সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদের উদ্ভব Origin of Capitalism from Feudalism

সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কৃষি নির্ভর সমাজ থেকেই উদ্ভব হয়েছে পুঁজিবাদের ধারণা এবং এর চরম প্রকাশ ঘটে শিল্প-বিপ্লবের মাধ্যমে। সামন্ততন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণুতার মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদের উত্থান ঘটেছে বলে অনেক তাত্ত্বিকই মনে করেন। মধ্যযুগের শেষার্ধে মনে করা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির ফলে কৃষিও শিল্পক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদন, শিল্প বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটার মাধ্যমে পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে। বস্তুত মধ্য যুগের উৎপাদন ব্যবস্থায় যান্ত্রিকতার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক ও সমাজব্যবস্থায় এক নতুন ধরনের অর্থব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় যা সামন্তবাদকে ভেঙে দিয়ে পুঁজিবাদ নামে পরিচিতি লাভ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইংল্যান্ডে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে এবং তা ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আরনেস্ট ম্যানডেল মনে করেন, তিনটি মৌলিক আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের ফল হিসেবেই আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। নিম্নে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো—
ক. উৎপাদন ও জীবিকা নির্বাহের উপকরণসমূহ থেকে উৎপাদকের বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে, আধুনিক পুঁজিবাদের উদ্ভবের প্রথম পূর্বশর্ত। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল গোচারণ ভূমি থেকে ক্ষুদ্র কৃষকদের উচ্ছেদ সাধন, মধ্যযুগীয় সমবায়গুলোর ধ্বংস সাধন, বর্হিদেশীয় অদখলকৃত ভূমির ব্যক্তিগত আত্মসাৎকরণ, যৌথ মালিকানাধীন গ্রামের জমির ব্যক্তিগত আত্মসাৎকরণ ইত্যাদির মাধ্যম।
ঘ. উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর একচ্ছত্র অধিকারী একটি সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব হলো আধুনিক পুঁজিবাদের উদ্ভব। এটি হলো উদ্ভবের দ্বিতীয় পূর্বশর্ত। এটিই মূলত আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণি। পুঁজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের ফলে পুঁজির মালিকেরা উৎপাদনের উপকরণসমূহেরও মালিকে পরিণত হয়।
গ. শ্রমশক্তি নিজেই একটি পণ্যে পরিণত হওয়া৷ হচ্ছে পুঁজিবাদের উত্তরের তৃতীয় পূর্বশর্ত। এর কারণ হলো পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় বিকাশের ফলে উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি সর্বহারা শ্রেণির জন্য হয়। এই শ্রেণি জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। যাহোক সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদের উদ্ভবের কারণসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো- ১. শ্রেণি শোষণ : কৃষক ভূমিদাস ও সমাজের সাধারণ মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল, সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় জমিদার ও ভূস্বামীদের শোষণের ফলে। শোষণ অত্যাচার, রকমারী কর প্রদান, নির্যাতন একদিকে যেমন শ্রেণি সংঘাত ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল অন্যদিকে এক শ্রেণিকে নিঃস্ব এবং অন্য শ্রেণিকে বিত্তশালী করে তুলেছিল। এ প্রক্রিয়াটি নতুন সমাজ হিসেবে পুঁজিবাদকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
২. শিল্পবিপ্লব : পুঁজিবাদের উৎকর্ষ সাধন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব সময়ে। পাওয়ার লুম, বিদ্যুৎ, আবিষ্কার, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, মাকু ইত্যাদি বস্ত্র শিল্পসহ সামগ্রিক শিল্পোৎপাদনে আমূল পরিবর্তন করে। আধুনিক পুঁজিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত শিল্পে যান্ত্রিক কলাকৌশলের প্রয়োগের মাধ্যমেই। ৩. আমলাতান্ত্রিক সংগঠন : রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী ও প্রশাসনিক নীতি পুঁজিবাদকে গতিশীল করে তুলেছিল। আমলাতন্ত্র যথাযথ মদদ যুগিয়েছিল বলেই পুঁজিবাদ একটি বিশাল প্রশাসনিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সুতরাং ব্রিটেনের পুঁজিবাদ বিকাশে আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম ।
