ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পটভূমি Background of Industrial Revolution

শিল্প সমাজের জন্ম হয়েছে কৃষি সমাজের গর্ভে। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সংঘটিত হয় সামন্তবাদের প্রভাবে। ফলে হঠাৎ করেই লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সামস্ত ও ম্যানর প্রথায় জমিদারি ও মধ্যস্বত্তভোগী শ্রেণি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়। এ সময় প্রযুক্তির উন্নতি ঘটে ও মানুষের মধ্যে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রেক্ষাপটে অর্থ বিত্তের মালিকেরা তাদের মূলধন শিল্পে বিনিয়োগ করে। এ সময় লক্ষ লক্ষ বেকার শ্রমজীবী মানুষ শিল্প ও কলকারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগদান করে। ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু হয় মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে এবং শিল্প অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। ফলে শিল্প সমাজ গড়ে ওঠে। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বস্তুত শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে ইউরোপে পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বে এ উৎপাদন ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৫০-১৮৬০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই শিল্প বিপ্লব বলতে ব্রিটেনের সমগ্র সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের পেছনে বিরাজমান সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কলাকৌশল কিংবা মানসিক পরিবর্তনের সমষ্টিকে বুঝায়। উল্লেখ্য যে, শিল্প বিপ্লব বলতে গৃহকেন্দ্রিক ও হস্তচালিত উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে যন্ত্রচালিত উৎপাদন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও রূপান্তরকে বুঝায়। ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো শিল্প বিপ্লব। মূলত শিল্পবিপ্লব বলা হয়ে থাকে শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন হওয়াকে। শিল্প বিপ্লব নামক শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক লেখক রাঙ্কি। পরবর্তী সময়ে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব প্রত্যয়টি ইংল্যান্ডে প্রবর্তন করেন ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা আরনল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) এবং এরপর বিভিন্ন স্থানে প্রবর্তন করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে শিল্প বিপ্লবের এই পরিবর্তন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আবার এর পটভূমিও একদিনে রচিত হয়নি। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পটভূমি আলোচনায় নিচের বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো-
১. বাণিজ্যিক বিপ্লব : শিল্প বিপ্লবের পথ সুগম হয়েছে বাণিজ্য বিপ্লবের মধ্য দিয়েই। এ বাণিজ্যিক বিপ্লবের অবসানের পরবর্তীকাল থেকেই শিল্প বিপ্লব চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। উৎপাদনের একক ছিল বাণিজ্যিক পুঁজিবাদের কৃষি। এখানে শহরের সংখ্যা ছিল অতি অল্প। তবে উৎপাদনের মূলকেন্দ্র বিন্দু ছিল এ শহরগুলো। এখানে উৎপাদন নিম্নমুখী ছিল তার কারণ হলো এখানকার উৎপাদন যন্ত্রে ও কলকারখানাগুলোতে যান্ত্রিক ছোঁয়া ছিল না। অর্থাৎ এ সময়ে কৃষি পণ্যের পরিবর্তে বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদনের দিকেই পুঁজিপতিদের কৃষি ছিল। ফলে সামন্ততন্ত্র ভেঙ্গে বণিক পুঁজি গড়ে ওঠে। শিল্প বিপ্লব হলো এই পর্যায়ের চূড়ান্তরূপ ।
২. রাজনৈতিক স্থিতিশিলতা : সপ্তদশ শতাব্দীর গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লব ও অন্যান্য কারণে ইংল্যান্ডের সমাজ ব্যবস্থায় ও রাজনৈতিক অন্যান্য কারণে ইংল্যান্ডের সমাজ ব্যবস্থায় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল। এর ফলেই শিল্প বিপ্লবের পথ ত্বরান্বিত হয়েছিল।
৩. মূলধনের উদ্ভব : ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থায় পশম বিক্রি করেছিল ইংল্যান্ডের বণিক সম্প্রদায়ের লোকেরা এবং উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল এনে তা ইউরোপীয় বাজার ব্যবস্থায় পুনরায় বিক্রি করে প্রভূত অর্থ লাভ করে। এছাড়াও দেখা যায় ইংল্যান্ডে কৃষি বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে খামার মালিকদের অর্জিত অর্থ ব্যাংকে জমা হয়। বাণিজ্য ও কৃষির মাধ্যমে অর্জিত উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার ফলে ইংল্যান্ডের ব্যাংকগুলো বাড়তি জমাকৃত টাকা দীর্ঘমেয়াদি সুদে শিল্প লগ্নি করে । ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব বিকাশের পথ দ্রুত সফলতা অর্জন করে মূলত মূলধনের সহজ লভ্যতার ফলেই।
৪. চাহিদা বৃদ্ধি : সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিশেষ অংশ শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। এর ফলে শহরে এসে যুক্ত হওয়া শিল্প শ্রমের সাথে শহরমুখী ও জনস্রোত বৃদ্ধিতে একদিকে যেমন শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনি অন্যদিকে ক্রেতা বিক্রেতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক হারে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য শিল্পভিত্তিক উৎপাদন কৌশল বা শিল্প বিপ্লবের গতিময়তা বৃদ্ধি পায়।
৫. যন্ত্রের আবিষ্কার : শিল্প প্রসারের ফলে একদিকে কৃষির অনুৎপাদনশীলতা ব্যাপক সংখ্যক কৃষি শ্রমিককে শিল্পের দিকে ধাবিত করে। যান্ত্রিক কলাকৌশলগত আবিষ্কার অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে। এ শিল্পায়নের শুরু হয় বস্ত্র শিল্পে দ্রুত গতিতে চালানো যায় এমন বয়নের মাকু আবিষ্কার (১৭৩৩) আর্করাইটের ওয়াটার ফ্রেস (১৭৬৯) হার গ্রিভস এর স্পীনিং (১৭৪৪) কার্ট রাইট কর্তৃক পাওয়ার লুম, জেমস ওয়াট কর্তৃক বাষ্প ইঞ্জিন (১৭৩৯) জর্জ স্টিফেনের রেলগাড়ির ইঞ্জিন প্রভৃতির আবিষ্কার বস্ত্র শিল্পে এক নব দিগন্তের সূচনা করে। যার ফলশ্রুতিতে শিল্প বিপ্লবের ব্যাপক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৬. রাস্তা ও পরিবহন : ইংল্যান্ডের সমাজব্যবস্থায় টেলফোর্ড কর্তৃক ও ম্যাক্সডাম কর্তৃক ইট আবিষ্কার করা হয়। পাথর ও গলানো পিচের সহযোগিতা প্রতিটি বস্তুতে পরিবর্তনযোগ্য রাস্তা নির্মাণের প্রণালিও আবিষ্কার করা হয়। আবার জর্জ স্টিফেনস কর্তৃক রেল ইঞ্জিন আবিষ্কার এবং খালগুলোতে সেই সাথে সারা বছর নৌকা দ্বারা পারাপারের ব্যবস্থা করা হলে সেক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থাতেও বিপ্লব সাধিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে শিল্প বিপ্লবেরও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতেই সমাজ পরিবর্তনের ধারায় সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার ফল অর্থনৈতিক ধারা সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। বাজার ব্যবস্থার প্রসার ঘটে এবং মুদ্রা অর্থনীতির সূত্রে বণিক শ্রেণি ও অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এর ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। দ্রুত নগরায়ন ঘটে এবং নব নব উদ্ভাবিত প্রকৌশলী ব্যবস্থা শিল্পে প্রয়োগ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এসব পরিবর্তন ও উৎপাদনই ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পটভূমি রচনা করতে সহায়তা প্রদান করেছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]