পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ Characteristics of Palaeolithic or Old Stone Age

এ যুগে আবিষ্কৃত অবিকৃত, অমসৃণ ও স্থূল পাথরের অস্ত্র ব্যবহৃত হলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মানব সভ্যতা বিকাশের প্রথম ভিত্তি পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগেই স্থাপিত হয়েছিল। এ জন্য পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগকে সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নিয়ে প্রাচীন প্রস্তর যুগ বা পুরোপলীয় যুগের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হলো—
১. বাসস্থান (Dwelling House) : পুরোপলীয় যুগে দীর্ঘদিন মানুষ গাছের ডাল, গাছের কোটর, পাহাড়ের গুহা, মাটির গর্ত প্রভৃতি স্থানে বসবাস করত। প্রাচীন প্রস্তর যুগে জলবায়ু উষ্ণ ও মৃদু থাকায় মানুষ তখন কোনো রকম আশ্রয় ছাড়াই উন্মুক্তস্থানে বসবাস করত। এ যুগের মানুষ বাড়িঘর তৈরিতে লতাপাতা, ছন, ডালপালা, মাটি, ঘাস, পশুর চামড়া, বড় বড়
জীব জানোয়ারের হাড়, বরফ ইত্যাদি ব্যবহার করত। এ সময়ের প্রাপ্ত তথ্যাবলি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই 'গুহাবাস' ছিল মানুষের কাছে খুবই পছন্দের বিষয়। প্রাপ্ত তথ্যাবলি হচ্ছে— ক. গুহাবাস, খ. মাটিতে গর্ত করে বসবাস ও গ. গুহা ও গর্ত ব্যতীত উন্মুক্ত স্থানে কুঁড়েঘরে বসবাস। এ যুগের মানুষ শুকনো পাতা, ডাল ও কাঠ সংগ্রহ করে, আগুন জ্বালাত, গুহায় আশ্রয় পাওয়ার জন্য পশুর সাথে প্রতিযোগিতা করেছে।
২. খাদ্য (Food) : প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী। এ যুগে মানুষ নিজে খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না। সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির উপর খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল ছিল। এ যুগের মানুষের খাদ্য তালিকায় ছিল ফলমূল, লতাগুল্ম, শাক- সবজি, পাখির ডিম, কীট-পতঙ্গ, ছোট বড় জীবজন্তুর মাংস, শামুক-ঝিনুকসহ জলজ অন্যান্য উদ্ভিজ ও প্রাণী। খাদ্য সংগ্রহে মানুষকে সর্বদা সংগ্রাম করতে হতো। জীবন ছিল হয় ভুরিভোজের, নতুবা উপবাসের (Life was either a feast or a fast)। আদি প্রস্তর যুগে মানুষ প্রথমে কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত। খাদ্য বণ্টনের সমতার নীতি প্রতিপালিত হওয়ায় মার্কসবাদীরা একে আদিম সাম্যবাদ (Primitive communism) নামে আখ্যায়িত করেছিল।
৩. হাতিয়ার (Tools) : প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার তৈরি করত। হাতিয়ার ছিল মূলত পাথরের। পিকিং মানুষ কোয়ার্টজ পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত পাষাণ খণ্ড বা পাথর কখনো অপরিবর্তিতভাবে আবার কখনো সুবিধামত আকার আকৃতি দিয়ে ব্যবহার করা হতো। এগুলো ছাড়া হস্ত কুঠার, শাবল, ছুরি, বাটালি, বিউরণ, করাত, হারপুন, বরশি, চাকু, তীর-ধনুক ইত্যাদি ছিল এ যুগের প্রধান হাতিয়ার। পাথরের পাশাপাশি বাঁশ, গাছের ডাল, পশুর হাড়, দাঁত, শিং ইত্যাদি দিয়েও হাতিয়ার তৈরি করা হতো। এ প্রসঙ্গে Gordon V. Child তাঁর Man makes himself গ্রন্থে বলেন, হাতিয়ার তৈরির মাধ্যমে প্রাচীন মানুষ এক প্রকার বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছিল।
