পাতাল স্পর্শী হতে পারে। পুঁবিবাদী বাজার অর্থনীতিতে যেকোনো পণ্যের মূল্য উৎপাদন ব্যয়ের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বাজারে বিদ্যমান চাহিদা ও সরবরাহের উপর এটি নির্ভরশীল।
৩. অর্থ ও লগ্নী ব্যবস্থা (Investment Mechanism) : পুঁজিবাদে লগ্নী প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পুঁজিপতি বা শিল্প উদ্যোক্তারা সাধারণত বিভিন্ন অর্থ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে তাদের
ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটায়। এভাবে একজন পুঁজিপতি তার নিজস্ব পুঁজির অভাব থাকলে অর্থ লগ্নি ব্যবস্থায় সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে পুঁজির স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
৪. শ্রম পণ্যে পরিণত (Labour becomes Commodity) : পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালিতে শ্রম একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হয়। পুঁজিপতি উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণের মালিক হওয়ায় শ্রমিক হয়ে পড়ে কেবল শ্রমশক্তির বিক্রেতা। পুঁজিপতি মজুরি প্রদানের বিনিময়ে শ্রমিকের শ্রম পণ্যটিকে ক্রয় করে বা ভাড়া করে। এ প্রসেঙ্গ মার্কস বলেন যে, শ্রমশক্তি চিরদিন পণ্য ছিল না। শ্রম চিরদিন মজুরি শ্রম, অর্থাৎ স্বাধীন শ্রম ছিল না।
৫. শ্রম শোষণ (Labour Explotation) : পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের মূল ভূমিকা পালনকারী শ্রেণিটি হলো শ্রমিক শ্রেণি। কিন্তু উৎপাদন যন্ত্রের মালিক বিভিন্ন কৌশলে শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের বক্তব্য হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক শ্রমিকের শ্রমকে চুরি করে বা উদ্বৃত্ত মূল্যকে (Surplus value) শোষণ করে।
৬. আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য হ্রাস (Declination of Bureaucracy) : পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানার প্রাধান্য বা গুরুত্ব
থাকে সর্বাধিক। আর এ কারণে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বহুলাংশে হ্রাস পায় ।
৭. প্রযুক্তি নির্ভরতা (Technology dependency) : পুঁজিবাদ একটা প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা। শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে যেমন পুঁজিবাদ বিকশিত হয়। তেমনি আবার পুঁজিবাদের হাত ধরে উৎপাদন যন্ত্রে বিপ্লব ঘটে। প্রায় সকল ধরনের উৎপাদন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার পুঁজিবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৮. মালিক শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ (Preservation of owner class interest) : পুঁজিবাদ এমন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ উৎপাদনের উপকরণের মালিক শ্রেণির স্বার্থ পুরোপুরি সংরক্ষিত হয়।
৯. শ্রেণি সংগ্ৰাম (Class strugle) : পুঁজিবাদ সমাজে ব্যাপক ধন বৈষম্য ও মুখোমুখি দুটি শ্রেণি সৃষ্টি করে। এর একটা হলো বুর্জোয়া এবং অপরটি হলো প্রলেতারিয়েত (মার্কসীয় দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে) পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি শ্রম শোষণের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে এবং শ্রমজীবী শ্রেণি সর্বহারায় পরিণত হয়। মার্কসবাদীদের মতে, এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হলো শ্রেণি সংগ্রাম ।
১০. ভোক্তার স্বার্থরক্ষা (Protection of consumer's interest) : পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিভিন্ন উৎপাদক ও ব্যবসায়ী- প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা হয় বলে তারা উৎপাদিত পণ্য মানসম্মত করতে এবং যতটা সম্ভব কম মূল্যে বাজার ছাড়তে বাধ্য হয়। তাছাড়া উৎপাদনকারীরা জনগণের চাহিদা ও তৃপ্তির প্রতি দৃষ্টি রেখে উৎপাদন করে। এতে ভোক্তারা তাদের চাহিদামত বা পছন্দমত পণ্য পেয়ে থাকে ।
১১. শ্রেণিবৈষম্য (Class inequality) : পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য প্রকট রূপ লাভ করে। এ সমাজের প্রধান দুটি শ্রেণি হলো পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণি (বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত) এছাড়াও বিদ্যমান থাকে উঠতি পুঁজিপতি, লুম্পেন বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত কৃষক। নানা পর্যায়ের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং চাকরিজীবী।