৪. ঔপনিবেশিক নীতি : ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক নীতি পুঁজিবাদ বিকাশে সহায়ক ছিল মূলত সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত। ব্রিটেনের পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছিল মূলত ঔপনিবেশিক অঞ্চল থেকে প্রচুর ধন-সম্পদ এবং শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ এবং সেসব অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের মাধ্যমে ।
৫. নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্রের ধারণা : রাজনীতির ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব এবং গণতন্ত্রের ধারণা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। সামন্ত যুগে এ ধারণা ছিল না, কিন্তু সামন্ত পরবর্তী যুগে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত রূপ পরিগ্রহ করে। এ ধারণা যত দ্রুত প্রতিষ্ঠা পায় অন্যত্র তা সম্ভব হয়নি। বস্তুত নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্রের ধারণাই ব্রিটেনের পুঁজিবাদ বিকাশকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল।
৬. পুঁজিবাদী মানসিকতা : সামন্তবাদের বিপরীতে নতুন ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদকে গ্রহণ করার মানসিকতা ব্রিটেনের জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। সমসাময়িক সমাজের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন সমাজব্যবস্থার প্রতি একাত্ম হওয়া। এ চ্যালেঞ্জ ব্রিটেনে সর্বপ্রথম সাফল্য প্রদর্শন করে এবং সেখানে পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করে ।
৭. রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা : ইংল্যান্ডসহ ইউরোপীয় সামন্তবাদ যখন পুঁজিবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন রাষ্ট্রীয় কোনো
প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি। বরং পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ।
৮. উদ্বৃত্ত উৎপাদন : ভূমির স্থায়ী মালিক ছিলেন সামন্তবাদ জমিদার ও ভূস্বামীরা। তারা ব্যাপক উৎপাদন ও ভূমির উন্নয়নে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। তাই এখানে ব্যাপক উৎপাদন সম্ভব হতো। রাষ্ট্র, জমিদার ও ভূস্বামী শ্রেণিরা। তারা বিরাট অংকের পুঁজি গঠনে সক্ষম হয়েছিল। উদ্বৃত্ত শোষণের মধ্য দিয়েই যা পরবর্তীতে পুঁজিবাদের বিকাশ ত্বরান্বিত করেছিল। ৯. মুক্ত পাইকারী ব্যবসা : মুক্ত পাইকারী ব্যবসায় যথেষ্ট প্রভাব ছিল ইংল্যান্ডে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন পুঁজি সংগঠন হয়েছিল অন্যদিকে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, বাজার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রা অর্থনীতি ইত্যাদিও বিকশিত হয়েছিল। এ বিষয়গুলো পুঁজিবাদ বিকাশে যথেষ্ট অবদান রেখেছিল।
১০. মুদ্রার প্রচলন : জমিদার ও ভূ-স্বামীরা সংগৃহীত ফসল মুদ্রার বিনিময়ে বাজারজাত করত মূলত উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও শোষণের
মাধ্যমে। এ মুদ্রা পরবর্তীকালে মেষপালন, জাতীয় আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ও বাণিজ্য ও স্থানীয় বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এ বিষয়গুলো বাণিজ্যিক পুঁজিবাদের পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করেছে।
১১. নিরঙ্কুশ ব্যক্তিগত মালিকানা : পুঁজিবাদকে ত্বরান্বিত করেছিল, ব্যক্তিগত মালিকদের দৌরাত্ম্য। কোনোরূপ বিধি নিষেধ
১২. এখানে ছিল না সম্পদের মালিকানার উপর। তাই দালাল ফটকাবাজ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পুঁজিপতি, বণিক শিল্পপতি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সবাই প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদকে বিকশিত করেছিল।
. মধ্যস্বত্ত্বভোগীর ভূমিকা : বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ক্রিয়াশীল ছিল ইউরোপের সামন্তবাদে। শুধু ভোগ বা ব্যবহারের ভিত্তিতে এ ধরনের মালিকানা বিকশিত হয়েছিল। এ শ্রেণি পরবর্তীকালে বুর্জোয়া বা পাতি বুর্জোয়া হিসেবে পুঁজিবাদকে ত্বরান্বিত করেছিল।
১৩. যোগাযোগ ব্যবস্থা : সমগ্র বিশ্বে ব্রিটিশ জাহাজের অবারিত চলাচল, এর পুঁজি গঠন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উৎপাদনের কাঁচামাল সংগ্রহ উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সহজতর করেছিল। পরবর্তীকালে (১৮৩৮) রেল পথের শুভ সূচনাও হয় ইংল্যান্ডে যা সমগ্র বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল। তাই বলা যায়, পুঁজিবাদকে অধিকতর বিকশিত করেছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা ।
