পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় লিঙ্গ সম্পর্ক/ অসমতা Gender Relations/ Inequality in Capitalist Society

পরিবারের সঙ্গে উৎপাদনের যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন এবং বৃহদায়তন কারখানাতে উৎপাদন স্থানান্তর হচ্ছে শিল্প বিপ্লব পরবর্তী পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী সমাজে নারী থেকে পুরুষ হোক। শিল্প উৎপাদনে অংশ নিতে হলে কারখানায় আগমন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। এখন আর বাড়িতে নারীর পক্ষে বসে উৎপাদনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। তাঁদের হয় পুরোপুরি গৃহবধূতে পরিণত হতে হয় নতুবা মজুরির বিনিময়ে কারখানায় এসে কাজ নিতে হয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য যে সবল নারী কলকারখানায় এসে কাজ নিতে পারল না, তারা অর্থকরী উৎপাদন কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুত হয়ে সম্পূর্ণরূপে পুরুষের উপর নির্ভরশীল গৃহবধূতে পরিণত হলো। Sheila Rowbotham বলেন, “পুঁজিবাদ কর্ম ক্ষেত্রে এবং পরিবারের নারী- পুরুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কগুলোর পুরাতন ধরন ভেঙে দিল। তবে মেহনতি শ্রেণির এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়েছিল। নারী উৎপাদন থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। অপরদকে মেহনতি শ্রেণির নারী কারখানায় কাজ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল এবং পরিণত হয়েছিল মজুরি শ্রমিকে।

শিল্প বিপ্লব তথা পুঁজিবাদ এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারী The Industrial Revolution: Capitalism and the middle and upper class women

উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষগণ শিল্প বিপ্লবের ফলে কলকারখানায় কাজ নেয়। তারা প্রধানত White collar এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি পায়। তাদের স্ত্রীদের অর্থকরী কর্মকাণ্ডে যোগদানে নিরুৎসাহিত করা হয়। Carrol Smith Rosenberg বলেন, “গার্হস্থ্য নীতিবাদ নব্য শ্বেতকায় মধ্যবিত্ত রমণীর উপর কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ ভূমিকা চাপিয়ে দেয়। তাকে আদর্শ নারীর মর্যাদা লাভের জন্য হতে হবে অনুগত, কোমল, আত্মত্যাগী, গভীর ধর্মভীরু এবং যৌনবাসনা রহিত। তাকে স্বামী ও সন্তানদের সেবায় গৃহে আবদ্ধ হয়ে নিয়োজিত থাকতে হবে এবং উৎপাদিত শ্রম ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা দরিদ্র রমণীকূল, তারা দারিদ্র্যের তাড়নায় কাজ করতে বাধ্য হয়, কখনো আদর্শ নারী হতে পারে না এবং তারাও তাদের পরিবারগুলোকে “অস্বাভাবিক” গণ্য করা হয়। ফলশ্রুতিতে অল্প বেতনে মধ্য ও উচ্চ বিত্তের নারীকে কলকারখানায় দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় না, অপরদিকে তারা গৃহকর্মের অবমূল্যায়ন ও অমর্যাদা মেনে নিতে বাধ্য হয়। Andrea Tone বলেন, এমন একটি কাজ কর্মকে প্রকৃত শ্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার সুনির্দিষ্ট বাজার মূল্য আছে। কিন্তু নারীর গৃহকর্মের বাজার মূল্য না থাকায় নারী আর্থিক ক্ষেত্রে হার মানতে বাধ্য হয়। উচ্চবিত্ত মেহনতি শ্রেণি বা গৃহভৃত্য সকল শ্রেণির নারীর সন্তান ধারণ, সন্তান লালন পালন, রান্না-বান্না ধোয়া মোছা এবং অন্যান্য সনাতন নারীসুলভ কর্ম হেয় বলে গণ্য করা হয়। পুরুষ প্রধান বাজার অর্থনীতির বিপরীতে, গৃহ নারী প্রধান স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং গৃহকে শ্রম ও উৎপাদনের কেন্দ্র নয় বরং অবসর যাপন ও ভোগের কেন্দ্র বলে গণ্য করা হয় ।

শিল্প বিপ্লব তথা পুঁজিবাদ এবং মেহনতি শ্রেণির নারী The Industrial Revolution: Capitalism and Hard Working class women

