পূজিবাদ ও দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন Capitalism and Rapid Social Change

শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজ হচ্ছে সমাজ বিবর্তনের সর্বশেষ স্তর। শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থাই হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিশেষ করে যান্ত্রিক ও স্বয়ংক্রিয় শিল্প, কলকারখানা মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ব্যাপক উৎপাদন করে। যেমন মানুষের মূল পরিধেয় বস্ত্র ছিল কৃষি কাজে হাতে বোনা কাপড়। কিন্তু ব্যাপক আকারে যান্ত্রিক উৎপাদন হয় শিল্প সমাজে। কৃষি যুগে মানুষের যাতায়াত কিংবা পণ্য পরিবহন ছিল অত্যন্ত সীমিত ও কষ্টসাধ্য। অন্যদিকে শিল্প যুগে দূরপাল্লার যানে দ্রুত গতিতে যাত্রী ও পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়। কৃষি সমাজ তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মোটামুটি ধরে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ১৭৬০ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত যান্ত্রিক শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সংঘটিত হয় যা শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। বস্ত্রকল আবিষ্কার, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, কয়লা, লৌহ ইত্যাদিকে ব্যাপকভাবে উৎপাদনে নিয়োজিত করা, লৌহ গলিয়ে নানাবিধ প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার ইত্যাদি শিল্প উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে। তখন ব্যাপক হারে শ্রমিক শোষণ হলেও মানুষ নিরূপায় হয়ে নগদ টাকার প্রয়োজনে পঙ্গপালের মতো কারখানার দিকে ছুটতো।
শহরে নতুন নতুন অস্বাস্থ্যকর ও অবৈধ বসতি এলাকা গড়ে তোলে শ্রমজীবী মানুষ। এই শ্রমিক পাড়া সমাজ ব্যবস্থায় নতুন
মাত্রা যোগ করে। এখানকার জীবনযাত্রা, নানাবিধ সমস্যাসমূহ, সামাজিক সম্পর্ক, জাতিতত্ত্ব ইত্যাদি স্বাতন্ত্রের দাবিদার। প্রযুক্তিগত দিক থেকে কৃষি সমাজ থেকে শিল্প সমাজ উন্নততর। কৃষি যুগের একাধিপত্য বিরাজমান ছিল অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত । উৎপাদন শিল্পের অভূতপূর্ব সাফল্য এবং ক্রমবিকাশ শিল্প সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই। মার্ক্সীয় অমার্ক্সসীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই শিল্প সমাজে মানুষের প্রয়োজনীয় সকল বস্তু উৎপাদন, বিতরণ ও ভোগের বিষয়টি ও প্রত্যক্ষভাবে শিল্পোৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। একদিকে উৎপাদন কৌশল এবং অন্যদিকে কারিগরি অগ্রগতি ও এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ১৫০ বছর যাবৎ পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় যে অগ্রগতি সাধিত হয় তা মূলত শিল্প বিস্তারেরই ফল।
গ্রামাঞ্চলে পরিবর্তনের ধারা-
১. গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন : বিজ্ঞানের আর্শিবাদের ফলে পুঁজিবাদী সমাজে ধীরে ধীরে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় কৃষি ক্ষেত্রে যান্ত্রিক চাষাবাদের পরিবর্তন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাপক বৃদ্ধি, প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রশাসন কাঠামো গঠন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার প্রচলন প্রভৃতি কারণে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
২. অর্থনৈতিক পেশায় পরিবর্তন : রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ফলে ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ছোট কৃষকেরা অকৃষিজ পেশায় অংশগ্রহণ করছে। গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক পেশায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে মূলত বিভিন্ন অফিস আদালতে চাকরি গ্রহণ করার ফলে।
৩. একক পরিবারের উৎপত্তি : পুঁজিবাদের বিকাশের কারণে শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে শিল্পকলকারখানা গড়ে ওঠে এবং শ্রমিকরা গ্রাম থেকে শহরে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমায়। গ্রামের মানুষ তাদের জীবন যাপন ও কাজের সুবিধার জন্য গ্রামের যৌথ পরিবার ছেড়ে শহরে ছোট ছোট পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করে। বিভিন্ন শিল্পকারখানা শ্রমিকদের ছোট ছোট থাকার জায়গা প্রদান করার মাধ্যমে একক পরিবার গঠনে ভূমিকা রাখে। পুঁজিবাদ শহরাঞ্চলের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি করে। ফলে বড় পরিবার নিয়ে শহরে বসবাস করা সম্ভব হয় না
৪. শিক্ষা বিস্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন : শিক্ষার সম্প্রসারণ হওয়ায় গ্রামীণ ছেলে মেয়েরা বর্তমানে পূর্বের চেয়ে ব্যাপক হারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ করেছে। গ্রামীণ কৃষকের মেয়েরা শহরে এসে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে । মূলত গ্রামে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মূল্যবোধের পরিবর্তনের কারণেই।