পরিশেষে বলা যায় যে, নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়। তার মধ্যে বন্দুক, ছাপাখানা, দিক নির্ণয়, জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব, নতুন ভূ-ভাগ আবিষ্কার, খ্রিষ্টধর্মের সংস্কার ও প্রচার, কলোনি স্থাপন ইত্যাদি। ফলে ব্যক্তিগত সম্পদের সৃষ্টি হতে থাকে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। এমনিভাবে জন্ম লাভ করে পুঁজিবাদী জাতীয় রাষ্ট্র এবং অবসান হয়
সামস্ত রাষ্ট্রের (Feudal State)।
৮.৬ পুঁজিবাদ বিকাশের ধাপ/ পর্যায়সমূহ
Phases/Stages of the Growth of Capitalism
সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই একদিনে কিংবা আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠেনি। বরং বিভিন্ন স্তর বা পর্যায় অতিক্রম করেই এ সকল ব্যবস্থা পূর্ণ বিকশিত হয়েছে। পুঁজিবাদের ক্ষেত্রেও এ কথাটি প্রযোজ্য। সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজ, অতঃপর দাস সমাজ থেকে সামন্ত সমাজের জন্ম হয়। আর মধ্যযুগে ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের পূর্ণ বিকশিত রূপ থেকেই পুঁজিবাদের উদ্ভব ঘটেছে বলে ধারণা করা হয় । তবে এ পুঁজিবাদকে পূর্ণ বিকশিত হতে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে।
পুঁজিবাদ বিকাশের পর্যায়কে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১. বণিক/বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ (Commercial Capitalism)
২. শিল্প পুঁজিবাদ (Industrial Capitalism)
৩. অর্থনৈতিক পুঁজিবাদ (Financial Capitalism)
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিকাশে এ তিনস্তরে যথাক্রমে তিনটি অর্থনৈতিক উপাদান তথা প্রতিষ্ঠান জড়িত। এ তিনটি হলো—
ক. বাজার (Market)
খ. শিল্প (Industry)
গ. ব্যাংক (Bank )
মার্কসবাদীদের মতে, সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকেই জন্ম হয় পুঁজিবাদের। ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ায় ধনতন্ত্র দু'টি স্তর অতিক্রম করেছিল। স্তর দুটি হলো-
১. প্রাক-একচেটিয়া স্তর (Pre-monopoly)
২. একচেটিয়া স্তর (Monopoly Phase)
উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যক্তিগত পুঁজিবাদী মালিকানা ও মজুরির বিনিময়ে নিযুক্ত শ্রমিককে শোষণ থাক একচেটিয়া ধনতন্ত্রের লক্ষ্যপথ নির্ধারণ করেছিল। একচেটিয়া স্তরে প্রতিযোগিতা ও উৎপাদন মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। নিয়ে পুঁজিবাদ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়/ ধাপ / স্তরসমূহ সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো-
১. বণিক/বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ (Commercial Capitalism) : আধুনিক শিল্পের জন্য যে বিরাট পুঁজির দরকার তা যে কেবল কিছু পরিশ্রমী লোকের সঞ্চয়ের ফলে সম্ভব হয়েছে এমনটি বলা যায় না। মূলত ব্যবসা থেকেই প্রথম পুঁজির সঞ্চার হয়। এ সময়ে ব্যবসা শুধু পণ্য বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দেশ জয়, দস্যুতা, দুষ্ঠন, শোষণ এসবও ছিল ব্যবসায়ের অঙ্গ। বাণিজ্য বা ব্যবসায়ের মাধ্যমে নিম্নলিখিত কারণে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে
ক. বণিক শ্রেণির উদ্ভব : সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সমাজে বিশেষ করে প্রাচীন ও সামন্ততান্ত্রিক যুগে বণিক ধনতন্ত্রের উনোখ ঘটে। গ্রিস, রোম, মিশর প্রভৃতি স্থানে বণিক দলের উদ্ভব ঘটে। তাদের প্রচেষ্টায় দেশ-বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকতা লাভ করে। এর ফলে সম্পদ সঞ্চিত এবং মূলধন গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
খ. ধর্মকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান : অতীতকাল থেকেই ধর্ম মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেন্দ্র করে যেসব বাজার বা মেলা বসত সেখানে গির্জা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করেছে।