যুক্তরাষ্ট্রীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কারখানা শ্রমিক ছিল নারী। কারণ প্রাক-বিপ্লব যুগে বস্ত্র শিল্পে কর্মী ছিল প্রধানত নারী। শিল্প উৎপাদনে নারী-ঐতিহ্যবাহী নিপুণতার অধিকারী ছিল, সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে মুনাফা অর্জনের জন্য শিল্প বুর্জোয়া নতুন বৃহৎ কলকারখানায় নারী শ্রমিকদেরকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। তবে এ সকল নারী শ্রমিকের সবাই ছিল মূলত দরিদ্র পরিবারে সদস্য। আরো দুটি কারণ ছিল এদেরকে কারখানায় নিয়োগ করার জন্য-
১. তাদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো যেত নারী শ্রমিকের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে, এরা সপ্তাহে কাজ করত ৭০ ঘণ্টা পর্যন্ত। ২. এদের স্বল্প বেতন দিতে হতো। কারণ পুরুষের ছিল পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব এবং নারীর উপার্জন ছিল গৌণ। এ ধরনের মানসিকতার জন্য নারী শ্রমিকদেরকে অল্প বেতন দিলেই চলত। এ সব কারণে মেহনতি শ্রেণির নারীরা বিপুল সংখ্যক কারখানার কাজে যোগ দেয় মূলত শিল্প বিপ্লবের শুরুতেই।
এ প্রসঙ্গে Shiela Rowbotham বলেন, "পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য ক্ষমতাসীন শ্রেণিতে, প্রকৃতপক্ষে জোরদার হয়েছিল। তবে
মেহনতি শ্রেণির নারীদের গৃহের বাহিরে কাজ করে মজুরি উপার্জন করতে হতো। ফলে ঐ শ্রেণির পুরুষরা স্ত্রীর উপর মালিকানার অর্থনৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছিল।
Engles তাঁর ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত 'Condition of the working class in England' গ্রন্থে নির্দেশ করেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পুঁজিবাদের মজুরি শ্রম নারীর জন্য স্বাধীনতা আনেনি বরং নারী ও পুরুষের অর্থনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন এনেছিল। এ অবস্থায় কারখানা উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবারের অভ্যন্তরে নারীর উপর পুরুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য
করেছিল বটে। তবে সামগ্রিকভাবে সমাজে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য বজায় ছিল।
পুঁজিবাদ কর্মকে গৃহ থেকে বহির্গত করে কারখানায় নেওয়ার ফলে একটি পরস্পর বিরোধী চাহিদার জন্ম হয়েছি। নারী প্রমের জন্য ফারখানায় নতুন একটি চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল বটে কিন্তু সন্তান ानন-পালন এবং পরিবারের গৃহস্থালির প্রয়োজন মেটানোও আবশ্যক ছিল। এই পরস্পর বিরোধী চাহিদা কাজে লাগিয়ে নারী সুবিধা করে নিতে সমর্থ হয়নি বরং পরিশ্রম করতে রাখা হয়েছিল গৃহ ও কর্ম উভয় স্থানেই। ফলে অর্থ উপার্জন কর্মের পাশাপাশি গৃহকর্মও নারীকেই করতে হলো। মূলত নানীই হলো একাধারে পরিবারের আয়ের উৎস এবং সাংসারিক কর্মের বাহন।
নারীর দ্বিগুণ দিন (Double day) : কর্ম জীবন নারীর কর্মদিবস দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ল মূলত শিল্প বিপ্লবের ফলে। যে সকল মারী কলকারখানা, অফিস আদালতে কর্ম গ্রহণ করল, তাঁরা গৃহস্থালি কর্ম থেকে নিতার গেল না। গৃহকর্ম তাদের কর্তব্য কর্মের অন্তর্ভুক্ত রইলো। তাদের গৃহকর্ম সম্পাদন করতে হলো, অর্থকরী কর্মের পাশাপাশি। নারীর কর্তব্য কর্মের বোঝাকে দ্বিগুণ কর্ম দিবা আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। দ্বিগুণ কর্ম দিবস প্রত্যয়টি ঐ সকল নারীকে নির্দেশ করে যাদের হাতে দু'টি কর্ম করতে হয় প্রম শক্তিকে পারিশ্রমিকের কর্ম এবং পরিবারে বিনা পারিশ্রমিকে গৃহস্থালি কর্ম । Julie Mathari বলেন বাস্তবিক পক্ষে আশা করা হয় যে, নারী হবে অতিনারী এবং পুরুষসুলভ শ্রমবাজার প্রতিযোগিতা এবং নারীসুলভ স্ত্রী ও মাতার কর্তব্য, উভয় ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা অর্জন করবে। নারীকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দিয়েছে শিল্প বিপ্লব। কিন্তু সেজন্য কর্মজীবী নারীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাকে গৃহস্থালির কাজকর্ম সামলিয়ে অর্থকরী কাজে অংশ নিতে হয়েছে। ফলে নারীর পরিশ্রমের মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। নারী বাইরে কাজ করে, ঘরেও কাজ করে। তাকে একাধারে দু'টি দায়িত্ব বহন করতে হয়, ফলে তার পরিশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দুর বা হ্রাস পায়নি বরং বৈষম্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। নারী-পুরুষের বৈষম্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, নারী শোষণের অধিকতর শিকার হয়েছে। পরিশ্রমের মাত্রায় শুধু বৈষম্য সীমিত নয়; নারী-পুরুষের বৈষম্য তুলনামূলক মজুরি ও চাকরির সাথে বিস্তার লাভ করেছে।
নারী-পুরুষের মধ্যে বেতন ও চাকরির শর্তে বৈষম্য। একই কাজের জন্য পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নারী কর্মী পুরুষ কর্মীর চেয়ে কম বেতন পায়। অপরপক্ষে নারীকে পুরুষের সমমানের চাকরি দিতে গড়িমসি করা হয় এবং পুরুষের তুলনায় নিম্নস্তর ও নিম্নমানের কাজ নিতে এবং করতে বাধ্য করা হয়। কম বেতনের নিম্নমানের কাজ করার ফলে নারী নিজের উপার্জন দিয়ে নিজের ভাগ্য গড়তে পারেনি; নিজের আর্থিক উপার্জন দিয়ে জীবনে উন্নতি করতে বা আত্মনির্ভরশীল হতে পারেনি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য সদস্য হলো বিশ্ব জুড়েই নারী। Andrea Tone বলেন, “কঠোর সেক্সভিত্তিক পেশাগত বিভেদের দ্বারা নিশ্চিত করা হয় যে, সর্বাধিক বেতনভোগী, সর্বজ্যেষ্ঠ নারী কারখানা শ্রমিক একই কারখানায় নিযুক্ত পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে কম বেতন আশা করবে।”
Ruth Milkman এভাবে বর্ণনা করেছেন, উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সকল ইউনিয়নের দাবি ছিল, পারিবারিক মজুরি অথবা পুরুষ শ্রমিকের জন্য এমন বেতন যা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ হতে পারে এবং তাদের আশা ছিল যে, উপরোক্ত দাবি পুরুষ হলে মেহনতি শ্রেণির নারী সকল মজুরি কর্ম ছেড়ে গৃহবধু হতে পারবে। অর্থাৎ সমাজ নারীকে গৃহবধূ হিসেবে দেখতে হবে। শিল্প বিপ্লবের আবশ্যকতায় নারী শ্রমশক্তিকে যোগ দিলেও সমাজ নারীর এই নতুন ভূমিকাকে ক্রান্তিকালীন হিসেবে গণ্য করেছে এবং নারী তার গৃহকর্মের ভূমিকায় ফিরে যাবে এটাই আশা করেছে। এসব কারণে শিল্প বিপ্লব নারীকে অর্থকরী কর্মগ্রহণের সুযোগ করে দিলেও তাঁর সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি। মজুরি আয় নারীকে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে কিছুটা ক্ষমতা দিয়েছিল, কিন্তু নারীর সামাজিক অবস্থানের' সামগ্রিক পরিবর্তন সাধন করেনি। বরং পরিবারে এবং বৃহত্তর সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থান কর্মস্থলে তার অধস্তন অবস্থাকে সুদৃঢ় করেছিল এবং চাকরি দাতা মালিক নারীকে ন্যূনতম বেতন দিয়ে মুনাফা লুটতে সক্ষম হয়েছিল।
সুতরাং দেখা যায় যে, শিল্প বিপ্লব নারীর সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন আনেনি, অবস্থার চাপে নারীকে অর্থকরী কার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে বটে, কিন্তু নারীমুক্তি বা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেনি। বরং নারী উত্তরোত্তর অধিকার শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। কর্মস্থল ও গৃহ উভয় স্থানে নিরবিচ্ছন্ন দায়িত্ব পালন এবং অর্থকরী কর্মে ন্যূনতম বেতন ও নিম্নতম কর্মগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দী এবং প্রধানত বিংশ শতাব্দীতে নারীকে নিজ অধিকার ও মুক্তি তথা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। নারী মুক্তির আন্দোলন তথা নারী অধিকারে যারা অবদান রেখেছেন তাদের নারীবাদী আখ্যায়িত করা হয় এবং নারীর প্রতি বৈষম্য ও শোষণের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকে। মূলত তাকেই বলা হয় 'নারীবাদ'।
পরিশেষে বলা যায় যে, নারী অধিকার বা নারী মুক্তি আন্দোলনে যারা অবদান রেখেছেন মূলত তাদেরকেই নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]