সমাজবিকাশের ধারায় আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজ, দাস সমাজ থেকে সামন্তবাদী সমাজ। পুঁজিবাদের উত্তরণ ঘটেছিল সামন্তবাদী সমাজ থেকেই। পুঁজিবাদ বিকাশকে ত্বরান্বিত হয়েছে মূলত শিল্প বিপ্লবের সফলতার ফলেই। প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্ম আন্দোলন, ইউরোপের রেনেসাঁ, শিল্প-বিপ্লব প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে উৎপাদন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ ক্ষেত্রে পুঁজিপতি শ্রেণির উত্থান ঘটে মূলত ক্যাথলিক চার্চ ও সামন্ত প্রভুদের দৌরাত্ম্য হ্রাস পাওয়ার কারণে। সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদের উত্থানের জন্য নিম্নোক্ত ঐতিহাসিক শক্তিসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে-
১. ব্যক্তিগত মালিকানা : সামস্তবাদী সমাজব্যবস্থায় ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার উপস্থিতিই হচ্ছে ইউরোপীয় সমাজের পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বিকাশের মূল কারণ। ফলে কৃষকরা পুঁজি গঠনের সুযোগ পায় এবং পুঁজি বিনিয়োগ করে কমে পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হয়।
২. কৃষি ও শিল্প বিপ্লব : ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশে কৃষি ও শিল্প বিপ্লব (ইংল্যান্ডে) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৭৬২ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। শিল্পবিপ্লবের ফলে পুরাতন যন্ত্রপাতিকে উৎপাদনের কাজে লাগিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। শিল্প বিপ্লব পুঁজিবাদ বিকাশের একটি প্রত্যক্ষ কারণ যা ধনতন্ত্রের অগ্রগতিতে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিল।
৩. পুঁজিবাদী দর্শন : পুঁজিবাদী দর্শনের মূলভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদীর ধারণা। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের মূলকথা হচ্ছে প্রত্যেকেরই স্বাধীন সত্তা রয়েছে। শ্রমিক তার স্বাধীনতাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের ফলেই। প্রত্যেক ব্যক্তিই তাদের স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার সুযোগ পায়। পুঁজিবাদের এ দর্শনের ফলে আর্থিক উৎপাদন ও অধিক মুনাফা অর্জন সহজ হয়ে যায় ।
৪. শহর ও নগরের বিকাশ : চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপে, গ্রামীণ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহর ও নগরের দিকে ধাবিত হতে লাগল এবং ক্রমান্বয়ে নগর ও শহরের বিস্তৃতি ঘটতে লাগল। দেশীয় পণ্য রপ্তানি, বিদেশি পণ্য আমদানি এবং বিদেশিদের সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠল। এর ফলেই মূলত পুঁজিবাদের উত্তরণের পথ প্রশস্ত হলো।
৫. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা : পুঁজিবাদ বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই ব্যবসা-বাণিজের গতিকে ত্বরান্বিত করা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। ইউরোপে পুঁজিবাদের উত্তরণ ঘটেছে মূলত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার পুঁজিবাদের উদ্ভবের কারণে।
৬. উপনিবেশ নীতি : ইউরোপের সাথে যখন নানা দেশের যোগসূত্র স্থাপিত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা আরম্ভ হলো ব্যবসায় বাণিজ্যের অগ্রগতি সাধিত হতে লাগল। ফলে দেশের উৎপাদিত দ্রব্য তারা বিদেশে বিক্রি করত এবং বিদেশের কাঁচামাল স্বদেশে নিয়ে যেত। আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলো যা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের অধীনে ছিল, এগুলোও উপনিবেশে
1 পরিণত হলো। ৭. যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন : যাতায়াত ব্যবস্থা তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল— যান্ত্রিক কলাকৌশলের মাধ্যমেই। পণ্য বাজারজাতকরণ, মুনাফা অর্জন, শিল্প কারখানা স্থাপন, সহজতর হয়ে ওঠে। বস্তুত শহর, বন্দর, শিল্পকলা একান্তভাবেই নগর সভ্যতা শিল্প ও যান্ত্রিক সভ্যতা।