গ. যোগাযোগ ব্যবস্থা : বাণিজ্যিক ধনতন্ত্রের বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয় নৌপথের প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে। অর্থাৎ যখন জাহাজ শিল্পের উন্নতি ঘটে তখন বণিকরা সমুদ্রপথে প্রচুর মালামাল ধারণক্ষম বাণিজ্য তরী বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করতে সক্ষম হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় উপনিবেশ এবং উপনিবেশগুলো বিজয়ীদের দেশি পণ্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে বণিক ধনিকতন্ত্র প্রসারে কতিপয় আদর্শবাদী কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন যুগে মানুষ আদর্শ ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে গমন করত। এটি বণিক ধনতন্ত্র বিকাশে সহায়ক ছিল। ঘ. দেশ জয় ও লুণ্ঠন বা শোষণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রসার : বহুপূর্ব থেকেই শুধু পণ্য বিনিময় নয় দেশ জয়, লুণ্ঠন, দস্যুতা, শোষণ এসবও ছিল ব্যবসায়ের অঙ্গ। ইতালির রাষ্ট্রগুলো কোনো কারণ ছাড়া এমনিতেই ক্রুসেড সংঘটন করেনি এবং ইউরোপের লোকদের ধর্মযুদ্ধের প্রেরণা দেয়নি। কারণ ক্রুসেডের পর দেখা যায় যে, ভেনিস জেনোয়া ও ফ্লোরেন্সের বণিকরা বিপুল সম্পত্তি লাভ করেছে। অনেকে মনে করেন তের চৌদ্দ শতকেই প্রাচ্যের লুণ্ঠিত সম্পত্তি থেকে ইউরোপে পুঁজির সৃষ্টি হয়। কার্ল মার্কস বলেন, আমেরিকায় সোনা-রুপার আবিষ্কার আদিম আদিবাসীদের দাস বানানো, প্রাচ্যের দেশগুলো জয় ও লুণ্ঠন নিগ্রোদের ধরে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা চালান দেওয়া— এগুলো থেকেই পুঁজিতন্ত্রী উৎপাদনের সূচনা ।
২. শিল্প পুঁজিবাদ (Industrial Capitalism) : আঠার শতকে ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লব সংঘটিত হয়। আর এ বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই শিল্প ভিত্তিক পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। কারিগরি ও সংগঠনের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সূচিত হওয়ার ফলস্বরূপ কৃষি ও শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। ফলে একটি ভিন্ন প্রকৃতির আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, যা শিল্পভিত্তিক ধনতন্ত্র নামে পরিচিত। শিল্প পুঁজিবাদ বিকাশের কারণসমূহ নিম্নরূপ—
ক. শিল্প-বিপ্লব ও নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা : শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় এবং একের পর এক উদ্ভাবনের ফলে নতুন নতুন শিল্পের প্রসার ঘটে। শিল্পের এ আবিষ্কার পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করে। উৎপাদন কৌশলে, কারিগরি অগ্রগতি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ১৫০ বছর যাবৎ যে অগ্রগতি সাধিত হয় মূলত শিল্প বিপ্লব তারই ফল।
খ. শ্রমজীবী শ্রেণির উদ্ভব : শিল্প-বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচিত হয়। শিল্প-বিপ্লবের ফলে এখানে অসংখ্য কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। কিন্তু শ্রমিকের শ্রমশক্তি ছাড়া পুঁজি খাটানো সম্ভব ছিল না। তাই শিল্প বিপ্লবের শুরুতে যেমন উপযুক্ত পরিমাণ পুঁজির দরকার হয়, তেমনি দরকার হয় উপযুক্ত সংখ্যক শ্রমিকের। এ সময় মানুষ কৃষি কাজ ছেড়ে শিল্পকারখানার দিকে বিপুলভাবে ঝুঁকে পড়ে এবং কৃষিভিত্তিক সমাজ শিল্পভিত্তিক সমাজের দিকে মোড় নেয়। এক পর্যায়ে এসে কৃষি অপেক্ষা ব্যবসা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ ও লাভজনক বলে বিবেচিত হয়। ফলে সমাজে স্থায়ীভাবে বিশাল একটি শ্রমজীবী শ্রেণির উদ্ভব হয়।
গ. রাজনৈতিক উদারতা : শিল্পভিত্তিক ধনতন্ত্রের রাজনৈতিক উদারতা ছিল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সামন্ততন্ত্রের যাবতীয় বেড়াজাল ছিন্ন করে এ পর্যায়ে এসে লেইসেজ ফেয়ার (Lajssez Faire) নীতি গৃহীত হয় এবং বিপুল সম্পদ অর্জনের শিল্পভিত্তিক
ধনতন্ত্রের যুগেই গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি প্রগাঢ় সম্মানবোধ পরিলক্ষিত হয়।
অর্থনৈতিক পুঁজিবাদ (Financial Capitalism) : আধুনিক পুঁজিবাদী বিশ্বে শুধু শিল্প কলকারখানাই নয় বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাংক, জীবনবীমা ইত্যাদিতে অর্থ লগ্নি করে পুঁজি গঠন অব্যাহত রাখে। এভাবে অর্থ নির্ভর ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। দ্বিতীয় পর্যায়ে শিল্প পুঁজিবাদের বৃহৎ শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৮৯০ সাল থেকে শিল্প পুঁজির পরিবর্তে গড়ে ওঠে Finance Capitalism। এর ফলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিচের মৌলিক পরিবর্তনগুলো সাধিত হয় ।
* পুঁজির বিপুল পুঞ্জীভবন ঘটে।
* হোল্ডিং কোম্পানির জন্মলাভ হয়।
ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলো কলকারখানায় টাকার যোগান দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। একমুখি পুঁজির বিনিময় ঘটে।
* ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা আলাদা হয়ে যৌক্তিক প্রশাসন গড়ে তোলে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]