৪. সামাজিক জীবন (Social life) : প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই দলবদ্ধ হয়ে বসবাস ও শিকার করত। পরবর্তীতেও বড় বড় জীবজন্তু শিকারের প্রয়োজনে তাদেরকে দলবদ্ধ থাকতে হয়েছে। এ দলবদ্ধ থাকার প্রসঙ্গে L.H. Morgan উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ জোট বেঁধেছে জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে। পরিবার ও সমাজের নেতৃত্ব বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেকেই মনে করেন যে, তখন পরিবার ও সমাজের নেতৃত্ব মহিলাদের উপর ন্যস্ত ছিল। একই পূর্বপুরুষ থেকে যাদের জন্ম নৃবিজ্ঞানীরা একে 'ক্ল্যান' নামে অভিহিত করেছেন। এই ক্ল্যানের মাধ্যমে ছোট ছোট শিকার কার্য পরিচালনা করা হতো। বড় শিকারের জন্য বেশি লোকের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় আদিম মানুষ কয়েকটি ক্ল্যান নিয়ে ট্রাইব সৃষ্টি করেছিল ।
৫. পোশাক পরিচ্ছদ (Clothing) : পুরোপলীয় যুগের মানুষ প্রথম দিকে জীব-জন্তুর মতো উলঙ্গ থাকত। পরবর্তীতে তারা গাছের পাতা, ছাল-বাকল ইত্যাদি লজ্জা নিবারণে ব্যবহার করত। সেলাইয়ের জন্য পশুর হাড় সুঁচ হিসেবে ও শক্ত গাছের বাকল দিয়ে তৈরি সুতা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। শেষ পর্যায়ে এসে পশুর চামড়া ও লোম দিয়ে পোশাক তৈরি করত। হাড়ের সূঁচ ব্যবহার করে নিজের শরীরের সাথে পশুর চামড়া সেলাই করে পোশাক বানাত। সুন্দরের প্রতীক হিসেবে পাথর, মাটি, হাড় ইত্যাদি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যবহারের জন্য গহনা তৈরি করত। তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গহনা ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল।
৬ আগুনের ব্যবহার (Use of fire) : প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষের প্রধান আবিষ্কার ছিল আগুন। আগুন জ্বালানোর কৌশল আয়ত্ত করার পরেই মানুষ মাংসকে পুড়িয়ে খাওয়া শুরু করল। বজ্রপাত, দাবাগ্নি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট আগুন এবং এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে তৎকালীন মানুষ বংশ পরম্পরায় আগুন সংরক্ষণ করত। আগুন আবিষ্কারের ফলে হিংস্র জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, জন্তু জানোয়ার শিকার করা সহজ হয় এবং শীতের তীব্রতা থেকেও রক্ষা পাওয়া সহজ হয় । পণ্ডিতদের মতে, এ যুগের মানুষ কৃত্রিমভাবে আগুন জ্বালানোর কৌশল আয়ত্ত করতে পারেনি। এ যুগের প্রথম দিকে মানুষ বাইরে থেকে আগুন সংগ্রহ করে এনে গুহার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে রাখত। আগুনের আবিষ্কারের ফলে স্বল্প সময়ে আহারের ব্যবস্থা করা যায় এবং রান্না সম্পর্কেও মানুষ জানতে পারে। এছাড়াও অস্ত্র নির্মাণ, মৃৎ ও অন্যান্য দ্রবাদি নির্মাণ কৌশলেও মনোনিবেশ করা যায় ।
৭. চিত্রকলা (Painting) : প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ গুহা অভ্যন্তরে নিপুণ হস্তে চিত্রকলা ফুটিয়ে তুলেছে। এসব চিত্র কলার মাধ্যমে তাদের শিকারি প্রাণী শিকার জীবন, ব্যবহৃত হাতিয়ারাদি, শিকারের দৃশ্য, বসনভূষণ, জীবন-যাপন পদ্ধতি, সংস্কৃতিবোধ, শিল্পবোধ, ধর্মীয় চেতনা-জাদু বিশ্বাস, দার্শনিক চেতনা ইত্যাদি প্রস্ফুটিত হয়েছে। ১৮৭৩ সালে স্পেনের আলতামিরা গুহা, ১৮৯৫ সালে ফ্রান্সের না মুখ গুহা, ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের পেয়ারনন পেয়ার গুহা, পাসকো ও আইজি তহা ইত্যাদিতে প্রাচীন প্রস্তর যুগের শিল্পকলার প্রমাণ পাওয়া যায়। অধিকাংশ গুহা চিত্রেই জীবন্ত জীব ও শিকারি জীবন প্রাধান্য পেয়েছে। তাই বলা যায় যে, জাদু বিদ্যার প্রভাব বাড়ানোর জন্য প্রাগৈতিহাসিক চিত্র শিল্পীরা স্বেচ্ছায় দুর্গম বিপদ সংকুল ও বসবাসের অযোগ্য গুহার ভিতরকে বেছে নিত এবং সেখানে বসে ছবি আঁকত ।