১২. সম্পদের যুক্তিসিদ্ধ ব্যবহার (Rational use of wealth) : প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজগুলোতে সম্পদ যথেষ্টভাবে ব্যবহৃত
হতো। যেমন— রাজা বা সামন্ত প্রভুরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ভোগবিলাস ও নানা অনুৎপাদনশীল কার্যক্রমে ব্যয় করত। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় এসে সম্পদের অপচয় যেমন কম হয়, তেমনি আবার সম্পদের যথার্থ ও যুক্তিসিদ্ধ ব্যবহার সুনিশ্চিত হয় ।
১৩. অবাধ প্রতিযোগিতা (Perfect compitition) : অবাধ প্রতিযেগিতা পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ প্রতিযোগিতায় কেবল যোগ্যরাই টিকে থাকে এবং অযোগ্যরা হারিয়ে যায়। বাজার দখলের প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন উৎপাদক গোষ্ঠী বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিরন্তরভাবে চলতে হবে।
১৪. সমাজ দর্শনের পরিবর্তন (Changing Social Philosophy) : পুঁজিবাদের একটা বিশেষত্ব হলো এই যে, পুঁজিবাদ বিশেষ সমাজ দর্শনের জন্ম দেয় বা সমাজ দর্শনের পরিবর্তন আনে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, বুদ্ধির মুক্তি, প্রতিযোগিতা, আইনের শাসন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতাবাদ, অবাধ বাণিজ্য, যুক্তিসিদ্ধ আইন, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো পুঁজিবাদী দর্শনের ভিত্তি।
১৫. মুনাফা অর্জনই মূল প্রেরণা (Profit oriented thinking) : পুঁজিবাদের মূল লক্ষ্যই থাকে মুনাফা অর্জন। মুনাফা অর্জন হয় বলেই পুঁজিপতিরা তাদের উৎপাদন কার্য চালিয়ে যায়। যেখানে মুনাফা নেই সেখানে পুঁজিপতি তার যন্ত্রের ঢাকা ঘোরায় না। একারণেই বলা হয়ে থাকে যে, মুনাফা আরোও অধিক মুনাফা অর্জনই হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মূল প্রেরণা বা বৈশিষ্ট্য।
১৬. গতিশীল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা (Economic System) : পুঁজিবাদ একটা গতিশীল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জন্ম দেয়। অবাধ প্রতিযোগিতা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, মেধা যোগ্যতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন, নব নব প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার, উৎসাহ যেমন দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতেও ব্যাপক গতিশীলতা পরিলক্ষিত হয় ।
১৭. উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা (Disorderlines in Production Sector) : মুক্ত বা অবাধ প্রতিযোগিতা এবং অধিক মুনাফা অর্জনই হলো পুঁজিবাদের মূলনীতি। অনেক সময় দেখা যায়, অধিক মুনাফা লাভের আশায় এবং অবাধ প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়ে উৎপাদক প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন করে বসে। এতে উৎপাদন ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং উৎপাদন ক্ষেত্র বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ।
১৮. ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্পর্কিত ধারণা (Conception about private property ) : পুঁজিবাদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক অধিকার। পুঁজিবাদী ধারণায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলো মানব প্রকৃতির সাহসী সহযাত্রী (Con comital of human nature), আইনগত অধিকার (Legal right) এবং পবিত্র (Property is sacred)।
১৯. রাষ্ট্রের ভূমিকা (Role of the State) : পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস বলেন, শ্রেণি বিরোধ নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এমনিভাবে শ্রেণিগুলোর সংঘাতের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হলো পুঁজি কর্তৃক মজুরি শোষণ ।
২০. শ্রমজীবী শ্রেণির স্বাধীনতা (Liberty of the Labour Class) : পুঁজিবাদ সমাজব্যবস্থায় দাস সমাজ বা সামন্ত সমাজের * তুলনায় যে শ্রমজীবী মানুষেরা কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছিল তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। এক্ষেত্রে শ্রমিক কিছুটা হলেও তার পছন্দ মতো শ্রমজীবী এবং মজুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দরকষাকষির সুযোগ পায়। তবে শ্রমজীবী মানুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে পড়ে মূল্যহীন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]