৫. ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি : গ্রামীণ কৃষিতে উন্নত ধানের বীজ, যান্ত্রিক চাষাবাদ, সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ভূমিতে উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ ধনী কৃষকরাই মূলত এর সুফল ভোগ করছে। তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে বেশি ফসল ফলিয়ে আরও ধনী হচ্ছে। গরিবরা আরো গরিব হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে মূলত কৃষি উৎপাদন সম্পর্কে শোষণের সম্পর্ক বিরাজের কারণে ।
৬. মূল্যবোধের পরিবর্তন : গ্রামীণ মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে মূলত শিক্ষার সম্প্রসারণের ফলে। মানুষ আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছে কুসংস্কার ও অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হয়েই ।
৭. নারী সচেতনতা বৃদ্ধি : প্রশাসন ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রভৃতি কারণে বর্তমানে নারী সচেতনতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত নারী শিক্ষা বৃদ্ধির কারণেই ।
৮. কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার : কৃষিতে উন্নত ধরনের বীজ, যান্ত্রিক চাষাবাদ। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষিতে উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
৯. অকৃষি পেশা : গ্রামাঞ্চলে কৃষি প্রধান পেশা হলেও বর্তমানে অনেক অকৃষি পেশারও বিকাশ ঘটেছে। অনেকেই পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন নার্সারি ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে।
১০. জীবনযাপন প্রণালিতে পরির্তন : বর্তমানে জীবন-যাপন প্রণালিতে গ্রাম ও শহরে সুস্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তৈজস পত্র, ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় বেশ পরিবর্তন।
শহরাঞ্চলে সামাজিক পরিবর্তনের গতিধারা-
১. মুনাফা অর্জন : পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন। মুনাফা অর্জনের নীতি ছাড়া পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা চলতে পারে না মর্মে মার্কস মত দিয়েছেন। পুঁজিপতিগণ এ ব্যবস্থায় মুনাফার লোভেই মূলধন বিনিয়োগ করে থাকে। ২. ব্যক্তিগত মালিকানা : পুঁজিবাদী ব্যবস্থাধীনে উৎপাদনের উপায়সমূহের (যেমন- জমি, খনি, যন্ত্রপাতি) ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে থাকে, রাষ্ট্র বা অন্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে না। বিনিময়, বণ্টন, যোগাযোগ ও ভোগের মাধ্যমগুলোও ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে থাকে ।
৩. নতুন পেশার উদ্ভব : নগরায়ণের ফলে উন্নত প্রযুক্তি এবং উন্নত অবকাঠামোভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার নতুন নতুন
পেশার উদ্ভব ঘটে। ফলে মানুষ শহরের প্রতি আকৃষ্ট হয় স্বভাবতই গ্রাম ছেড়ে।
৪. শ্রেণি বৈষম্য : মার্কসের মতানুসারে পুঁজিবাদ সমাজ দু'টি শত্রু শিবিরে বিভক্ত। যেমন- একটি হলো শ্রমিক শ্রেণি এবং
অপরটি হলো পুঁজিপতি তথা মালিক শ্রেণি। এ দু'টি শ্রেণির মধ্যকার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হলো বিদ্যমান শ্রেণিদ্বন্দ্ব।
৫. অবাধ প্রতিযোগিতা : অবাধ প্রতিযোগিতার বিষয়টি সুনিশ্চিত করে মূলত পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায়। অর্থাৎ শিল্পকারখানা বা
উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সেখানে অবাধ প্রতিযোগিতা চলে।
৬. শহরে একক পরিবার : পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শহরায়নের ফলে গ্রামীণ যৌথ পরিবারের উদ্ভব ঘটে। ফলে যৌথ
পরিবারের পারস্পরিক স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিক জীবনের বিকাশ ঘটে।
৭. অপরাধমুলক কাজকর্ম বৃদ্ধি : শহরের বস্তিজীবনের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে মূলত গ্রাম থেকে আসা ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপেই। যার ফলে অপরাধমূলক কাজকর্ম যেমন- চুরি, ডাকাতি, মাদক দ্রব্য, অপহরণ ও শিশু এবং নারী পাচার ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৮. উন্নত চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা : নগরায়ণের ফলে আধুনিক রেডিও নাট্যমঞ্চ, টেলিভিশন, ডিশ-এন্টিনা সমৃদ্ধ উন্নত চিত্রবিনোদনের ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।
৯. আধুনিক জীবন পদ্ধতির বিকাশ : পূর্বের গ্রামকেন্দ্রিক জীবনের পরিবর্তে শহরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত গতিশীল
জীবনের উদ্ভব ঘটে মূলত শহরায়নের ফলেই ।
১০. পণ্য উৎপাদনের সার্বিক প্রাধান্য : পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেসব দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করা হয় তার মূল লক্ষ্য হলো বাজারে বিক্রয় করা। ভোগ করা হয় মূলত ব্যক্তিগতভাবেই। সুতরাং পুঁজিবাদে শিল্প কল কারখানা ও কৃষি খামার পণ্য দ্রব্য উৎপাদন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে।
পরিশেষে বলা যায় যে, পুঁজিবাদী সমাজে দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জীবন প্রণালির মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ পরিবর্তনে শিল্পায়ন ও শহরায়ন বা নগরায়ণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]