পুঁজিবাদ বিকাশে ওয়েবারীয় তত্ত্ব/ প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতা ও পুঁজিবাদের উত্থান Weberian Theory of the Growth of Capitalism/ Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism

সমাজচিন্তার জগতে যে সবল মনীষী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে সমাজবিজ্ঞানকে গতিশীলতা দান করেছেন তাদের মধ্যে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তার “The Protestant Ethic and the Spirit of Capitlism' গ্রন্থে পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে একটি সমাজ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি সামাজিক ঐতিহ্য এবং মুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে পুঁজিবাদ ও ধর্মীয় নীতিবোধের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক আবিষ্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
পুঁজিবাদ বিকাশে ক্যাথলিক তথা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় নীতিমালার ভূমিকা ম্যাক্স ওয়েবার বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেন। নিম্নে পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদ বিকাশে ম্যাক্স ওয়েবারের মতবাদ/ তত্ত্বটি পর্যালোচনা করা হলো-
১. বৈধ উপার্জন : ম্যাক্স ওয়েবার পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় নীতিমালা ও অনুভূতির স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বৈধ উপায়ে অর্থোপার্জন ও জীবিকা নির্বাহ করার মাধ্যমে পরকালের পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। বৈধ উপার্জন পবিত্র কাজ বলে মনে করা হয়। প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় নীতিমালায় পার্থিব পেশা ও জীবিকার্জনের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যাবলীকে পবিত্র কাজ বলে ধরে নেওয়া হয়। যেহেতু যৌক্তিক ও সুশৃঙ্খল জীবনের মাঝেই নিহিত রয়েছে মানুষের মুক্তি। তাই এ মূল্যবোধ মানুষকে অর্থোপার্জনে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায় ৷
২. সামাজিক পরিবর্তনে ধর্মীয় নীতিকথা : ম্যাক্স ওয়েবার প্রচলিত ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরোধিতা করেন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে সামাজিক পরিবর্তনের একটি উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন। এছাড়া তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পুঁজিবাদের মধ্যে ঐতিহাসিক কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণ করেন।
আধুনিক ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তিনি এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেন যে, প্রচলিত ধর্মীয় নীতিমালা সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।
৩. প্রটেস্ট্যান্ট নীতিমালা : ম্যাক্সওয়েবার উল্লেখ করেন যে, ইউরোপের প্রটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক উভয় সম্প্রদায় নাগরিকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, পুঁজির মালিক এবং দক্ষ শ্রমিকদের প্রায় বৃহৎ অংশই ছিল প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী। ম্যাক্সওয়েবার দেখতে পান যে, জনক্যালভিন একজন প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারবাদী নেতা ছিলেন। তিনি একটি সুশৃঙ্খল নীতিমালার উপর গুরুত্বারোপ করেন। এ জাগতিক সংস্রব এবং জীবনের একটি যৌক্তিক সংগতিসাধন পরিচিত হয়ে ওঠে Protestan Ethics বা প্রটেস্ট্যান্ট নীতিমালা হিসেবে ।
পুঁজিবাদ :
: পুঁজিবাদ হলো বাজারব্যবস্থার সাথে বাঁধা একটি মুনাফা তৈরির ব্যাপার, বা বিভিন্ন দেশে একাধিকরূপে বিকশিত হয়। তিনি মার্কসবাদীদের মতো পুঁজিবাদের উদ্ভবকাল সতেরো থেকে আঠার শতক এ ধরনের নির্দিষ্টকরণের বিরোধী। ম্যাক্স ওয়েবার পুঁজিবাদকে দু'টি পর্যায়ে ভাগ করেন, যার একটি হলো প্রজ্ঞাহীন এবং অপরটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন। একই সাথে তিনি এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ষোল শতকের পূর্ব পর্যন্ত পুঁজিবাদী কর্মকাণ্ডকে কখনো আধুনিক ইউরোপীয় পুঁজিবাদের মতো যৌক্তিক ও সুপরিকল্পিত বলে মনে করা উচিত হবে না। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে আধুনিক ইউরোপীয় প্রজ্ঞাসম্পন্ন পুঁজিবাদ যৌক্তিক চরিত্র ও মুক্ত শ্রমের যৌক্তিক সংগঠনের দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
যৌক্তিক ক্রিয়া : ম্যাক্স ওয়েবার তার যৌক্তিক ক্রিয়াকে পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত উদ্দীপনার সাথে সংশ্লিষ্ট করেন। এছাড়া তিনি পুঁজিবাদের পরিপক্ রূপের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা, সাংগঠনিক উৎকর্ষ তথা আমলাতন্ত্র, যৌক্তিক হিসাবরক্ষণ ইত্যাদিকে যুক্ত থাকতে দেখেছেন। প্রটেস্ট্যান্টিজমের সাথে যুক্ত রয়েছে ক্যালডিনিজম, মেথডিজম, পিটিজম, ক্যাপ্টিজম ইত্যাদি। এখানে ম্যাক্স ওয়েবার ক্যালভিনিজমকে উপজীব্য করে তার তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন।
পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত বাণী : ম্যাক্স ওয়েবার তার মতবাদে বেঞ্জামিন ফার্ডিনান্ডের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। বেঞ্জামিন ফার্ডিনান্ড পুঁজিবাদের কতকগুলো অন্তর্নিহিত বাণী প্রচার করেন। যেমন- মনে রেখ সময়ই অর্থ, মনে রেখ জমা রাখা বা বিনিয়োগ করার অর্থই হলো টাকা ইত্যাদি। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, এ নীতিবাক্যগুলো ষোল থেকে আঠার শতকে ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের পথে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। কারণ ঐ সময়ে ইউরোপের বৃহৎ অংশ ক্যাথলিক ধর্মের পরিবর্তে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মগ্রহণ করে এবং পুঁজিবাদ বিকাশে সহায়তা করে।
৭. প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় বিশ্বাস : ম্যাক্সওয়েবার দেখিয়েছেন যে, আধুনিক ইউরোপের ব্যাবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার প্রধানগণ উচ্চ মানসম্পন্ন ও দক্ষ। শ্রমিক টেকনিশিয়ান ইত্যাদি অধিকাংশই প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অবশ্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বেঞ্জামিন ফার্ডিনান্ড কর্তৃক প্রচারিত বাণীর কোনো অর্থই থাকে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলো আধ্যাত্মিকতাবাদের স্থলে মানুষকে ইহজাগতিক বিষয়াবলির দিকে দৃষ্টি দিতে আহ্বান জানাচ্ছে। ম্যাক্স ওয়েবার বলেন, এ আহ্বানটি প্রকৃত অর্থেই এসেছিল প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের ক্যালভিনিস্ট নিমিত্ত থেকে ।
৮. যৌক্তিক কর্মমুখী জীবন দর্শন : ম্যাক্স ওয়েবারের মতে অর্থোপার্জনকে উৎসাহিত করা হয়েছে যখন পর্যন্ত না তা অপব্যয় বা বিলাসিতা করা হয়। এ মতবাদে দারিদ্র্যতাকে অসুস্থতার আহ্বান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এভাবেই যৌক্তিক কর্মমুখী জীবন দর্শন যা মূলত প্রটেস্ট্যান্টিজমের মধ্য দিয়ে ব্যাপ্ত তা আধুনিক পুঁজিবাদী শিল্পোদ্যোগ ও জীবনচারণকে অনুপ্রাণিত করে। অধ্যাপক এলড্রিজ তার Max Weber গ্রন্থে বলেন, প্রটেস্ট্যান্ট নীতিমালার বৈশিষ্ট্য হলো, শিল্পনির্ভর শ্রমে একজন শ্রমিক হিসাব করে কীভাবে নূন্যতম উপার্জন করা যায়।
১. কঠোর পরিশ্রম নীতিকে ধর্মীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ : ম্যাক্স ওয়েবার তার মতবাদে উল্লেখ করেন ক্যালভিন তার অনুগামীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, পার্থিব জীবনে ভালো কাজ করলেই যে মুক্তি বা বিধান লাভ করা যাবে এমন নয়, কারণ তা পূর্ব নির্ধারিত। সুতরাং মানুষকে কঠোর পরিশ্রম করার নীতিকেই ধর্মীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, মুক্তি পাওয়ার আশায় নয়। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে এ ধরনের মতবাদ ক্যালভিনের অনুগামীদের মধ্যে অধিক পরিশ্রম করে অধিক আয় করার মানসিকতা সৃষ্টি করে।
সমালোচনা (Criticism) : ওয়েবারের তত্ত্বটি প্রচণ্ডভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। নিম্নে তা আলোকপাত করা হলো-
১. সরোকিন বলেন, ম্যাক্সওয়েবার ধর্মকে বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য একটি মাত্র পরিবর্তনকে উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যা আদৌ ঠিক নয়।
২. ম্যাক্স ওয়েবারের ধর্মের সমাজতত্ত্ব কিছু ক্ষেত্রে বেশ অস্পষ্ট। মূল্যবোধ ছাড়াও সামাজিক পরিবর্তনের অন্যান্য যে কারণ রয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কোনো আলোচনা করেননি।
৩. ম্যাক্স ওয়েবারের আলোচনা থেকে এ ধারণা জন্মে যে, কেবল প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রভাবে আধুনিক ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে।
এ ধারণা অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিক বিচারে প্রমাণিত হয় না। যেমন— জাপানের শিল্পোন্নতি ধর্মের প্রভাবে হয়েছে তা বলা যায় না।
৪. আলবার্ট হাইমা ( Albert Hyma) তাঁর 'Calvinism and Capitalism in the Netherlands' শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, সামগ্রিকভাবে ডাচ রিপাবলিকের সবচেয়ে সমৃদ্ধির দিনে যেসব প্রদেশে ক্যালভিনবাদ সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল সেখানেই ধনতন্ত্র সবচেয়ে কম বিকাশ লাভ করেছিল।
৫. K. George তাঁর The Protestant mind of the England Reformation গ্রন্থে ওয়েবারের তত্ত্বের পর্যালোচনায় বলেন, ওয়েবারীয় ধনতন্ত্র যা আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে জাগতিক লুণ্ঠনভিত্তিক ধনতন্ত্রের সঙ্গে ক্যালভিনবাদের কোনো গতিমান, মনস্তাত্ত্বিক এবং কারণ ঘটিত সম্পর্ক নিশ্চিতভাবে নেই।
পরিশেষে বলা যায় যে, বর্ণিত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ম্যাক্সওয়েবার কেবল প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মকেই পুঁজিবাদ বিকাশের অন্যতম উপাদান হিসেবে মনে করেছেন। অর্থাৎ পুঁজিবাদ বিকাশের শর্ত হিসেবে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের উপর অতিরিক্ত মহিমা আরোপ করেছেন। মূলত পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদ বিকাশ সম্পর্কে তিনি যে মতামত প্রদান করেছেন, তা ছিল মতাদর্শগত। এজন্যই তিনি তার আলোচনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ করেছেন ঐতিহ্য এবং ধর্মের গণ্ডির মধ্যে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]