৮. শিকার (Hunting) : এ যুগে মানুষ বড় বড় প্রাণী শিকারের দিকে ধাবিত হয় এবং পাথরের উন্নত অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি ফাঁদ পেতে পশু শিকারের কৌশল আয়ত্ত করে। সুতরাং প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রথম দিকে ছোট ছোট প্রাণী শিকার করলেও হাতিয়ারের উন্নতির সাথে সাথে এ যুগের মানুষের শিকার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
৯. শ্রম বিভাজন (Division of labour) : এ যুগে শ্রম বিভাজন হয় নারী-পুরুষ ও বয়সভেদে। প্রাচীন প্রস্তর যুগে খাদ্য সহ কর্মকাণ্ডে শ্রম বিভাগের সূত্রপাত হয় বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। বার্নস বলেন যে, এ সময় মেয়েরা ফলমূল সংগ্রহ, পুরুষেরা শিকার এবং অল্প বয়সীরা ছোটখাটো জীবজ ও মাছ ধরে আনত এবং ব্যাস্কদের কাজে যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করত। বৃদ্ধরা অস্ত্র তৈরি ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করত।
১০. সামাজিক স্তরভেদ (Social stratification) : প্রাচীন প্রস্তর যুগে সামাজিক শ্রেণি না থাকলেও সামাজিক স্তরভেদের সৃষ্টি হয়েছিল। গণ্ডিতদের মতে, শ্রমভেদ থেকেই সমাজে সামাজিক স্তরভেদের জন্ম হয়। তখন সামাজিক স্তরভেদ মূলত নারী- পুরুষ (Sex) ও বয়সভেদে (Age) সৃষ্টি হয়েছিল। এ যুগের সমাজে বয়স্কদের উচ্চ মর্যাদা বিদ্যমান ছিল।
১১. ধর্মীয় বিশ্বাস ও জাদু বিদ্যা (Religious belief and Magic) : সমাজ বিজ্ঞানী ডুর্খেইম (Durkheim) আদিম ধর্মীয় বিশ্বাসকে টোটেম (Totem) বলেছেন। নাচ, গান, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষ পূজা ইত্যাদিতে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশ পেত। প্রাকৃতিক বৈরিতা থেকে মুক্তি, শিকারি জীবনকে সফল করা, আত্মরক্ষা, পূর্ব পুরুষের কৃপা লাভ প্রভৃতি কারণে এ যুগের মানুষ অদৃশ্য কোনো শক্তির সাহায্য প্রার্থনা করত। এভাবে তাদের মনে একটা ধর্মীয় অনুভূতির জন্ম হয়। ধর্মের পাশাপাশি জাদু বিদ্যাতেও তাদের বিশ্বাস ছিল। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানী জাদু বিদ্যার ব্যর্থতাই ধর্মের উৎপত্তির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন (Where magic ends, religion begins ) ।
অতএব বলা যায়, প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষরা অদৃশ্য ও অলৌকিক শক্তিতে ব্যাপক বিশ্বাস করত। আর তা থেকেই তাদের মনে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় অনুভূতির জন্ম হয়েছে।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়াও পুরোপলীয় যুগের মানুষ সামান্য পরিমাণে ভাষার ব্যবহার, সীমিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব, ব্যক্তি ব্যবহার্য সম্পত্তির ধারণা, কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির উদ্ভাবন ইত্যাদি ব্যাপকভাবে অর্জন করেছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]