৮. সামন্ততন্ত্রের অবসান : ইংল্যান্ডের রাজা উইলিয়াম ১০৮৬ সালে সেলিসবারিতে প্রজাদের এক সভা আহ্বান করে এবং সে সভায় আইন পাস করা হয় যে, স্বাধীনতা থাকবে কৃষি দাসদের। বহুলোককে জায়গির দিলেন মূলত রাজা জমির মালিকদের নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করেই। ফলে শিথিল হয়ে গেল সামন্ত প্রভুদের ক্ষমতা। স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে ছিল জনগণ। সক্রিয়ভাবে অনেক সামন্ত প্রভুও ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করলেন। এভাবেই পুঁজিবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে যায় সমাজ ।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য : পুঁজিবাদী অর্থনীতি সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সামাজিক, রাজনৈতিক শক্তিসমূহও ছাড়াও গান পাউডার, কার্পাস, মুদ্রণ যন্ত্র, সুতা কাটা যন্ত্র ইত্যাদির আবিষ্কার। উপনিবেশ গঠন, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য। জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ এবং ভৌগোলিক আবিষ্কার পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করেছিল।
ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন : বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ইউরোপীয় সমাজে সংঘটিত হয়েছিল। যেমন- প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলন। ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা, পুঁজি গঠনে বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল ইউরোপীয় সমাজ। এর ফলে পুঁজিবাদের পথ প্রশস্ত হয়।
১১. কাগজের টাকা প্রচলন : জিনিসের মাধ্যমে প্রথমে ব্যবসার ক্ষেত্রে আদান-প্রদান করা হতো। পরবর্তীকালে সোনা, রুপা ও
লোহার বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। এগুলো নিয়ে দূরদেশে যাতায়াত করা কষ্ট সাপেক্ষ ছিল, যখন বাজারে কাগজের নোট প্রচলন আরম্ভ হলো তখন বিদেশের সাথে ব্যবসার অগ্রগতি বাড়ল। এভাবে বণিক শ্রেণি ও খুদে ব্যবসায়ীজীবীগণ ইউরোপে ব্যক্তি মালিকানার প্রতি উদ্বুদ্ধ হলো এবং পরবর্তীকালে সমাজে পুঁজিপতি হয়ে সামাজিক মর্যাদা লাভ করল। এভাবেই মূলত ইউরোপে পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশ ঘটে।
১২. বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব : ইউরোপে কলকারখানা ও যন্ত্রের কারখানায় যন্ত্রপাতির দ্বারা যখন উৎপাদন বেড়ে গেল এবং তা কয়েকজনের কুক্ষিগত হওয়ার ফলে তাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত ছিল সমাজের কর্তৃত্ব। তারা যন্ত্রের ও কলকারখানায় হাজার হাজার শ্রমিকদের দ্বারা যে পণ্য উৎপাদন করত তা বিক্রি করে যে মুনাফা পেত সে টাকা দিয়ে আরো কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করত। পরবর্তীকালে তাদের বংশধরগণও এভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করত। এভাবে সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণির আবির্ভাব ঘটল এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পুঁজিবাদ বিকাশে ।
১৩. জাতীয় রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা : মধ্যযুগে ইউরোপে জাতীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে পুঁজিবাদ বিকাশের একটা যোগসূত্র
রয়েছে। রাজতন্ত্রের উত্থান শুধু সামন্ত প্রভুত্বই নিশ্চিহ্ন করেনি, বুর্জোয়ার বিকাশকেও লালন করেছিল।
১৪. ব্যক্তি সম্পত্তির পবিত্রতার ধারণা : ব্যক্তিগত সম্পত্তি পবিত্র, এটা মানুষের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক এবং আইনগত
অধিকার। এটি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার প্রতীক, ব্যক্তিগত সম্পত্তি উন্নতি ও অগ্রগতির অনুপ্রেরণা যোগায় ইত্যাদি ধারণা এবং দর্শন পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদ বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছিল বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ একদিনে হয়নি এবং এর জন্য একটি কারণ নির্দিষ্টভাবে দায়ী নয় । পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদ বিকাশের কারণ বহুবিধ। বস্তুত উপযুক্ত কারণ বা উপাদানগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ইউরোপে পুঁজিবাদের উত্থান সুনিশ্চিত করেছিল এবং সে সঙ্গে পুঁজিবাদকে সুদৃঢ় ভিত্তি দান করেছিল।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত